কান্তা মনি পর্ব-২১+২২

0
1071

#কান্তা_মনি
#পর্ব_২১
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা

-না! বল তুই মিথ্যা বলছিস। বল? (নওশাদের জামার কিছু অংশ খামচে ধরে হুংকার দিয়ে বলে ওঠে কান্তা মনি)
কান্তা মনির যেন নওশাদের কথা বিশ্বাসই হচ্ছেনা।

বাঁকা হেসে ওঠে নওশাদ।
-আমি কেন মিথ্যা বলব বল ভাবিজান? মিথ্যা বলে আমার স্বার্থকতা কি? অপেক্ষা করো কিছুক্ষণবাদেই তোমার জন্য চমক আসবে যতটকু আশা করা যায়। (নওশাদ)

কান্তা মনি কান্না করতে করতে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়।
-বিশ্বাসঘাতকদের সব দিন ভালো যায়না। কথাটা মাথায় রাখিস। (কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে কান্তা মনি)

হোহো করে হেসে ওঠে নওশাদ।
-আচ্ছা তা দেখা যাবে। তা তোমার প্রিয় আব্বাজানকে কে বা কারা হত্যা করেছে আর কেন হত্যা করেছে শুনবেনা? (ভ্রু কুচকে তাকায় নওশাদ)

কান্তা মনি অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে তাকায় নওশাদের দিকে।
-আরে আরে এত আগে রাগলে হবে? আগে শোনো তো সবটা। চলো আবারও কিছু সময় পেছনে যাওয়া যাক।

মারজান সরদারের কক্ষে গুপ্ত বৈঠক বসেছে। বৈঠকে বসার মূল উদ্দেশ্য জমিদারী হাতানো এবং নিয়াজকে হত্যার পরিকল্পনা করা। কক্ষে উপস্থিত মারজান সরদার, মেহরিন, শাহ সুলতান মির্জা, শাহ আহসান মির্জা, নওশাদ। হঠাত মারজান সরদারের একজন খাস কর্মচারী রমিজ হাওলাদারকে টেনে হিচড়ে কক্ষের ভেতর নিয়ে আসে।
-সাহেব এই রমিজ বাইরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দ্বারে কান পেতে ভেতরের কথোপকথন শুনছিল। আমি দেখেই এইযে টেনে-হিচড়ে এখানে নিয়ে এসেছি। কত বড় সাহস বিনা অনুমতিতে সাহেবের কক্ষে আড়ি পাতে।

-একে এখানে রেখে তুমি বাইরে যাও। আপাতত যেন আমার কক্ষে কেউ প্রবেশ করতে না চায় সেদিকে লক্ষ্য রাখো বাইরে দাঁড়িয়ে। (মারজান সরদার)
-যথা আজ্ঞা সাহেব। (কথাটা বলেই কক্ষের বাইরে চলে যায় খাস কর্মচারী)

-তা রমিজ কি কি শুনলে আড়ি পেতে? (বাঁকা হেসে বলে ওঠে মারজান সরদার)
-আপনারা জমিদারী দখল করার লাইগা আর নিয়াজ বাবারে মাইরা ফেলানোর জন্য ষড়যন্ত্র করতাছেন। আমি এক্ষুনি গিয়ে নিয়াজ বাবারে আর জমিদার সাবরে সব কিছু কইয়া দেব। আপনাগো পরিকল্পনা আমি সফল হইতে দেব না কিছুতেই। (বলেই রমিজ হাওলাদার কক্ষ হতে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়)
-আরে দাড়াও দাড়াও রমিজ চাচা। এত তাড়া কিসের? (মেহরিন)
-শুনছিলাম তুম্বি নাকি নিয়াজ বাবারে ভালোবাসো। কিন্তু ভাগ্যক্রমে আমার মাইয়ার সাথে বিয়া হইল। কিন্তু তুমি একদিনের জন্য হলেও যারে ভালোবাসছো তারে হত্যা করার পরিকল্পনা করো কেমনে? (রমিজ হাওলাদার)
-ভালোবাসছি? হাহা। (মেহরিন)

রমিজ হাওলাদার শাহ সুলতান মির্জার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
-আপনজনদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে বিবেকে বাধেনা সাব?

হঠাত ঘ্যাচ করে একটা তলোয়ার রমিজ হাওলাদারের পিঠ হয়ে পেট ফুড়ে বের হয়ে যায়। গগন বিদারী চিৎকার করে ওঠে রমিজ হাওলাদার। কোনো মতে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে দেখে নওশাদ তলোয়ারের অপর মাথা ধরেই দাড়িয়ে আছে।

-সব কিছুর উর্ধ্বে স্বার্থ। স্বার্থের কাছে আপনজনেরা তো কিছুই না। স্বার্থের জন্য বিশ্বাসঘাতক হলেও দোষ নেই। (বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে নওশাদ)

নাক-মুখ হতে অঝোরে রক্ত ঝরছে রমিজ হাওলাদারের। ক্ষত স্থান হতে রক্ত ক্ষরণ ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। নওশাদ তলোয়ার ঘ্যাচ করে আবার বের করে নিতেই মেঝেতে পড়ে যায় রমিজ হাওলাদার।
মারজান সরদার একটা ছোট ছুরি নিয়ে রমিজ হাওলাদারের দিকে অগ্রসর হয়।

-নিয়াজকে বলে দিবি সব তাইনা? তার সুযোগ তো তুই পাচ্ছিস না রমিজ। (মুখে পৈশাচিকতা ফুটিয়ে তুলে রমিজ হাওলাদারে শরীরে ছুরি বসিয়ে বসিয়ে টানতে থাকে মারজান সরদার)

যন্ত্রণায় ছটফট শুরু করে দেয় রমিজ হাওলাদার।
-অন্যায় করে পাড় পায় না সবাই। শুধু সময়ের অপেক্ষা। (গোংরাতে গোংরাতে বলে রমিজ হাওলাদার)
মেহরিন তেড়ে আসে। মারজান সরদারের হাত থেকে ছো মেরে ছুরিটা নিয়ে রমিজ হাওলাদারের শরীরে বারবার ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে ছুরিয়ে বসিয়ে দিতে থাকে।
-আব্বার কথায় নিয়াজকে মারার জন্য প্রস্তুত হলেওনিয়াজকে ধীরে ধীরে পছন্দ করতে শুরু করি।নিয়াজের সাথে বিয়ে হলে হয়ত আমি ওকে মারতে পারতাম না। কিন্তু আমার মন ভেঙ্গে দিয়ে ও তোর মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছে। নিয়াজকে মরতেই হবে। আমার মন ভাঙার শাস্তি ও তো ওকে পেতে হবেই। (হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে থাকে মেহরিন)

শেষবারের মতো ছুরিটা রমিজ হাওলাদারের শরীরে গেথে দিয়েই ঝট করে উঠে রক্তে মাখামাখি হয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে যায় মেহরিন। শাহ সুলতান মির্জা এসে পা দিয়ে একটা পাড়া দিয়ে ছুরিটা আরও ভালোভাবে গেথে দেয়। বড় একটা নিশ্বাস টেনে নেয় রমিজ হাওলাদার। চোখের কোণ বেয়ে একফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

কান্তা মনি উঠে দাড়িয়েই একটা বসিয়ে দেয় নওশাদের গালে। নওশাদ হোহো করে হেসে ওঠে।

-তোরা কি মানুষ? (কান্তা মনি)
-আসলেই তো! আমরা কি মানুষ? (প্রশ্নাত্মক ভঙ্গিতে বলে ওঠে নওশাদ)
-তোকে আজকে আমি একদম জানে মেরে ফেলব। (বলেই এগোতে নিতেই জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে কান্তা মনি)

পিটপিট করে চোখ খুলতেই নিজেকে পালঙ্কের ওপর আবিষ্কার করে কান্তা মনি। আশপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ আসতেই পুরোপুরি চোখ খুলে শোয়া থেকে উঠে বসে কান্তা মনি। তার পাশে বসে রাহেলা চোখের পানি ফেলছে। তার পাশেই রজনী চুপচাপ হয়ে বসে আছে। পালঙ্কের পাশ ঘেষে মেহরিন দাঁড়িয়ে আছে। মেহরিনকে দেখেই ক্ষেপে যায় কান্তা মনি।

-এই মেয়ে এখানে কি করে। বের হয়ে যেতে বল কেউ একে। বের করে দাও একে। এই মেয়ে আমার আব্বার হত্যার সাথে জড়িত। কি হলো এই মেয়ে বেত হোস না কেন? (কান্না করে বলে ওঠে কান্তা মনি)
-কান্তা মনি! এসব কি বলছো তুমি? (অবাকের ভঙ্গিতে বলে ওঠে মেহরিন)
-বের হয়ে যা কক্ষ হতে। বের হ। নাহলে একদম মেরে ফেলব এখানেই। (কান্তা মনি)
মেহরিন কক্ষ হতে বের হয়ে যায়। কক্ষে মানুষের ভীড় দেখে হাজারো প্রশ্ন মাথায় এসে বাজলেও চুপ থাকে কান্তা মনি। কিন্তু রাহেলা আর রজনীকে কে এনেছে এখানে?

-কান্তা মা! চল নিচে ছল। (রাহেলা)
-না আমি কোথাও যাবো না। আমার ওনাকে এনে দাও না মা। আমার বুকটা যে ফেটে যাচ্ছে। (কান্তা মনি)
কান্তা মনির কথাটা শুনে বুকটা ছ্যাত করে ওঠে রাহেলার।
-চল মা নিচে ছল। (কান্তা মনির হাত ধরে টেনে বলে ওঠে রাহেলা)

রাহেলা আর রজনী হাত ধরে কান্তা মনিকে সিড়ি বেয়ে নিচে নিয়ে যাচ্ছে।
-কোথায় নিয়ে যাচ্ছো মাকে? আমি কোথাও যাব না।
কথা শেষ করে সামনে তাকাতেই স্তম্ভিত হইয়ে যায় কান্তা মনি। এবার আর কান্তা মনিকে ধরে ধরে নিচে নামাতে হচ্ছেনা। রাহেলা আর রজনীর থেকে হাত ছাড়িয়ে উন্মাদের মতো দৌড়িয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে সামনে থাকা খাটিয়ার পাশে এসে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে কান্তা মনি।

খাটিয়ার ওপর সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা অবস্থায় নিয়াজের শরীরের অংশগুলো টুকরো টুকরো অবস্থায় পড়ে আছে। কিন্তু সেখানে কিছু অংশ অনুপস্থিত। মাথাটাও যে নেই সেখানে। এক একটা টুকরোর সাথে জড়িয়ে থাকা খানদানী কাপড় দেখে বোঝা গেছে এটা নিয়াজেরই খন্ডিত লাশ। আর এই কাপড়ের জামাটা যে নিয়াজ সঙ্গে করেই নিয়ে গিয়েছিল শহরে। নদীর কিনারা থেকে জেলেরা বস্তা পায়। বস্তাতে নিয়াজের খন্ডিত লাশ পায় জেলেরা।

কান্তা মনি চিৎকার করে খাটিয়ায় বিছানো চাদরটা খামচে ধরে।

-সব আমার দোষ। কেন আমি আপনাকে আগে থেকে বলতে পারলাম না। আমার এখন নিজেকেই এভাবে টুকরো টুকরো করে ফেলতে ইচ্ছা করছে। কেন আমি আপনাকে সাবধান করতে পারলাম না? কেন ওই নরপশুগুলোর সাথেই আপনাকে ছেড়ে দিলাম। আমিতো পারলাম না আমার হেতিজা বুবুর কথা রাখতে। আমিতো পারলাম না আম্মার কথা রাখতে। ফিরে আসুন না আপনি। আমি পারছিনা আর এক মুহূর্ত টিকে থাকতে। আমাদের বাচ্চাটা যে কাউকে আর বাবা বলে ডাকতে পারবেনা। তার বাবাকে তো সে দেখতে পারলো না। আসুন না । দোহায় লাগে ফিরে আসুন না। হে আল্লাহ আমার সহায় হোন আমি যে আর এক মুহূর্ত আর টিকে থাকতে পারছিনা। (নিজের চুল টেনে ধরে বলে ওঠে কান্তা মনি)

সকলে কান্তা মনির কান্ড-কারখানা দেখে অবাক। সকলেই ভাবছে হয়ত নিয়াজের মৃত্যুর শোকেই এমন উল্টোপাল্টা বকছে। কিন্তু বেগম নূর জাহান একদৃষ্টে কান্তা মনির কান্ড-কারখানা দেখে চলেছে। কিছুক্ষণ পর পর জ্ঞান হারাচ্ছে আবার কিছুক্ষণ পর পর জ্ঞান ফিরছে এভাবেই চলছে বেগম নূর জাহানের অবস্থা।
কড়া তদন্ত চলছে কে বা কারা এই দস্যুদেরকে পাঠিয়েছিল।

জমিদারবাড়িতে যেন ঘোরতর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর শোক কোনোভাবেই সামলাতে পারেননি। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা। হৃদরোগ যেন পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সকলের মুখ ভার। হেতিজা এখনো শহর থেকে এসে পৌছাতে পারেনি।

চোখের পানি মুছে নেয় কান্তা মনি। পেটে হাত বুলিয়ে মনে মনে ভাবতে শুরু করে এবার যে তাকে বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হবে। তাকে একারই মরণযুদ্ধে নামতে হবে। নাহ সে একা না। সাথে আছে পদে পদে নিয়াজের দেওয়া অনুপ্রেরণাগুলো। নিয়াজ অনুপস্থিত থাকলেও তার ভালোবাসার অস্তিত্ব যে আজীবন কান্তা মনির মনের মাঝেই গেথে থাকবে। করে আসা ভুলকে আর বাড়তে দেওয়া যাবেনা। মৃত্যুও যদি এসে হানা দেয় এক চুল পরিমাণ সরে দাঁড়াবে না কান্তা মনি। করে আসা ভুলকেই এবার জেদের মালা বানিয়ে গলায় পরে প্রতিশোধের খেলায় মেতে উঠবে এক রমনী।

চলবে…

#কান্তা_মনি
#পর্ব_২২
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা

নিশ্চুপ হয়ে নিয়াজের লাশের খাটিয়া থেকে কিছুটা দূরে দেয়াল ঘেষে মেঝেতে বসে আছে কান্তা মনি। হঠাত কাউকে চিতকার করে কান্না করতে শুনে সেদিকে না তাকিয়েই আস্তে করে চোখ বন্ধ করে নেয় কান্তা মনি। হেতিজা এসেছে বুঝতে পেরেও তার কাছে যায়না কান্তা মনি। কাঁদুক মেয়েটা। এই পরিস্থিতিতে কান্না করাটা যে খুব দরকার। নাহলে যে বুকের ওপর জমে থাকা কষ্টের ভারী পাথর কখনো নামবেনা।

-ও ভাইজান চোখ ওঠো না ভাইজান। এই যে তোমার আলসে শেহজাদি আসছে। ও ভাইজান তোমার বোনটা তোমাকে রেখে শশুড়বাড়ি চলে গেছে তাই তুমি তাকে এভাবে ফাকি দিলে? তোমার মুখটা দেখার সুযোগটুকু পেলাম না? কারা মেরেছিস আমার ভাইজানকে? (কান্না করতে করতে অগ্নিদৃষ্টে নওশাদের দিকে তাকায় হেতিজা)

হেতিজা আস্তে করে উঠে কান্তা মনির সামনে গিয়ে বসে।
-ও ভাবিজান তুমি পারলেনা আমার ভাইজানকে আগলে রাখতে? কেন পারলে না ভাবিজান? বল না কেন পারলেনা? তোমাকে তো আমি বলেছিলাম ভাইজানকে সব বলে দাও। কেন বললে না কিছু? কেন তাকে সাবধান করলেনা? তোমার মায়ার জন্য আজ এই পরিস্থিতি ভাবিজান। (কিছুক্ষণ থেমে) ও ভাবিজান আমার ভাইজানকে ফিরিয়ে আনোনা। (কান্তা মনিকে জাপটে ধরে বলে ওঠে হেতিজা)

কান্তা মনি নিরবে চোখের জল ফেলে। তার মুখ থেকে যে এখন একটা বুলিও ফুটবেনা। আশেপাশের সবার কানে হেতিজার কথা গিয়ে বাজতেই সকলে হেতিজা আর কান্তা মনির দিকে বিস্ময়ে ভরা দৃষ্টিতে তাকায়। শাহ সুলতান মির্জা হিংস্র নয়নে হেতিজার দিকে তাকায়। তা আর কান্তা মনির দৃষ্টি এড়ায়নি। কান্তা মনিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শাহ সুলতান মির্জা ইতস্থত হয়ে স্থান ত্যাগ করে।

শাহ সুলতান মির্জাকে ইতস্থত হয়ে স্থান করতে দেখে কান্নার মাঝেও বাকা হেসে ওঠে। এই হাসি যে বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে নিরবে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিল।

দেখতে দেখতে তিনদিন কেটে গেছে। পুরো গ্রাম যেন শোকের চাদরে মুড়ে আছে। তরুণ জমিদারের মৃত্যু গ্রামের প্রতিটা মানুষের বুকের মাঝে আঘাত হেনেছে। তাদের যেন একটা চাওয়া হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া।

মেহরিন এই তিন দিন ধরেই জমিদার বাড়িতেই আছে।
কিছু একটা স্বপ্ন দেখেই বেগম নূর জাহান ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে। কখন যে চোখটা লেগে গেছিল বুঝতেই পারেননি বেগম নূর জাহান। পাশ ফিরে তাকাতেই চোখ-মুখ কুচকে আসে বেগম নূর জাহানের। মেহরিন পালঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে হাত পাখা দিয়ে বেগম নূর জাহানকে বাতাস করছে।

-এই তুমি আমার কক্ষে কি করো? বের হয়ে যাও। আমার চোখের সামনে থেকে সরে যাও। (ক্ষেপে গিয়ে বলে ওঠেন বেগম নূর জাহান)
-এমন করছেন কেন খালা? (বোকা বোকা ভাব নিয়ে)
-চুপ একদম। একদম চুপ। আমাকে খালা ডাকবিনা। তুই আমার পুত্রের হত্যার সাথে জড়িয়ে আছিস। বল আর কে কে জড়িয়ে আছিস? বল? (বেগম নূর জাহান)

-এইযে আমি। (হঠাত বেগম নূর জাহানের কক্ষে কেউ প্রবেশ করে)
-তুমিও? ছি। একটু হাত কাপেনি তোদের? বল আর কে কে জড়িয়ে আছিস? কেন করলি এমন? (বেগম নূর জাহান)
-এই পুরো জমিদার বাড়ির দখল চাই। জমিদারী দায়িত্ব চাই আমাদের। (বলেই কক্ষে প্রবেশ করে শাহ সুলতান মির্জা)
-তুমিও? তাহলে আমার পুত্র মারজান সরদারকে সন্দেহ শুধু শুধু করতো না। তোরা সবাই জড়িয়ে আছিস এতে। ছি। বিশ্বাসঘাতক তোরা। না জানি উনি এই কোথা জানতে পারলে কি করবেন। (কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে বেগম নূর জাহান)
-তা আদরের পুত্র কিভাবে হত্যা হলো শুনবেন না খালা? (মেহরিন)

বেগম নূর জাহান নির্বাক হয়ে নিজের আদরের পুত্রের হত্যার বর্ণনা শুনে গেলেন। চোখে যেন অশ্রুরা এসে টলমল করছে। বুকের মাঝে কে যেন গলিত লাভা ঢেলে দিয়েছে অনুভব হতেই চোখ খিচে বন্ধ করে নেন।

-একটা কে ও ছাড়ব না আমি। তোদের সবগুলোকে শাস্তি পেতেই হবে। (ফুসে উঠে বলে উঠেন বেগম নূর জাহান)

বেগম নূর জাহানের কথা শুনে সকলে একে অপরের দিকে একবার তাকিয়ে একসাথে হেসে ওঠে।

ছেলের মৃত্যুর শোকে কাতর মা। গলা দিয়ে কি খাবার নামে? এশার নামাজ শেষ করে জগ হতে পানপাত্রে পানি ঢেলে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে পালঙ্কের ওপর এসে বালিশে মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে পড়েন বেগম নূর জাহান। ঘন্টাখানেক পরেই গলা-বুক-পেট জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে যায় বেগম নূর জাহানের। নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। গলা এবার বিষ ব্যথা ধারণ করছে। ছটফট শুরু করেন বেগম নূর জাহান। বুঝে গেছেন পেটে বিষাক্ত কিছুই পড়েছে। সারাদিনে তো কিছুই খাননি। শুয়ে পড়ার আগে পানি খেয়েছিলেন। তাহলেই কি পানিতেই কিছু মিশিয়ে রাখা ছিল? কাদের কাজ বুঝতে বাকি নেই। প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করছে তারা। ইতোমধ্যে নাক-মুখ থেকে রক্ত বের হওয়া শুরু হয়ে গেছে। বেগম নূর জাহান ধরে ধরে পালঙ্ক থেকে নেমে কাগজ আর কলম নিয়ে তাতে কিছু একটা লিখে কাগজটা ভাজ করে আলমারির তাকে রাখেন। আলমারি বন্ধ করেই আলমারি ঘেষে মেঝেতে বসে পড়েন বেগম নূর জাহান।নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। মৃত্যু অনিবার্য তা অবগত হয়ে গেছেন তিনি। হাতরিয়ে পানি এনে পান করার সাধ্য টুকু হারিয়েছেন বেগম নূর জাহান। ধীরে ধীরে শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে। হঠাত কক্ষের দ্বার খুলে যায়। বেগম নূর জাহান নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে নিজের সন্দেহকে সত্য প্রমাণ করেন।

বেশ রাত এখন। মারজান সরদারের অসুস্থতার বাহানা দিয়ে জমিদার বাড়ি ছেড়েছে মেহরিন। ভয়ে ঘামছে মেহরিন। আশপাশের ঝোপ-ঝাড়ের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কুকড়ে ওঠে সে। কিন্তু এই মুহূর্তে জমিদার বাড়িতে থাকার চেয়ে এই অন্ধকার পথ ধরে বাড়ি ফেরাই উত্তম মনে হয় মেহরিন। রমনীর ধারণাই নেই যে পেছনে হয়তো কেউ তাকে অনুসরণ করছে।

কান্তা মনি অন্ধকারের মাঝে ধীর পায়ে মেহরিনকে অনুসরণ করে চলেছে। কাধে থেকে ব্যাগটার ওপর হাত রাখছে কিছুক্ষণ পর পর যে, সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। মুখ ঢেকে রাখা কালো কাপড়টা আরো শক্তপোক্ত করে বেধে নেয় কান্তা মনি।

গ্রামের বড় বটগাছটার নিকট আসতেই কারও ডাকে আতকে উঠে পেছনে ফিরে তাকায় মেহরিন। চাদের মৃদু আলো আর হারিকেনের পিটপিট আলোয় কান্তা মনির হাস্যজ্জ্বল মুখখানা দেখে সারা শরীরে কম্পন উঠে যায় মেহরিনের। শুকনো একটা ঢোক গিলে মুখে জোর পূর্বক হাসি ফুটিয়ে তুলে মেহরিন বলে ওঠে,
-কান্তা মনি তুমি? এত রাতে এই অবস্থায় বেরিয়েছো কেন?
জবাবে হেসে ওঠে কান্তা মনি।

-এই মুহূর্তে আমাকে এখানে আশা করোনি তাইনা মেহরিন? তা এত রাতে পালিয়ে আসলে কেন? কাল সকালেও তো আসতে পারতে। সত্যি বল তো কোনো জট পাকিয়ে রেখে এসেছো বুঝি? তাই এত রাতে মিথ্যা বাহানা দিয়ে পালিয়ে এলে। (কান্তামনি)

-কি সব বলছো কান্তা মনি। আমার আব্বাজান অনেক অসুস্থ। আমাকে তাই এখনই বের হতে হয়েছে। (মেহরিন)

-আরে এত তাড়া কেন। তোমার যাওয়া লাগবে না। তোমার আব্বাই না হয় আসবে। তুমি বরং আগে গিয়ে এক বিশেষ জায়গায় অপেক্ষা করো। তোমার আব্বাকেও সেখানে তোমার কাছে পাঠানোর দায়িত্ব আমার। এখন বিদায়। (বলেই কাধের ব্যাগে থাকা ছুরিটা বের করে মেহরিনের পেটে ঢুকিয়ে দেয় কান্তা মনি)

বিকট শব্দে আর্তনাদ করে ওঠে মেহরিন।

-আমার আব্বাজানকে যেন কিভাবে ছুরি দিয়ে থেতলে দিয়েছিলি? দাড়া তোর ওপর ও ওই পদ্ধতি প্রয়োগ করি।

মেহরিন ব্যথায় কুকড়ে উঠে মাটিতে বসে পড়ে।

-কান্তা মনি আমাকে মেরো না দোহায় লাগে। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি বড্ড অন্যায় করেছি। (মেহরিন)
-বিপরীত মানুষের কঠোরতা আর মৃত্যুর কাছে সবাই কাবু দেখেছিস। মানুষ ভুল করার পর ঠিকটা বুঝতে পারে। কিন্তু তুই এবং তোরা ক্ষমার অযোগ্য। একে একে সবগুলোকে সরিয়ে দেব। আমার আব্বাজানকে মেরেছিস আমার স্বামীকে মেরেছিস তোরা। আমার সন্তানকে পৃথিবীতে আসার আগেই পিতৃহারা করেছিস। শাস্তি তো তোদের পেতেই হবে। তোরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস।(কান্তা মনি)
-কান্তা…
মেহরিনকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ছুরি দিয়ে বারবার তার শরীরে আঘাত করতে থাকে কান্তা মনি।

-তোদের একটাকেও ছাড়ব না।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে