কলঙ্ক পর্ব-১৫

0
1178

#কলঙ্ক
#১৫তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক


জীবনে প্রথমবারের মতো বাবার কথার উপর কথা বলি আমি।বলি,’বাবা, জীবনে শেষ বারের মতো একটা সুযোগ চাইছি আমি।প্লিজ এই সুযোগটা আমায় দাও।কথা দিলাম আমি পড়াশোনা শেষ করেই ফিরবো!’
বাবা আমার কথা শুনে ঈষৎ কেঁপে উঠেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন,’তুই পারবি না মা।এর আগেও পারিসনি! তোকে ওরা খুব অপমান করবে।তুই সহ্য করতে পারবি না এসব কিছুতেই!’
আমি তখন অসহায় হয়ে পড়ি। পেছনের ব্যর্থতাগুলো এসে মস্তিষ্ক ঠুকরে ধরে। খুব ব্যথা করে। ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে কাঁদতে! তবুও কাঁদি না আমি।শান্ত স্বরে বাবার আরেকটু কাছে ঘেঁষি আমি। আমার সাহস হয়।আমি বলি,’পারবো বাবা। এবার যে আমায় পারতেই হবে।’
বাবা বলেন,’কার জন্য পারতে হবে?মেহরাবের জন্য?’
আমি ডান দিকে মাথা কাঁত করে হ্যা বলি।
বাবা তখন বলেন,’মারে, অতদিন সে তোর জন্য কিছুতেই অপেক্ষা করবে না। তাছাড়া কেউ ইচ্ছে করে ঘরে কলঙ্ক নিতে চায় না! হয়তো আমি কিংবা তোর মা,তোর ভাই তোকে কলঙ্ক ভাবছি না।কারণ আমরা তোর রক্ত।অথবা তুই আমাদের রক্ত।আমরা সত্যিটা জানি।আমরা জানি এটা তোর ভুল ছিল। কিন্তু অন্য মানুষ তো এটাকে ভুল বলে মানবে না। মেহরাব যদিও মুখে বলেছে সব মেনে নিবে সে, কিন্তু আসলে সে কিছুই মানবে না!’
আমি তখন খপ করে বাবার একটা হাত ধরে ফেলি। তারপর বলি,’বাবা,ও আমায় ছেড়ে দিক।এতে আমার কোন দুঃখ হবে না। কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে হবে যে সে আমায় ছাড়বে না। মানুষ লক্ষ্য ছাড়া কিছুই করতে পারে না।কারোর যদি কোন গন্তব্য না থাকে তবে সে জীবনে কিছুই করতে পারবে না।জীবনটা তার কাছে হবে তখন কর্মহীন,লক্ষ্যহীন।আমি এমন হতে চাই না বাবা।আমি চাই মেহরাবকে পাওয়ার জন্য পড়াশোনাটা করতে। এই আশাটা না থাকলে আমি পড়াশোনাটা করতে পারবো না! কিন্তু জেনে রেখো বাবা,ও যদি আমায় বিয়ে নাও করে আমি কিন্তু তখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবো। নিজের পায়ে নিজে দাঁড়িয়ে যাবো। তখন কিন্তু কারোর প্রতি আমার আশা নিয়ে থাকতে হবে না। নিজের কাজটা নিজেই করতে পারবো!’
বাবা কিছু বলেন না। রাগে,অভিমানে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠোন পেরিয়ে রাস্তার দিকে চলে যান। রাস্তার গা ঘেঁষে নদী আছে।কংশ নদী।আমি জানি বাবা এখন নদীর পাড় ঘেঁষা সবুজ তুলতুলে ঘাসের উপর বসে থাকবেন। নদীতে কমে যাওয়া স্বচ্চ জলের দিকে তাকিয়ে ভাববেন তার মেয়ে কী আসলেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কি না!আর রাতে ঘরে ফিরে জানাবেন, তিনি শেষ বারের মতো রাজি আছেন।

রাতে ঘরে ফিরে বাবা ঠিক জানালেন তিনি রাজি আছেন। কিন্তু তার একটা শর্তও আছে। তিনি বললেন আমি যেন মেহরাবকে বলি,কাল সকালে একবার মেহরাব যেন আমাদের বাসায় আসে।
আমি রাতেই মেহরাবের সাথে কথা বলি।বলি,’মেহরাব কাল সকাল বেলা আপনার ডাক পড়েছে!’
মেহরাব বলে,’কোথায়?’
‘আমাদের বাসায়।’
‘কে ডেকেছে?’
‘বাবা।’
মেহরাব আশাহত হয়।সে হয়তোবা ভেবেছিল অন্যকিছু।সে হয়তোবা ভেবেছিল তাকে আমি ডেকেছি!

সকাল বেলা মেহরাব আসে। তার পরনে নীল পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির বুকে মেঘের খন্ড খন্ড চিত্র।
কী যে সুন্দর লাগে তাকে এভাবে দেখতে!
বাবার সাথে কথা বলার আগেই সে আমায় বলে,’তূর্ণা, চলুন আমরা পুকুর পাড়ে যাই!’
আমার পরনে জামা ছিল। তাড়াহুড়ো করে আমি জামা পাল্টে সাদা রঙের একটা শাড়ি পরে নেয়। কপালে একটা নীল সরু টিপ পরি। চোখে কাজল মাখি।হাতে একটা চিকন কালো ফিতের ঘড়ি।দু পায়ে সাদা চকচকে রূপোর নূপুর। তারপর খালি পায়ে বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে বলি,’চলুন।’
মেহরাব আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। তারপর হাঁটে।আমরা গিয়ে দাঁড়াই গত পড়শুদিন সেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক সেখানেই। সেই ফাগুন বাতাস,তিরতির করে পাতার কাঁপুনি,মুকুলের মিষ্টি ঘ্রাণ এইসব কিছু নিয়ে আমরা মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াই।
মেহরাব বলে,’আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে!’
আমি মোলায়েম হাসি।
মেহরাব আবার বলে,’আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে!’
আমি আগের মতই হাসি।
মেহরাব আমার দিকে এগিয়ে আসে এক পা দু পা করে। আমার একেবারে কাছাকাছি এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। তারপর পকেট থেকে একটা লাল টকটকে গোলাপ বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে,’আই লাভ ইউ।’
তখন আমার কাছে মুহূর্তে পৃথিবীটাকে স্বর্গের মনে হয়।আমের মুকুলের ঘ্রাণকে মনে হয় স্বর্গের কোন অচিন ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ। দিঘির জলকে মনে হয় স্বর্গের নহরের মিষ্টি জল। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক মেহরাবকে মনে হয় সে যেন এ জগতের কেউ নয়।সে স্বর্গের এক যুবক।যে দেখতে আদি পিতা আদমের মতো লম্বা চওড়া। ইউসুফের মতো রুপবান তরুণ।তার গলার স্বর দাউদের গলার মতো (পড়ুন আঃ)।আমি উন্মাদের মতো হয়ে পড়ি কেমন। তারপর হাত বাড়াই।গোলাপটা টেনে নিয়ে বুকের কাছে চেপে ধরি।আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে বলি,’মেহরাব,আই লাভ ইউ টু ওওওও।’
মেহরাব আমার দিকে তাকিয়ে হাঁটু সোজা করে উঠে দাঁড়ায়। তারপর বলে,’আপনার বাবা আমায় কিসের জন্য ডেকেছে আমি জানি।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’কিসের জন্য?’
‘তিনি আমায় ওয়াদা করাতে চাইবেন। জিজ্ঞেস করবেন আমি সত্যি সত্যি আপনাকে বিয়ে করবো কি না। এই জন্যই আপনাকে আমি পরীক্ষা করে দেখলাম। পরীক্ষায় আপনি ফেল করে ফেলেছেন।আমি এখন আপনার বাবাকে বলবো, আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করবো না। আপনি আপনার মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ রেখে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিন।কথা দিলাম ওর সম্পর্কে জানা কোন বিষয়ে আমি কোনদিন কারোর কাছে মুখ খুলবো না।আপনারা নিরাপদ!’
আমি উদভ্রান্তের মতো হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,’আমার ভুলটা কোথায় হয়েছে মেহরাব?’
মেহরাব রেগে যায় হঠাৎ।রেগে গিয়ে বলে,’আপনি জানেন না আপনি কী ভুল করেছেন?’
আমি বুঝতে পারি না। সত্যি সত্যি বুঝতে পারি না!ভুলটা আমি কোথায় করলাম?
আমায় চুপ করে থাকতে দেখে মেহরাব বললো,’আপনি ভীষণ বোকা আর প্রচন্ড রকম আবেগী।বোকা আর আবেগী বলেই আপনার জীবনটা আজ এমন।ওই যে আমান আপনাকে ঠকিয়ে গেলো তা আপনার আবেগের জন্যই।আর আপনার বোকামির জন্যও।আমায় আপনি চিনেন কতদিন হলো?এই দু থেকে তিনদিন। এই দু তিন দিনে আপনার সাথে আট দশটা বাক্যের উপর কথা হয়নি আমার।এই আট দশটা কথায় কী আপনি আমায় বোঝে গিয়েছেন?চিনে ফেলেছেন আমায় সবটুকু?’
আমি বুঝতে পারছি না মেহরাব এমন করছে কেন?
আমি ওর দিকে বোকার মতোই তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ করে মুখ ভেঙে কান্না এসে যেতে চায়। ঠোঁট কাঁপে তিরতির করে সবুজ সবুজ আম পাতাদের মতো। চোখে জল টলমল করে ঢেউ খেলে যায়।
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকি,’মেহরাব!’
মেহরাব তখন বলে,’আপনাকে আমি প্রপোজ করলাম আর আপনি সাত পাঁচ না ভেবেই হুট করে রাজি হয়ে গেলেন!কী আশ্চর্য!এর নাম কিন্তু ভালোবাসা নয়।এর নাম ঠকা। ভালোবাসার আগে হাজার বার ভেবে নেয়া উচিৎ।যাকে ভালোবাসবেন তাকে চিনে নেয়া উচিৎ। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করা উচিৎ।
আরেকটা কথা হলো, এই যে আপনি ঢাকায় যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেলেন আপনি তো ঢাকায় গিয়ে থাকতে পারবেন না। আপনি বোকা আর আবেগপ্রবণ। আপনাকে যখন ওরা আঘাত করে কথা বলবে। অপমান করবে। তখন কিন্তু আপনি আবার বাড়িতে পালিয়ে আসবেন। এবং এটাই সত্যি!’
আমি এবার কেঁদে ফেলি।সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলি।
আমাকে কাঁদতে দেখেও মেহরাব মায়া দেখায় না।সে আমায় পেছনে ফেলে হেঁটে হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বাবার সাথে দেখা করবে।কথা বলবে। হয়তো না করে দিবে।বলবে,আমায় বিয়ে করবে না।বলে দিবে আমাকে অন্য কোথাও বিয়ে দেয়ার জন্য!
না যদি করবেই তবে আগে এতো স্বপ্ন দেখালো কেন?এতো এতো স্বপ্ন!
তারপর আবার জিভে কামড় দেই শক্ত করে আমি।কান্নার মাঝেই মনে হয় আমি আবার আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি।আসলে আমাকে এখন আর আবেগী হলে চলবে না। পৃথিবীতে আবেগপ্রবণ মানুষেরা জীবনভর কষ্ট পেয়ে যায়! এদের কপালে সুখ নামক বস্তু কোনদিন জোটে না!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে