কলঙ্ক পর্ব-১৬

0
1237

#কলঙ্ক
#১৬তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক



মেহরাব বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।সালাম দেয়। কুশল বিনিময় হয় দুজনের মধ্যে। তারপর বাবা কিছু বলতে চাওয়ার আগেই সে বাবাকে বলে,’বাবা, আপনি টেনশন করছেন এবং নিরাশায় ভোগছেন যে আমি কী তূর্ণাকে বিয়ে করি কি না এ নিয়ে! সেটাই তো?’
বাবা কোন উত্তর করতে পারেন না।কী বলবেন বুঝতে পারেন না।
মেহরাব নিজেই ফের বলে,’বাবা,আমি কথা দিচ্ছি তূর্ণাকে আমি বিয়ে করবো। কিন্তু এর জন্য তুর্ণাকে পড়াশোনা করতে হবে। তূর্ণা আমার সাথে কথা দিয়েছে সে পড়াশোনা করবে।’
তারপর মেহরাব বাবার সামনে দাঁড়িয়েই আমায় ডাকে।বলে,’তূর্ণা, এদিকে আসো তো একটু!’
ওর মুখ থেকে তুমি ডাক শুনে চমকে উঠি আমি। মেহরাব এই প্রথম আমায় তুমি করে ডেকেছে।
আমি ধীরে ধীরে পা ফেলে লজ্জায় লাল হওয়া মুখ নিয়ে এসে ওদের পাশে দাঁড়াই। তারপর মাথা নত করে তাকিয়ে থেকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মাটি খুড়ি।
মেহরাব তখন বলে,’তূর্ণা, তুমি কী এবার জিততে পারবে?’
আমি চোখ জোড়া উপরের দিকে তুলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলি,’পারবো।’

সে রাতেই বাবা বলেন,’আমি এই বিষয়ে আর কিছু বলবো না।মেহরাব যখন বলেছে তবে তার কথা শোনা উচিৎ। ছেলেটাকে মনে হচ্ছে অনেক ভালো। তাছাড়া তার বাবাও ভালো মানুষ ছিলেন।আমি খবর নিয়েছি ওদের সম্পর্কে।’
মা তখন কেমন যেন ধরা গলায় বলেন,’আমার কপালে আল্লাহ শান্তি দেয় নাই! মানুষের ছেলে মেয়েরা বাপ মার কথা শোনে।মান ইজ্জতের কথা ভাবে। আমারে যে আল্লাহ কোন জাতের সন্তান দিলো! তাদের যা ইচ্ছা তারা তাই করে।বাপ মা কী বলে না বলে সেই দিকে তাদের কোন নজর নাই!’
মা কথাগুলো বলে অভিমানে কেঁদেই ফেলেন।
মার কান্না দেখে আমার খারাপ লাগলেও আমি চুপ করে থাকি।আর মনে মনে তখন আমি ভাবি,মা তোমার এই কান্না আমি ঠিক একদিন হাসিতে পরিণত করবো। অবশ্য এর জন্য আমার অনেক কষ্ট করতে হবে। অনেক সংগ্রাম করতে হবে। তবে আমি এই কষ্টটুকু এখন করতে প্রস্তুত আছি। এবার আমি বিজয়ী বেশেই ফিরবো ইনশাআল্লাহ!

ঢাকায় যাচ্ছি।এবারও ট্রেনে করে যাচ্ছি।ঝক ঝক করে ছুটছে ট্রেন। মেহরাবের কথা ছিল সে আমায় স্টেশন অবধি পৌঁছে দিবে। কিন্তু সে আমার সাথেই আছে এখন।ঢাকা পর্যন্ত যাবে আমার সাথে।
আমি প্রথম বেলা ভাবতেই পারিনি যে সে আমার সাথে যাবে। ভাবছিলাম সে এমনিতেই আমার পাশে বসে আছে। কিন্তু একটু পর যখন ট্রেন ছেড়ে দিল,স্টেশন কেটে ট্রেন চলে গেল অনেক দূরে তখনও বুঝতে পারছিলাম না কিছু। ভেবেছিলাম সামনের কোন একটা স্টেশন দেখে সে ঠিক নেমে পড়বে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো সে আমায় ভীষণ রকম অবাক করে দিয়ে সামনে আরো দু তিনটে স্টেশনেও নামলো না।
এবার আমি তার সাথে কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু কী বলে সম্বোধন করবো বুঝতে পারছিলাম না তাকে।সে তো আমায় তুমি তুমি করে বলছে। আমার কী বলে তাকে এখন সম্বোধন করা উচিৎ? আপনি?
আরেকবার মনে হচ্ছে তুমি করেই বলে ফেলি।সে যদি তুমি করে বলতে পারে তবে আমি কেন পারবো না!
তারপর মনে হলো মেহরাব তো আমার চেয়ে বয়সে অনেক বেশি বড়ো।বড়োদের তো তুমি করে বলা উচিৎ নয়। তাছাড়া তার সাথে আমার এখনও বিয়ে হয়ে যায়নি।প্রেম টেমও হয়নি।আমরা ভালো বন্ধুও না।
এবার একটা বুদ্ধি খেলে যায় মাথায়।মেচ্যুয়ুর মেয়েদের মতো করে আমি বলি,’মেহরাব!’
মেহরাব আমার দিকে তাকায়।
আমি এবার ভয় ভয় করা গলায় বলি,’আমরা কী তুমি তুমি করে বলতে পারি?’
কথাটা বলার পর হঠাৎ কেন জানি নিজেকে নির্লজ্জ মনে হতে থাকে আমার।তাই শামুকের মতো নিজের খোলসে নিজেকেই হঠাৎ ঢেকে ফেলতে থাকি!
মেহরাব তখন বলে,’আমি তো অনেক আগে থেকেই তুমি তুমি করছি তোমায়। তুমি করছো না কেন?’
আমি সাহস করে বলে ফেলি,’কোন অধিকারে তুমি করে বলবো? আমার তো ভয় করে!’
মেহরাব সাদা মুক্তোর মতো দাঁত বের করে হেসে উঠে। তারপর বলে,’আমি যে তোমায় তুমি করে বলি সেই অধিকারেই ডাকো।’
আমি আরো লজ্জায় আবিষ্ট হই। তারপর ফিক করে হেসে উঠে বলি,’তুমি!’
মেহরাব বলে,’আমি কী?’
আমি হাসি।হাসতে হাসতে বলি,’তুমি কী তা আমি কী করে জানবো!আমি কী তোমার সম্পর্কে সব জানি নাকি!’
‘তবে কতোটুকু জানো!’
‘জানি তুমি একটা নাটক বাজ!’
বলে ফিক করে আবার হেসে উঠি আমি।
মেহরাব রাগ পায় প্রচন্ড।মুখ কালো করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।গাড়ি আরেকটু পরেই শ্রীপুর স্টেশনে পৌঁছাবে। মেহরাব আমার সাথে একদম কথা বলে না।আমি অনেক চেষ্টা করেও তাকে কথা বলাতে পারি না।সে হঠাৎ কানে ফোন ধরে বললো,হ্যা হ্যা আমি সামনের স্টেশনেই নেমে যাবো। একজন নাটকবাজের ঢাকায় যাওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না!
আমি জানি মেহরাব তখন কাউকে ফোন করেনি।এই কথাটা আমায় শুনাবার জন্যই সে বলেছে।
আমি তখন ওকে বলি,’সরি মেহরাব!’
মেহরাব আমার দিকে ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত করে না।
আমি এবার অনুনয়ের গলায় বলি,’মেহরাব,আমি অনেক সরি!মজা করেছি তোমার সাথে!’
মেহরাব তবুও শুনে না।
ট্রেন ছুটছে। পাগলের মতো ছুটছে। বাইরে বাতাস।রেলের পাতের ও পাশটায় ধুলো উড়ছে। বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে ধুলো। দূরে একটা মহিলাকে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেল।আমি বুঝতে পারছি না কিছুই। মহিলা কী কারোর জন্য অপেক্ষা করছে?এই ট্রেনে করে কী তার কোন প্রিয়জনের আসার কথা!
এসব ভাবতে ভাবতেই ঝট করে ট্রেন এসে থেমে গেল শ্রীপুর স্টেশনে। হঠাৎ ও পাশে তাকিয়ে দেখি মেহরাব নেই। বুকটা আমার হঠাৎ ধুকপুক করে কেঁপে উঠলো।এ কী!ও কী আমায় না বলেই নেমে গেছে তবে?

ট্রেনের বগির ভেতর খুব করে খুঁজি।ভিড়ের ভেতর একজন একজন করে দেখি। কিন্তু তার দেখা মিলে না। অবশেষে বগির দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে উঁকি দিয়ে এদিক ওদিক দেখলাম। কোথাও মেহরাব নেই।ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ওকে ফোন করলাম। ফোনের সুইচ অফ।কী মহা মুশকিল!
এমন না যে আমি ওকে ছাড়া ঢাকায় যেতে পারবো না! কিন্তু আমার ওকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে!এই যে আমার ঢাকায় ফেরা, পড়াশোনা শুরু করার ইচ্ছে সবটাই তো ওর জন্য!
নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে নিজেই নিজের সব চুল টেনে উপড়ে ফেলি!

ট্রেন ছেড়ে দিবে।সময় হয়ে গেছে। বাঁশি বাজাচ্ছে। এখন আমি কী করবো? ওকে ছেড়েই চলে যাবো!নাকি নামবো?
কিন্তু নেমে যদি ওকে না পাই?
আর পেলেও যদি ওর রাগ না ভাঙ্গে?
ভয় হচ্ছে আমার। খুব ভয় হচ্ছে। এমনিতেও সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কেমন একটা আঁধার আঁধার ভাব বাইরে।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। সামান্য গতিতে ছুটছে। এখনও মানুষ ট্রেনে উঠছে। প্লাটফর্ম ছেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্তই এভাবে মানুষ উঠতে থাকবে। কিন্তু আমি কী করবো?
নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে হঠাৎ।মুখ ভেঙে কান্না পাচ্ছে। নিজের প্রতি কী যে রাগ হচ্ছে।কেন যে আমি ওকে এমন একটা কথা বলতে গেলাম!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে