ওয়ারদূন আসরার পর্ব-০১ | বাংলা ধারাবাহিক গল্প

0
2160

#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
“সূচনা পর্ব”

০১.
– বিয়ে টা কি সিঁদূর দিয়ে হবে?

– কখনো না! আমি মুসলিম হয়ে কখনোই ওই লাল রঙ মাথায় মাখবো না আমি ইসলামিক রীতিতেই বিয়ে করবো নইলে আমি এই বিয়ে করবো না!

– মা একটু বুঝ!

– কোনোকিছু বুঝতে চাইনা আমি আব্বুজান কি করে পারছো এতো বড় গুনাহ করতে বলতে পারো? কেন এতো বড় গুনাহর ভাগীদার করছো?

– ঠিক আছে এখানে তাহলে কাগজে কলমেই তোমাদের বিয়ে সম্পন্ন হবে।

কিছুক্ষণ আগের কথা,,,

আজ জাফিয়ার বিয়ে! বিয়ে উপলক্ষে চারপাশটা আনন্দ-উল্লাসে থাকা উচিত ছিলো কিন্তু তার পরিবর্তে চারপাশে সকলের আত্মৎনাৎ, বুক ফাটা কান্না। জাফিয়া বিয়ের আসরে বসতেই ৪ জন লোক তার ভাইকে কাফনের কাপড়ে জড়িয়ে সকলের সামনে রাখলো। জাফিয়া দৌড়ে তার ভাইয়ের কাছে এসে ভাইয়ের দিকে একপলক তাকায় তারপর লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”আ…আমার ভা..ভাইয়ের কি হয়েছে?”
জাফিয়ার মা ততোক্ষণে ফুয়াদের(ফায়রুজের ভাই)মাথার কাছে এসে মরণ কান্না জুড়ে দিলো। কোন মা-ই বা অকালে নিজের সন্তানের চলে যাওয়া সহ্য করতে পারে? যাকে আদর ভালোবাসা সোহাগ দিয়ে বড় করেছে সে এভাবে চলে যাবে সে যে কল্পনায়ও ভাবেনি। ফুয়াদ ১৬ বছর বয়সী! জাফিয়ার কথায় একজন লোক মাথা নিচু করে বলে,”আমরা ফুয়াদকে রক্তাক্ত অবস্থায় বাগানে পেয়েছি এর বেশি আমরা কিছুই জানিনা!”

লোকটার কথায় জাফিয়া আর নিজেকে সামলে উঠতে পারেনা! চিৎকার দিয়ে ধপ করে বসে পড়ে ভাইয়ের কাছে! এভাবে নিজের ভাইকে অকালে হারাবে কখনো সে ভাবেনি। উপস্থিত সকলের মাঝে শোকের ছায়া। কিছুক্ষণ কান্নার পর জাফিয়া মূর্তির মতো বসে রইলো। কথায় আছে না, “অল্প শোকে কাতর, অতি শোকে পাথর!” জাফিয়ার বাবা ফয়েজ দূরে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে! জাফিয়ার ছোট চাচা দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খুবই ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,, “ভাইজান(জাফিয়ার বাবা) যীনাতের বর রোড এক্সিডেন্ট করেছে এবং ঘটনাস্থলে ছেলেটা আর তার বন্ধুরা নিহত হয়।”
চাচার এমন কথায় পুরো বিয়েবাড়ি যেনো নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।

বিয়ের দিনে এতো দুর্ঘটার জন্য মানুষ এখন জাফিয়ার দিকে আঙুল তোলা শুরু করলো। সকলে বলাবলি শুরু করে,”মেয়েটা একটা অমঙ্গলের বস্তা! দেখিস না বিয়ের দিনই ভাইটাকেও খেলো সাথে নিজের হবু স্বামীকেও! কেমন অপয়া হলে এভাবে মানুষ মারে চিন্তা করতে পারিস? এই মেয়ে আস্তা অলক্ষী! এ যেই ঘরেই যাবে তাদের সবাইকে মেরেই ছাড়বে, না বাপু এর থেকে দূরে থাকা লাগবে, না জানি কবে আমরা আবার এই মেয়ের ভাগীদার হই।”

সব কথোপকথন ফয়েজের কানে আসছে কিন্তু চেয়েও কিছুই বলতে পারছে না কি বলবে সে?সে নিজেও যে কোনোকিছু বলার মতো অবস্থায় নেই। ওইদিকে কাজী সাহেব তাড়া দেয়া শুরু করে বলে,”কি হলো ছেলে কই? বিয়ে তো দিতে হবে নাকি?”

এবার ফয়েজ কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। আজ যদি তার মেয়ের বিয়ে না হয় তাহলে সম্মান তো যাবেই সাথে মেয়েটার জীবনও নষ্ট হয়ে যাবে। অতি আদর ভালোবাসায় বড় করেছে মেয়েকে সে কষ্ট পাক তা যে কখনোই চায়না। ছেলেও কম আদরের ছিলো না কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন! উপায় না পেয়ে ফয়েজ সবার কাছে মিনতি করে যেনো কোনো যুবক ছেলে তার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয় কিন্তু কেউ ভয়ে এক পাও এগোলো না যদি কোনোভাবে এই মেয়ে তাদের জীবনে বীপর্যয় ডেকে আনে? তাই সবাই নাকোচ করে দেয়! ফয়েজ এবার না পেরে ধপ করে সবার মাঝে বসে পড়ে। কেঁদে কেঁদে কবলে,”হে আল্লাহ এ কেমন পরীক্ষা নিচ্ছেন আপনি আমাদের পরিবারের উপরে? কি দোষ করেছে আমার ছেলে মেয়ে দুটো যাদের জীবন এমন হয়ে গেলো! আমার ছোট ছেলে টা কে নিয়ে নিলেন এখন আমার মেয়েটাকে কেন সবার ঘৃণার পাত্রী বানাচ্ছেন? সে তো সবসময় আপনারই ইবাদতে মশবুল ছিলো!! তার প্রতিদান আপনি এভাবে দিলেন?”

বলেই হাটু গেড়ে বসে কাঁদতে লাগে! এমন সময়ই তার কাধে কেউ হাত রাখে ফয়েজ সাথে সাথেই চোখে অশ্রু নিয়ে পিছু ফিরে তাকায়। যিনি হাত রেখেছেন তিনি আর কেউ নন প্রভাবশালী মেয়র মিস্টার দেবনাথ দেব। বয়স তার ৭৭ এর কাছাকাছি। এই বয়সেও তিনি অনেক ফিট এবং পরশ্রমী। ফয়েজ উঠে দাঁড়ায় এবং দেবনাথ দেব কে বলে,”আপনি?”

– হ্যাঁ আমি সবটা দেখেছি এবং শুনেছি তোমাকে একটা প্রস্তাব দিতে চাই।

– কিসের চাচা?

– আমি আমার ছোট নাতিনের জন্য তোমার মেয়েকে চাচ্ছি! আমি চাই আমার নাতিনের সাথে তোমার মেয়ের এই মুহূর্তে বিয়ে হোক!

সকলে অবাক হয়ে দেবনাথ দেবের দিকে তাকায়! অবাক হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ দেবনাথ দেবের পুরো পরিবার সনাতন ধর্মের অনুসারী। কি করে একজন মুসলিম মেয়ে একটা হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করবে এটা যে চরম অপমান ইসলামের দৃষ্টিতে। দেবনাথ দেব সকলের প্রশ্ন বুঝতে পেরে বলে,”আমি জানি আপনাদের মনে কি প্রশ্ন আছে। তবে এইটুকু বলবো এখানে কোনোরকম কারো ধর্মকে অপমান করে বিয়ে হবে না মেয়েটার ধর্ম ঠিক থাকবে আর ছেলেরও।”

হঠাৎ একজন লোক বলে উঠে,”এটা কি করে সম্ভব মেয়র সাহেব? আপনারা বড় ঘরের মানুষ ঠিক আছে কিন্তু আপনাদের ধর্ম আর মেয়েটার ধর্ম সম্পূর্ণ আলাদা সেখানে আপনি কি করে…”

লোকটিকে বলতে না দিয়ে দেবনাথ দেব কঠোর ভাবে বলে,”এতো যখন আপনাদের ধর্ম নিয়ে চিন্তা তাহলে আপনাদের মাঝে থেকে কেউ কেন এগিয়ে আসলো না মেয়েটাকে বিয়ে করতে? জবাব দিন? হ্যাঁ আমরা মানুষ কিন্তু আপনারা আপনাদের অমানুষ রূপ টা দেখিয়েই চলেছেন। এখানে একজন মধ্যবয়সী লোক সবার সামনে কেঁদে বুক ভাসালো কই আপনারা কেউ তো তার দিকে এগিয়ে আসলেন না? আমরা অন্য ধর্মের হলেও নিজেদের মাঝে একটা মনুষ্যত্ববোধ আমাদের আছে! আর আমি আমার এরিয়াতে কোনো মেয়েকে এভাবে অপমান হতে দিবো না যেখানে আপনারা মেয়েটাকে অপবিত্র বলছেন! দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে স্বাভাবিক তাই বলে মেয়েটার কি দোষ এখানে? সবই উপরওয়ালার ইচ্ছা এখানে কারো হাত থাকে না। আর আমি যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আমার ছোট নাতিনের সাথেই জাফিয়ার বিয়ে দেবো মানে দেবোই। আমরা অন্য ধর্মের অনুসারী বলে কি মানুষ নই?”

সকলে দেবনাথ দেবের কথায় একদম চুপ হয়ে গেলো। এদিকে ফয়েজ কি বলবে কিছুই ভেবে পায়না। সকলকে চুপ থাকতে দেখে দেবনাথ দেব বলে,” আশা করছি এখানে কারো আপত্তি নেই!”

– আমার আপত্তি আছে!

সকলে জাফিয়ার দিকে তাকালো। জাফিয়া চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”আমার ভাই এখানে মারা গেছে সেখানে আপনারা আমার বিয়ে নিয়ে পড়ে আছেন? ”

– দেখো মা আমরা তো তোমার ভালোর জন্যই বলছি আজ যদি তোমার বিয়ে না হয় তোমার জীবন টা যে শেষ হয়ে যাবে মা।

– আব্বাজান আপনার সব কথা আমি শুনি কিন্তু এবার পারবো না! আমার ভাই….

বলে আবার ডুকরে কেঁদে উঠে। ফয়েজ মেয়েকে শান্তনা দিয়ে বলে,”এভাবে কাঁদিস না মা আল্লাহ যার আয়ু যতোটুকু রেখেছে তারা ততোটুকু সময়ই যে বাচবে সময় হলে তারা ঠিকই চলে যাবে। আর তোর ভাইটা যে কষ্ট পাচ্ছে! ফুয়াদের কতো ইচ্ছে ছিলো নিজের বোনের বিয়ে দেখবে এভাবে তার ইচ্ছা অপূর্ণ করো না!”

– কিন্তু বাবা আমি অন্য ধর্মের ছেলেকে কখনোই বিয়ে করবো না। এতে আল্লাহ আমার উপর নারাজ হবেন তা আমি কখনোই চাইনা।

একজন হিন্দু মহিলা বলে উঠে,”এতোই যদি তোমার আল্লাহকে নিয়ে ভয় তাহলে তোমার সেই আল্লাহ কেন তোমাকে এমন বিপদে ফেললো?”

জাফিয়া শত কষ্টের মাঝে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে,”আল্লাহ আমার ধৈর্য্যের পরিক্ষা নিচ্ছেন এবং তিনি কখনোই কারো খারাপ চান না। তিনি আমার তকদিরে যা লিখেছেন আমার সাথে তাই হচ্ছে এ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আর আপনি অন্য ধর্মের অনুসারী হয়ে আমার প্রভুকে কটুকথা শোনানোর আগে ১০বার ভেবে নিবেন এখন চুপ থাকলেও পরের বার আল্লাহর কসম আমি আপনাকে কোনো প্রকার ছাড় দেবো না।”

জাফিয়ার এমন রুক্ষতা মহিলাটির গা জালিয়ে ছেড়েছে। দেবনাথ দেব শান্ত কন্ঠে বলে,”তোমার জন্য এখন এই পথ টাই খোলা আছে তাই বলছি রাজি হয়ে যাও!”

– ক্ষমা করবেন দাদু আমি কখনোই পারবো না নিজের ধর্মকে ত্যাগ করে আপনার নাতিনকে বিয়ে করতে!

– এখানে ত্যাগ করার বিষয় কেন আসছে? আমরা কেউ তো তোমার ধর্মকে ছাড়তে বলছি না শুধু বলছি তুমি আমার নাতিনকে বিয়ে করবে। আমি নিজে কথা দিচ্ছি কেউ তোমাকে কোনোরকম জোর করবে না তোমার ধর্ম বদলাতে! তুমি তোমার ইবাদত নিজের মতো করে করবে।

– আপনাকে আমি কি করে বোঝাই ইসলামে অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করতে নেই এটা দ্বন্দনীয় অপরাধ!

-(আর আমি তোমায় আমি কিভাবে বোঝাই যীনাত আমার নাতিনটা যে তোমার জন্য পুরোই যোগ্য! তোমার আগমন বিপদ থেকে জাইফই বাচাতে পারবে। আর জাইদ যে তোমার মতোই….নাহ কাউকে বলতে পারবো না আমি সত্যটা এতে করে যে আরও সমূহ বিপদ!)

এমন সময়ই জাফিয়ার শিক্ষক এলাকার ইমামসাহেব আসলেন। জাফিয়া সালাম দিলে তিনি সালামের উত্তর নিলেন। জাফিয়া ছোট থেকে তাকে খুব মানেন।তিনি সবটা শুনে কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলেন। একে তো ফুয়াদের জানাজাও বাকি তার মাঝে জাফিয়ার বিয়ে। হুজুর কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে শান্ত গলায় বলে,”আমি আপনার নাতিনকে দেখতে চাই সে কি বিয়েতে এসেছে?”

– হ্যাঁ এসেছে দাঁড়ান আমি এখনই তাকে সামনে আনছি!

বলেই তিনি অন্যদিকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরেও এলেন এক সুদর্শন যুবক কে নিয়ে। যুবকটা এতোটাই সুন্দর যে চারপাশের মানুষ হা করে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার রূপের রশ্মি যেনো জ্বলজ্বল করে সকলকে জানান দিচ্ছে তার সৌন্দর্য! সকলে অনেকটাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

——————————–

চলবে!!!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে