ওয়াদা ২৫

0
3264

ওয়াদা ২৫
চেন্জ করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি মেঘ খাটের উপর বসে ল্যাপটপ এ কাজ করছে। আমি আয়নার সামনে দাড়িয়ে চিরুনি করছি আর ভাবছি কি থেকে কি হয়ে গেলো। এমন সময় কাকিমা রুমে এলো।
-নাশু?
-হ্যা কাকিমা কিছু বলবে?
-হুম। তুইতো রাতে হালকা মিষ্টি ছাড়া কিছু খাসনি। আমি টেবিলে খাবার দিয়েছে খাবি আয়।
-কাকিমা আমার খেতে ইচ্ছা করছে।
-খেতে ইচ্ছা না করলেও খেতে হবে। সারারাত না খেয়ে থাকবি নাকি। আর হ্যা আজ থেকে আমায় আর কাকিমা বলে ডাকবি না শুধু মা বলে ডাকবি বুঝলি।
-আমার একটু সময় লাগবে।
-আমি ওতো সময় দিতে পারবো না। তুই আমায় এখন থেকে মা বলেই ডাকবি। তুই শুধু আমার ছেলের বউ হয়ে নয় আমার মিয়ে থাকবি।
-হুম। ঠিক আছে।
-আমি যাচ্ছি তাড়াতাড়ি খেতে আয়। মেঘ তুইও আয়।
তারপর আমি আর মেঘ দুজনই খেতে গেলাম। খাওয়া শেষে কাকিমা আমায় তার রুমে নিয়ে গেলো।
-কিছু বলবে কাকিমা মানে মা।
-হ্যা। তোকে কিছু বলার ছিলো।
-বলো।
-দেখ আমি জানি হুট করে হওয়া এই বিয়েটা তুই মন থেকে মেনে নিতে পারিস নি। এটা স্বভাবিক। কিন্তু মা রে বিয়েটা যখন হয়েই গেছে তখন তুই মন থেকে সব কিছু মেনে নে। বিশ্বাস কর যা কিছু হয়েছে তা তোর ভালোর জন্যই হয়েছে। দেখবি তোরা দুজন খুব সুখি হবি।
-(আমি মাথা নিচু করে বসে আছি)
-একটা ভুল সিদ্ধান্ত মানুষের জীবনের মোড়টাই ঘুরিয়ে দিতে পারে আর একটা সঠিক সিন্ধান্ত জীবনের সব ভুল গুলোকে শুধরে দিতে পারে। এই বিয়েটাকে কখনো তোর জীবনের ভুল সিন্ধান্ত মনে করিস না। আজ হয়তো তোর মানতে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু একদিন আসবে যেদিন এই বিয়েটাকে তোর জীবনের সবথেকে সঠিক সিদ্ধান্ত ছিলো বলে তোর মনে হবে। তাই বলছি মন খারাপ করে থাকিস না। যা হয়েছে তা মন থেকে মেনে নিয়ে খুব সুখী হ। বুঝলি।
-হুম।
-যা এবার শুতে যা। অনেক রাত হয়েছে।
আমি কিছু না বলে উঠে চলে এলাম। আমি জানি এই বিয়েটা আমার জীবনের কোনদিনও সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। এটা আমার জীবনের সব থেকে ভুল সিদ্ধান্ত। আর এই ভুল সিদ্ধান্তের জন্য চারটা জীবন নষ্ট হয়েছে। চারজন মানুষের কষ্ট পাওয়াটা কিভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে। কখনই পারে না। এইসব ভাবতে ভাবতে রুমে আসলাম। মেঘ এখনো ল্যাপটপ এ কাজ করছে। আমি ওকে গিয়ে বললাম।
-আমার ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমাবো।
-ঘুমাতে কেউ মানা করেছে নাকি?(ল্যাপটপেরর দিকে তাকিয়েই বললো)
-আপনি ওই ভাবে বিছানার উপর বসে থাকলে আমি কোথায় ঘুমাবো?
(মেঘ আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো তারপর বললো)
-কেন তোমার কি আমার বুকের উপর মাথা দিয়ে ঘুমানোর কথা নাকি?
-কিহ? কি যাতা বলছেন আপনি? মাথা ঠিক আছেতো আপনার?
-আমার মাথা ঠিক আছে। তোমার গেছে না হলে তুমি আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে চাইতে না।
-আমি কখন বললাম আমি আপনার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে চাই? (অবাক হয়ে বললাম)
-একটু আগেইতো বললে।
-কখন বললাম?
-এইতো একটু আগে।
-আরে বাবা একটু আগে কি বললাম আমি।
-এটাই যে তুমি আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে চাও।
-আগে জানতাম আপনার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে এখন দেখছি মাথার সাথে কানটাও গেছে।
-আমার মাথার মতো কানটাও একদমই ঠিক আছে ওকে।
-সেতো দেখতেই পাচ্ছি। বললাম এক আর উনি শুনলেন আর এক।
-যা বলেছো সেটাই শুনেছি। আর যা বোঝাতে চেয়েছো সেটাই বুঝেছি।
-কি বলেছি আর কি বোঝাতে চেয়েছি শুনি?
-তুমি একটু আগে বললে যে “আপনি ওইভাবে বিছানার উপর বসে থাকলে আমি কোথায় ঘুমাবো”। আমি খাটের একপাশে বসে কাজ করছি। আর ওই পাশটা পুরো ফাকা থাকার স্বত্বেও তুমি ওই কথাটা বললে। এতেতো বোঝাই যাচ্ছে যে তুমি চাও আমি এইভাবে বসে না থেকে শুয়ে পরি আর তারপর তুমি আমার বুকের উপর মাথা দিয়ে ঘুমাবে।
-আল্লাহ গো। আমি বললাম কি আর উনি বুঝলেন কি।
-আমি ঠিকই বুঝেছি।
-কচু বুঝেছেন। আমি বলতে চেয়েছি আপনি বিছানায় থাকলে আমি কোথায় থাকবো।
-আমার বিছানাটা অনেক বড়। আর আমার পাশে অনেক জায়গায় আছে। চোখে দেখতে পাচ্ছো না।
-আমি আপনার সাথে এক খাটে ঘুমাতে পারবো না।
-তাহলে সোফায় গিয়ে ঘুমাও।
-আমি ওই অল্প জায়গায় ঘুমাতে পারবো না।
-তাহলে নিচে ঘুমিয়ে পরো।(ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলছে)
-নিচে ঘুমালে আমার ঠান্ডা লাগবে।
-তাহলে পাশের রুমে চলে যাও।
-আজ আমাদের বাসর রাত। এখন যদি আমি পাশের রুমে গিয়ে ঘুমাই তাহলে সবাই কি মনে করবে আপনি বুঝতে পারছেন।
-তাহলে তোমার যেখানে খুশি সেখানে ঘুমাও।
-আমি বিনাছায় ঘুমাবো।
-ঘুরে ফিরে সেই বিছানাতেই এলে। তাহলে এতো প্যাঁচাল পারলে কেন। যতসব।
-আমি বিছানায় ঘুমাবো আর আপনি সোফায় ঘুমাবেন আমি এটাই বোঝাতে চাইছি আপনাকে এতোক্ষন ধরে।
-মগেরমুলুক নাকি। আমি বিছানাতেই ঘুমাবো ওকে। তুমি চাইলে ওই পাশে ঘুমাও না হলে সারারাত এইভাবেই দাড়িয়ে থাকো।(বলে ল্যাপটপ ওফ করে শুয়ে পরলো।) আর আমি ওখানেই দাড়িয়ে থাকলাম। কোথায় শুবো বুঝতে পারছি না।
-ভায় পাওয়ার কোনো কারন নেই। মাঝখানে বালিশ দিয়ে বর্ডার দিয়ে শুয়ে পরো। আমি জানি এই বিয়েটা তুমি মানো না। তাই তোমার অসম্মান হোক এমন কিছুই করবো না।(খুব নরম ভাবেই কথাটা বললো)
আসলেইতো আমার মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে। আমি মেঘকে নিয়ে ভয় পাচ্ছি। আমিতো মেঘকে চিনি। ও অনেক রাগি ঠিক আছে কিন্তু ওর মন মানতিকা এতো নিচু নয়। তাছাড়া ঔতো এই বিয়েটা মানে না। ওতো রাত্রিকে ভালোবাসে। তাই আর কিছু না ভেবে বিছানার মাঝখানে বালিশ দিয়ে অন্য পাশে শুয়ে পরলাম। ঘুম আসছে না। মাথার মধ্য নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি জানি না। সকালে কারো ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো।
-মেহজাবিন নাশরাহ ওঠ। সকাল হয়ে গেছে।(মেঘ)
-উফ আর একটু ঘুমায় প্লিজ। পরে উঠছি।
-না এখনি ওঠ। অনেক বেলা হয়ে গেছে।
-আর একটু পরে উঠি প্লিজ।
-ওকে।(বলে চলে গেলো)
একটু পর কেউ একজন গায়ে পানি ঢেলে দিলো। আর আমার ঘুম উধাও। দেখি মেঘ গ্লাস হাতে দাড়িয়ে আছে।
-এটা কি হলো?
-কি হলো?
-আপনি আমার গায়ে পানি ঢাললেন কেন?
-কখন থেকে ডাকছি। উঠছো না। তো কি করবো।
-তাই বলে পানি ঢেলে দিবেন?
-হ্যা দিবো। আর এরপর থেকে যদি সকালে এমন লেট করো তাহলে প্রতিদিনই এইভাবেই ভিজিয়ে দিবো।
-কিহ্?
-হুম। এখন তাড়াতাড়ি উঠে পরো।
আমার যে এখন এই লাটসাহেবটার উপর কি পরিমাণ রাগ হচ্ছে তা বলে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু মুখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই। না হলে আবার কি করবে আল্লাহই জানে। আমি উঠতে যাবো তখনই মেঘের ফোনে একটা মেসেজ আসলে। দেখেতো আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। না না মেসেজ দেখে নয় মেসেজটাতো জিপি থেকে এসেছি কিন্তু টাইম দেখে আমার রাগের মাত্রাটা এবার উচ্চ থেকে উচ্চতর পর্যায়ে পৌছে গেলো। এখন ভোর ৪:৪০ বাজে। আর উনি কিনা বলেন ওনেক লেট হয়ে গেছে।
-এটার মানে কি?
-কোনটার?
-এখনতো কেবল ৪:৪০ বাজে। এতো সকালে উঠে আমি কি করবো?
-দেখ তুমি যতদিন এই বাড়িতে আছো ততদিন তোমায় আমার কথামতো চলতে হবে। আজ প্রথমদিন তাই কিছু বললাম না। কিন্তু কাল থেকে আরও তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।
-আমি এতো সকালে কখনো ঘুম থেকে উঠিনি। আমি পারবো না।
-আগে কি করতে সেটা আমি তোমার কাছে জানতে চাইনি। এরপর থেকে উঠবে।
-কিন্তু এতো সকালে উঠে আমি কি করবো? আজব।(একটু ধমক দিয়ে)
-ঘুম থেকে উঠে প্রথমে নামাজ পড়বে তারপর কোরান তেলওয়াত করবে। এবাড়ির সবাই এটাই করে। তোমার তো এটা জানার কথা।(নরম ভাবেই বললো)
-হুম তা জানি। কিন্তু,,,,,
-মায়ের কাছ থেকে শিখে নিয়ো।
-কি?
-তুমি কোরান তেলওয়াত করা ভুলে গেছো আমি জানি। মায়ের কাছ থেকে নতুন করে শিখে নিও। এখন উঠে নামাজ পরে নাও। আর আজ থেকে পাচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে। দেখবে মনের ভেতর যত খারাপ লাগা, ভয়, কষ্ট, দুশ্চিন্তা, রাগ সব কিছু ধুলার সাথে মিশে গেছে। মনের মধ্য আলাদা একটা শান্তি বিরাজ করবে। নিজেকে প্রবিত্র লাগবে। মনের সব দোটানা দূর হবে। তোমার জীবনের সমস্ত জটিলতার জট আস্তে আস্তে খুলে যাবে। মনটাকে হালকা লাগবে। তোমার জন্য আজ আমার অনেক দেরি হয়ে গেলো।(বলে ও নামাজ পড়তে মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো)
আমিও উঠে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নামাজ পড়ে নিলাম। কতদিন পরে নামাজ পরলাম নিজেও জানি না। মেঘ ছোট বেলা থেকে যত দুষ্টুই হোক না কেন পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। আর ছোট বেলায় আমাকেও পড়াতো। ও চলে যাবার পর কেউ আমায় নামাজ পড়ার কথা বলতো না তাই আমিও পড়তাম না। সত্যি নামাজ পড়ে মনটা অনেক হালকা লাগছে। ভেবেছিলাম নামাজ পড়ে আবার ঘুমাবো কিন্তু এখন আর ঘুমাতে ইচ্ছা করছে না। বেশ ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছে। তাই রুম থেকে বেরিয়ে বাইরে এলাম। বাইরে আসার পর মায়ের কোরান তেলওয়াত শুনতে পাই। তাই আস্তে আস্তে মায়ের রুমের দিকে গেলাম। দরজা খোলাই আছে। আংকেলও নামাজ পড়তে গেছে। আমি আস্তে করে মায়ের পাশে গিয়ে বসে ওনার তেলওয়াত শুনতে লাগলাম। একটু পরে মায়ের তেলওয়াত শেষ হলো।
-কি রে এত সকালে উঠলি যে। তুইতো এতো সকালে উঠিস না।
-না মানে,,,,
-বুঝেছি। বলতে হবে না। তা নামাজ পড়েছিস?
-হুম। কাকিমা,,,,
-কি বললি?
-না মা। সরি ভুল হয়ে গেছে।
-হুম। আর যেন একবারো এই ভুল না হয়
-ঠিক আছে।
-কি বলছিলি যেন।
-বলছি আমায় একটু কোরান তেলওয়াত করা শিখিয়ে দিবে। আমি ভুলে গেছি। আসলে অনেক ছোট থাকতে পড়েছিতো তাই।
-আচ্ছা ঠিক আছে। তুই একটা কাজ করিস সকালে নামাজ পড়ে আমার রুমে চলে আসিস। আমি শিখিয়ে দিবো।
-ঠিক আছে।
তারপর আমি আর মা মিলে রান্নাঘরে গেলাম। মা অবশ্য আমায় রান্নাঘরে যেতে মানা করেছিলো কিন্তু আমি শুনিনি। আমি রান্না করতে জানিনা তাই মাকে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছি। মেঘ আর আংকেলও চলে এসেছেন। মেঘ এসে ড্রইং রুমের সোফায় বসলো। আর আংকেল রান্নাঘরে এলো।
-কি ব্যাপার মেঘের মা তুমি আমার মেয়েকে দিয়ে কাজ করাচ্ছো কেন?(আংকেল)
-না না আংকেল। মা আমায় কিছু করতে বলেনি। আমায়তো রান্নাঘরে আসতেই দিচ্ছিলো না। আমি নিজে থেকেই এসেছি।
-হুম বুঝলাম। কিন্তু তুমি আমার প্রতি এই অবিচারটা কেন করলে?
-অবিচার? আমি কি কোন ভুল করেছি আংকেল?
-ভুল নয় অন্যায় করেছো।(একটু গম্ভীর গলায়)
-কি অন্যায় করেছি। আমি বুঝতে পারছি না।
-ওকে মা বলে ডাকছো আর আমায় আংকেল। এটা অন্যায় না?
-ওহ্। সরি।
-হুম। আজ থেকে আমায় বাবা বলেই ডাকবে। তুই জানিস না মা সেই কবে থেকেই তোর মুখ থেকে বাবা ডাক শোনার ইচ্ছা আমার।(বলে উনিও সোফায় গিয়ে বসলেন)
চলবে,,,

#মেহজাবিন_নাশরাহ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে