এক শহর ভালোবাসা পর্ব-৪৬ এবং শেষ পর্ব

0
3810

#এক_শহর_ভালোবাসা
#সুরাইয়া_নাজিফা
#শেষ_পর্ব

“এই অবস্থায় তুমি এতো উপরে উঠেছো কেন স্টুপিড? ”

হঠাৎ এতো জোরে কারো চিৎকারের আওয়াজ শুনে আমি পিছু ফিরে তাকালাম শান দাঁড়িয়ে। কিন্তু নড়াচড়া না করে আমি একবার উনার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজ করতে লাগলাম আর পেরেক গেঁথে বললাম,

“এই ছবিটা লাগাবো তাই উঠেছি। ”
“এখান থেকে পড়লে কি হবে হ্যাভ ইউ এ্যানি আইডিয়া? ” শান রাগান্বিত কন্ঠে বললো।
“কিছু হবে না ছবিটা লাগানো হলেই নেমে যাবো। ”
“এখনি নামো তুমি। ”
“প্লিজ আপনি দুই মিনিট একটু চুপ করে দাঁড়ান আমার কাজটা হয়ে যাবে। ”
শান চিৎকার করে বললো,
“সোহা। ”

আমি উনার কথা পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলাম। ছবিটা লাগিয়ে একটা বিশ্বজয়ী হাসি দিলাম। এতক্ষনের কষ্টটা সফল হলো। তারপর পিছনে ফিরে দেখলাম শান লাল লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। এতক্ষন ভয় না পেলেও এখন ভয় লাগতে লাগল। আমি ভিত চোখে তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম। তারপর ধীরে ধীরে চেয়ার থেকে নামতে যাবো হঠাৎ আমার শাড়ীর সাথে পা ভেজে পা টা পিছলে যেতেই আমি ভয় পেয়ে নিজের চোখ বন্ধ করে নিলাম। আমার বুকের ভিতর ডিপডিপ শব্দটা দ্বিগুন হলো। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের পেঁটে হাত দিলাম। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো যাক আমার বেবী ঠিক আছে। আমি আস্তে আস্তে চোখ খুলে সামনে তাকালাম। শানের চোখ থেকে যেন আগুন ঝরছে। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলাম আমি শানের কোলে তাই ব্যাথা পাই নি আজ যদি শান না থাকত তাহলে কি হতো আমার?

শান আমাকে কোলে নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসিয়ে দিলো আমি মাথানিচু করে রইলাম। শান গম্ভীর কন্ঠে বললো,

“এখন কি হতে পারত জানো তুমি?এতো লাফালাফি করো করো কেন সবসময়?”
“স্যরি।”
শান রেগে বললো,
“কিসের স্যরি আজকে একটা অঘটন ঘটলে এই স্যরি নিয়ে আমি কি করতাম।কি প্রয়োজন ছিল ওখানে তোমার? ”
আমি মাথানিচু করে আমতা আমতা করে বললাম,
“আপনার ছবিটা লাগাতে গেছিলাম। পুরো ঘরেরই লাগিয়েছি শুধু ওখানেই বাকি ছিল তাই লাগিয়ে দিলাম। ”

শান একবার পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিলো। এতক্ষনে খেয়াল করল পুরো রুম জুড়ে শানের ছবি লাগানো। সোহাকে চেয়ারের উপরে দেখেই মাথাটা এতো গরম হয়ে গেছিলো যে সেটা খেয়ালই হয়নি। শান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“এসব কি করেছো?”

আমি শানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বললাম,
“মা বলেছে এই সময়ে চোখের সামনে যা দেখে বেবী দেখতেও তেমনই হয় তাই অনেক গুলো বেবীর ছবি দিয়ে গেছিল পরে এসে লাগিয়ে দেবে। কিন্তু আমি তো চাই আমাদের বেবী আপনার মতো হোক তাই আমি আমার পছন্দের ছবি লাগিয়েছি।যাতে ঘরের যেদিকেই তাকাই শুধু আপনাকেই দেখতে পাই আর একা একা বসে বোর হচ্ছিলাম তাই ভাবলাম নিজেই লাগিয়ে নেই। ”

শানের মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠল আমার কথা শুনে। তবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার পাশে বসল । তারপর দুই হাতে আমার মুখটা ধরে বললো,
“যাইহোক সুইটহার্ট এই সময়টা তোমার একটু সেইফলি থাকা উচিত। আমি চাই না তোমার একটু গাফিলতির জন্য তোমার কোনো ক্ষতি হোক। আমি তোমাকে হারাতে চাইনা জান। এখন তুমি আর বেবী ছাড়া আমার জীবনে আর কিছুই নেই তাই একটু লাফালাফিটা কম করো খুব ভয় হয় আমার তোমাকে নিয়ে প্লিজ অন্তত বেবীর জন্য।

আমি হেসে শানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম,
“একদম চিন্তা করবেন না আমার বা বেবীর কিছুই হবে না আমি সবসময় আপনার সাথেই থাকবো বুঝেছেন বাই এনি চান্স যদি কখনো মরেও যাই তাও পিছু ছাড়ব না খুশি এবার। ”

শান আমাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,
“সোহা এসব কি ফালতু কথা বলছো তুমি। কিছু হবে না তোমার। এইসব কথা আরেকবার বললে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। ”

আমি হেসে বললাম,
“ওকে কিছু হবে না আমি সারাজীবন আপনার সাথেই থাকব। আমি তো কথার কথা বলেছিলাম এতো হাইপার হচ্ছেন কেন? যাইহোক ওইদিকের কাজ হয়ে গেছে?”

“হুম বাকিটা বাড়ির সবাই সামলে নেবে এখন কথা না বলে একটু রেস্ট নেও।”

আমি শুয়ে পড়লাম শান আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ইশারায় বললো চোখ বন্ধ করতে। আমি চোখ বন্ধ করে একটু হাসলাম। আসলে বাড়ির সবাই আমার প্রেগন্যান্সির খবর শুনে এতটা খুশি হয়েছে যে আমার আর বেবীর সুস্থতার জন্য আজকে বাড়িতে অনেক গরীব দুঃখিকে খাওয়ানো হয়। আমার আম্মু তো আমার জন্য এতো এতো আচার নিজের হাতে বানিয়ে নিয়ে এসেছে।যেন বাহিরের কিছু না খাই। আব্বু এখনই বাবুর জন্য খেলনা কিনে নিয়ে এসেছে। আম্মু আমার কপালে চুমু দিয়ে বললো,
“আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না আমার সেই ছোট মেয়েটা এখন নিজে কারো মা হবে। ”

আমি প্রতিউত্তরে শুধু হাসলাম আর প্রচন্ড লজ্জা লাগছিল কেন জানি এই অবস্থায় বাবা মায়ের সামনে বসতেই পারছিলাম না । শ্বাশুড়ী মা তো বলেই দিয়েছেন উনার নাতি বা নাতনী যেই আসুক না কেন উনার হাতের তৈরী কাঁতা ছাড়া কিছু ব্যবহার করবে না। তাই এখন থেকেই উনি বাবুর জন্য কাঁতা সেলাই করা শুরু করেছেন।

ভূমিকা আপু বলেই ফেলেছেন,
“অবশেষে আমাদের অপেক্ষার অবশান শেষ হলো এখন আমাদের শানের ঘরেও ছোট্ট অতিথি আসতে চলেছে।”

এই একটা সংবাদে বাড়িতে যেন খুশির জোয়ার বইয়ে এনেছিল। আরশ ভাইয়া ছোট চাচ্চু হওয়ার খুশিতে এখনই বাবুর নাম সিলেক্ট করার কাজে লেগে পড়ল। সবার খুশি দেখে আমারও খুব ভালো লাগছিলো।আগে তো সবাই এমনিতেও চোখে চোখে রাখত আর এখন তো চোখের আড়ালই করে না। এক পা নিচে নামাতে দেয় না। মুখ ফুটে কিছু চাইতে না চাইতেই সেটা হাতের সামনেই পেয়ে যাই। শান তো আমাকে পুরো নিয়মকানুনের মাঝেই বেঁধে দিয়েছে দিনের চব্বিশ ঘন্টায় কি কি করব, কি খাবো, কি পরবো, কতটা ঘুমাবো এভরিথিং আর এসব উনি নিজেই পাশে থেকে অনুসরণ করায় হয় ভালোবেসে নাহলে ধমক দিয়ে আর আমাকে সেইসব কিছু মুখ বুঝে পালন করতে হয়। কিছুই বলতে পারিনা ওনার ভয়ে। এইভাবেই সবার ভালোবাসার ছায়ায় আমার জীবনের আরো ছয় মাস চলে গেল।


এই মাসেই আমার আট মাস হলো শরীরের ভিতরে বেশ পরিবর্তন হয়েছে। অনেক ভারী হয়ে গেছি। এখন আর চাইলেও আগের মতো লাফালাফি করতে পারিনা এখন হাঁটাচলাতেই প্রচুর কষ্ট হয়। পেঁটের আকারও বেড়ে গেছে অনেকটা।আস্তে আস্তে আমার ভিতরে আমার আর শানের প্রাণপাখি বেড়ে উঠছে। প্রতিটা মিনিট প্রতিটা সেকেন্ড তার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি আমি। শানও এই অনুভুতি অনুভব করতে কখনো ছাড়ে না।সারাদিন বাবুকে নিয়ে চিন্তা। বাবু আসলে কি করবে, কিভাবে মানুষ করবে সারাদিন শুধু এই গল্প।উনার এসব পাগলামি দেখে সারাদিন শুধু নিজের মনেই হাসতে থাকি আর উনার কথায় তাল মিলাতে থাকি।

আগের থেকে দেখতে মোটা হয়ে গেছি।এখন শরীর সবসময় খারাপ লাগে।খাওয়া দাওয়া তেমন একটা করতে পারিনা। খাবার সামনে আসলেই যেন ভিতর থেকে সব ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। সময়ে অসময়ে ঘুম আসে আবার অনেকগুলো রাত তো না ঘুমিয়েই কেঁটে যায়। আর ঐ রাত গুলোতে শানও আমার সাথে জেগে থাকে। আমার সাথে বসে বসে গল্প করে যতক্ষন আমি না ঘুমাই। উনাকে কারণ জিজ্ঞেস করলেই উনি সবসময় বলে,

“দেখো সুইটহার্ট যেই কষ্ট গুলো তুমি অনুভব করছো সেটা তো আমি পারবো না কিন্তু সেই কষ্ট গুলো যেটুকু লাঘব করা যায় বা ভাগ করা যায় সেটুকু আমি করতে চাই।কারণ ও শুধু তোমার একার না আমারও। আর এই সুখের অনুভুতি গুলো অনুভব করা থেকে আমি বঞ্চিত হতে চাই না। ”

আমি শুধু উনার দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবি আমাদের সন্তান একজন উপযুক্ত দায়িত্ববান বাবা পেতে চলেছে যে সবসময় ওকে আগলে রাখবে সব বিপদ থেকে।

দুপুরে গোসল করে আসার পর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা মুছছিলাম তখনই শান এসে বললো,
“মাথা মুছতে মুছতে তো পুরো শরীর ভিজিয়ে ফেলছো এখনও পর্যন্ত মাথা মুছাটা শিখলে না এমন করলে তো ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার সহ বাবুর এখন তো একটু কেয়ারফুল হও। ”

আমি মুখ ফুলালাম,
“প্রতিদিনই কেন আপনাকে এসব কথা বলতে হবে আমি জানি মাত্রই মুছতে শুরু করেছি তার মধ্যেই আপনি চিল্লাচিল্লি শুরু করছেন। ”

“প্রতিদিন বলেও তো তোমাকে ঠিক করতে পারছি না জানি না একসাথে দুটো বাচ্চাকে আমি কি করে সামলাবো। ”

আমি একটু হাসলাম। এইসব কথা এই চারমাসে শুনতে শুনতে এখন আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। উনার এতোটা ভালোবাসা রোজ পাচ্ছি সেটাই আমার কাছে অনেক।আমি উনার গলা জড়িয়ে উনার নাকের সাথে আমার নাক স্লাইড করে বললাম,
“ভালোবাসা দিয়ে। ”

শান হাসল। উনার রাগটা যত দ্রুত আসে তেমনিই দ্রুতই চলে যায় আমার ভালোবাসাময় পাগলামিতে। শান আমার চুল গুলো মুছে দিয়ে আমার জন্য খাবার নিতে গেল। এই খাবার নিয়েই রোজ শানের সাথে আমার একটা ঠান্ডা যুদ্ধ চলে যায় যেখানে অলওয়েজ শানেরই জয় হয়। শান আমার মুখোমুখি বসে আমার সামনে খাবার ধরল,

“হা করে। ”
আমি একটু নাক উঠিয়ে বললাম,
“পরে খেলে হয় না। ”
শান চোখ দেখিয়ে বললো
” একদম না এখনই খেতে হবে। ”

আমি হা করতেই শান যত্ন সহকারে আমার মুখে খাবার তুলে দিতে লাগল।আমি শানের দিকে তাকিয়ে আমাদের বিয়ের প্রথম দিকের কথা গুলো ভাবতে লাগলাম কি ছিলাম আর এখন কি হয়ে গেছি। মনে পড়তেই হাসি পেল শান আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“হাসছো কেন?”
আমি নিজের হাসি থামিয়ে চোখের ইশারায় বললাম “কিছু না। ”

শান আবারও খাবার মুখের কাছে আনতেই আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম,
“খাবো না। ”
“খেয়ে নেও নাহলে শরীর খারাপ লাগবে। ”
“বমি আসছে। ”
“আচ্ছা একটু পরে খেও। ”

আমি হতাশ হলাম উফ তারপরেও খাইয়েই ছাড়বে। হঠাৎ আমার মাথা একটা প্লান আসলো এই থেকে বাঁচার। আমি “ওয়াক ওয়াক” করতে লাগলাম। শান অস্থির হয়ে বললো,
“কি হয়েছে? ”
আমি নাক উঠিয়ে বললাম,
“প্রচুর বমি আসছে খাবো না আমি। ”
“সত্যিই। ”

আমি ইনোসেন্ট মুখ করে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালাম শান বললো,
“ওকে তুমি রেস্ট নেও আমি এসব রেখে আসছি। ”

শান চলে গেল আমি বিশ্বজয়ী একটা হাসি দিলাম। যাক আজকে বেঁচে গেলাম।

আমি বিছানায় পিছনে বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে বসলাম। হঠাৎ আমার মন চাইল আইসক্রিম খেতে যদিও জানি শান খেতে দিবে না তারপরেও।আমি পেঁটে হাত রেখে বললাম,
“উফ সোনা কেন যে এসব খাবার খেতে ইচ্ছা হয় তুই তো চিনিস না তোর বাবাকে এইসময়ে তো এসব একদমই খেতে দেবে না। ”

আমার মনটা খারাপ হলো তারপরও ভাবলাম একবার বলেই দেখি। শান নিচ থেকে আসতেই আমি চোখ ছোট ছোট করে শানের কাছে আবদার করে বললাম,
“শুনুন না আমার না আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করছে প্লিজ এনে দিন না। ”

আমার কথা শুনেই শান রেগে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভালো জিনিস খেতে চাও না। দেখলেই বমি আসে।আর যেসব জিনিস খেলে শরীর খারাপ করে সেসবই খাওয়ার জন্য হা করে থাকো। ”

আমি আহত কন্ঠে বললাম,
“প্লিজ কিছু হবে না খাবো আমি। ”
“একদম না চুপচাপ গুমিয়ে যাও বিকালে হাঁটতে যাবে। ”

আমার এতো রাগ হলো আমি শোয়ার জন্য বালিশ ঠিক করতে করতে শানকে শুনিয়ে বেবীকে বললাম,
“দেখেছিস তো তোর বাবা আমাকে একদমই তোর পছন্দের জিনিস গুলো খেতে দেয় না সবসময় এমন করবে।আমি তো কিছু বলতে পারছি না কবে যে তুই আসবি আর তোর বাবাকে ইচ্ছা মতো বকে দিবি সেই অপেক্ষাতেই আছি। ”

শান আমার পাশে বসে বললো,
“আমার প্রিন্সেস কখনোই তোমার কথা শুনবে না কারণ ও জানে ওর মা কতটা কেয়ারলেস ওর বাবা যা করছে সেটা ওদের ভালোর জন্যই। ”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
“মেয়েই হবে কে বলেছে আপনাকে?”
“আমি জানি। ”
“ছেলে হবে। ”
“মেয়ে। ”
“আমি বলছি ছেলে। ”
“ওকে বেবীকেই জিজ্ঞেস করে নেও। ”
“ও কি করে বলবে?”
“বলবে জিজ্ঞেস করো। ”

আমি পেঁটে হাত রেখে বললাম,
“সোনা বল তো তুই আমার প্রিন্স। ”

শান ভ্রু উচিয়ে বললো,
“কি বেবী কিছু বললো না তো। ”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
“ধ্যাত ও কি করে বলবে পাগল নাকি। ”
শান হেসে বললো,
“ওয়েট এবার আমাকে দেখো।”

শান পেঁটের কাছে এসে হাত বুলিয়ে বললো,
“প্রিন্সেস তোমার মাকে বলে দেও তো যে তুমি আমাদের প্রিন্সেস। ”

আমি হা করে ওনার কাজ গুলো দেখছিলাম কি করছেন উনি পাগল হলেন নাকি?কিন্তু আশ্চর্যের হলেও সত্যিই কথাটা বলতেই বেবী জোরে পেঁটে কিক করলো। আমি লাফিয়ে উঠে পেঁটে হাত রাখলাম। শান আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে দিল।
“দেখলে এবার। ”

আমি রেগে বললাম,
“ধ্যাত পিচ্চি বের হওয়ার আগেই বাবার দলে চলে গেছিস। যা থাক তোর বাবার সাথে। কথাই বলবো না আর তোর আর তোর বাবার সাথে। ”

কথাটা বলেই আমি চাঁদর মুড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষন পর শান আমার মাথার কাছে এসে বললো,
“সোহা উঠো। ”

আমি শুনেও না শুনার মতো থাকলাম। শান আবারও বললো,
“উঠো না সুইটহার্ট। ”

আমি তখনও উঠলাম না। সোহা উঠছে না দেখে শান ইচ্ছা করেই বললো,
“ওকে উঠো না তবে আইসক্রিমটা আমি একাই খাই। ”

আইসক্রিমের কথা শুনতেই আমি দ্রুত উঠে গেলাম আর উঠেই দেখলাম শানের হাতে আইসক্রিম বক্স। আমার চোখ চকচক করে উঠলো। আমি শানের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে এক চামচ মুখে দিতেই শান বললো,
“বেশী না অনলি চার চামচ। ”
“মাত্র।”
“হুম। ”

যদিও মন খারাপ হলো তারপরও একদম না খাওয়ার চেয়ে এই চার চামচই বা কম কিসে। এভাবেই শান শত নিয়মকানুনের মাঝেও একটু একটু করে আমার সব ইচ্ছা – আবদার গুলো পূরণ করে।


রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। শান যেন ঘুমায় তাই একটু শুয়ে ছিলাম উনার পাশে। আমার জন্য আজকাল উনিও ঘুৃমাতে পারেনা। কিন্তু শুতেই শরীরে অস্বস্থি অনুভব হচ্ছিল তাই উঠে বসলাম।বেবীও হয়েছে একটা পাজি দিনের বেলা ঘুমাবে আর রাতের বেলায় আমাকে একটু শান্তিতে থাকতেই দিবে না।

আমি বিছানা থেকে নেমে রুমের ভিতরেই হাঁটতে লাগলাম। বাহিরে খুব সুন্দর চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছে মন চাইছো এই টাইমটায় যদি বের হতে পারতাম। হঠাৎ রুমের নেভানো আলোটা জ্বলতেই আমি একটু পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম শান বসে আছে। আমি এগিয়ে এসে বিছানার একপাশে বসলাম,

“কি ব্যাপার উঠে গেলেন কেন?”
“তোমার শরীর কি বেশীই খারাপ লাগছে। ”
“না।”
“তাহলে উঠে গেলে যে? ”
“আপনি তো জানেনই রাতের বেলা আমার খুব হয় না এই কয়দিন তাই সমস্যা নেই আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। ”
শান আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে একটা চুমু দিলেন,
“তোমার খুব কষ্ট হয় না সুইটহার্ট। এতটা কষ্ট হবে জানলে আমি কখনো বেবীই নিতাম না। ”
উনার কথা শুনে আমি হাসলাম,
“কি বাচ্চাদের মতো কথা বলছেন বলুন তো এই কষ্টের মধ্যেও কত সুখ আছে জানেন আপনার কোনো অধিকার নেই আমাকে এই সুখ থেকে বঞ্চিত করার। ”

শান একদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন আর আমিও উনাকেই দেখতে লাগলাম। হঠাৎ আমি বলে উঠলাম,

“আচ্ছা শান বেবী আসার পর আপনার আমার প্রতি ভালেবাসা কমে যাবে না তো?”

শান আমার গলা জড়িয়ে বললো,
“না বরং ভালেবাসাটা আরো বাড়বে সুইটহার্ট। তুমি আমাকে এত বড় একটা গিফট দেবে বাবা হওয়ার সুখ দেবে তাহলে সেই তোমার প্রতিই আমার ভালোবাসা কি করে কমবে?”

আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। শান আবারও বললো,
“চলো আমার সাথে?”

আমি অবাক হয়ে বললাম,
“এতো রাতে কোথায় যাবো।”

শান নাক টেঁনে বললো,
“চলোই না দেখতে পাবে। ”

আমি আর কথা না বলে শানের সাথে চলে গেলাম। শান আর আমি আস্তে আস্তে বাড়ির সদর দরজা ঠেঁলে বেরিয়ে এলাম। কোনো গাড়ি ছাড়াই বেরিয়ে গেলাম গেইট থেকে। আমি শানের কর্মকান্ড দেখে একটু অবাক হলাম এতো রাতে বাহিরে নিয়ে এলো আমায়। আশেপাশে কোনো মানুষ নেই একদম জনমানবশূন্য ।পুরো শহর জুড়েই যেন আমরা। মাথার উপর থালার মতো চাঁদটা পুরো আকাশ জুড়ে আলো ছড়াচ্ছে। আর রাস্তায় সোডিয়াম লাইটের আলোয় দুইপাশের পথটাই আলোকিত হয়ে আছে। হালকা বাতাসে আমার চুল গুলো উড়ছে।কিছুটা গিয়ে আমি শানকে প্রশ্ন করলাম,
“এতো রাতে রাস্তায় কেন?”

শান আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভয় লাগছে?ভয় পেও না আমি আছি তো।”
“ভয় লাগছে না ভাবছি এই সময় এখানে নিয়ে এলেন?”
“কেন তোমার ইচ্ছা ছিল তো আমার কাঁধে মাথা রেখে এমন একটা জনমানবশূন্য রাস্তায় হাঁটার। কথা দিয়েছিলাম তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করব তাহলে এটা ভুলে যাই কি করে।

শানের কথা শুনেই আমার প্রায় পাঁচ বছর আগের সেই রাতের কথা মনে পড়ল যেদিন আমরা প্রথম একে অপরকে নিজেদের ভালোবাসার কথা বলেছিলাম।

“যখন শহরটা ঢেকে যাবে ভালোবাসায়
তোমায় প্রতিটা ছোঁয়ায় খুঁজে পাবো তোমায়
কোনো এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় নতুন করে আবারও প্রেমে পড়ব তোমার
ফাঁকা রাস্তায় সোডিয়াম আলোর হালকা আলোতে খালি পায়ে তোমার কাঁধে মাথা রেখে হারিয়ে যাবো তোমার সাথে
তখন শুধু তুমি তোমার ওষ্ঠদ্বয় দিয়ে আমার অধর ছুয়ে দিয়ে মিষ্টি করে বলো “ভালোবাসি”
তোমার শত ব্যাস্ততায় আমাদের ভালেবাসা যেন কখনো না হারায়
তুমি সবটা সময় শুধু দিবে আমায়
পুরো শহর জুড়ে ছেঁয়ে যাবে জনমানবশূন্যতায়
থাকবে না কেউ পিছু ডাকার, থাকবে না কেউ দূরে রাখার, থাকবে না কেউ আমাদের মাঝে আসার
রয়ে যাবো শুধু তুমি আর আমি
সেই শহরে লেনাদেনা হবে তোমার আর আমার
এক শহর ভালোবাসার।”

কথা গুলো মনে মনে আরো একবার আওড়ে নিতেই মুখে হাসি ফুঁটে উঠল। এতো বছরেও শান নিজের কথার এতটুকু খেলাপ করেনি। সবসময় অক্ষরে অক্ষরে আমাকে দেওয়া প্রতিটা কথা ভালোবাসা দিয়ে পূরণ করেছে। আমি নিজের পায়ের জুতোটা খুলে হাতে নিয়ে নিলাম শান বললো,
“আরে করছো কি জুতো খুলেছো কেন?”
“খালি পায়ে আপনার সাথে হাঁটবো বলে। আমি সেদিন বলার সময় এটাও তো বলেছিলাম।”
“ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার।”
“কিছু হবে না একদিনই তো। ”

শান আর কিছু বললো না উল্টো নিজেও নিজের পায়ের জুতোটা খুলে হাতে নিয়ে নিলো। আমি উনার দিকে তাকাতেই উনি আমার কপালে ঠোঁট ছুইয়ে একটু হাসল। আমি উনার কাঁধে মাথা রাখলাম উনি আমাকে একহাতে জড়িয়ে ধরলেন।আমরা দুজনেই হাঁটতে লাগলাম অজানা গন্তব্যে। কোথায় যাচ্ছি জানা নেই শুধু হারিয়ে যেতে চাই আজ একে অপরের সাথে কোনো এক ভালোবাসার শহরে আর বলতে চাই এক শহর ভালোবাসা দিতে চাই তোমায়।
.
.
সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে