এক টুকরো আলো পর্ব-১১+১২

0
206

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_১১
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

দু’দিন হলো হুরাইন ফিরেছে তাসিনের সাথে। সাজেদা থমথমে গলায় টুকটাক কথার জবাব দেন। তবে খোঁচাতে বেশি পছন্দ করেন। যেসব ওনার ধাতে নেই, তেমন ব্যবহারও আজকাল করে বসছেন। তাসিন ঘরে থাকার পরও এ কাজ ও কাজের বাহানায় ডেকে নিয়ে আসেন হুরাইনকে। নিশি নিজের মত সময় কাটায়। সেও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না।
তাসিন বাইরে থেকে এসে জামাকাপড় ছেড়ে নিলো। হাতে হাতে সবটা এগিয়ে দিচ্ছে হুরাইন। তাসিন জিজ্ঞেস করল, “খেয়েছো?”

“না।”

হুরাইনের জবাবে প্রশস্ত হাসলো সে। হুরাইনের নাক টিপে দিয়ে বলল,“খিদে পেলে অপেক্ষা করতে হবে না। খেয়ে নেবে।”

“আপনি তাড়াতাড়ি ফিরবেন। তাহলে আমারও আর আগ বাড়িয়ে খিদে পাবে না।”
নিচু স্বরে জবাব দিল হুরাইন। তাসিন বাধ্য স্বামীর মতো মাথা নাড়লো। দুজন একসাথে খেয়ে ঘরে আসতেই হুরাইনের দিকে একটা বাক্স এগিয়ে দিল। ভ্রু কুঁচকে বাক্সটি উল্টেপাল্টে দেখতেই তাসিন বলল,“খুলে দেখো পছন্দ হয়েছে কিনা? সবার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে।”

হুরাইন ফোন দেখে অবাক হলো। তার কোনো ফোন ছিল না। প্রয়োজনে মা বা ভাবির ফোন ব্যবহার করেছে। তাই ফোনের সেটিংস সম্পর্কে তার তেমন ধারণা নেই। বাক্স খুলে তাসিন সবকিছু ঠিক করে দিয়ে শুয়ে পড়লো। কপালের উপর এক হাত রেখে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাঝখানে এক হাত দূরত্ব। হুরাইন চোখ বন্ধ করলো না। তাকিয়ে রইলো তাসিনের মুখপানে। কিছু একটার অপেক্ষা করছে সে। অথচ তাসিন নির্বিকারভাবে শুয়ে আছে। হয়তো ঘুমিয়েও গিয়েছে। মন খারাপ করে রইল হুরাইন। ক্ষণ সময় পর তাসিন হেসে ফেলে বলল,“এভাবে চোখ দিয়ে গিলে না নিয়ে বুকে এলেই পারো। আমি জানি আমি খুব এ্যাটাকট্রিভ।”

হুরাইন নড়চড় করলো না। মুহূর্তেই চোখের পাতা বন্ধ করে নিলো। যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাসিন চোখ সরু করে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ এক টা*নে তাকে কাছে নিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে রগঢ় করে বলল,“সত্যি রাগ করেছো না-কি আদর-টাদর পাওয়ার বাহানা?”

লজ্জা পেয়ে স্বর উঁচু হয়ে গেল হুরাইনের। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ঝাড়ির সুরে বলল,“ধ্যাৎ, সরুন তো।”

তাসিনের চোখে চোখ পড়তেই থমকে গেল সে। চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ঢোক গিলল হুরাইন। স্বর একেবারে ক্ষীণ করে বলল,“স…

বাকিটুকু বলার পূর্বে পুরো ঘরটা যেন কেঁপে উঠলো। হুরাইনকে চমকে দিয়ে শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো তাসিন। হতভম্ব হয়ে গেল হুরাইন। সে ভেবেছিল উঁচু গলায় কথা বলায় তাসিন রেগে গিয়েছিল। আচানক তার চোখে পানি চলে এলো। এবার তাসিন নিজেই হতভম্ব হয়ে গেল। সে তো ধমক-টমক দেয়নি। চাপা উত্তেজনা নিয়ে বলল,“আমি কী করলাম?”

তাসিনের অফিস যাওয়া-আসা হচ্ছে। সকালে বের হওয়ার পূর্বে হুরাইনের ডাক পড়ে। তারপর একেবারে বেরিয়ে যাওয়ার আগে মাকে বলে তবেই বের হয়। সবটা মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করেছেন সাজেদা। যেহেতু হুরাইনকে তিনি পুত্রবধূ রূপে মানতে পারেননি, তাই মাথায় একটা কথা গেঁথে গিয়েছে। মাত্র কয়েকদিনেই ছেলে ওনার পর হয়ে গিয়েছে। আগে খাওয়া শেষ করে মাকে বলে তারপর বের হতো। এখন খাওয়া শেষ করে আগে বউকে ডাকে। একটুখানি ক্ষোভ জন্মালো মনে। হুরাইন তরকারি কা*টা*কু*টি করছে। সাজেদা পাশে দাঁড়িয়ে কাজের ছলে একথা- ওকথা বলে হুরাইনকে বুঝিয়ে দিচ্ছে বাড়ির বড়ো বউ হিসেবে বাপের বাড়ি থেকে ফার্নিচার এনে ঘর সাজানো, স্বামীকে গাড়ি উপহার দেওয়া স্ত্রীর কর্তব্য। হুরাইন সবটা বুঝেও চুপচাপ শুনে রইল। না বুঝার ভান করে শাশুড়ির সাথে কথা বাড়িয়ে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। দুই-তিন দিন যাবত এসব নিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে কথা শোনাচ্ছেন। সাজেদা যদিও লো*ভী নারী নন, তবুও হুরাইনকে এসব বলে অশান্তি দেওয়াই ওনার মূল উদ্দেশ্য।
যেহেতু হুরাইন কিছুই বুঝতে চেষ্টা করছে না, তাই সাজেদা আজ সরাসরি বললেন,“তুমি তো পরিবারের ছোটো মেয়ে। সবার আদরের। কই সেরকম কিছু তো নজরে পড়ছে না।”

সাজেদা কথা শেষ করে আড়চোখে হুরাইনকে দেখে নিচ্ছেন। মাথায় ভালোভাবে আঁচল টেনে কাজ করছে মেয়েটা। আশ্চর্য কাপড়টা যেন মাথা থেকে সরছেই না! এমন সোনার টুকরা বউ কে না চায়? ছেলের কারণেই বউকে তিনি মেনে নিতে পারছেন না। নিজের বাপের দিকের লোকজনের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। তাহলে এই মেয়েকে মেনে নেবেন কীভাবে?

হুরাইন মৃদু স্বরে বলল,“কী করলে বুঝা যাবে আমার বাবা-মা, পরিবার আমাকে ভালোবাসেন?”

সাজেদা তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,“মানুষ ছোটো মেয়েদের ভালোবেসে শশুর বাড়িতে টুকটাক জিনিসপত্র দেয়। জামাইকে গাড়িটাড়ি উপহার দেয়। এসব তো দূরের ব্যাপার আমার ছেলে বিয়েতেই কোনো সোনার জিনিস উপহার পেল না। একজন রিকশা চালকের মেয়ের জামাইও সোনা উপহার পায়। আর আমার ছেলেটা যেখানে নিজেই সোনার টুকরা।”

হুরাইন মৃদু হেসে জবাব দিল,“ঠিকই তো আম্মা। আপনার ছেলে নিজে যেখানে সোনার টুকরা, সেখানে সামান্য সোনা দেওয়া তাঁকে অপমান করার সমান নয় কি?”

সাজেদা তেতে উঠলেন। নিজের কথায় ফেঁসে গিয়ে বললেন,“না দেওয়ার জন্য এখন কতশত যুক্তি বের করবে। এসব আমার জানা আছে।”

হুরাইন কাজ না থামিয়ে বলল,“আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, রাসুল (সা:) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার প্রিয়জনকে আগুনের কড়া বা আংটি পরানো পছন্দ করে, সে যেন তাকে সোনার কড়া বা আংটি পড়ায়। (আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪৪০১, বাংলা মিশকাত হা/৪২০৫)

আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা:) এক লোকের হাতে সোনার একটি আংটি দেখলেন। তিনি তা খুলে নিয়ে নিক্ষেপ করলেন এবং বললেন, “তোমাদের কোন ব্যক্তি আগুনের টুকরো হাতে রাখতে চাইলে এই আংটি হাতে রাখতে পারে।” (মুসলিম, আলবানী, আদাবুয যুফাফ ২১৫ পৃষ্ঠা)।

সাজেদা থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন। ঘন্টা না পেরোতেই আবারও অন্যান্য উপহারের জন্য বলতে লাগলেন।
হুরাইন বলল,“আম্মা আপনারা কি যৌতুক নিতে চান? তাহলে আমি আব্বুকে বলবো যৌতুক পাঠাতে।”

খ্যাঁক করে সাজেদা জবাব দিলেন।
“যৌতুক চেয়েছি আমরা? আমাদের এত নিচু মানসিকতা নেই। উপহার আর যৌতুক কি এক হলো?”

হুরাইন চুপ করে রইল। এই মুহূর্তে সে যতই বুঝাতে যাক না কেন, হিতে বিপরীত হবে। সাজেদা ভেবে বসবেন সে তর্ক করছে। বিকেলে আবারও ইনিয়েবিনিয়ে এসব কথা তুলতেই হুরাইন নিজের ফোন নিয়ে শাশুড়ির পাশে বসলো। বলল,“আম্মা আপনার চুলে তেল দিয়ে দিই, আসুন।”

“লাগবে না তোমার তেল দেওয়া।”

হুরাইন বারণ শুনলো না। সাজেদা স্বেচ্ছায় তেল দিতে দেবেন না সে বুঝে গিয়েছে। তাই জোর করে তেল নিয়ে সাজেদার পেছনে বসলো। এদিকে ইউটিউবে ঢুকে ওয়াজ চালিয়ে দিয়েছে। ওয়াজের মূল বিষয়বস্তু যৌতুক। কীভাবে আধুনিকভাবে টেকনিক করে মানুষ যৌতুক আদায় করছে। আর নাম দিচ্ছে উপহার। এর ভয়াবহতা সম্পর্কেও বলা হচ্ছে। সাজেদার শরীর দিয়ে আগুন ঝরছে। এই মেয়ে তো বড্ডো ধড়িবাজ। কী সুন্দর ওয়াজ চালিয়ে তাকে জবাব দিচ্ছে। তিনি শক্ত হয়ে বসে রইলেন। মুখ ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। পেছনে বসে ঠোঁট টিপে হেসে চলেছে হুরাইন। তারও তর্ক করা হলো না। এদিকে শাশুড়িও বুঝে গেলেন। ব্যাপারটা “সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না।” টাইপ হয়ে গেল।
তেল দেওয়া শেষ করে ঘরে এসে নিজের কাজে নিজেই কিছুক্ষণ প্রাণ খুলে হেসে নিলো হুরাইন। পুরো ওয়াজ শেষ করে তবেই উঠেছে সে৷ সাজেদা একটু কথাও আর মুখ দিয়ে বের করেননি। শক্ত হয়ে একইভাবে বসেছিলেন।

★★★

তীব্র যন্ত্রণায় দিন কাটছে ফাবিহার। বাড়ি এলে তাসিনের কথা মনে পড়ে আর ক্যাম্পাসে গেলে শাবাবের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। আজ আর একদমই ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করছে না। সে শুয়ে রইলো। মা এসে ডাকাডাকি করে গেলেন। ফাবিহা জানিয়ে দিল সে আজ ক্লাসে যাবে না। এখন যেন ডাকাডাকি না করে। বাবার কথা মনে পড়লো তার। মানুষটা তার জন্য অধিক দুশ্চিন্তা করেন। তার সাথে সাথে তার বাবাকেও দৌড়ের উপর রাখছে শাবাব। বাবা কেমন অস্থির হয়ে পড়েন। বয়স হয়েছে। পূর্বের মতো শারিরীক আর মানসিক শক্তি কোনোটাই নেই। তাকে নিয়ে চিন্তা করে কালও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি এমনিতেই হার্ট রোগী। ফাবিহা সিদ্ধান্ত নিলো বাবাকে আর কিছু জানাবে না। সে শাবাবের সাথে সমঝোতায় এসে সবটা মিটমাট করার চিন্তাভাবনা করলো।

ফাবিহা দুদিন ক্লাসে গেল না। ফোন বেজে যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। শব্দ পেয়ে ঘরে এসে নম্বর দেখলো। অপরিচিত নম্বর দেখে প্রথমেই রিসিভ করলো না। মাথা খাটানোর চেষ্টা করলো এটা তাদের কারো নম্বর কিনা? তেমন কারো কথাই মনে পড়ছে না। ফাবিহা ফোন তুলে সালাম দিল। ওপাশ থেকে সালামের জবাব এলো না। ভেসে এলো ধমকের সুর।
“এ্যাই জানেমান ক্যাম্পাসে আসছো না কেন? আমার শশুর কি অক্কা পেয়েছে? তুমি শোক পালন করছো? আমি তো মেয়ের জামাই। আমাকে খবর দেওয়া তোমার উচিত ছিল।”

কথার ধরণ শুনে ফাবিহা বুঝে গেল এই ল*ম্প*ট শাবাব। তার বাবাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। মুখ দিয়ে আর সুশীল ভাষা বের হলো না। প্রচন্ড উগ্রকণ্ঠে বলল,“কু***** তোর বাপের কথা বলতে পারিস না? আমার বাবাকে নিয়ে আর যদি উল্টাপাল্টা কথা বলিস, তো এক কো*পে তোর মাথা আলাদা করে দেব। এরপর জে*লে যাবো। অ*স*ভ্য, অ*জা*তকু*জা*তের বংশধর।”

ফাবিহার শরীর কাঁপছে রাগে। তার চোখে পানি চিকচিক করছে। বাবা তার প্রাণ। আর সেই বাবাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র কথা সে সহ্য করবে না। এতবড়ো কথা তো নয়ই।
শাবাব বেহায়ার মত হো হো করে হেসে বলল,“এত রাগ? আগে বলো ক্যাম্পাসে আসছো না কেন? আমাকে ভ*য় পাচ্ছো?”

“তোকে ভয় পাওয়ার কী আছে? কেন নিজের অপকর্ম দিয়ে পরিবারকে গা*লি শোনাতে চাচ্ছিস? তোর লজ্জা-শরম নেই?”

শাবাব ধমকে উঠলো,“আহ্ জানেমান। তুই-তুকারি করবে না।”

“তুই যেটার যোগ্য তোকে সেটাই বলবো। তুই-তুকারি করলে কী করবি?”

“আজীবনের জন্য মুখটাই বন্ধ করে দেব জান।”
এবার শাবাবরের স্বর কঠিন শোনাল। যেন ফাবিহাকে সামনে পেলে এক্ষুনি টুঁটি চে*পে ধরে মে*রে ফেলতো। ফাবিহা ফোঁসফোঁস করে বলল,“তোর ওই নোং*রা মুখে আমাকে জান ডাকবি না।”

“আজীবন আমার মুখ থেকেই তোমায় জান শুনতে হবে জানেমান। কাল সোজা ভার্সিটি আসবে। নয়তো….

“নয়তো কী?”

“তোমার বাসায় চলে যাব। হাঙ্গামা করলে আশেপাশের মানুষ যখন কানাকানি করবে, তখন আমার শশুর-শাশুড়ি ঠিক থাকবেন কি-না সেটাই দেখার বিষয়। সেদিন একটু খানি দৌড়ঝাঁপ করেই শশুর আমার হাঁপিয়ে গিয়েছেন। ভেবে দেখো তুমি কী করবে?”

ফাবিহা অতিষ্ঠ হয়ে বলল,“কী চাও তুমি? কেন আমার আর আমার পরিবারের সাথে এমন করছো?”

“এসব করবো না আমি। তোমার বাবা-মা শান্তিতে থাকবে। একটা শর্ত আছে।”

ফাবিহা হার মানার ভঙ্গিতে বলল,“কী শর্ত?”

“আমি যতদিন চাইবো, ঠিক ততদিন তুমি আমার সাথে প্রেম করবে। আমার ইন্টারেস্ট হারিয়ে গেলেই তোমার মুক্তি মিলবে।”

আতঙ্কে মৃদু চিৎকার দিল ফাবিহা।
“অসম্ভব।”

শাবাব হেসে বলল,“তাহলে এসব চলতে থাকবে সবসময়। জেনে খুশি হবে যে, আমি তোমার বিয়েও হতে দেব না আর নিজেও তোমায় বিয়ে করবো না। যতবার পাত্রপক্ষ আসবে, ততবারই তারা জানবে তুমি আমার বউ।”

ফাবিহা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“তোমার মত কুলা**ঙ্গার জন্ম দিয়ে তোমার মা কতটা আফসোস করছেন সেটা দেখার খুব ইচ্ছে আমার।”

“তাহলে বের হও। আমি আসছি তোমাকে নিতে। তোমার ইচ্ছেও পূরণ হবে সাথে শশুর বাড়িও ঘুরে দেখবে।”

ফাবিহা অতিষ্ঠ হয়ে বলল,“আল্লাহ তোর বিচার করুক। তুই ম*র*তে পারিস না শয়*তান?”

“শয়তান ম*র*লে তোমার মত ভালো মানুষদের কাতুকুতু দিবে কে?”

এবার কল কেটে বিছানায় ফোন ছুঁড়ে মা*র*লো ফাবিহা। নিজের চুল নিজের ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।
শাবাব ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটে স্পষ্ট হাসির রেশ। ভীষণ কষ্টে হাসি কন্ট্রোল করছে সে।

#চলবে…..

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_১২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

ঘন অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া শহরে মিঠে আলোর ছোঁয়া। রাত্রি বোধ করা যায় বারো এর ঘর পেরেয়েছে। এখনো জেগে আছে দুজন মানুষ। কলিংবেলের শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছতেই ত্রস্ত পায়ে ছুটে গেলেন মধ্যবয়সী নারী সুরাইয়া। পেছন ফিরলে হয়তো স্বামীর রোষপূর্ণ দৃষ্টি দেখতে পেতেন। সুরাইয়া দরজা খুলে দিতেই কাঙ্ক্ষিত চেহারা ভেসে উঠলো। চিন্তামুক্ত হলেন তিনি। শাবাব মায়ের সাথে হেসে কথা বলে ভেতরে ঢুকতে গিয়েও ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল বাবাকে দেখে। সুরাইয়া ছেলেকে ঠেলে বললেন,“হাতমুখ ধুয়ে আয়। খাবার দিচ্ছি।”

ফিরোজ আলমের চোখের চাহনি কঠিন। দরাজ গলায় বললেন,“বাড়ি না ফিরলেই হতো। এতরাত পর্যন্ত যেখানে কাটিয়েছিস সেখানেই বাকি রাত পার করে দিতে পারতি।”

সুরাইয়া বিরক্তমাখা গলায় বললেন,“আহা! এমন করছো কেন? ছেলেটা মাত্র বাইরে থেকে এসেছে।”

“বাইরে থেকে এসেছো তো কী হয়েছে? কাজ করে তো আসেনি। আনন্দ ফূর্তি করে এসেছে। বসে বসে আমার অন্ন ধ্বংস করা ছাড়া আর তো কোনো কাজ নেই।”

শাবাব বাবার কটাক্ষ স্বরের বিপরীতে তীব্র প্রতিবাদ জানালো। দমে না গিয়ে বলল,“খাবো না তোমার খাবার। বারবার এসব খোঁটা ভালোলাগে না।”

মেজাজ চড়ে ছিল ছেলের উপর। এবার আরেকটু ক্ষেপে গেলেন ফিরোজ আলম। বললেন,
“কতবার আর একই কথা বলবি? না নিজে চাকরিবাকরি কিছু করছিস আর না আমার সাথে থেকে ব্যাবসার হিসাব বুঝে নিচ্ছিস। আমি তো এখনই সব ঘাড়ে নিতে বলিনি। যতদিন আমি বেঁচে আছি তোর চিন্তা করার দরকার নেই। কিন্তু সবটা বুঝে তো নিবি। সেটাও করছিস না। তাছাড়া চাকরির কথা বলছিই বা কেন? রেজাল্টের নমুনা দেখলে কেউই চাকরি দেবে না।”

নাক উঁচু শাবাবের অহংকার যেন মুহূর্তেই ঝনঝন করে ভেঙে চূর্ণ হলো। নিজের অপমান সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। আর রেজাল্ট, পড়াশোনা দিয়ে কী হবে? কতজন পড়াশোনা করে কিছু করতে পেরেছে? ৯০ শতাংশ মানুষই শিক্ষিত বেকার। তার বাবার টাকা থাকতে সে কেন শুধু শুধু মেধা খাটাতে যাবে? বাবাকে শুনিয়ে দিল কিছু কথা।
“পড়াশোনা, ভালো রেজাল্ট দিয়ে কতজন তোমার মতো টাকা কামিয়েছে? ছোটোবেলায় আমার বাবা স্কুল চু*রি করেছে। আমি সাধু-সন্ন্যাসী হবো এটা ভাবাও আমার বাবার নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ।”

বাবার ছোটোবেলার কথা মনে করিয়ে দিতে পেরে শাবাব মনে মনে নিজেকে বীর ঘোষণা করলো। ভেবেছিল বাবাকে বুঝি টেক্কা দিতে পেরেছে! ফিরোজ আলম বললেন,“আমি স্কুল পলাতক ছাত্র হয়ে যা করেছি, তুই শুধু এর এক তৃতীয়াংশ করে দেখা।”

শাবাব বলল,“যার বাপের এতকিছু আছে তার আবার কিছু করার কী দরকার? মা ভাত দাও।”

ফিরোজ আলম চরম হতাশ এই ছেলেকে নিয়ে। সাথে আশ্চর্য সুরে বললেন,“একটু আগে না বললি আমার খাবার খাবি না? এখন খাবার দিতে বলছিস কোন মুখে?”

শাবাবের স্বাভাবিক জবাব।
“আমি তো তোমার খাবার খাবো না বলেছি। মাকে তো আমার খাবার দিতে বলেছি।”

সুরাইয়া চোখ রাঙিয়ে বলল,“শাবাব, চুপচাপ হাতমুখ ধুয়ে আয়। বাবার সাথে এভাবে ত*র্ক করা ভালো না।”

শাবাব এবার চুপ করে চলে গেল নিজের ঘরে। ফিরোজ আলম স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,“আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল তোমার কথায় ছেলেকে প্রশ্রয় দেওয়া। বিয়ের এক যুগ পর জন্ম নেওয়া সন্তান তার মাঝে একমাত্র সনৃতান বলে ওকে অতিরিক্ত মাথায় তুলে ফেলেছি। এখন না পারছি মাথা থেকে সোজা পথে নামাতে আর না পারছি একেবারে আঁচড়ে ফেলতে।
এক সন্তান হিসেবে ওর প্রতি অতিরিক্ত আবেগি হয়ে শাসনের কথাই ভুলে গিয়েছি। সন্তানের আদরের পাশাপাশি শাসনও প্রয়োজন।
তুমি ওর অন্যায় আবদার গুলোকেও প্রশ্রয় দিয়েছো।”

সুরাইয়া বললেন,“আমার অনেক সাধনার ছেলে। তাছাড়া ছেলেমানুষ, এখন এসব আড্ডাবাজি করবেই। বিয়ের পর দায়িত্ব কাঁধে এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“তুমি এখনো প্রশ্রয় দিচ্ছো। যে ছেলে ২৭ বছরেও ঠিক হতে পারলো না, সে বিয়ে করেই ঠিক হয়ে যাবে? দায়িত্ব কাঁধে নেবে বলছো? বরং আমাদের মাথায় ঝামেলা তুলে দিয়ে সে নির্বিকার ঘুরেফিরে বেড়াবে। স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবে না, ইচ্ছে মতো সব করবে। তখন ঝামেলা ওর ঘাড়ে নয়, আমাদের ঘাড়ে আসবে। তাছাড়া এই বাউন্ডুলে ছেলের হাতে কে মেয়ে দেবে? দিনদিন হচ্ছে একটা অ*স*ভ্য।”

শাবাব বাবার কথা কিছুটা শুনেছে। বিয়ের কথা শুনতে পেয়ে সে চেয়ার টেনে বসে বলল,“ভালো কথা মনে করেছো। আমাকে বিয়ে করিয়ে দাও।”

“তোকে ঘর থেকে বের করবো আমি।”

সুরাইয়া গদগদ কন্ঠে বললেন,“আব্বা মেয়ে পছন্দ হয়েছে? ঠিকানা দে। আমরা গিয়ে সব পাকা করে আসি।”

শাবাব মুখের খাবার গিলে পানি পান করলো। তারপর ধীর গলায় বলল,“মেয়ে রাজি না। মেয়ের বাপও রাজি না। শুধু আমি রাজি।”

ফিরোজ আলমের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। এক্ষুনি হামলে পড়ে ঠা*স*ঠা*স করে গালে দুটো দিয়ে বসবেন। ফোঁসফোঁস করে উঠছেন তিনি। শাবাব বলল,“বাবা এমন অজগর সাপের মত ফোঁসফোঁস করছো কেন?”

এবার আর গালটা নিরাপদ রইলো না। পরপর কয়েকটা চ*ড় পড়ে তব্দা খেয়ে গেল শাবাব। বাবা-মা কোনোদিন তার গায়ে হাত তোলেনি। আজ প্রথম বাবা তাকে মে*রে*ছে। খাবার ছেড়ে উঠে গেল সে। সুরাইয়া ছেলেকে আটকানোর চেষ্টা করলেন। না পেরে কান্নাকাটি করে ফিরোজ আলমকে দোষারোপ করলেন।
“তুমি আমার ছেলেকে কেন মে*রে*ছো? কে তোমার কানে বি*ষ ঢেলেছে? তুমি ওকে ইদানীং সহ্যই করতে পারো না।”

ফিরোজ আলম দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,“আমার তো এতদিনে চোখ খুলেছে। আফসোস আরো আগে কেন চোখ খুললো না?
তুমি এখনো অন্ধের মতো ছেলেকে তুলুতুলু করো। ভবিষ্যতে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাবে না। যে ছেলে এখন আদর দিয়ে বে*য়া*দ*ব বানাচ্ছো সেই তোমার আশাভঙ্গ করবে। যে ছেলেকে সামান্য চ*ড় দেওয়ায় তুমি কান্নাকাটি করছো, সেই ছেলের দেওয়া ব্যথাতেই তুমি একসময় কাঁদবে। ঠিকানা হবে বৃদ্ধাশ্রম। আমার জীবনে আফসোস থেকে যাবে। না পারলাম ছেলেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে আর না পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। তোমার পাশাপাশি সমান দোষী আমিও। আমার চোখ খুলে গেছে। দয়া করে নিজের চোখ দুটো খুলে আশেপাশে তাকাও।”

সুরাইয়া স্বামীর কথায় পাত্তা দিলেন না। মুখ ঝামটি দিয়ে ঘরে চলে গেলেন। খাবারদাবার ওভাবেই পড়ে রইল টেবিলে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফিরোজ আলম খাবার সব গুছিয়ে রাখলেন। সুরাইয়ার প্যাঁচ কম। যা তিনি বুঝেছেন, সেটাই সই। অন্যকেউ হাজার ব্যাখা করে ভালোমন্দ বুঝালেও বুঝেন না তিনি। সংসার আলাদা হওয়ার পর ফিরোজ আলম আশঙ্কায় থাকতেন। সুরাইয়া সবটা গুছিয়ে নিতে পারবেন কিনা! দেখা গেল একটা জিনিস ঘরে নিজেদের আজ প্রয়োজন। কেউ এসে চেয়ে বসলে কোনোকিছু না ভেবে তাঁকে ওই জিনিসটা দিয়ে দেন।
ঘুমাতে গিয়েও শান্তিতে দুচোখের পাতা এক করতে পারলেন না তিনি। সুরাইয়া ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদেই যাচ্ছেন। এখন কিছু বললে এই কান্না ফজরের পরও থামবে না। পুরোটা রাত এভাবেই কাটবে। কানে বালিশ চাপা দিয়ে পড়ে রইলেন।

শাবাব পরদিন সকালে উঠে নাস্তা না করেই বেরিয়ে গেল।
আজ আর অপেক্ষা করতে হলো না। পথেই মুখোমুখি হলো ফাবিহার।

★★★

বন্ধুদের আড্ডায় বসলো তাসিন। কত কত ছেলে বন্ধু মেয়ে বন্ধু। পূর্ব থেকে এমনভাবে মিশেছে যে এখন চাইলেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। যতটুকু পারা যায় হুঁ, হা উত্তর দিচ্ছে সে। একজন বলল,“তাসিন কি কোনো কারণে রেগে আছো? দেখছি আমাদের সাথে কথা বলছো না।”

“না, তেমনটা নয়।”

অপরজন বলল,“আমার মনে হচ্ছে রেগে নেই। সুন্দরী বউ পেয়ে আমাদের এড়িয়ে চলতে চাইছে।”

তাসিন বলল,“তোমরা ভুল বুঝো না। আসলে আমাদের এভাবে চলাফেরা উচিত না।”

কয়েকজন মুখ টিপে হাসলো। কয়েকজন সরাসরি হেসে বিদ্রুপ করে বলল,“হুজুরনি বিয়ে করে তুইও দেখছি হুজুর হয়ে গিয়েছিস। চিল ভাই। আমরা সবাই ভাই-বোনের মতো। আমাদের কারো প্রতি কারো ওইরকম কোনো আকর্ষণ নেই। তাহলে কেন অযথা চিন্তা করছিস?”

তাসিন জানে এই যুক্তি সম্পূর্ণ দুর্বল। তবুও তার মন বারবার বন্ধুদের কথায় সায় দিতে চাইছে।
কতটা দুর্ভাগা মনুষ্য জাতি আমরা।
আমরা জানি যা করছি পা*প করছি। তবুও আমাদের মস্তিষ্ক খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে নিজের পা*প*কেও পুণ্য প্রমাণ করছে। নিজেকে বুঝিয়ে থাকি আমার অন্তর তো পরিষ্কার। আমার তো ইমান ঠিক আছে।
অথচ আমরা টেরই পাই না অন্তর কতটা অসুস্থ, ময়লা হয়ে গিয়েছে আমাদের। জানি কিন্তু মানি না।
তাসিনও তার ব্যতিক্রম নয়। চাইলে মুহূর্তের মাঝেই নিজেকে পরিবর্তন করা যায় না। জেনারেলে পড়ুয়া, আধুনিক সভ্যতার সাথে তাল মিলিয়ে চলা মানুষের হিদায়াত প্রাপ্ত হওয়া খুব সহজ কথা নয়। তাসিন বন্ধুদের আড্ডায় মজে গেল। ভুলে গেল স্ত্রীকে দেওয়া কথা।
সকলের সাথে হাসিঠাট্টায় হারিয়ে গেল।

রাতে বাড়ি ফিরে হুরাইনকে দেখতে না পেয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। দরজার কাছে যেতেই গুণগুণ শব্দে মধুর কন্ঠস্বরে কিছু শুনতে পেল। সামনে এগিয়ে যেতেই আরও স্পষ্ট হলো কুরআন তেলাওয়াতের মধুর কণ্ঠ। তাসিনের চোখ কান, দুটোই জুড়িয়ে গেল। হুরাইনের চেহারার দিকে তাকিয়ে থমকে গেল সে। মনে পড়ে গেল সেই বন্ধুদের আড্ডার কথা। অনুশোচনা হচ্ছে। তবে এমন এক পর্যায়ে সে ঝুলে আছে, যেখান থেকে মুক্তি পাওয়া দুষ্কর।

#চলবে…….

রি-চেইক করা হয়নি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে