এক টুকরো আলো পর্ব-১৩+১৪

0
203

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_১৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

আজ মন ভালো আছে ফাবিহার। তবে এই ভালো বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। শাবাব নামক যুবকটি ফাবিহার জীবনের অ*শা*ন্তি ডেকে আনতে যথেষ্ট। যেমন এখন পথিমধ্যে তাকে আটকে রেখে ফুরফুরে মেজাজের কুলখানি বানিয়ে দিয়েছে। রোজকার মতো পরিপাটি হয়ে বেশ ভাব নিয়ে সামনে দাঁড়ালো শাবাব। ফাবিহার শক্ত মুখে তাকিয়ে সুখ মিশ্রিত হাসি টা*ন*লো ঠোঁটে। কৌতুক গলাতেও গভীরতা। কেমন টা*না সুরে বলল,“জানেমান।”

ফাবিহা চোখ বুজে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করলো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ঠান্ডা মাথায় বলল,“তুমি তো আমায় ভালোবাসেো না, এটা তোমার আচরণে স্পষ্ট। তাহলে আমাকে এভাবে হে*ন*স্তা করার কারণটা কী? আমি সত্যিই বিরক্ত।”

শাবাব খুব মনোযোগ দিয়ে ফাবিহার কথা বলার ভঙ্গিমা পরোখ করলো। যেমনটা একজন প্রেমিক করে থাকে। প্রেমিকার হাসি থেকে কথা বলার স্টাইলটুকু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা। শাবাবের জবাব না পেয়ে তার গতিবিধি ফাবিহাও লক্ষ করলো। এমন হ্যাংলামো দেখে একটু জোর গলায় বলল,“স্পষ্ট করে বলো কেন এসব করছো? তোমার চাওয়া কী?”

শাবাব এবার আর রসিকতায় গেল না। কথা বলতে গিয়ে অপমানে তার গালের হাঁড় শক্ত হয়ে এলো। দৃষ্টি ভীষণ ধারালো।
“তুমি আমায় রিজেক্ট করেছো। এবার আমি তোমাকে রিজেক্ট করবো। এটাই আমার চাওয়া।”

ফাবিহার খুব হাসি পেল। তাচ্ছিল্যের হাসি। সে নিজেকে দমিয়ে না রেখে হেসেও ফেললো। বলল,“তোমার পেছনে ঘুরতে যাচ্ছে কে? তুমি আমায় রিজেক্ট করবে? আমি তো তোমায় আগেই রিজেক্ট করে দিয়েছি।”

শাবাবের রাগ যেন আরও উত্তপ্ত হলো। ক্রোধের আগুনে হিসহিসিয়ে বলল,“আমায় রিজেক্ট করার একটা কারণ দেখাও। হ্যান্ডসাম, অর্থ কোনদিক থেকে আমি অযোগ্য?”

ফাবিহা এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে আফসোসের সুর তুললো। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল শাবাবের যোগ্যতার ঘাটতি। বলল,“তুমি একটা চ*রি*ত্র*হী*ন। এখানটায় তুমি অযোগ্য। তুমি বাপের পয়সায় চলো, এখানটায় তুমি অযোগ্য। তুমি মানুষকে সম্মান দিতে জানো না, এখানটায় তুমি অযোগ্য।
কতটা প্রেম করতে পারলে সেটাকেই যোগ্যতা ভেবে তুমি যে অহং*কার দেখাচ্ছো? সেটা কোনো যোগ্যতা নয়। এটা তোমার চ*রি*ত্রে*র দোষ। মেয়ে*বাজ তুমি।
আর সবার আগে মানুষ হও। তুমি একটা অ*মা*নু*ষ। অন্তত ছোটো বাচ্চা থেকে বৃদ্ধকে পর্যন্ত তার প্রাপ্য সম্মান দিতে শেখো। তারপর নিজের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।”

সবকিছু ছাপিয়ে চ*রি*ত্র*হী*ন শব্দটা তীরের মতো আ*ঘা*ত করলো শাবাবকে। চোখের সাদা অংশ লাল হয়ে গেল রাগে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“এতদিন আমি মজা করলেও এবার আমি সিরিয়াসলি বলছি। আমি যদি চ*রি*ত্র*হী*ন হয়ে থাকি, তাহলে এই চরিত্র**হীনকেই তোমার বিয়ে করতে হবে। প্রয়োজনে আমাকে যা যা করতে হয় করবো।”

ফাবিহা যেন মজা পেল। রঙ্গ করে হাসলেও তার কথা ঠান্ডা মাথায় নিশানা বরাবর তীর ছোড়ার মতো। বলল,“শয্যাসঙ্গী দরকার তোমার। তুমি কতোটা কা*মু*ক, চ*রি*ত্র*হী*ন তা আবার প্রমাণ করে দিলে। সমাজের ভয়েই কি বৈধতা অবলম্বন করতে চাইছো? তোমার তো এতটুকু আত্মসম্মান, ইজ্জত নেই। চাইলেই রাতের আঁধারে অন্ধকার গলিতে যেতে পারো। তোমারও খায়েশ মিটবে আর তোমার ললিতাদেরও ইনকাম হবে।”

নিজের চরিত্রের এতবড়ো দোষ হজম হলো না শাবাবের। সে একটা অভদ্র, অসভ্য ছেলে, গার্লফ্রেন্ড চেঞ্জ করা তার অভ্যাস হলেও সে কখনো অন্ধকার গলিতে যাওয়া কিংবা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ফূর্তি করার কথা ভাবেনি। আজ চরমভাবে অপমানিত হলো ফাবিহার কাছে। বরাবরই সে একরোখা, বেপরোয়া ছেলে। এই অসম্মান সে ভুলবে না। ফাবিহাকে অবশ্যই তার স্পর্ধার সমান বড়ো মাসুল দিতে হবে। টকটকে চোখ স্থির থাকলেও স্থির থাকেনি হাত দুটো। সোজা ফাবিহার টুঁটি চে*পে ধ*র*লো।
“আল্লাহর কসম আমি তোর জীবন জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়বো।”

দম বন্ধ হয়ে চোখ দুটো কোটর ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। দু’হাতে গলা থেকে শাবাবের হাত সরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো ফাবিহা। যখন তার শরীরটা নেতিয়ে পড়তে চাইলো তখন শাবাব নিজ থেকেই ছেড়ে দিল। ফাবিহা ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। এক্ষুনি তার ম*র*ণ হতে পারতো। আঙ্গুল তুলে তাকে আরো একবার শাসিয়ে নিলো শাবাব।
“প্রস্তুত থাকবি।”

ফাবিহা আপাতত জান শ্বাস নিতে ব্যস্ত। শাবাব তাকে পথে রেখেই চলে গেল। আজ আর শরীর কুলাতে চাইলো না। শরীরে খানিকটা ভয় ঢুকেছে। থরথর করে কাঁপছে হাত-পা। তার সাথে প্রতিযোগিতা করে লাফিয়ে চলেছে হৃৎপিণ্ড। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। হেনস্তা হতে হতে অতিষ্ঠ হয়ে মনের সম্পূর্ণ ক্ষোভ মিটিয়ে নিয়েছে সে। তার জায়গায় অন্যকোনো মেয়ে থাকলে নিশ্চয়ই এটাই করতো। বাড়ি ফিরে গেল ফাবিহা। আর কত চুপ করে বসে থাকবে? বাবাকে জানাবে না বলেও জানিয়ে দিল আজকের ঘটনা। সোজা বাবার হাত ধরে পৌঁছে গেল থানায়। সহ্যের সীমা আর কত হলে এসবের সমাপ্তি ঘটবে?

★★★

ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে আয়াত শেষ করে কুরআন বন্ধ করে তাকালো। তাসিনকে দেখে মিষ্টি করে হেসে সব গুছিয়ে উঠে পড়লো। হুরাইন সামনে গিয়ে দাঁড়ালেও আজ আর তাকে জড়িয়ে ধরলো না তাসিন। নিজের বিবেক তাকে বাঁধা দিচ্ছে। অবাক হলো হুরাইন। অন্যদিন জোর করে হলেও বাইরে থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরতো তাসিন। অথচ আজ সামনে পেয়েও নির্লিপ্ত। হয়তো শরীর অসুস্থ। নিচু স্বরে বলল,“আমি খাবার আনছি। আপনি হাতমুখ ধুয়ে নিন।”

তাসিন নিজের জড়তাকে গম্ভীরতার মাঝে গুলিয়ে ফেললো। গমগমে স্বরে বলল,“বন্ধুদের সাথে খেয়ে এসেছি।”

মুখ ভার করলো হুরাইন। ছোট্ট করে বলল,“আমি আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।”

“তুমি খেয়ে নাও।”

হুরাইন চুপচাপ এসে খেয়ে নিলো। মনে অনীহা থাকলেও পেটে ক্ষুধা। তাই কথা বাড়ালো না। খাওয়া শেষ করে তাসিনের পাশে শুয়ে পড়লো। অনেকক্ষণ নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে তাকে নিজের দিকে টে*নে নিলো তাসিন। চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,“এবার তোমার গল্প শুনবো। বলো আজ সারাদিন কী কী করলে?”

ছোট্ট এক টুকরো ভালোবাসায় হুরাইনের মন খারাপ উবে গেল। সে বেশ আগ্রহ নিয়ে তাসিনকে সারাদিনের গল্প শোনাচ্ছে। তাসিন আগ্রহ নিয়ে শুনছে কম, হুরাইনকে দেখছে বেশি। তার তুলনায় মেয়েটা নিতান্ত ছোটো। তবে মস্তিষ্ক পরিপক্ক। বুঝদার নারী হওয়ার চেষ্টা করে সবসময়। কথা বলতে বলতে এক সময় কন্ঠনালিতে অধরের উষ্ণ চুম্বন অনুভব করে শিউরে ওঠে হুরাইন। রাতের গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে গভীরতা বাড়লো ভালোবাসার।
রাতে যে অনুশোচনা ছিল তাসিনের মাঝে। ভোরের আলো ফোটার পরই হয়তো সে সব ভুলে বসেছে।

কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বের হলো নিশি। তার মুখে সাজসজ্জা। একটা থ্রিপিস পরনে। ওড়না গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে। হুরাইন মৃদু স্বরে বলল,“আপু এভাবে বের হওয়া ঠিক নয়।”

নিশি হুরাইনের কথায় বিশেষ মাথা ঘামালো না। স্বাভাবিক গলায় বলল,“আমি এভাবে চলতে অভ্যস্ত। আপনি যেমন আমার চলাফেরায় অভ্যস্ত নন, তেমনি আমিও আপনার মতো চলাফেরায় অভ্যস্ত নই ভাবি।”

“নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে ক্ষতি কী আপু?”

নিশি রাগান্বিত স্বরে বলল,“দেখুন, আপনি ভাইয়ার স্ত্রী। তার যেকোনো ব্যাপারে নাক গলাবেন তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। সেটা আপনাদের ব্যাপার। কিন্তু প্লিজ আমার ব্যাপারে নাক গলাতে আসবেন না। নিজের স্বাধীনতায় অন্যের হস্তক্ষেপ আমার পছন্দ নয়।”

হুরাইন কেবল একটা কথাই বলল,“নিজের মূল্য বুঝুন আপু। আপনি অমূল্য রত্ন।”

নিশি বিরক্তিতে মুখ গুঁজে বেরিয়ে গেল।
তার গমনপথে চেয়ে তার হেদায়েত প্রার্থনা করলো হুরাইন।

#চলবে….

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_১৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

বিয়ের পর থেকে দুজনের কোথায়ও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। তাসিন আজ অফিস শেষে প্রস্তুতি নিয়েই বাসায় এলো। হুরাইনকে ঘরে না পেয়ে খুঁজে দেখলো। সে সাজেদার ঘরে বসে আছে। যদিও সাজেদা এখনো হুরাইনকে মেনে নেননি, তবুও সে নাছোড়বান্দার মত শাশুড়ির মন জয় করতে উঠেপড়ে লেগেছে। আগ বাড়িয়ে শাশুড়ির সব কাজ করে দিচ্ছে। বিকেলে অবসর সময়ে গল্প করার চেষ্টা করে। সাজেদার ঘরে এসে বসে থাকে। তাসিন মায়ের ঘরের দরজায় এসে হালকা কেশে নিজের উপস্থিতি জানান দিলো। সাজেদা আর হুরাইন ফিরে তাকাতেই সে ঘরে ঢুকে মায়ের পাশে বসলো। হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো,“শরীর কেমন আছে মা?”

থমথমে গলায় জবাব এলো,“ভালো।”

হুরাইনকে চোখের ইশারায় বলল,“ঘরে যাও। আমি আসছি।”

হুরাইন যেন বুজেও বুঝলো না। না বুঝার ভান করে সেও ইশারায় শুধালো,“কী?”

তাসিন ফের বুঝালো,“ঘরে যাও।”

ইশারায় স্বামী-স্ত্রীর কথপোকথন সাজেদার চোখ এড়ালো না। প্রেমালাপ ধরে নিলেন তিনি। চোখ ঘুরিয়ে অপর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

হুরাইন ঘরে যাচ্ছে না দেখে সরু চোখে তাকালো তাসিন। হুরাইন মিটিমিটি হেসে বসে রইল। এবার শান্ত একটা দৃষ্টি দিলো তাসিন। যার অর্থ কাছে পেলে বুঝিয়ে দেব। হুরাইন ঢোক গিলে উঠে পড়লো। সাথে সাথেই কেটে পড়লো ঘর থেকে দুর্বোধ্য হাসলো। পরপর সাজেদা বেগমের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে বলল,“হুরাইনকে নিয়ে একটু বেরোবো মা। ফিরতে সন্ধ্যার পর হতে পারে।”

সাজেদার অভিব্যক্তি পরিবর্তন হয়ে গেল। কঠিন মুখে শুধালেন,“কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

“একটু ঘুরেফিরে চলে আসবো।”

কটাক্ষোর বান ছুঁড়ে দিলেন সাজেদা।
“হুজুর পরিবারের মেয়ে ঘুরতে যাওয়ার নাম মুখে নেয় কীভাবে?”

তাসিন শান্ত স্বরে বলল,“কে বলেছে তাদের ঘুরতে যেতে মানা? তাছাড়া সে তো পরপুরুষের সাথে যাচ্ছে না মা। আমি তার স্বামী।”

“তোরা নিজেরা নিজেদের মর্জির মালিক। আমাকে বলার কোনো দরকার আছে? যা ইচ্ছে কর।”

“রাগ করছো কেন মা?”

“আমার রাগে কি তোর কখনো এসে-যায়? বিয়ে যেহেতু নিজের মর্জিমাফিক করতে পেরেছিস, বাকিসবও নিজের মর্জিমাফিক করতে পারবি।”

“আমরা বের হবো একটু পর।” বলেই মায়ের ঘর থেকে বিদায় নিলো তাসিন। সাজেদা বেগম আরো ফুঁসে উঠেছেন। তিনি ভাবতে পারেননি তাসিন ওনার কথা অমান্য করে বের হবে স্ত্রীকে নিয়ে। রাগে ফোঁসফোঁস নিঃশ্বাস ফেলছেন।
তাসিন ঘরে ঢুকতেই হুরাইন সিটিয়ে গেল ভয়ে। একবার ধরা পড়লে আর রক্ষে নেই। তাসিন তার দিকে তাকিয়ে থেকে কদম ফেলে এগিয়ে আসছে। পিছিয়ে যাচ্ছে হুরাইন। তার চোখের চাহনি সুযোগ খুঁজছে পালাবার। এগিয়ে এসে খপ করে হুরাইনের হাত ধরে তাকে বুকের কাছে টে*নে নিয়ে দুষ্টু হাসলো। হুরাইন ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল,“আর করবো না।”

“করবে, আর আমি রোজ তোমায় শাস্তি দেব। আজকের শাস্তি রাতের জন্য তোলা রইলো।”
একটু থেমে হুরাইনের নাকে টোকা দিয়ে বলল,“তৈরি হও। আমরা আজ বের হবো।”

হুরাইন খুশি হলো ভীষণ। তবুও ইতস্তত করে বলল,“আম্মাকে জিজ্ঞেস করেছেন?”

তাসিন বলল,“তুমি আম্মার স্ত্রী নও। আমার স্ত্রী। তাই আমার অনুমতি তোমার জন্য যথেষ্ট। আমি আম্মার ছেলে। তাই আম্মাকে জবাবদিহি করার দায়িত্ব আমার। যাও তৈরি হও।”

হুরাইন ঝটপট বোরকায় আবৃত করে নিলো নিজেকে। নিকাব পরিধান করে মোজা হাতে নিলো। তার হাত থেকে মোজা দুটো টে*নে নিয়ে নিলো তাসিন। কোমল হাত ধরে খুব মনোযোগ দিয়ে মোজা পরিয়ে দিলো৷
ছোটো ছোটো যত্নেগুলো হৃদয় শীতল করে দেয় হুরাইনের। সে বিভোর হয়ে তাকিয়ে থাকে তার অর্ধাঙ্গের মুখপানে। তাসিন চমৎকার হেসে বলল,“এখন বের হবো। তাই এমন চাহনি দিয়ে লাভ নেই।”

হুরাইন লজ্জা পেয়ে মাথানিচু করে নিলো। সে তো কেবল মুগ্ধতা প্রকাশ করেছে। অথচ দুষ্ট পুরুষ কত কী ভেবে বসে আছে! হুরাইনের অবস্থা দেখে হেসে ফেললো তাসিন। হাত টে*নে বেরিয়ে গিয়ে মায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়ালো।
“মা আমরা আসছি।”

সাজেদা কথা বললেন না। চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন। হুরাইনও ছোট্ট করে বলল,“আসছি আম্মা।”
দুজন ঘুরাঘুরি করে একটা রেস্তোরাঁয় বসে খাবার খেয়ে নিলো। নিকাব খুললো না হুরাইন। নিকাবের নিচ দিয়েই খেয়ে নিলো। তাসিন তাকে যত দেখে, সে মুগ্ধ হয়। অথচ সে কিছুতেই দুনিয়াবি মায়া ত্যাগ করতে পারছে না। যতবার সে নিজের পরিবর্তনের কথা চিন্তা করে, ততবারই মস্তিষ্ক তাকে সব ভুলিয়ে দেয়। কোনো একটা অন্ধকারে হারিয়ে যায়। দুনিয়ার চাকচিক্য তাকে আলো দেখিয়ে চুম্বকের মতো টানে।
আগের ফোনে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। একটা নতুন ফোন কেনা জরুরি। হুরাইনকে নিয়ে আসায় অগত্যা তাকে সাথে নিয়েই ফোন কিনতে গেল। কয়েকটা জায়গায় ভীড় দেখে অন্য জায়গায় এসে ফোন দেখলো। হুরাইনকে ফোনের রং দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,“দেখো তো এটা কেমন লাগে?”

হুরাইন বলল,“এটার রং ভালোলাগছে না। কালোটা সুন্দর।”
এতটা নিচু ছিল তার স্বর। তাসিন পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল বিদায় শুনতে পেল। সে চোখ ছোটো করে বলল,“এটাই সুন্দর৷ এটা নেব।”

তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো হুরাইন। নিকাবের পাতলা আবরণে উপর দিয়েও তা নজর এড়ালো না তাসিনের। সে কেশে ছেলেটাকে বলল,“ভাই কালোটাই দিন।”

বেঁকে বসলো হুরাইন। তাসিনের শার্ট খামচে ধরে তাকে নিজের দিকে ফেরালো। তাসিন ইশারায় বলল, “কী?”

থমথমে গলায় বলল,“আপনি যেটা পছন্দ করেছেন ওটাই কিনুন।”

“না, তোমার পছন্দ করাটাই সুন্দর।”

“না আপনি ওটাই কিনুন।”

“না এটাই সুন্দর।”

দুজনের কথাবার্তা কারো কানে পৌঁছাচ্ছে না। উপস্থিত মানুষ দেখলে বোঝা যায় স্বাভাবিক কোনো কথা হচ্ছে দুজনের মাঝে। হুরাইনের অভিব্যক্তি বুঝার উপায় নেই। সে পুরোটাই আবৃত। অনেকক্ষণ দুজনের কথা কাটাকাটির পর হুরাইনের পছন্দ করা ফোনটাই কিনলো তাসিন।

বেরিয়ে আসার সময় হুরাইন চাপা রাগ ঝেড়ে বলল,“বেঁচে গেলেন। যদি আমার পছন্দের ফোনটা না কিনতেন? তবে..

“জানি, সবার দৃষ্টিতে না পড়ার ভয়ে ঘরে জায়গা দিলেও বিছানায় জায়গা দিতে না। আমি নিজের ভালো বুঝি।”
হুরাইনের কথা সম্পন্ন করতে না দিয়ে উক্ত কথাটি বলল তাসিন।
হুরাইন পূর্বের কন্ঠে স্থির থেকে বলল,“আপনি কী বলতে চান? আমি অত্যা*চারী?”

তাসিন সব দোষ মাথা পেতে নিলো।
“আমি অত্যা*চারী রাজা।”

ঝগড়ায় জিতে গিয়ে নিকাবের আড়ালে মুখ টিপে হাসলো হুরাইন। তাসিন বিড়বিড় করে বলল,“ঝগড়াতেও দেখছি পারদর্শী।”

“কিছু বললেন?”

“হুঁ? হ্যাঁ, বলছিলাম সংসারে শান্তি চাইলে বউয়ের কথায় সম্মতি দিন। শান্তিতে সংসার করুন। সংসার জীবনে উন্নতির চাবিকাঠি হলো স্ত্রীর পরামর্শে চলা।”

★★★

শাবাব দিনের বেশিরভাগ সময়ই বাইরে থাকে। দুপুরে খেয়ে মাঝেমধ্যে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। আজও খেয়ে শুয়ে পড়লো। সে যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, তখন দরজায় বেল বাজলো। সুরাইয়া দরজা খুলে পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। সহজ-সরল মানুষ নিজের দরজায় পুলিশ দেখলেই ভয় পেয়ে যায়। তিনি ভীত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,“আপনারা?”

“মিস্টার রাফিদ শাবাব বাসায় আছেন?”

কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠলো সুরাইয়ার। তোতলানো স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,“কী করেছে শাবাব?”

“ওনাকে ডাকুন। ওনার নামে ওয়ারেন্ট আছে।”

সুরাইয়া হাহুতাশ করে কেঁদে ফেললেন। এসব পরিস্থিতিতে কীভাবে কথা বলতে হয় তিনি জানেন না। ভয়ে হাত জোড় করে বললেন,“আপনারা চলে যান। আমার ছেলে কিছু করেনি।”

“প্লিজ ওনাকে ডাকুন।”

কান্নাকাটির আওয়াজ শুনে ঘুম পাতলা হয়ে এলো শাবাবের। এবার কান খাঁড়া করে শুনে বুঝতে পারলো মায়ের স্বর। ধড়ফড়িয়ে ঘুম ছেড়ে উঠলো সে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে দরজার সামনে মা আর পুলিশ দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল তার। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,“আপনারা হঠাৎ?”

সুরাইয়া শাবাবকে আড়াল করে বললেন,“তুই সরে যা শাবাব। আব্বা আমার, যা এখান থেকে।”

পুলিশের মধ্যে থেকে একজন বললেন,“আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে। আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।”

“কীসের ওয়ারেন্ট? কী করেছি আমি?”

“ একটি মেয়েকে ইভটি*জিং আর মে*রে ফেলার চেষ্টা করায় আপনার নামে ওয়ারেন্ট এসেছে।”

শাবাবের মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠলো। বুঝে গেল কে করেছে এসব। সে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,“আপনারা অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।”

খালি গায়ে শোয়ার অভ্যাস শাবাবের। শোয়া থেকে উঠেই চলে এসেছে। ঘরে গিয়ে শার্ট পরতে পরতে বেরিয়ে আসতেই সুরাইয়া ঝাপটে ধরলেন শাবাবকে। বাঁধ ভাঙা কান্নায় গলার স্বর বদলে গেল।
“আব্বা, আব্বা তুই কোথাও যাবি না।”

শাবাব মাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। এক হাতে মাকে জড়িয়ে বলল,“আমি চলে আসবো মা। ওনাদের সাথে গিয়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে হবে। তুমি কান্নাকাটি কোরো না। আমি যাবো আর আসবো।”

সুরাইয়া শার্ট খামচে ধরে রাখলেন শাবাবের। শাবাব মাকে ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেল পুলিশের সাথে। সুরাইয়া উপায়ন্তর না পেয়ে নিচে ধপ করে বসে পড়লেন। তেরো বছরের তুলি এসে মালকিনের পাশে বসলো। বলল,“আম্মা, খালুরে খবর দেন। কান্নাকাটি না কইরা খালুরে জানাইলে, তিনি ভাইজানরে নিয়া আইতে পারবো।”

সুরাইয়ার যেন হুশ এলো। তিনি মোবাইলের জন্য উঠে পড়তেই তুলি ফোন বাড়িয়ে দিল। সুরাইয়া কল দিয়ে যাচ্ছেন সমানে। রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে কোনো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
“শাবাবের বাবা।”

শাবাবের বাবার পিলে চমকে উঠলো। আচানক স্ত্রীর কণ্ঠ শুনে ভয় পেয়ে গেলেন। আতঙ্কিত স্বরে বললেন,“কী হয়েছে শাবাবের মা। তুমি ঠিক আছো? শাবাব ঠিক আছে?”

“শাবাব ঠিক নেই। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন। আমার কলিজার টুকরারে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে।”
আহাজারি করে কেঁদে কেঁদে বললেন সুরাইয়া।

ওপাশ থেকে উত্তেজিত কন্ঠস্বর শোনা গেল,“কীহ্!”

★★

ফিরোজ আলম বাড়ি এসে আগে বিস্তারিত জানতে চাইলেন। সুরাইয়া কিছুই গুছিয়ে বলতে পারছেন না। তুলির কাছে যতটুকু শুনেছে তাতে ছেলের জন্য এতক্ষণ যে দুশ্চিন্তা কাজ করছিল, তা ক্রোধে পরিণত হয়েছে। ছেলে তাঁর অগোচরে এত নিচে নেমে গিয়েছে? অসভ্য খেতাব তো আগেই পেয়েছে। তারচেয়েও নীচ কাজ করবে তিনি ভাবতে পারেননি। ঘটনা সম্পূর্ণ সত্য না হলেও কিছু হলেও সত্য। তিনি সুরাইয়াকে সাফসাফ জানিয়ে দিলেন,“তোমার ছেলেকে আমি ছাড়িয়ে আনতে পারবো না। সে অন্যায় করেছে, শাস্তি প্রাপ্য। আমার সম্মান তো সে রোজই ডুবাচ্ছে। বাকিটুকু ডুবতে দেব না আমি।”

সুরাইয়া শত আহাজারি করেও কিছু করতে পারলেন না। তাঁর আকুতিও আজ ফিরোজ আলমকে টলাতে পারছে না। তিনি অফিসে ফিরে গেলেন। রাত আটটা বেজে গেল। সুরাইয়ার শরীর অসাড় হয়ে আসছে। চোখে সব কিছু ঝাপসা দেখছেন। এরপরই সব অন্ধকার হয়ে গেল। তুলি ফোন হাতে নিয়ে কল দিল ফিরোজ আলমকে। সুরাইয়ার অবস্থা জানাতেই তিনি আবার ছুটে বাসায় এলেন। স্ত্রীর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করে চলেছেন। ছেলের জন্য ওনার মন পুড়ছে না, এমন নয়। একমাত্র ছেলে, তার প্রতি অগাধ ভালোবাসা রয়েছে ফিরোজ আলমের মনে। কিন্তু ছেলেকে আর প্রশ্রয় দিতে চান না। দুদিন জে*লে থেকে শিক্ষা হোক এটাই চেয়েছিলেন তিনি। এখন মনে হচ্ছে বসে থাকা যাবে না। সুরাইয়া আবার যেকোনো সময় অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।
সুরাইয়ার জ্ঞান ফেরার পর তুলিকে ওনার পাশে রেখে থা*না*র উদ্দেশ্যে বের হলেন ফিরোজ আলম।

শাবাবকে একপলক দেখে নিলেন। ছেলের চোখে কোনো অনুশোচনা, লজ্জা নেই। বরং ক্রো*ধে*র আগুন খেলা করছে। চোয়াল শক্ত হয়ে হাড় স্পষ্ট হয়ে আছে।
ফিরোজ আলম কোনোভাবে কোনো গতি করতে পারলেন না। বুঝা গেল আরেকটু ঘোরাঘুরি করতে হবে এই বে*য়া*দ*ব, অপদার্থ, অকর্মার ঢেঁকির জন্য। এই ছেলে যেমন তাঁকে পিতৃত্বের স্বাদ দিয়েছে, তেমনই এখন জীবনটা ভাজা ভাজা করে দিচ্ছে।

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে