এক টুকরো আলো পর্ব-১০

0
234

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_১০
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

“আমার হৃদয়ের খুব কাছে, যাকে ভেবে আমার বুক তড়পায়, যার জন্য আমি অপেক্ষা জমাই, তার প্রতি এই ব্যাকুল অনুভূতির কী নাম দেবে তুমি?
ভালোবাসা না কি ভালো থাকা?”

গভীর শ্বাসে টান পড়ে। থেমে যায় ভারী পড়া নিঃশ্বাসের শব্দ। পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে ঘর জুড়ে। দখিনা জানালা দিয়ে ধেয়ে আসে মৃদু শীতল বাতাস। অপ্রত্যাশিত জবাবে অন্তর রঙিন হয়ে ওঠে হুরাইনের। আনন্দে সলজ্জ হাসে। তাসিন শুধালো, “তুমি ভালোবাসো?”

হুরাইনের চোখে সত্যের ঝিলিক। অকপটে ঠোঁটের ডগায় প্রস্তুত করে শব্দ।
“গতকাল থেকে আমি আপনার প্রতি বিশেষ এক ধরনের টা*ন অনুভব করি। ইনশাআল্লাহ সেটা ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে যাবে শীঘ্রই।”

তাসিন দূরত্ব কমায়। নাকে টে*নে নেয় মিষ্টি খুশবু। হুরাইনের শরীর থেকে আতরের সুবাস ভেসে আসছে। চুলে মুখ গুঁজে দিয়ে তাসিন জিজ্ঞেস করল,“এত সুগন্ধি কেন?”

কুঁকড়ে যাওয়া শরীরে, মৃদু কন্ঠস্বর,“আপনার জন্য।”

কথা না বাড়িয়ে হাসলো তাসিন। চট করে হুরাইনের মস্তিষ্কে কিছু প্রশ্ন উঁকি দিল। উত্তর তার জানা। কেবল স্পষ্ট হতে চাইছে সে। ঘুরে বসল তাসিনের মুখোমুখি। মুখে নববধূর ছাপ স্পষ্ট। খাড়া নাকের বাঁ পাশে ছোট্ট সোনার নাকফুল জ্বলজ্বল করছে। বলল,“আপনার মা কি আমার উপর নারাজ?”

জবাব না দিয়ে চেয়ে রইল তাসিন। ক্ষণ সময় অপেক্ষা করিয়ে জিজ্ঞেস করল,“কেন মনে হলো?”

হুরাইন ইতস্তত করে বলল,“কাল থেকে ওনাকে দেখিনি। আমি যখন সকালে দেখা করতে গেলাম। মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন। বাবার সাথে এ বাড়ি আসার পূর্বে আবারও দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি কথা বলেননি আমার সাথে।”

তাসিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হুরাইনের দু’হাত মুঠোয় নিয়ে বলল,“মা তোমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু ওনার মনোবাসনা অন্যকিছু ছিল। আমি নিজের পছন্দে বিয়ে করেছি বলে নারাজ। এটা সাময়িক ব্যাপার। তুমি এসব নিয়ে চিন্তা কোরো না। আমি চাই আমার পরিবারের সকলেই তোমার কাছ থেকে শিখুক। তুমি হয়ে ওঠো একজন আদর্শ শিক্ষক। সেদিকেই ফোকাস করবে তুমি।”

হুরাইন মাথা দোলায়। মনে মনে আওড়ায়,“এই হাত দুটো ধরে রাখুন ভরসায়।”

তাহাজ্জুদ পড়তে উঠে পড়ল হুরাইন। রোজ এই সময় তার ঘুম ভাঙে। তাসিনকে কয়েকবার ডাকার পরও সে সাড়া দিল না। আর ডাকলো না সে। একদিনেই কারো মাঝে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তবে আল্লাহ চাইলে সেকেন্ডেই সব সম্ভব। তাহাজ্জুদ পড়ে অপেক্ষায় রইল ফজরের। মুয়াজ্জিনের ডাক ভেসে আসছে চারদিক থেকে। ধীরে ধীরে বাড়ির পরিবেশ গরম হয়ে উঠলো। সকলেই জেগে গিয়েছেন। বাদ নেই হুসাইনের ছেলে তারশীদ। সেও রোজ বাবা-দাদার সাথে ফজর পড়তে মসজিদে যায়। হুরাইন জায়নামাজ ছেড়ে তাসিনের মাথার পাশে এসে বসল। ধীর আওয়াজে ডাকলো,“শুনছেন? ফজরের আজান হয়েছে। নামাজ পড়তে উঠুন।”

এমন নরম সুরে তাসিনের ঘুম ভাঙার পরিবর্তে আরও গাঢ় হচ্ছে। মনে হচ্ছে কে যেন মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুমিয়ে থাকার আহবান জানাচ্ছে। আরেকটু আরাম করে পাশ ফিরে গেল সে। হুরাইন ফের ডাকলো। এক সময় তার স্বর বড়ো হলো। তাসিনের কানে গিয়ে স্পষ্ট পৌঁছচ্ছে। তার মস্তিষ্ক জাগ্রত হচ্ছে। শুনতে পাচ্ছে হুরাইন তাকে ফজরের সালাতের আহ্বান জানাচ্ছে। উঠছি উঠছি করেও গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে। তার গায়ে হাত রেখে মৃদু ধাক্কা দিল হুরাইন। বলল,“আপনি না আমায় দায়িত্ব দিয়েছিলেন দুজনকে জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার? আপনি নাকি আমাকে সাহায্য করবেন! কোথায় গেল আপনার কথার মূল্য?”

তাসিন ঘুম জড়ানো গলায় বলল,“অল্প কিছুক্ষণ। উঠে যাচ্ছি।”

“আব্বু, ভাইয়া, তারশীদ সকলেই মসজিদে চলে যাচ্ছে।”

“আমি ঘরে পড়ে নেব।”

এবারে হুরাইনের স্বর কঠিন হলো।
“না। আপনি এক্ষুনি সবার সাথে মসজিদে যাবেন। একটা সাত বছরের বাচ্চা যদি আরামের ঘুম ত্যাগ করতে পারে, আপনি কেন পারবেন না? উঠে পড়ুন। হাত-পা ঝেড়ে ফেলে ওজু করে নিন।”

এবার তাসিনের ঘুম ছুটে গেল। এক লাফে বিছানা ছাড়তেই এতক্ষণের আদুরে ঘুম উবে গেল। এখন সতেজ লাগছে। তাসিন ওজু করে নিতেই তার পাঞ্জাবি, টুপি এগিয়ে দিল হুরাইন। একটু আগের কঠিন মুখশ্রীতে এখন কেবল কোমলতা। এক টুকরো নুর জ্বলজ্বল করছে। তাসিন পা বাড়িয়ে বের হলো। হুরাইন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে গেল।

★★★

শাবাবের পরিবার সম্পর্কে আতাউর রহমান খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলেন। জানতে পারলেন বাবা বেশ প্রভাবশালী। একমাত্র পুত্র। বিবাহিত জীবনের তেরো বছর পর একমাত্র সন্তানের জন্ম। বাবা-মায়ের আদরের পুত্র জেনে আতাউর রহমান যা বুঝার বুঝে গেলেন। এর পরিবারকে জানিয়ে খুব একটা লাভ হবে না। হয়তো বা টাকা দিয়ে আতাউর রহমানকে মুখ বন্ধ রাখতে বলবেন। কী করতে হবে তিনি মনস্থির করে ফেললেন। টাকা ছিটলেই আজকাল অনেককিছু পাওয়া যায়। কিছু ছেলেপুলে হায়ার করলেন শাবাবকে মে*রে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার জন্য। তিনি মেয়েকে ভার্সিটি পাঠিয়ে ফোন লাগালেন সেই ছেলেদের লিডারের কাছে।
“হ্যাঁ, হাত-পা ভেঙে দিয়েছ? কয়েকমাস অন্তত আমার মেয়ে শান্তিতে থাকবে আর ওই বেয়া*দবটা শিক্ষা পাবে।”

ওপাশ থেকে অট্টহাসি ভেসে এলো। চমকে উঠলেন আতাউর রহমান। তিনি বললেন,“এ্যাই হাসছ কেন? যে কাজে পাঠিয়েছি সেটা করেছ?”

“আমি শাবাব বলছি শশুর আব্বা। আপনার মেয়ের জামাই। আমার ছেলেদেরকেই আমাকে মা*রা*র জন্য পাঠিয়েছেন? বলি কি শশুর আব্বা একটু ঘিলু খাটিয়ে কাজ করুন।”

খ্যাঁক করে উঠলেন আতাউর রহমান।
“এ্যাই, এ্যাই অ*স*ভ্য ছেলে। কী বলতে চাও তুমি? আমার ঘিলু নেই, না?”

শাবাব কটাক্ষ করে বলল,“আছে নাকি? বাপ-মেয়ে দুটোই ঘিলু ছাড়া। ঘিলু থাকলে তো মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিতেন।”

দাঁতে দাঁত চাপলেন আতাউর রহমান। “তোমাকে সামনে পেলে..

মুখের কথা টে*নে নিল শাবাব। রগঢ় করে বলল,“বাড়ি নিয়ে জামাই আদর করতেন, তাইনা? অবশ্য শশুর হিসেবে আপনি পারফেক্ট। আপনার মেয়ে নিয়ে লড়াইটা বেশ জমবে। আই লাভ ইউ শশুর আব্বা। ইশ! আপনার মেয়েকে এখনো আই লাভ ইউ বলা হয়নি। যাই গিয়ে বলে আসি।”

“এ্যাই বয়া*দব একদম ফোন কাটবি না। আমার মেয়ের কাছে যাবি না তুই। ছিঃ কী নির্লজ্জ! আমাকে আই লাভ ইউ বলা হচ্ছে?”

আতাউর রহমানের নাক-মুখ লাল হয়ে গেল। ভারি লজ্জার ব্যাপার। শাবাব খট করে কল কেটে দিয়ে কুটিল হাসল। বিড়বিড় করে বলল,“এবার দেখুন শশুর আব্বা, কীভাবে আপনাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাই। শরীরে তেল-চর্বি বেড়ে গিয়েছে। দৌড়ঝাঁপ করলে শরীর ফিট থাকবে। কৃতজ্ঞতা জানান আমাকে।”

ছেলেগুলোর দিকে ফোন ছুঁড়ে দিয়ে সামনে পা বাড়ালো শাবাব। তার গন্তব্য ফাবিহা। হাত ঘড়িতে সময় দেখল সে। চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে নবাবী স্টাইলে হাঁটছে। চেহারা, চলাফেরার স্টাইল, উচ্চতা বিচার করলে একজন হ্যান্ডসাম পুরুষ। কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। ক্ষমতাও তার কম নয়। বাবার একমাত্র ছেলে। টাকাপয়সা তো সব তারই। আড়ালে-আবডালে জুনিয়র মেয়েরা ঠিকই আড়চোখে দেখে তাকে। তাতে যেন শাবাব দাম্ভিক হয়ে ওঠে। কী কম আছে তার? একটা মেয়ে কেন তাকে এড়িয়ে চলবে?

ফাবিহার ক্লাস শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রইল শাবাব। ক্যাম্পাসের গেট পেরিয়ে বেরুতেই শাবাবকে দেখে থমকে গেল ফাবিহা। অজানা ভয় মনে ভেতর বাসা বাঁধলো। বাবা তো বললেন আজকের পর থেকে সে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে। শাবাব নামক কোনো কালো ছায়া আর থাকবে না। ফাবিহা ধীরে ধীরে পাশ কাটানোর চেষ্টা করলো৷ ডেকে উঠলো শাবাব।
“আরে জানেমান কোথায় যাচ্ছো? আমি তোমার অপেক্ষায় শুকিয়ে যাচ্ছি।”

ফাবিহা কথা বাড়াতে চাইলো না। চুপ থাকাই শ্রেয়। শাবাব এগিয়ে এসে খপ করে ফাবিহার হাত চেপে ধরে বলল,“চলো চলো জানেমান। শশুর আব্বা বলেছেন তোমাকে আই লাভ ইউ বলতে। তুমি নাকি গতকাল কেঁদেকেটে পুকুর বানিয়েছ? আশ্চর্য সামান্য আই লাভ ইউ শোনার জন্য কেউ এমন করে?”

ফাবিহা হতভম্ব হয়ে গেল। কী আবোল-তাবোল বলছে এই ছেলে? হাত মোচড়ানো শুরু করে দিয়ে বলল,“দেখ, পাবলিক প্লেসে সিনক্রিয়েট কোরো না। হাত ছাড়ো আমার।”

“আচ্ছা, তাহলে আমার সাথে চলো।”

“তোমার সাথে যাবো মানে? কোথায় যাবো আমি?”

“তোমার শশুর বাড়ি যাবে, চলো। বিয়ের আগে সবটা দেখতে হবে না?”

হাত ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে দিল ফাবিহা। তেজী কন্ঠে বলল,“কখনো না। তুমি যদি পৃথিবীতে শেষ পুরুষ হয়ে থাকো, তবুও আমি তোমায় বিয়ে করবো না। ল*ম্প*ট একটা।”

শাবাব চুপ করে রইল। তার চোখে কাতরতা। ফাবিহার হাত দুটো আবারও মুঠোবন্দি করে আকুতি করে বলল,“তোমাকে পেলে আমি ভালো হয়ে যাব ফাবিহা। বিশ্বাস করো।”

ফাবিহা তাকালো শাবাবের চোখে। কোথাও মিথ্যের ছিঁটেফোঁটাও নেই। তবুও ফাবিহার মন গললো না। কেবল নিজের হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,“যেতে দাও আমায়। তুমি আমার সামনে না এলেই খুশি হবো।”

শাবাব হো হো করে হেসে ফেললো। ভারি চমকালো ফাবিহা। মুহূর্তেই রং বদল হয়ে গেল। শাবাব ঠোঁট চোখা করে আফসোস সূচক শব্দ করলো। তার চোখে-মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি। ফাবিহাকে একটু হলেও বোকা বানাতে পারল। মন না গলুক কিঞ্চিৎ হলেও মেয়েটার মনকে ভাবতে বাধ্য করেছে। শাবাব ভর্ৎসনা করে বলল,“আজ দ্বিধায় ছিলে বিশ্বাস করবে কি করবে না। কাল – পরশু তো আমাকে বিয়েই করে ফেলবে।”

আতাউর রহমান এদিকেই ছুটে আসছেন। হাঁপিয়ে গিয়েছেন তিনি। ঘনঘন শ্বাস টা*ন*ছে*ন। ফাবিহা উৎকণ্ঠিত হলো।
“বাবা কী হয়েছে তোমার?”

শাবাব হাঁক ছাড়লো। পাশের দোকানদারকে বলল,“টিটু একটা ঠান্ডা পানি দে তো।”

টিটু ঠান্ডা পানি নিয়ে ছুটে এলো। শাবাব বোতলের ক্যাপ খুলে আতাউর রহমানের সামনে দিয়ে ঢকঢক করে গিলে নিলো সব পানি। তৃষ্ণা মিটিয়ে চমৎকার হেসে বলল,“আপনি হাঁপিয়ে গিয়েছেন শশুর আব্বা। আপনার কষ্ট কি আমার সহ্য হয়? তাই পানি পান করে তৃষ্ণা মেটালাম।”

আতাউর রহমান হতভম্ব। পাশ থেকে ফাবিহা রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। সে ভেবেছিল পানি বুঝি তার বাবার জন্য। শাবাব ফাবিহার দৃষ্টি দেখে সামান্য ঘাড় উঁচু করে বলল,“যা বাবাহ, আমি কী করলাম?”

ফাবিহা মুখ শক্ত করে বলল,“তুমি একটা হৃদয়হীন, অ*মা*নু*ষ।”

শাবাব ভাবলেশহীন। কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,“ওহ্ তোমাকে তো আই লাভ ইউ বলা হলো না। শশুর আব্বা আপনি এসেছেন ভালো করেছেন। আপনাকে সাক্ষী রেখে আমি আপনার মেয়েকে বলছি আই লাভ ইউ জানেমান।”

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে