একা তারা গুনতে নেই পর্ব-২+৩

0
345

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২
দিপু শেষ পর্যন্ত মরেনি। ইমাদ দিপুর সাথে দেখা করতে হাসপাতালে এল তিনদিন পর। দিপু হাসপাতালের বেডে শুয়ে অসহায় চোখে ইমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। ইমাদ চেয়ার টেনে বসতে বসতে গলা উঁচিয়ে ডাকল, “আপনি কী একটু ভেতরে আসবেন?”
“দোস্ত, তাহমিদ এসেছে?” দিপু চাতকিনীর মতন ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করতে করতে এই আধমরা অবস্থাতেও উঠে বসল।
ইমাদ কিছু বলল না।
দিপু চোখ ঘুরিয়ে দরজায় তাকাল। না তাহমিদ ত আসেনি। সে দেখল লম্বা বেণুণী সামনে ফেলে রাখা, বড় বড় বিড়াল চোখের একটা মেয়েটা ভেতরে এল। পাতলা গোল মুখ,ভাসা ভাসা চোখ। দিপু ক্লান্ত স্বরে ইমাদকে বলল “আমিও কী পাগল তাইনা বল? ও আসবে কেন?” দিপু আবার শুয়ে পড়ল। মেয়েটি কোনো ভূমিকা না করে সোজা এসে দিপুর মাথার কাছে বেডেই বসল। ইমাদ পরিচয় করিয়ে দিলো, “ও হলো আমার বন্ধু দিপা। আমরা সবাই দিপু ডাকি।”
কড়ি দিপার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কড়ি। আপনার কাছে আমার একটু দরকার আছে।”
“দরকার?” দিপা অবাক হল। এখনও দরকার ফুরিয়ে যায় নি তার!
কড়ি সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “আমিও কী আপনাকে দিপু ডাকতে পারি?”
দিপা বিভ্রান্ত হয়ে ইমাদের দিকে তাকাল। ইমাদ মনোযোগ দিয়ে কমলা খাচ্ছে। একটু আগে দিপার বড় খালা দিপাকে দেখতে এসে এতসব ফলফ্রুট দিয়ে গেছেন। ইমাদ সেই প্যাকেট খুলেই কমলা খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। ওর দিকে না তাকিয়েই বলল-
“উনি তোর দলেরই লোক।”
“আমার দলের মানে?”
কড়ি তাদের কথায় বাগড়া দিলো, “আপনার কাছে ধার চাইতে এসেছি। কিছু সাহস আর দুঃখ ধার দিবেন? আপনার বড্ড সাহস। দুঃখেরও শেষ নেই।”
দিপা ভ্যাবলাকান্তের মতন হা করে কড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। এই বিষণ্ন সময়ে এত সব নাটকীয়তা তার পছন্দ হচ্ছে না।
ইমাদ এখন কমলা রেখে আঙুরে মন দিয়েছে। একটা বাটিতে আঙুর ভিজিয়ে রেখে টুপটুপ করে মুখে দিচ্ছে। আঙুরের দাম বেশি। দীপুর জন্য আঙুর আনার কথা সে ভাবতেই পারেনি। কমলা আনতে চেয়েছিল। দাম করল। ১৪০ টাকা কেজি শুনেই উল্টোপথে হাঁটা ধরেছে। জিনিসপাতির দাম শুনলেই তার ইচ্ছে করে বইয়ের পাতায় ডুব দিয়ে শায়েস্তা খানের আমলে চলে যেতে। এক টাকায় আট মণ চাল!
আচ্ছা এই বকবকে, কথা না শোনা, ফ্যাচফ্যাচে কাঁদুনি দীপুটাকে নিয়ে সে যাবে কোথায়! দীপু বোধহয় তার মাথাটা নষ্ট করে দিয়ে এরপর শান্তি হবে। কখনো কোনো কথা শুনেছে মেয়েটা? শুনবে কেমন করে? নিজে বলেই ত শেষ করতে পারে না। কতবার সে আর নিলয় বুঝাল তাহমিদ ছেলেটা ভালো না। শুনলই না। ব্রেকআপের পর আবার মরতে বসল। আরেকটুর জন্য তার আত্মা উড়ে যাচ্ছিল। কিছু যদি হয়ে যেত দীপুর! তাও ভালো কড়ি নামের এই মেয়েটিকে গত তিনদিন ধরে বহু আরাধনা করার পর পেয়েছে সে। কাজিনের বিয়েতে গিয়ে বসেছিল মেয়েটা। আর সে এদিকে তার বাড়ির সামনে রাতদিন ঘুরঘুর করেছে। দোকানদারের সন্দেহ দূর করতে মিথ্যে বলেছে। বলেছে এই এলাকায় টিউশনী করে। অথচ, এই এলাকায় সে এর আগে….
আচমকা শার্টের আস্তিনে টান পড়ায় ইমাদের চমক ভাঙল। দীপু হাত ধরে টানছে, “ইমাদ, তুই ওকে কোথা থেকে আবিষ্কার করলিরে?
আঙুর খাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটায় ইমাদ মনে মনে বিরক্তির শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল। তবে চেহারায় সেই বিরক্তির কোনো প্রকাশ নেই। সে অস্ফুট গলায় বলল, “ফুডপাণ্ডায় অর্ডার করলাম।”
দিপা ইমাদ থেকে বাটিটা কেড়ে নিলো। কড়ির দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “নাও কড়ি আঙুর খাও।”
কড়ি আঙুরের বাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি টিয়া আঙুর খাই না।”
“কালো আঙুর খাও?”
“খাই।”
দিপা ইমাদের হাতে বাটিটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “ডানদিকের প্যাকেটটায় কালো আঙুর আছে। কালো আঙুর দে ওকে।”
ইমাদ বলল, “আচ্ছা।”
কড়ি আর দীপা আবার কথায় মন দিলো। একটু পর দীপা আবার রুষে উঠল, “ইমাদ!”
ইমাদ আঙুর খেতে খেতে ইমাদ মুখ তুলে বলল, “কী?”
“তোকে বলেছিলাম ওকে আঙুর ধুয়ে দিতে।”
“ও আচ্ছা।” ইমাদের আচ্ছা দীপুর ক্লান্তি আর বিরক্তি আরো বাড়িয়ে দিল। এত বিরক্ত হলো দীপা! শরীরটা ভালো থাকলে এখনি সে ইমাদের মাথা ফাটিয়ে দিতো।
ইমাদ চেয়ার ছেড়ে উঠল। আরেকটা বাটিতে কালো আঙুর ধুয়ে হেঁটে এসে কড়িকে দিয়ে গেল। কড়ি বলল, “ধন্যবাদ।”
ইমাদ ফিরে এসে আবার চেয়ার বসল। এবার সে আনারের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়াল। তার খাওয়ায় ফের ব্যাঘাত ঘটল আধ ঘণ্টা পরই। এবার কড়ি ডাকল। উঠে এসে বলল, “আমি আসছি।”
ইমাদ ধীর গতিতে উঠে দাঁড়াল, “আচ্ছা।”
কড়ি দিপার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, “টাটা।”
দিপা বলল, “তোমায় যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না।”
“তাই?”
দিপা উপর নীচ মাথা নাড়ল, “একদম তাই। আবার এসো।”
কড়ি তার কানের কাছে বেণুণীতে গুঁজা ফুলটা খুলে দিপার কানের কাছে গুঁজে দিলো। হেসে বলল, “সুন্দর লাগছে।”
“থেঙ্ক ইউ।”
“নট এট এল।” কড়ি ডানদিকে হাতটা প্রসারিত করে সুর তুলে বলল।
তারপর দরজার দিকে এগুলো। ইমাদও কড়িকে এগিয়ে দিতে পেছন পেছন যাচ্ছিল। দিপা পিছু ডাকল, “ইমি?”
ইমাদ ঘাড় ঘুরতেই দীপা বলল, “আই লাভ ইউ দোস্ত।”
ইমাদ খেয়াল করল দীপুর আগের সেই ক্লান্ত স্বর এখন কিছুটা সতেজ। সে তার স্বভাবসুলভ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আচ্ছা।”
দিপা সাথে সাথে সাইডে থাকা টেবিল থেকে স্টিলের গ্লাসটা ইমাদের দিকে ছুঁড়ে ফেলল, “শালা, আরেকবার আচ্ছা বললে আমি আবার হাত কাটব।”
ইমাদ সেদিকে না তাকিয়েই হেঁটে করিডোরের দিকে চলে গেল। নীচে নেমে কড়িকে একটা রিকশা ঠিক করে দিলো। কড়ি রিকশায় উঠে চলে গেল। ইমাদ একটু সামনে হেঁটে একটা অটোতে উঠল। ড্রাইভারের পাশের সিটটায় বসতেই অবাক হয়ে দেখল কড়ির রিকশাটা একটু সামনে গিয়েই থেমে গেছে। রিকশা এদিকেই ফিরে আসছে আবার। কড়ির রিকশাটা এসে ওর অটোর সামনেই থামল। কড়ি হুড তোলা রিকশার মাঝ থেকে মাথা বের করে ইমাদকে বলল, “আপনি এখন শান্ত হতে পারেন। আপনার বন্ধু ঠিক হয়ে যাবে। ”
“আমি তো শান্তই আছি।”
“তাই?”
“জি।”
কড়ি অনেকক্ষণ চুপ করে ইমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একসময় বলল, “আপনি আমাকে যাওয়ার সময় ধন্যবাদটুকুও বলেননি। আপনি স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। এতটা অশান্ত হবেন না। দিপু এখন থেকে ভালো থাকবে।”
ইমাদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে অটোচালককে বলল, “ভাই চলুন।”
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
#পর্বঃ৩
#লামইয়া_চৌধুরী
কলিংবেল বাজতেই মিলা দুতলার বারান্দা থেকে নীচে উঁকি দিলো। ইমাদকে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুবিনকে ডাকল, “মুবিন, স্যার এসেছেন। নীচে গিয়ে গেইট খোল।”
মুবিন সোফার উপর চিত হয়ে শুয়ে রুবিক্স কিউব মেলাতে মেলাতে বলল, “তুই খোল। স্যারটা কী আমার একার?”
“তুই অনেককিছু বুঝিস না, মুবিন। যা গিয়ে গেইট খোল।”
মুবিন না উঠেই বলল, “কী বুঝি না আমি? আমি সবই বুঝি।”
মিলা বিরক্ত হয়ে গেল। কথা বাড়াল না আর। নীচে গিয়ে গেইট খুলে ইমাদকে সালাম দিলো। ইমাদ গেইটে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
মুবিন আর মিলা ভাই-বোন। দুজন দশম শ্রেণীতে পড়ে। মুবিন বছর খানেকের বড় হলেও একই ক্লাসে দুইবার থাকায় এখন দুজন সহপাঠী। ইমাদ তাদের বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলো পড়ায়। মিলা খুব মনোযোগী ছাত্রী। পড়াশুনায় অসাধারণ, অধ্যবসায়ী, শান্তশিষ্ট মেয়ে। উল্টোদিকে, মুবিন দুরন্ত এবং উদ্যত। পড়াশুনায় কোনো মন নেই। দুজনকে একসাথে পড়াতে গিয়ে ইমাদকে হিমশিম খেতে হয়। দেখা যায় মিলার যে চ্যাপ্টারটা এক সপ্তাহে শেষ হয়ে যায়, মুবিনের জন্য তা বারবার পুনরাবৃত্তি করতে হয়। ইমাদ তাদের মায়ের সাথে এই বিষয়ে কথা বলেছিল। বলেছিল, “আন্টি, মিলা আর মুবিনকে আলাদা পড়ালে ভালো হয়। দুজনের পড়া আয়ত্ত করার ক্ষমতা ভিন্ন। একসাথে পড়ালে মুবিনের জন্য হয় মিলা পিছিয়ে থাকে নতুবা, মুবিন পড়া বুঝে না।”
তাদের মা মিসেস শিল্পী জবাবে বললেন, “তুমি একসাথেই পড়াও। মিলা এমনিতেই পারবে। তুমি মুবিনের দিকে নজর দাও।”
ইমাদের এরপর আর কিছু বলার থাকে না। তাই সে বলেওনি।
ইমাদ মিলাকে বলল, “মুবিন কোথায়?”
“ভেতরেই।”
“আমি এসেছি জানেনা?”
মিলা মিথ্যে বলল, “না স্যার ওর আসলে মাথা ব্যথা করছিল ত তাই শুয়ে আছে। আমি ভয়ে ডাকিনি।”
ইমাদ টেবিল থেকে উচ্চতর গণিতের বইটা টেনে এনে বলল, “যাও ডেকে নিয়ে এসো।”
মিলা ঘরে গিয়ে মুবিনকে বলল, “স্যার ডাকেন। এখনও আসিসনি কেন তুই? তোর জন্য আমাকে মিথ্যে বলতে হয়েছে।”
“কে বলেছে তোকে মিথ্যে বলতে?”
মিলা ভাইয়ের হাত টেনে ধরে ভাইকে সোফা থেকে টেনে তুলল, “প্লিজ চল। সময় নষ্ট হচ্ছে। স্যার এক ঘণ্টার বেশি এক মিনিটও পড়ান না।”
“কেন? তোর কী উনার কাছে সারা দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই পড়তে ইচ্ছে করে?”
“বাজে কথা বলবি না। চল।”
“যাব না। কী করবি?”
“উফ কিছুই করব না। অনুরোধ করছি প্লিজ চল।”
মুবিন গায়ে গেঞ্জি চড়াতে চড়াতে বলল, “যা তুই। আমি আসছি।”
“না তোকে না নিয়ে যাব না।”
মুবিন মুখ দিয়ে বিরক্তির শব্দ করে আগে আগে চলল। মিলা মুবিনের পেছনে পেছনে এসে চেয়ারে বসল। ইমাদ মাঝে দুইজন দুই দিকের চেয়ারে। সে ঠাণ্ডা চোখে মুবিনের দিকে তাকাল, “বাড়ির কাজ করেছ?”
“না।”
“কেন করোনি?”
মুবিন বলল, “এমনি।”
ইমাদ টিউশনীটা ছেড়ে দিত। বাজে ছাত্রদের পড়ানো যায়, বেয়াদবদের নয়। কিন্তু টাকা? এখানে হেরে যেতে হয় ইমাদদের। সে মুবিনের সাথে কথা বলা বাদ দিয়ে মিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “আজকে কোন চ্যাপ্টার করবে?”
“ত্রিকোণমিতি করি, স্যার?”
ইমাদ দুজনের ব্যবহার দেখে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আপন ভাই-বোন দুজন অথচ, দুজনের মাঝে কত তফাত! ইমাদ স্বভাবসুলভ ভাবেই বলল “আচ্ছা।” খাতা খুলে অঙ্ক কষতে কষতে তার হঠাৎ মনে হলো বড় আপু ছাড়া এই প্রথম সে কারো কাছে ধরা পড়ে গেল। কড়ি! মেয়েটা তার মনের ঝড়টা বুঝে ফেলল! দীপুর জন্য আসলেই সে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। এত ভালো একটা মেয়ে দীপু! কথা একটু বেশি বলে এই যা। এই এত ভালো মেয়েটার সাথে এমন হতে হলো? তাহমিদকে শায়েস্তা করতে পারল না? ঐ তাহমিদই কী সব জীবনে? এই যে ওরা বন্ধুরা কী কেউ নয়? তাহমিদ না থাকলে মরে যেতে হবে? পরিবার আর বন্ধুদের নিয়ে থাকা যায় না? কিন্তু কড়িকে কেন তার ভেতরের ঝড়টা বুঝে ফেলতে হবে? তার বুকের গহীনের ঝড়টুকু একমাত্র তার বড় আপুই বুঝতে পারে। এটুকুই যথেষ্ট নয় কি? তার অতি মূল্যবান অনুভূতিগুলো কেউ বুঝুক সে তা চায় না। বড় আপুর বুঝে ফেলাতেও সে মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়। অার কোথাকার কোন অচেনা একটা মেয়ে তাকে বলে গেল বিচলিত হবেন না! আনমনেই মুচকি হাসল ইমাদ। মনে মনে বলল, “নাহ, এতটা সহজ হতে দেবে না সে নিজেকে।”
কড়িকে নিয়ে আকাশপাতাল সব ভাবতে ভাবতে আচমকা সে খেয়াল করল কলম চলছে না তার। সূত্রগুলো সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। বইয়ের পাতা উল্টে সূত্র দেখে নিলো একবার। সূত্র বসিয়েও অঙ্কটা মিলাতে পারছে না। না পারছে না, কিছুতেই পারছে না। মুবিন হঠাৎ বলে উঠল, “স্যার দেখি আটকে গেলেন?”
ইমাদ মুবিনের দিকে স্বাভাবিকভাবে তাকাল। মুবিনের মুখে ঠাট্টা মিশ্রিত হাসি। মিলা ইশারায় ভাইকে চুপ থাকতে বলল। মুবিন অঙ্ক গাইডটা খুলে সেই অঙ্কটা খুঁজে বের করে ইমাদের সামনে দিলো। বলল, “নিন স্যার আপনার হেল্প হবে।”
ইমাদ মিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “ক্যামিস্ট্রি বই বের করো।”
মিলা তাড়াতাড়ি করে মুবিনের খুলে রাখা গাইডটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে বন্ধ করল। রসায়ন বই খুলতেই ইমাদ বলল, “কোন চ্যাপ্টার পড়বে?”
মিলা কিছু বলার আগেই মুবিন ঠেশ দিয়ে বলল, “স্যার, আপনিই বলেন কোন চ্যাপ্টারে ভালো প্রস্তুতি আছে আপনার। নাহয় আবার আটকে যাবেন।”
ইমাদ মুবিনের দিকে আর তাকাল না। মিলাকে বলল, “তোমাদের আম্মু বাসায় আছেন?”
মিলা ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে বলল, “না স্যার।”
“আচ্ছা আমার আজ মাথা ধরেছে। আমি আসছি।”
ইমাদ উঠে চলে গেল। বাইরে বেরিয়েই সে তাদের মায়ের নাম্বারে কল করে জানিয়ে দিলো সে আর তাদের পড়াবে না। গত মাসের বেতনটা যেন বিকাশ করে দেন।

ইমাদ বেরিয়ে যেতেই মিলা মুবিন এর উপর চড়াও হলো, “এভাবে বলার কী দরকার ছিল তোর?”
“যা সত্য তাই বললাম। অঙ্ক মেলাতে পারছেন না আর ভাব ধরেন।”
“শোন স্যার অনেক ভালো। স্যারের জায়গায় আমি হলে তোকে মেরে বসতাম। স্যার ভালো বলেই চুপচাপ উঠে চলে গেলেন।”
“ভালো বলে চলে গেলেন না। উনার টাকা দরকার তাই চুপচাপ চলে গেলেন। আমরা পে করি। ওকে?”
“পে তো সব টিচারকেই করা হয়। তবুও তোর জন্য কেউ টেকে? ইমাদ স্যারও আর আসবেন না। দেখে নিস।”
“না এলে না আসবে।”
“হ্যাঁ, তুই তো এটাই চাস। কোনো টিচারকেই তোর পছন্দ হয়না।”
“ভুল বললি। আমার যেই টিচারকে পছন্দ হয় সেগুলো তোর পছন্দ হয় না।”
“হবে কী করে? তুই নিজে যেমন ফাঁকিবাজ তেমন ফাঁকিবাজ টিচারই তোর পছন্দ হয়।”
“ইমাদ স্যার চলে যাওয়ার এত ভয় কেন তোর? প্রেমেটেমে পড়লি নাকি?”
“একদম বাজে কথা বলবি না। আমি এমন নাকি?” বিস্ময়ে, রাগে মিলার চোখ দুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল।
মুবিন বুঝল এবার বেশি বেশি বলে ফেলেছে, “স্যরি।”
“তোর স্যরি প্লিজ তোর কাছেই রাখ। সামনে পরীক্ষা। তোর জন্য এই মুহূর্তে টিচার হারালে আমার রেজাল্ট খারাপ হবে। আর এরকম করে করে তোর জন্য আমিও জীবনে কিছু হতে পারব না।”
“তো মা – বাবাকে বল তোর জন্য আলাদা টিচার রাখতে। আমার সাথে আর পড়িস না। তুই তোর সাধু সাধু টিচারের কাছেই পড়িস।”
মিলার গলার স্বরটা নেমে এল। কান্নামিশ্রিত গলায় বলল, “মা- বাবার কাছে আমার কোনো মূল্য নেই, মুবিন। ওদের শুধু তোকে দরকার। তাঁদের ডিভোর্সের পর দুজনেই শুধু তোকেই নিজেদের কাছে রাখতে চায় দেখিস না তুই? আমাকে না বাবা রাখতে চান আর না মা। সেখানে আমার পড়াশুনা নিয়ে ওদের মাথা ব্যথা থাকতে যাবে কেন?”
মুবিন আমতা আমতা করতে লাগল। মিলা ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিজের ঘরে এসে কেঁদে ফেলল সে। পৃথিবী কত অদ্ভুত।
.
কড়ি নাশতার টেবিলে বসে বলল, “বাবা, আমি এই সেমিস্টার ড্রপ দিতে চাই।”
কাদের সাহেব খেতে খেতে বললেন, “হঠাৎ?”
“এমনি একটা ব্রেক দরকার। না করো না, বাবা।”
কাদের সাহেব কিছু সময় ভেবে বললেন, “আচ্ছা।”
নাশতা করা শেষে কড়ি নিজের ঘরে বসে চা খাচ্ছিল। কাদের সাহেব এসে পাশে বসলেন। কড়ি বলল, “চা খাবে, বাবা? আনব?”
“নিয়ে আয়।”
কড়ি বেডসাইড টেবিলে নিজের আধ খাওয়া চা সহ কাপ নামিয়ে রেখে বাবার জন্য চা করে নিয়ে এল। কাদের সাহেব জানালা দিয়ে আকাশ দেখছিলেন। সেই ঘনিয়ে আসা কালো মেঘের আকাশের এক ফোকরে এক কাপ চা সহ একটা হাত উঁকি দিলো। কাদের সাহেব আকাশ দেখতে দেখতেই বললেন, “তুই খেয়েনে। আমার খাওয়া হয়ে গেছে।”
কড়ি বেড সাইড টেবিলে রেখে যাওয়া নিজের চায়ের কাপটায় চোখ দিলো। বাবা তার বাকি চাটুকু খেয়েছে নিয়েছেন। সে বাবার পাশে বিছানায় বসতে বসতে বলল, “নাও তুমি একটু খেয়ে দাও। তারপর আমি খাচ্ছি।”
কাদের সাহেব বললেন, “সিগারেটের গন্ধ করবে। তুই খেতে পারবি না।”
“করুক।”
“আমি সিগারেট ছেড়ে দিব।”
“যখন দিবে দিও। এখন চায়ে একটা চুমুক দাও।” কড়ির গলার স্বর কঠিন।
কাদের সাহেব চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে পুরো এককাপ ধুয়া উঠা গরম চা একটানে সাবাড় করে দিলো। পুড়া ঠোঁট আর জিহ্বা নিয়ে তিনি বললেন, “বললাম ত সিগারেট ছেড়ে দিব।”
কড়ি বলল, “হয়েছে আর মিথ্যে বলতে হবে না।”
“আমি কখনো মিথ্যে বলি না।”
“বাবা – মায়েরাই সবচেয়ে বেশি মিথ্যে বলে। আর ওদের মিথ্যেগুলো সত্য থেকেও বেশি সুন্দর আর আদর আদর।”
কাদের সাহেব মেয়ের দিকে ঘুরে বসলেন, “তুই আমায় কেমন মিথ্যে বলিস?”
“কেমন বলতে?” কড়ির ঠোঁট হাসি হাসি।
“কেমন বলতে বেশি না কম?”
“কম কম বলি। বেশি মিথ্যে বলি না।”
কাদের সাহেব মেয়ের একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলেন। অসহায় হয়ে বললেন, “সত্যি সত্যি বল ত সেদিন যে তুই একটা ছেলের কথা আমায় বলেছিলি ওটা কি মজার ছলে বলেছিলি নাকি আমি রেগে যাওয়ায় মজা বলে চালিয়েছিস?”
কড়ি ঠোঁটের কাছে হাত নিয়ে অভিনভ ভঙ্গিতে শব্দ করে হেসে উঠল। যেন কোনো শিশুর ঝুনঝুনির শব্দ। পুরো ঘরটাও তার হাসির শব্দের সাথে ঝনঝন করে উঠল। সে হাসতে হাসতেই বলল, “ওহ বাবা তুমিও না পারো। তোমার কী মনে হয় আমি সত্যি সত্যি প্রেম করলে তোমাকে এসে বলতে পারতাম? মেয়েরা বাবাকে এসব বলতে পারে? প্রেমটেম করি না বলেই মজা করে বলতে পেরেছিলাম।”
“এই ধরনের মজা আর কোনোদিন করবি না। আর কখনো না, নেভার।” কাদের সাহেব ক্রোধের গলায় বললেন এবং বলতেই থাকলেন। বলতে বলতে উঠে চলে গেলেন। কড়ি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। মেঘগুলো হালকা হয়ে পৃথিবীতে নেমে আসছে। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সাথে যোগ হলো ঘূর্ণি হাওয়া। কড়ি বিড়বিড় করে উঠল, “আমি কখনো মিথ্যে বলি না, বাবা। আমি শুধু কুৎসিত সত্যগুলো চাপা রাখি।” কড়ি কাঁদছে। বৃষ্টি এলেই সে কাঁদবে বলেছিল।
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে