একদিন কাঁদবে তুমিও পর্ব-১০+১১

0
631

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_১০
#Saji_Afroz

মা এর কথা শুনে গলাটা শুকিয়ে গেছে মানতাশার। সে আমতাআমতা করে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি ডেকেছ মানে?
-হু, আমি ডেকেছি ওকে।
-কিন্তু কেন?
-তোমার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে।
-বাবার সাথে!
-হু।

চিন্তার ভাজ পড়লো মানতাশার কপালে। কী হতে যাচ্ছে ভাবতেই মাথাটা ঘুরে আসছে তার।

মরিয়ম বেগম বললেন, নিজেকে অনেক চালাক মনে করো? গোপণে প্রেম করে বেড়াবে আর আমরা টের পাব না! এমনটা ভেবেছ?

এইবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এজাজের দিকে তাকালো মানতাশা। সে কী সব বলে দিয়েছে মরিয়ম বেগম কে!

তিনি আরও বললেন, ওর দিকেও ওভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। আজরার বিয়েতে আমি তোদের কথোপকথন শুনেছিলাম। তখনি বুঝেছি তোদের সম্পর্ক আছে। পরে অবশ্য শিওর হওয়ার জন্যে এজাজের সাথে কথা বলি। ও সবটা স্বীকার করে নেয়। আর একথা তোর বাবা কে জানাই। তোর বাবা এজাজের সাথে দেখা করতে চেয়েছে। তাই ডেকেছি ওকে।

এই বলে এজাজের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, বসো তুমি। তোমার আঙ্কেল কে ডেকে নিয়ে আসি।

এই বলে তিনি ভেতরের দিকে যান।
মানতাশা রাগে কটমট করতে করতে বলল, শান্তি হলো তো? বলেছিলাম মা আছে ওভাবে ঘুরঘুর করো না।
-আরে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। আমি তো ভয় পাচ্ছি না।
-বাবা যখন শুনবে তুমি বেকার তখন না করে দেবে। এরপর?

এইবার চিন্তায় ভ্রু কুচকে আসে এজাজের। মানতাশা আপনমনে বলল, এটাই যেন হয়! তার বাবা দিদার আলম যেন এজাজ কে কয়েকটা শক্ত কথা শুনিয়ে দেন। এতে করে মানতাশারও এজাজের সাথে সম্পর্কটা ছিন্ন করতে সহজ হবে!
.
.
.
অনেকক্ষণ রুমে একা একা বসে রয়েছে আজরা।
সেই ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে সে। নামাজ সেরে আবারও শুয়েছিল। কিন্তু চোখে আর ঘুম আসেনি।
বাসার জন্য বড্ড মন খারাপ তার। যদিও এই নিয়ে বেশ কয়েকবার ফোনে কথা বলা হয়েছে। সন্ধ্যায় তাদের দেখা পাবে আজরা।
তাই সে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। কখন যে সন্ধ্যে হবে!
-কিছু খাবেন ম্যাডাম?

বুয়ার ডাকে ঘড়ির দিক থেকে দৃষ্টি সরালো আজরা। জবাবে বলল, নাহ।
-কিছু লাগবে আপনার?
-বাড়ির সবাই কোথায় বলতে পারেন?
-আজকে রাতের আয়োজনে সবাই ব্যস্ত।
-ইনতিসারও?
-জি।

এই বলে সে চলে যায়।
বেশ ক্লান্ত লাগছে আজরার। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কেউ এসে নতুন বউ এভাবে শুয়ে আছে দেখলে কিছু মনে করবে না তো?
এসব ভেবে আর শোয়া হলো না আজরার।

স্টাডি রুমে পায়চারি করছে ইনতিসার। গতকালের ঘটনাটা কোনোমতেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না সে। এমন একটা জঘন্য কাজ সে কীভাবে করতে পারলো! এটা শুধু পাপ নয়, অন্যায়! আজরার সাথে করা অন্যায় এর জন্যে মনটা অস্থির হয়ে আছে তার।
কেন নাবীহা কে দেখার পর সবকিছু উলোটপালোট লাগছে তার কাছে! কী আছে ওর মাঝে? যার কারণে কালকের মতো বিশেষ রাতেও নিজের স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণবোধ করলো না ইনতিসার!
.
.
.
দিদার আলম এসে বসলেন এজাজের সামনে। পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো মানতাশা ও মরিয়ম বেগম।
এজাজ তাকে সালাম জানাতেই তিনি বললেন, মরিয়মের মুখে সবটা শুনেছি। এখন নাকি কিছু করো না তুমি? তা ফিউচার প্লান কী তোমার?
-কিছু করি না বলেই আপনাদের সামনে আসতে পারিনি আঙ্কেল। তবে আমার রেজাল্ট সব ভালো। আশাকরি ভালো একটা জব পেয়ে যাব। এরপরেই পরিবার নিয়ে আপনাদের সাথে দেখা করব। এমনটাই ভেবে রেখেছিলাম।
-বাসায় জানে ওর কথা?
-জানে।
-তবে একদিন আসতে বলো তাদের।

মানতাশা ও এজাজ দু’জনেই অবাক চোখে তাকালো দিদার আলমের দিকে। তিনি বললেন, একমাত্র মেয়ে আমার। ওর খুশিতেই আমার খুশি। তুমি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর বিয়ে সাদি করতে চাও সেটা অন্যকথা। এর আগে অন্তত আমরা দুই পরিবার দেখা সাক্ষাত করে নিই? আমারও দেখতে হবে, যে ঘরে মেয়েটা যাবে পরিবারের সদস্যরা কেমন!

একথা শুনে একগাল হেসে এজাজ বলল, অবশ্যই। আমি মা কে নিয়ে আসব।

এসব শুনে তিরিক্ষি হয়ে উঠলো মানতাশার মেজাজ। সম্পর্ক শেষ করার মুহুর্তে দুই পরিবার একত্রিত হতে চলেছে। এখন কীভাবে এসব থেকে নিজেকে সরাবে সে! সে তো এজাজ কে চায় না। চায় ইনতিসারের মতো কাউকে তার জীবনে। সেই স্বপ্ন কী স্বপ্নই থেকে যাবে!
.
.
.
-তুই আসবি না মানে? অবশ্যই আসবি। জহির কে নিয়ে চলে আসবি। আমি আর কোনো কথাই শুনতে চাই না।

আজরার কথা শুনে নাবীহা বলল, বিশ্বাস কর কাজ পড়ে গেছে।
-রাতে কীসের কাজ রে? আমি কোনো বাহানা শুনতে চাইনা।
-বোঝার চেষ্টা কর…
-কী বুঝব? কেন আসবি না তুই? ওহ আচ্ছা! ভাবছিস ইনতিসার আমাকে ফেলে তোর পেছনে ঘুরবে? এমন ছেলে ও নয়।
-কীসব বলছিস!
-তবে তুই কেন আসতে চাইছিস না বল আমায়?
না আসলে তো আমি এটাই ভাববো। আমার বর কে তুই অন্যসব পুরুষের সাথে গোলাতে পারিস না নাবীহা।

আজরার কথা শুনে নাবীহা বলল, এমন কিছু নয়। আর আজরার মতো বউ থাকতে উনি অন্যদিকে চোখ কীভাবে দিতে পারে! এই ভাবনা আমার মনেও আসেনি।
-তবে চলে আসিস। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আসা যাওয়া লেগে থাকতে হবে। আজ থেকেই শুরু হোক!

ফোন রেখে ওয়ারড্রব খুলে জামা বের করলো নাবীহা। আজরার জন্যে ও বাড়ি সে যাবে। তবে ইনতিসার তার দিকে নজর দেবে এমন কিছু সে ভাবেনি আর ভাবেওনা। শুধুমাত্র তার যাওয়াটা ইনতিসারের পরিবার কীভাবে দেখবে এটা নিয়েই ভাবছে সে!
এদিকে ইচ্ছে করে নাবীহা কে এসব শুনিয়েছে আজরা। নাহলে যে সে আসতো না ভালো করেই জানতো। একবার আসলে সংকোচ দূর হয়ে যাবে। বান্ধবীর বাসায় বান্ধবী আসবে না তা কী করে হয়! অতীত নিয়ে পড়ে থেকে বর্তমান সময় টাকে নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। আগেও তাদের মাঝে সম্পর্ক যেমন ছিল, এখনো তেমনই থাকবে এবং আজীবন তাই থাকবে। এই প্রত্যাশা করে আজরা।
এই ভেবে সন্ধ্যের জন্য তৈরী হতে শুরু করলো সে।
.
.
তৈরী হওয়া শেষে নিজেকে আয়নায় দেখতে ব্যস্ত আজরা। ইনতিসারের আগমনে পেছনে ঘুরে তাকায় সে। হালকা গোলাপি রঙের ভারী কাতান শাড়িটাতে বেশ মানিয়েছে আজরা কে। ইনতিসার তার দিকে এক নজর চোখ বুলিয়ে বলল, ভালো লাগছে তোমাকে।

মিষ্টি করে হেসে আজরা বলল, ধন্যবাদ। আপনি তৈরী হবেন না?
-হতে এলাম।

এই বলে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে যায় ইনতিসার। সে বেরিয়ে আসলে তাকে দেখে আজরাও বলল, আপনাকেও মানিয়েছে সাদা রঙটা।
-ধন্যবাদ।

এই বলে ঘড়ি হাতে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ইনতিসার। আজরা বলল, সারাদিন কী খুব বেশি ব্যস্ত ছিলেন? না মানে সকালের পর থেকে আর দেখাই পেলাম না আপনার।

মন মেজাজ যে খারাপ ছিল তা গোপন করে ইনতিসার বলল, হ্যাঁ একটু। কিছু খেয়েছ?
-জি।
-ওকে থাকো তবে। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে ফোন দিও।

এই বলে তাড়া দেখিয়ে আবারও বেরিয়ে যায় ইনতিসার।
সারাদিন একা রুমের মাঝে থাকতে থাকতে বিরক্ত আজরা। শাশুড়ী বেশ কয়েকবার আসলেও সময় দিতে পারেননি। আজ বাড়িতে কাজ আছে কিনা! খুব করে একটা ননদের অভাববোধ করছে আজরা। যদিও ইনতিসারের কাজিনরা রয়েছে। তবে আপন বোন নয় বলে হয়তো সবাই যে যার মতো থাকতে পছন্দ করছে। নাকি বড়ো ঘরের নিয়মই এমন!
এই ভেবে আবারও ঘড়ির দিকে তাকালো সে। বাড়ির মানুষজন, মানতাশা ও নাবীহা যে কখন আসবে!
.
.
.
সন্ধ্যায় আজরার বাড়ির সবাই তাদের আত্মীয় স্বজনের সাথে তার শ্বশুর বাড়িতে আসলো।
মানতাশা ও নাবীহাও এসেছে তাদের সঙ্গে।
ইনতিসারের পরিবার ছাদে স্টেজ সাজিয়েছে। যেখানে বসানো হয়েছে ইনতিসার ও আজরা কে।
এদিকে সবাই ছাদে চলে গেলেও মানতাশা গেল না। এই বাড়িতে প্রবেশ করেই চমকে উঠলো সে। এত বড়ো বাড়ি শুধু টিভি তেই দেখেছে সে সবসময়। আজ সরাসরি দেখে তার মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। পুরো বাড়ি সে ঘুরে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়। জিনিসপত্রও ঘেটেঘুটে দেখতে শুরু করে দিয়েছে সে।

হঠাৎ কারও ডাকে পেছনে ফিরে তাকায় মানতাশা। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা নিজেকে ইনতিসারের খালাতো বোন হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলল, তুমি কে?
-আমি আজরার বান্ধবী।
-ওহ! সবাই উপরে গেছে। তুমি যাওনি যে?
-ওয়াশরুম! ওয়াশরুম খুঁজছিলাম।

তিনি ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলেন মানতাশা কে। ওয়াশরুমে এসে আরও চমকে যায় মানতাশা।
এই এক ওয়াশরুমই তো তার রুমের চেয়েও বড়ো!
এসব দেখে আজরার রুম দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠে সে। ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই একজন বুয়াকে দেখতে পায় সে। এখানের সব কর্মীরাই একই রকম পোশাক পরিধান করেছে। এই পোশাকের কথা বলেই ইলারা জামান বলেছিলেন, কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তাদের বলতে।

মানতাশা বলল, আজরার রুমটা কোনদিকে?
-আপনি কে?

মানতাশা গম্ভীরমুখে বলল, আমি ওর বান্ধবী। যেন তেন বান্ধবী নয়! ক্লোজ ফ্রেন্ড।
বুঝো ক্লোজ ফ্রেন্ড মানে?
-ঘনিষ্ট বান্ধবী।

বাপ্রে! শিক্ষিত বুয়া! মনে মনে তা আওড়িয়ে আবারও রুম দেখাতে বলল সে। বুয়া রুম দেখিয়ে দিতেই সেখানে গেল মানতাশা।

আজরার রুম দেখে কিছুক্ষণ নীরব ভাবে তাকিয়ে রইলো মানতাশা। এরপর সারারুমে পায়চারি করে সে প্রতিটা জিনিস দেখতে লাগলো আর আপনমনে ভাবলো, কপাল নিয়ে জন্মেছে এই মেয়ে। নাহলে এই বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্যতা তার আছে! কী এমন করে সে? চেহারাও আহামরি না। কিন্তু ঠিকই কপালটা আহামরি হয়ে গেল। এসব ভেবে হিংসায় সারা শরীর জ্বলে উঠে মানতাশার।

-তুই এখানে?

পেছনে ফিরে এক ঝাক বান্ধবীর দল কে দেখে মানতাশা আমতাআমতা করে বলল, ওয়াশরুম ইউজ করতে এসেছি।

তারানা বলল, ওদিকে যে আজরা তোকে খুঁজছে? দেখা করে আসবি না? তোকে খুঁজতে আসলাম আমরা।
-ওয়াশরুম তো বলে কয়ে আসেনা! সেরে যাব ভেবেছিলাম।

সকলে রুমে প্রবেশ করে। সবাই অবাক হয়ে চারপাশ দেখতে থাকে। আজরার কপাল নিয়ে একেকজন একেক কথা বলছে।

মাইমুনা বলল, আসলে আজরার কপালের সাথে সাথে ইনতিসারের কথাও বলতে হয়। সে চাইলেই সুন্দরী কাউকে বিয়ে করতে পারতো। কিন্তু সে খুঁজেছে সুন্দর মন।

তার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে মানতাশা বলল, মন কী দেখা যায়? আসলে তার মা চায়নি কোনো সুন্দরী মেয়ে এই বাড়িতে এসে রাজত্ব করুক। শুনিসনি? মা এর পছন্দে বিয়ে করেছে সে।
-উনি এমনটা কেন চায়বে?
-অনেক মা আছে এমন। ছেলের বউ এর রাজত্ব মেনে নিতে পারে না। বিচ্ছিরি মেয়ে এনে দাবিয়ে রাখতে চায়।
-আজরা কী বাজে নাকি?
-উহু! আহামরি সুন্দরীও তো না! এখন কোনো সুন্দরী মেয়ে ইনতিসারের আশেপাশে ঘুরঘুর করুক! আজরা কে ছেড়ে দেবে নিমিষেই।

তাদের মধ্যে এক বান্ধবী ছিল মানতাশার স্বভাবের। যার নাম হাসনা। সে মানতাশার কথা শুনে হেসে বলল, আমারও তাই মনে হয়।

কিন্তু অন্যরা এতে সহমত পোষণ না করলে হাসনা বলল, এখন কী তোদের প্রমাণ করে দেখাতে হবে? তারপর বিশ্বাস করবি তো?

মাইমুনা বলল, কেমন প্রমাণ?
-এই যে ইনতিসার সুন্দরী মেয়ে পেলে পটে যাবে।
-কীভাবে প্রমাণ করবি?
-আগে বল বাজি হয়ে যাক দুই টিম নিয়ে? মানতাশা ও আমি একদিকে। তোরা আরেকদিকে।

সবাই রাজি হলে হাসনা বলল, আমাদের মানতাশা পটাবে ইনতিসার কে। যদি পটে যায় তবে বাজিতে আমরা জিতব। না পটলে তোরা!

তারানা বলল, কিন্তু এসব আজরা জানলে?
-আজরা বা নাবীহা কেউই জানবে না।

একথা শুনে ভ্রু কুচকে মানতাশা বলল, ও হ্যালো? অন্যের হাসবেন্ড কে আমি কেন পটাবো!

হাসনা হেসে বলল, জাস্ট বাজিতে জেতার জন্য।
-নো ওয়ে! ওকে পটিয়ে সময় নষ্ট করতে চাইনা আমি।
-তাই? নাকি নিজের উপরে ভরসা নেই তোর? তোরা চাইলে কাজটা আমিই করছি। মানতাশার প্রেমে পড়বে না বলে সে আগে থেকেই ভেগে যাচ্ছে।

এই বলে হেসে উঠলো হাসনা। মানতাশা তা শুনে একপ্রকার জেদ থেকেই বলল, মোটেও না! এটা আমার জন্য কোনো ব্যাপারই না।
-তবে করে দেখা?

একটু ভেবে মানতাশা বলল, দেখাব। ইনতিসার কে যদি নাকে দঁড়ি দিয়ে না ঘুরাই তবে আমার নামও মানতাশা নয়!

এই বলে সে রুম থেকে বেরিয়ে ছাদের দিকে এগুই। মাইমুনার কপালে চিন্তার ভাজ দেখে তারানা বলল, কী ভাবছিস?
-ভাবছি সত্যি যদি ইনতিসার পটে গিয়ে মানতাশার প্রেমে হাবুডুবু খায়? তখন কী হবে?

এদিকে আপনমনে হেসে চলেছে হাসনা। সে তো এটাই চেয়েছিল! এই তিন বান্ধবীর জন্য তার জীবন থেকে সরে গিয়েছিল ভালোবাসার মানুষটি। সেই থেকে তাদের উপরে ক্ষোভ রয়েছে হাসনার। তাই সে তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চায়। আর আজ সে মানতাশার মাথায় এসব ইচ্ছে করেই ঢুকিয়েছে। মানতাশার স্বভাব সে জানে। ইনতিসার যদি একবার তার প্রেমে পড়ে তবে সে যে নিজেকে এই বিলাসবহুল জীবন থেকে সরাতে পারবে না জানে সে। আর তখনি তার ও আজরার মধ্যে হবে ঝামেলা। আগে তো এদের আলাদা করুক। নাবীহা কেও দেখে নেবে সে!
.
চলবে

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_১১
#Saji_Afroz

আজরার সাথে স্টেজে বসে রয়েছে নাবীহা। ইনতিসার কিছুক্ষণ ছিল। কিন্তু এখন নেই। কয়েকটা ছবি তুলেই সে স্টেজ থেকে নিচে নেমে যায়। মেহমানদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত সে।
আজরা বলল, এই মানতাশা টা গেল কোথায়?
-আছে হয়তো কোথাও!

নাবীহা ও আজরা কথা বলছে। ইনতিসারের দৃষ্টি না চাইতেও বারবার সেদিকে যাচ্ছে। তবে আজরার জন্য নয়। নাবীহার জন্য।
নিজের এরূপ কাণ্ডে নিজের উপরেই বিরক্ত ইনতিসার। সে ছাদ থেকেই নেমে যাচ্ছে। এখানে থাকলে নাবীহা কে দেখে আরও অস্থির হয়ে উঠবে তার মনটা।
তাড়াহুড়োয় সিঁড়ি বেয়ে নামার পথে মানতাশার সাথে ধাক্কা লাগে তার।
ইনতিসার ব্যস্ত হয়ে বলল, দুঃখিত।

তাকে দেখে বান্ধবীদের দেওয়া বাজির কথা মনে পড়ে মানতাশার। নিজের চুল গুলো ঠিক করতে করতে বলল সে, আপনি ঠিক আছেন তো?
-জি।

আর কোনো কথা না বলে ইনতিসার স্টাডি রুমে চলে যায়। তার পথের দিকে চেয়ে রয়েছে মানতাশা।
এই লোকটি কে তার বশে আনতে হবে। কিন্তু বিবাহিত একজনের সাথে এসব করতে কেমন যেন লাগছে তার। আবার না করলেও বাজিতে হেরে যাবে। একদিকে এজাজ কে কীভাবে সরাবে সেই চিন্তা। আবার এদিকে যুক্ত হলো নতুন চিন্তা। তা হলো ইনতিসার কে কীভাবে বশে আনবে!
উফফ! চিন্তায় চিন্তায় মাথাটাই হয়তো ফেটে যাবে তার।

এই ভেবে ছাদে উঠতে লাগলো মানতাশা। উঠে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেল সে। তাকে দেখে আজরা কাছে ডাকলো। মানতাশা এসে পাশে বসতে বসতে বলল, ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম।
-ও আচ্ছা!
-হ্যাঁ রে আজরা, তোর বাড়িটা এত সুন্দর! রুমটাও দারুণ। সব রুমই কী এত সুন্দর?

আজরা হেসে বলল, আমি নিজেও এখনো পুরো বাড়ি ঘুরে দেখিনি।
-কী বলছিস?
-হু। দেখব আরকি। আমারই তো বাড়ি। এখনো নতুন বউ। ওভাবে ছুটাছুটি করলে কেমন দেখায় না?
-উনারা তোকে দেখতে বলেনি?
-ব্যস্ত ছিল বউ ভাতের আয়োজনে।

একটু থেমে মানতাশা দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে বলল, গতকাল কী করলি? বল বল?
-কী করলাম মানে?

নাবীহার দিকে তাকিয়ে মানতাশা বলল, শোনো মেয়ের কথা? কী করলো মানে বুঝছে না!

মানতাশার কথা শুনে নাবীহাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেল। সে বলল, থাক না ওসব কথা এখন।
-কেন থাকবে? এই আজরা বল না কী হলো? বাসর রাতে কী কী হলো?

আফসোরের সুরে আজরা বলল, হতে হতেও হয়নি রে।
-মানে?
-মানে শুরু তো করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ থেমে গেলেন তিনি।
-কী বলছিস?
-হু।
-থেমে গেল কেন?
-বললেন মাত্রই বিয়ে হয়েছে। আগে দু’জন দু’জন কে সময় দিই। ওভাবে হুট করে শুরু করা তার উচিত হয়নি।
-তুই কিছু বললি না?
-কী বলব?
-আরে তুই যে সেটাই কিছু মনে করিস নি?
-বলেছি। তবে যে আমার ভালো লাগছিল ওসব বলতে পারিনি। কেমন দেখায় না!

মাথায় হাত দিয়ে মানতাশা বলল, তুইও না! আর ইনতিসার ওমন আচরণ করলো কেন! বাসর রাতে বুঝি সবাই গল্পই করে শুধু? বাসর করে না? আমার তো মনে হচ্ছে অন্য কারণ।
-কী?
-হয়তো তার মন অন্য ভাবনায় চলে গিয়েছিল তখন।

এই বলে সে আড়চোখে তাকালো নাবীহার দিকে। মানতাশা কী বোঝাতে চাচ্ছে তা বুঝতে পেরে নাবীহা বলল, কী যে বলিস না তুই! প্রথম দিনেই সব হতে হবে কেন? সারাজীবন পড়ে আছে এসব করার জন্যে।
-শুরু তো করেছিল। মাঝপথে থামলো কেন এটাই ভাবার বিষয়।
-কী ভাবার আছে এতে!
-ওই সময় তার এমন কী ভাবনা এলো যে ওমন একটা বিশেষ মুহুর্তে নিজেকে কন্ট্রোল করে ফেললো?

এইবার চিন্তার ভাজ পড়ে আজরার কপালে।
সেই মুহুর্তটার কথা ভাবলে গা শিউরে উঠে তার। মনে হয়েছিল যেন সুখের বন্যায় ভেসে যাচ্ছিলো সে। অন্য কিছুই তার মাথায় ছিল না। শুধু মনে হচ্ছিলো আরও গভীরে হারিয়ে যেতে চায় সে। মিশে যেতে চায় ইনতিসারের সাথে। ইনতিসারেরও কী এমনটা মনে হয়নি? হলে নিজেকে সামলে নিলো সে কীভাবে!

আজরা কে নিশ্চুপ দেখে নাবীহা বলল, দেখ আজরা! তোদের পারিবারিক ভাবে বিয়েটা হয়েছে। উনি হয়তো দ্বিধা নিয়ে শুরু করলেও কন্টিনিউ করতে পারেনি তুই কী ভাবছিস মনে করে।

নাবীহার কথা শুনে নিজের মন কে শান্তনা দিয়ে আজরা বলল, আমিও এটাই ভেবেছি।
-এটাই হবে। এসব কথা ছাড় তো।

এরমধ্যে একজন বয়স্ক মহিলা এসে বলল, বান্ধবীদের সময় দিলেই হবে! আমাদেরও নতুন বউ এর মুখ দেখার সুযোগ দিতে হবে তো!

এই বলে তিনি আজরার দিকে এগিয়ে আসলেন। তাকে দেখে বললেন, সে কী! নতুন বউ এর নাকে নাক ফুল নেই কেন?
আজরা আমতাআমতা করে বলল, আসলে আমার পরার অভ্যেস নেই তো। ভুলে গিয়েছিলাম।
-মানুষ জন কী ভাববে! পরে নাও পরে নাও।

নাবীহা বলল, কোথায় রেখেছিস? আমি নিয়ে আসি।
-ড্রেসিং টেবিলের প্রথম ড্রয়ারেই একটা ছোট বাক্সে পাবি। কাউকে জিজ্ঞাসা করলে দেখিয়ে দেবে আমার রুম।
-আচ্ছা।

এই বলে নাবীহা নেমে যায়। হাসনা রাও চলে এসেছে। নাবীহা তাদের দেখে দাঁড়ালো। তারা আজরার বাড়ি সম্পর্কে বলতে শুরু করে। নাক ফুল আনতে যাচ্ছে শুনে একজন বলল, সেই সুযোগে আজরার রুমটাও দেখে আয়। অনেক সুন্দর!

কথাটা কেমন যেন লাগলো নাবীহার কাছে। সে বলল, ওর রুমে যেতে আমার সুযোগের অপেক্ষা কেন করতে হবে? যখন খুশিই যেতে পারি।
-না আমি কথার কথা বললাম।

এই বলে কথা ঘুরিয়ে মেয়েটি অন্য কথা বলতে শুরু করে।
.
.
.
-মনের ভেতরে থাকা সমস্ত ভাবনা একপাশে রেখে এখন শুধু এটা ভাব যে, তোর স্ত্রী রয়েছে। ওর সাথে সময় কাটা। সুন্দর কিছু মুহুর্ত তৈরী কর। দেখবি আর কোনো ভাবনা আসছে না তোর মনে। এভাবে নাবীহা কে ভাবতে থাকলে তো আজরার প্রতি কোনো টান তুই অনুভব করবি না! মেয়েটার কথা ভাব একবার! সে কিন্তু তোকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছে। তোরও উচিত নিজেকে ও তাকে একটা সুযোগ দেওয়া।

বন্ধু আসমলের কথা শুনে যেন সাহস পেল ইনতিসার। একমাত্র তাকে মনের সব কথা বলে শান্তি পায় সে। আর সেও তাকে সবসময় ভালো পরামর্শ দেয়।
আসমলের কথা শুনে সে বলল, আমি চেষ্টা করব।
-এখন থেকেই কর?
-মানে?
-মানে উপরে যা। বউ এর সাথে সময় কাটা। একগাল হেসে ইনতিসার ছুটে যায় ছাদের দিকে।
.
.
বান্ধবী দের সাথে কথা শেষে নিচে নেমে আসে নাবীহা। একজন কর্মচারীর কাছে আজরার রুম কোন দিকে তা জানতে চায় সে। সে রুম দেখিয়ে দিলে নাবীহা সেখানে প্রবেশ করে। যদিও এর আগে কাউকে না পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করতে হয়েছিল তাকে।
আজরার বিশাল রুম দেখে তাকেও এক নজর চোখ বুলাতে হলো। পরিপাটি রুমটাতে বিছানার পেছনের দেয়ালে ইনতিসারের একটি বড়ো ছবি টাঙানো রয়েছে। ক’দিন বাদে হয়তো এই ছবিটি সরিয়ে আজরার সাথে তোলা কোনো ছবি টাঙানো হবে।
এই ভেবে সে রুমের ভেতরে প্রবেশ করলো। আজরার কথা মতো ড্রেসিংটেবিল এর প্রথম ড্রয়ারে নাক ফুল খুঁজতে শুরু করলো সে। এবং খুব তাড়াতাড়ি পেয়েও যায়।
নাবীহার ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন। এসেছে যখন আজরার ওয়াশরুম ব্যবহার করা যাক। এই ভেবে সে প্রবেশ করে ওয়াশরুমে।
.
.
.
ছাদের দরজা অবধি এসে থেমে যায় ইনতিসার। স্টেজে আজরা কে দেখে না। পাশেই তার একজন বান্ধবী দাঁড়িয়ে আছে। ইনতিসার তার কাছে আজরা কোথায় জানতে চায়।

জবাবে সে বলল, স্টেজ থেকে তো নিচে নামবে বলে নেমেছিল। হয়তো রুমে গেছে!

একথা শুনে ইনতিসার আবারো নিচে থামতে থাকে।
রুমে এসে আজরা কে পায় না সে। তবে ওয়াশরুমের ভেতর থেকে পানির শব্দ শুনে বুঝলো, আজরা ভেতরে আছে।
কালকের বিষয়টির জন্য অনুতপ্ত ইনতিসার। আজ থেকে সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে আজরাতেই আঁটকে থাকতে চায়। নাবীহার উপস্থিতির মাধ্যমেই শুরুটা হোক। কেন তার উপস্থিতি ইনতিসারের মন কে অশান্ত করবে! তার মন শান্ত হয়ে থাকতে চায় আজরার ভালোবাসা পাওয়ার মাধ্যমে। সবাই উপরে আছে। এই সুযোগে আজরা কে নিজের বাহুডোরে নিয়ে সবকিছু ভুলে নতুন এক শুরুর পথে চলতে চায় ইনতিসার।
এই ভেবে রুমের লাইট বন্ধ করে দেয় সে। ওয়াশরুমের পাশে এসে অপেক্ষা করতে থাকে আজরার জন্য।

এদিকে নাবীহা ফ্রেশ হয়ে নিজের জামা-কাপড় ও চুল ঠিক করে ওয়াশরুমের দরজাটা খুললো। সে কী! রুম এত অন্ধকার কেন? এটা ভেবে ওয়াশরুমের বাইরে এক পা রাখতেই নিজের হাতে টান অনুভব করে নাবীহা। কিছু বুঝে উঠার আগেই কারও বুকের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করলো সে। নাবীহার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হওয়ার আগে ইনতিসার তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ভয় পেওনা! আমি…

ইনতিসারের কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলো নাবীহা। সে কী ইচ্ছে করেই এমনটা করেছে নাকি তাকে আজরা ভেবেছে?

এদিকে আজরাও রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে স্টেজ থেকে নেমেছিল। ভেবেছে নাবীহার যদি রুম খুঁজতে অসুবিধে হয়?
কিন্তু নিচে নামার পর ইনতিসারের এক আত্মীয়া তাকে একপাশে নিয়ে যায় ছবি তোলার জন্য। যার কারণে ইনতিসার এসে তাকে স্টেজে পায়নি।
ছবি তোলা শেষে মানতাশা কে সাথে নিয়ে নিচে নামতে থাকে আজরা। এতক্ষণেও নাবীহা আসেনি মানে রুম খুঁজতে হয়তো অসুবিধে হচ্ছে তার। এই ভেবে আজরা দ্রুত হাঁটতে বলল মানতাশা কে। মানতাশা ভাবছে অন্য কথা। রুম খুঁজে না পেলে ফোন করে জিজ্ঞাসা করতো বা মানতাশা তাকে ফোন দিয়েছিল তা রিসিভ করতো। গেল কোথায় এই মেয়ে? তার মতো ওয়াশরুমে যায়নি তো? যেতেই পারে। এই আজরা অহেতুক এত দুশ্চিন্তা করে।
এই ভারী পোশাক নিয়ে নিচে নামতে হচ্ছে বলে আজরার প্রতি বিরক্ত মানতাশা।
.
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে