একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব-০৭

0
1244

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৭
ইশি চুপচাপ বসে আছে সোফায়।ওর সামনেই গম্ভীরমুখে অর্থ বসে আছে।ইশি এইবার মিনমিন কন্ঠে বলে,’ কিছু দরকার ছিলো ভাইয়া?আমাকে ডেকে পাঠালেন যে?’

অর্থ নড়েচড়ে বসলো।নিজেকে খানিকটা সামলালো।এইভাবে কোন কারো লাইফ নিয়ে ঘাটাঘাটি করা তার মোটেও ভালো লাগে না।তবে আজ কেমন যেন ও নিজের কৌতুহল দমাতে পারছে না।প্রাহির ওই জয়কে এতোটা ভয় পাওয়ার কারন জানার জন্যে ওর মন মস্তিষ্ক দুটোই অস্থির হয়ে উঠেছে।অর্থ প্রশ্ন করে ফেললো, ‘ আমাকে সব বলবে তুমি।প্রাহি কেন এতোটা ভয় পাচ্ছিলেন উনার কাজিনকে দেখে?আই নিড ইচ এন্ড এভ্রি ডিটেইলস ওফ দ্যাট!’

ইশি শুকনো ঢোক গিললো। গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসছে।সামনের টি-টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ঢোকঢোক করে খেয়ে ফেললো।এখন একটু ভালো লাগছে।আস্তে আস্তে বলা শুরু করলো ইশি, ‘ প্রাহি আমি হেমন্ত সবে মাত্র কলেজে উঠেছি।একদিন প্রাহির আব্বু মানে আঙ্কেলকে জানান উনাকে মিশনে যেতে হবে।তাও পুরো একবছরের জন্যে।আঙ্কেল আবার আর্মি ছিলেন।আঙ্কেল প্রাহিকে আর আন্টিকে একা এতো বড় বাড়িতে রেখে যাবেন এটা নিয়ে চিন্তায় ছিলেন।তাই তিনি সিদ্ধান্ত ছিলেন প্রাহি আর আন্টিকে তার বাবার বাড়ি রেখে আসবেন।এতে আর আন্টি আর প্রাহিকে আর এতোটা খারাপ লাগবে না।অবশ্য তখন প্রাহির নানুভাই বেঁচে ছিলেন।তাই তারাও রাজি হয়ে যায়।এটাই ছিলো আঙ্কেলের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত।প্রথম ৬ মাস ভালোই কাটছিলো।হঠাৎ একদিন প্রাহির কাজিন মানে ওর মামাতো ভাই জয় বিদেশ থেকে আসে।প্রাহির সাথে কেমন যেন অন্যরকম আঁচরন করতো।প্রাহি প্রায় আমাকে আর হেমন্তকে বলতো যে জয় ওর দিকে কেমন যেন বাজে দৃষ্টিতে তাকায় আবার মাজে মাজে ওকে বাজেভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করে।হেমন্ত তো একদিন রেগেমেগে জয়কে মারার জন্যে যেতে চাচ্ছিলো।প্রাহি ওকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে থামায় যে আর মাত্র কয়েকটা দিন তারপর তো আঙ্কেল এসেই পরবেন। একদিন হঠাৎ জানতে পারলাম প্রাহিকে হোস্পটিলাইজ্ড করানো হয়েছে।আমি প্রায় ছুটে যাই প্রাহির কাছে।ওর জ্ঞান ফিরতেই আমাদের সবকিছু খুলে বলে ও।সেদিক নাকি ওর মা আর মামি সোপিংয়ে গিয়েছিলেন।আর প্রাহির মামা তো কাজে থাকেন।বাকি থাকে প্রাহির নানুভাই তিনি প্রায় শয্যাশায়ী মানুষ।অসুস্থ থাকেন প্রায় বারো মাসকাল।জা*নোয়ারটা সেই সুযোগটা লুফে নেয়।একলা ঘরে প্রাহির সাথে জোড়জবরদস্তি শুরু করে প্রাহি চিৎকার করাতে প্রাহির গায়ের ওড়না কেরে নিয়ে ওর মুখ বেধে দেয়।বিছানার চাদর দিয়ে ওর হাতপা বেধে দেয়।সেদিনই হেমন্ত প্রাহির থেকে কেমিস্ট্রি সাবজেক্টের নোট্স নিতে এসেছিলো।অনেকক্ষণ কলিংবেল বাজাচ্ছিলো কিন্তু কেউ দরজা খুলছিলো না। উপায় না পেয়ে দারোয়ানকে বললো এক্সট্রা চাবি দিয়ে গেট খুলে দিতে।দারোয়ান যেহেতু হেমন্তকে চিনে তাই আর বেশি দ্বিমত করলো নি।বাড়ির ভীতরে ডুকে হেমন্ত সারাবাড়ি খুজেও প্রাহিকে পাচ্ছিলো না।অবশেষে গেস্টরুমের কাছ থেকে যেতে নিতেই।কেমন যেন শব্দ পায় হেমন্ত।দরজা ঠেলে ঢুকতে নিলে দেখে দরজা বন্ধ।হেমন্ত আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দরজা ভেঙ্গে ভীতরে ঢুকে দেখে যা দেখে তা তো বুঝতেই পারছেন।হেমন্ত সাথে সাথে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করে জয়কে।জয় যখন জ্ঞানশূন্য হয়ে পরে। ওকে ছেড়ে প্রাহির কাছে যায় হেমন্ত।প্রাহির অবস্থা দেখে কেঁদে দেয় হেমন্ত।প্রাহির হাতপা খুলে দিয়ে চাদর দিয়ে ওকে ঘুরে দেয়।অল্পর জন্যে প্রাহি সেদিন বেঁচে যায়।হেমন্ত ওকে নিয়ে সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যায়।সবাইকে ফোন করে জানিয়ে দেয় সবটা। আঙ্কেলকে সবটা বলাতে তিনিও সব ফেলে সেদিনই ছুটে চলে আসেন।জয়কেও ওর বাবা হাস্পাতালে ভর্তি করেন।এতো কিছুর পরেও জয়ের বাবা মা নিজের ছেলের কুকির্তী মেনে নেওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেন না। তাদের ভাষ্যমতে প্রাহিই নাকি তাদের ছেলেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এসব করার জন্যে আহ্বান করেছে।আর জয় ছেলে মানুষ একটু তো বেসামাল হবেই।প্রাহির নানুভাই প্রিয় নাতনির এই অবস্থা মেনে নিতে পারেননি।জয়কে সবাই পুলিশে দিতে চায়।হেমন্ত তো বার বার জয়কে মারার জন্যে যেতে চাচ্ছিলো। আমরা অনেক কষ্টে সামলিয়েছিলাম।প্রাহির মামা মামি পায়ে ধরে বলেন ওনার ছেলেকে যেন জেলে না দেয়।উনাদের কুমিরের কান্না দেখে মেনে নেয় সবাই। কিন্তু প্রাহির নানুভাই তৎক্ষনাৎ প্রাহির মামা, মামি আর জয়কে তেজ্য করে দেন। এমন একটা ঘটনা প্রাহির নানুভাই কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি।কিছুদিন পর তিনি মারা যান।এটা যেন প্রাহিকে আরো ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়।একে সেই ঘটনা আবার ওর নানুভাই মারা যায়।এতে অনেক বড় একটা শক খায় প্রাহি। তিনমাস নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখে।আমি আর হেমন্ত অনেক চেষ্টা করে ওকে সুস্থ করেছি।কতো যে পাগলামি করতো।অনেক কষ্টে আবার ওকে আগের মতো করতে সফল হয়েছি আমরা।সেই থেকেই ও জয়ের নাম শুনলেই ভয়ে অস্থির হয়ে যায়।’

একনাগাড়ে সব বলে দম নিলো ইশি। এদিকে সবটা শুনে অর্থ’র সারাশরীর থরথর করে কাঁপছে।রাগে চোখ লাল হয়ে আছে ওর।হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টা করছে।ইশি অর্থ’র দিকে তাকালো।অর্থ’র এমন ভয়ংকর রূপ দেখে ভয় পেলো।মিনমিনে কন্ঠে বলে, ‘ ভাইয়া আমি প্রাহির কাছে যাই।’

ইশির কথায় কোনরূপ প্রক্রিয়া করলো না অর্থ।ইশি নিজেও আর কিছু না বলে উঠে চলে যায়।এখন ওর বোধহয় একটু হেমন্ত’র কাছে যাওয়া উচিত।ছেলেটা না জানি কি করছে।রাগ উঠলে তো আবার এই ছেলের হুশ থাকে না।

এদিকে অর্থ নিজের মোবাইলে কারো নাম্বার ডায়াল করে ফোন লাগালো। ফোন রিসিভ হতেই গম্ভীর গলায় বললো, ‘ আই এম সেন্ডিং আ পারসোন্স নেম এন্ড পিকচার।আই ওয়ান্ট ওল হিস ডিটেইলস। এন্ড ব্রিং হিম ফ্রোম হোয়ারএভার ইউ ক্যান।গোট ইট?’

ফোন রেখে আজকের পার্টির সিসিটিভি ফুটেজ থেকে জয়ের ছবি নিয়ে সেন্ড করে দিলো।তারপ উঠে চলে গেলো। এখন গিয়ে প্রাহিকে দেখে আসতে হবে।মেয়েটার অবস্থা কেমন কে জানে?মনটা কেমন যেন অস্থির হয়ে আছে।

————-
মায়ের বুকের সাথে লেপ্টে আছে প্রাহি।চেহারাটা কেমন মলিন আর শুকিয়ে আছে। চোখজোড়া কান্নার কারনে ফুলে ঢোল হয়ে আছে।ঠোঁটজোড়াও হালকা ফুলে আছে।চুলগুলো এলোমেলো।তারপরেও যেন মেয়েটার চেহারায় এক সমুদ্র সমান মায়া জড়িয়ে আছে।অর্থ তাকিয়ে আছে প্রাহির দিকে।মেয়েটাকে একবার দেখা শুরু করলো আর চোখ সরানো যায়না। এরশাদ সাহেবের কথায় প্রাহির থেকে চোখ সরায় অর্থ।

‘ আমরা এখন বিদায় নিতে চাচ্ছি মিষ্টার শিকদার।’

হিয়াজ সিকদার বললেন, ‘ আজ থেকে যান মিষ্টার রহমান।’

‘ না মনে দুঃখ নিয়েন না প্লিজ।আমাদের আজ যেতে হবে।বিদায় দিন আমাকে।’

এরশাদ সাহেবের করুন কন্ঠ শুনে কেউ আর জোড় করলেন না উনাদের।

প্রাহি উঠে দাড়াতে নিতেই মাথা ঘুরে পরে যেতে নেয়।অর্থ দ্রুত পায়ে এসে প্রাহিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে সামলে নেয়। এদিকে অর্থ’র স্পর্শ পেয়ে সারা শরীর ঝংকার দিয়ে উঠে।থরথর করে কেঁপে উঠে সারা দেহ।অর্থ নরম কন্ঠে বলে, ‘ ঠিক আছেন আপনি?’

প্রাহি দূর্বল চোখে তাকালো অর্থ’র দিকে।আস্তে করে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো ঠিক আছে।অধীক উত্তেজনায় মুখ দিয়ে কথাও বের হচ্ছে না ওর। এরশাদ সাহেব আর রাবেয়া এগিয়ে এসে মেয়েকে আগলে নিলেন।বাড়ির সবাই উনাদের বিদায় জানালেন।সবার থেকে বিদায় নিয়ে প্রাহিরা রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। ইশিও চলে যায় উনাদের সাথে।

—————–
ঘটনার চক্করে ডিনার করা হয়নি শিকদার বাড়ির কারোরই। সবাই ডিনার করতে বসেছে।হেমন্তকে অনেক ডাকা হয়েছে কিন্তু ও জানিয়ে দিয়েছে যে ও খাবে না।তাই আর বেশি কেউ জোড় করেনি।হেমন্ত ক্ষিদে সহ্য করতে পারে না।ক্ষিদে লাগলে নিজে এসেই খেয়ে নিবে।সবাই যখন খাওয়ায় ব্যস্ত তখন হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে আসে হেমন্ত। অনেকটা ব্বিধস্ত দেখাচ্ছে ওকে।হেমন্তকে এই অবস্থায় দেখে অর্থ জিজ্ঞেস করে,’ হেমন্ত হোয়াট হ্যাপেন্ড?এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে।’

হেমন্ত যা বললো তা শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিলো না কেউই।শিকদার বাড়ির প্রতিটা সদস্য স্তব্ধ হয়ে আছে শুনে।হেমন্ত বলেছে, ‘ প্রা..প্রাহি! প্রাহিদের গাড়ি নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে।ওদের সবাইকে হাস্পাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।সবাই আইসিইউ তে ভর্তি।জলদি যেতে হবে আমাকে।আমি আসি ভাইয়া।’

হেমন্ত আর কাউকে কিছু না বলে।দ্রুত পায়ে চলে যায় বাড়ি থেকে।এদিকে বাড়ির সবাই খাবার রেখে তারাও রওনা হয় হাস্পতালের উদ্দেশ্যে।অর্থ’র বুকটা ধরাসধরাস করছে।হাতপা মৃদ্যু কাঁপছে।একটু আগেও মেয়েটাকে বুকে নিয়েছিলো অর্থ।অদ্ভূত ভালোলাগা কাজ করছিলো মনে।আর এখন এই খবর শুনতে হলো ওকে। এ কেমন ভাগ্যের পরিহাস।অর্থ’র গাড়ির স্পিড আরো বাড়িয়ে দিলো।যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব হাস্পাতালে পৌছাতে হবে। সবাই যেন ভালো থাকে মনে প্রানে তা প্রার্থনা করলো।

#চলবে__________

ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে