একটি প্রেমাচ্ছন্ন বিকেল পর্ব-০১

0
5629

#একটি_প্রেমাচ্ছন্ন_বিকেল
#পর্বঃ০১
#Arshi_Ayat

পিঠ উন্মুক্ত করে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মৌপ্রিয়া।রক্তে পিঠ লাল হয়ে আছে।ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে ও।প্রচন্ড মারের চোটে শরীরের বেহাল দশা।ব্যাথায় দাত মুখ খিচিয়ে আসছে প্রায়।হঠাৎ পিছনে কেউ গরম কিছু একটা ছোয়াতেই মৌপ্রিয়া ব্যাথায় গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো।কান্নাকন্ঠে বলল,’আল্লাহ গো পুড়ে গেলো।উফফ!জ্বলে গেলো।’

মাহমুদা বেগম বাম হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন,’মৌ মা একটু ধৈর্য ধর তোর পিঠের রক্তগুলো পরিস্কার করে দেই।’

মৌপ্রিয়া দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।একটু আগে মাহমুদা বেগমের স্বামী বলতে গেলে মৌ এর সৎ বাবা লতিফ উদ্দিন প্যান্টের বেল্ট দিয়ে পিটিয়েছন।অপরাধ হলো ভুলবশত মৌ বসার ঘরে মেহমানদের সামনে চলে গিয়েছিলো।

মাহমুদ বেগম আস্তে আস্তে মেয়ের পিঠে স্যাভলন লাগাচ্ছেন।কাটা জায়গায় স্যাভলন লাগতেই জ্বলে যাচ্ছে।বুক ফেটে চিৎকার আসছে কিন্তু চিৎকার করলে আবার মার খেতে হবে।পুরো পিঠের রক্ত পরিস্কার করে মাহমুদা বেগম ব্যাথা নাশক ঔষধ লাগিয়ে দিলেন।কাঁদতে কাঁদতে মৌ ঘুমিয়ে গেছে।মাহমুদা বেগম মমতাভরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন।এটা নিত্যকার কাহিনী।প্রতিদিনই ওকে মার খেতে হয়।আপন মা হয়েও মাহমুদা বেগম মেয়ের জন্য কিছু করতে পারে না।এতোটাই অসহায় তিনি!
মৌপ্রিয়ার যখন পাঁচবছর তখন ওর বাবা ক্যান্সারে মারা যায়।মাহমুদা বেগম চেয়েছিলেন আর বিয়ে করবেন না।একমাত্র মেয়েকে নিয়ে জীবন পার করবেন।কিন্তু তার চাওয়া পূরণ হলো না।তিনমাসের মাথায় ভাইদের জোরাজোরি তে বিয়ে তে রাজি হতে হয়।যেহেতু বাবা মা নেই সেহেতু ভাইদের কথাই মানতে হয়।বিয়ের সময় কথা হয় মৌপ্রিয়াও মায়ের সাথে থাকবে।প্রথমে এই শর্ত শ্বশুর বাড়ির লোকেরা মেনে নিলেও পরে মৌপ্রিয়াকে সহ্য করতে পারতো না কেউ।ছোটোবেলা থেকেই মৌ অবহেলা,অপমান,মারধর এগুলোর সাথে খুব ভালো ভাবে পরিচিত।তিনবেলা খাবার না জুটলেও মারটা জুটে যেতো।তবে নিশুতিরাতে মা যখন বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখতো তখন সব কষ্ট ভুলে যেতো মৌ।কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারতো না মায়ের কোলজুড়ে।মৌ এর দমবন্ধ লাগে এইবাড়ির আবহাওয়া।দূরে কোথাও মা’কে নিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে।মায়ের কষ্টও মৌ এর সহ্য হয় না।সারাদিন বাড়ির প্রত্যেকটা কাজ করে রাতে মদ্যপ স্বামীর খায়েশ পূরণ করতে হয় না পারলে তো চাবুকের আঘাত আছেই।মধ্যরাতে মারের আঘাতে মায়ের আত্মচিৎকার মৌ এর মরে যেতে ইচ্ছে করে।নিজের মায়ের অসহায়ত্ব দেখার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো কিন্তু পরক্ষণেই মায়ের কথা চিন্তা করে মৌ আর সাহস পায় না মরার।

ঘুমের ঘোরেই পেটে কারো নোংরা স্পর্শে মৌ ধড়ফড়িয়ে উঠে যায়।সামনে থাকা লোকটাকে দেখেই ভয় পেয়ে যায়।এই লোকটা সম্পর্কে মৌয়ের সৎ চাচাতো ভাই রাশেদ।ও যখনই সুযোগ পায় মৌয়ের সাথে অসভ্যতা করতে ছাড়ে না।আর সবাইকে বলে বেড়ায় ও নাকি মৌ কে বিয়ে করবে।কিন্তু মৌ লোকটাকে প্রচন্ড ঘৃণা করে।একে বিয়ে করার চেয়ে কলা গাছের সাথে ফাঁস নেওয়া ভালো।কতো মেয়ের জীবন নষ্ট করছে আল্লাহ ভালো জানে।এলাকায় বেশ দাপট থাকায় কেউ কিছু বলে না এদের।

রাশেদ মৌ এর ভীত সন্ত্রস্ত মুখ দেখে বিচ্ছিরি এক হাসি দিয়ে বলল,’আমাকে ভয় পাস কেনো মৌ?তোকে তো আমি বিয়ে করবো।হবু স্বামীকে কি কেউ ভয় পায় নাকি?’
মৌ কিছু বলল না গুটিশুটি মেরে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।রাশেদ মৌয়ের হাত পায়ে মারের দাগ লক্ষ্য করে ন্যাকা আফসোসের স্বরে বলল,’চাচা আবার তোরে মারছে না?থাক কান্দিস না।তুই আমার বউ হলে কেউ তোরে মারতে পারবে না।’

এটা বলেই রাশেদ খপ করে মৌ এর এক হাত চেপে ধরে।আতংকে মৌ বারবার হাত ছাড়াতে চাচ্ছে কিন্তু রাশেদ খুব শক্ত করে হাত চেপে ধরে রেখেছে।এরইমধ্যে মাহমুদা বেগম চলে এলেন।রাশেদকে দেখে থমথমে গলায় বলল,’রাশেদ,এই ঘর থেকে যাও।মৌ এখন খাবে।’

রাশেদ একবার মাহমুদা বেগমের দিকে তাকিয়ে মৌ এর হাত ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো।রাশেদ যেতেই মাহমুদা বেগম দরজা আটকে দিয়ে মৌ এর কাছে এসে বসলেন।তারপর কোমল গলায় বললেন,’মৌ তুই পালিয়ে যা।এখানে তুই ভালো থাকবি না।ওরা চাইছি রাশেদের সাথে তোর বিয়ে হোক কিন্তু আমি চাই না আমার মতো কষ্টে তুইও থাক।আমি আমার খালাতো বোন সিন্থিয়ার সাথে কথা বলেছি তুই আজকে ভোরে চলে যাবি।তোকে ওর মেয়ে শিরিন নিতে আসবে।’

মৌ আদ্র কন্ঠে বলল,’কিন্তু মা তুমি?’

মাহমুদা বেগম মলিন হেসে বলল,’তুই পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাড়াবি।তারপর আমায় নিয়ে যাবি এখান থেকে।ততদিন আমি তোর অপেক্ষা করবো।কিন্তু এখন তোকে যেতেই হবে।’

মৌ মা’কে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিলো।এই পৃথিবীতে একমাত্র এই মানুষটা ছাড়া আর কেউ তাকে ভালোবাসে নি।

ভোর হওয়ার আর কিছুক্ষণ বাকি।উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে মৌ এর।আজ এবাড়ি থেকে বের হতেই হবে।অপেক্ষা করতে করতে একপর্যায়ে ভোরের আলো ফুটলো।মৌ কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে দরজা দিয়ে আস্তে আস্তে বের হলো।এখনো কেউ ওঠে নি।পা টিপে টিপে মেইন দরজার কাছাকাছি যেতেই ডানপাশ থেকে রাশেদের ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ হলো।মৌ দ্রুত সামনে থাকা টেবিলের নিচে লুকিয়ে গেলো।নিচ থেকেই দেখা যাচ্ছে রাশেদ আর ওর বন্ধুরা বের হয়েছে।রাশেদ ওর বন্ধুদের বিদায় দিয়ে আবার নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।ওরা সারারাত জুয়া খেলেছে আর মদ গিলেছে।প্রতিদিনই এমন করে।বাড়ির কেউ কিছু বলে না অবশ্য বলবেই বা কি!তারা তো নিজেরাই এমন।মদ গিলে বউ পেটানো এদের ধর্ম।তাহলে এদের ঘরের ছেলেরা আর কেমন হবে!যা দেখবে তাই তো শিখবে।
মৌ টেবিলের নিচ থেকে বেরিয়ে দরজা সামনে এসে ধীরে ধীরে দরজা খুললো যেনো শব্দ না হয়।ঘর থেকে বেরিয়ে ওড়না দিয়ে ভালো করে মুখ ঢেকে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে আরম্ভ করলো।ভয়ে বারবার বুক কাঁপছে যদি একবার ধরা পড়ে যায় তাহলে আজকে বোধহয় জান যাবে।বাড়ির গেইটের সামনে আসতেই দো’তলা থেকে কে জানি চিল্লিয়ে বলল,’এই কে রে?’
মৌ না তাকিয়েও বুঝতে পারলো এটা রাশেদ।কারণ ওর ঘরের বারান্দা থেকে নিচটা পুরো দেখা যায়।
মৌ ভয়ে ওপরের দিকে তাকালো না।দ্রুত পায়ে গেইট দিয়ে বেরিয়ে গেলো।পেছন থেকে রাশেদ কিছু বলেছিলো কি না শোনা যায় নি।আধো অন্ধকারে দ্রুত বেগে হাঁটতে থাকে।গলির মোড়ের কাছে পৌঁছাতে হবে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে শিরিন।দ্রুত হাঁটতে হাঁটতেই পেছন থেকে শুনতে পেলো কেউ ওকে দাড়াতে বলছে।পিছনে তাকিয়ে দেখলো রাশেদ আর আরো কয়েকজন আসছে।মৌ ব্যাগটা শক্ত করে কাঁধে নিয়ে সর্বশক্তি নিয়ে দৌড় দিলো।মনে প্রাণে শুধু একটাই চাওয়া শুধু মুক্তি!
দৌড়াতে দৌড়াতে পেছনে তাকিয়ে দেখলো ওরাও দৌড়াচ্ছে।পিছনে তাকানোর ফলে সামনের একটা ইটের সাথে উষ্ঠা খেয়ে পড়ে গেলো।নখ ভেঙে গেছে।মৌ আবারও উঠে দাড়িয়ে দৌড়ানো শুরু করলো।দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু দৌড়াতে হবে।ওরা অনেকটাই কাছাকাছি।মৌ আর পিছনের দিকে না তাকিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দৌড়াতে লাগলো।পেছন থেকে রাশেদ অজস্র গালাগাল দিয়ে থামতে বলছে।কিন্তু মৌ থামছে না।মোড়ে এসে শিরিন আপুকে দেখতে পেলো না।হয়তো এখনো আসে নি।এখন কি করবে!ওরাও প্রায় কাছাকাছি।মৌ তাড়াতাড়ি ডানের পাশের রাস্তা ধরলো।একটু এগিয়ে একটা বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো।রাশেদসহ ওই লোকগুলোও এই রাস্তায় এলো কিন্তু মৌ কে পেলো না হঠাৎ যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে হেলো।রাশেদ একজনকে বাম পাশের রাস্তায় আরেকজনকে ডান পাশের রাস্তায় পাঠালো আর নিজে গলির মোড়েই দাড়িয়ে রইলো।আর এদিকে মৌ থরথর করে কাপছে।মনে হচ্ছে কাঁপতে কাপতে পড়েই যাবে।অনেক্ক্ষণ খোজাখুজির পরও পেলো মা ওরা মৌ কে তাই হাতাশ হয়ে লোকগুলো চলে গেলেও রাশেদ ডানপাশের রাস্তা ধরে আবার খুঁজতে লাগলো।প্রায় বেশ খানিকক্ষণ পর মৌ ধীরে ধীরে বের হলো।এখনো শিরিন আপু আসে নি।মোড়ে তেমন কেউ নেই।শুধু একটা ছেলে ছাড়া।ওই ছেলেটা বাইকের সাথে হেলান দিয়ে ফোন চালাচ্ছে।মৌ ছেলেটার কাছাকাছি এসে দাড়াতেই ছেলেটা চোখ তুলে ওর দিকে চাইলো।তারপর বলল,’আপনি মৌপ্রিয়া না?’

মৌ ভীত গলায় বলল,’জ্বী।’

তারপর ছেলেটা কিছু বলার আগেই একটা লোক এসে মৌ এর হাত ধরে বলল,’কার সাথে পালাচ্ছিলি?এটা তোর নাগর?তোর পালানো আমি বের করছি।আজকে তোকে বিয়ে করবে।’

এটা বলেই রাশেদ মৌ কে টেনে নিয়ে যেতে আরম্ভ করলো।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে