উত্তরাধিকার পর্ব-০৩

0
1118

#উত্তরাধিকার
#৩য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক



রাত বারোটায় ফিরেছে মেহের। হেমা অপেক্ষা করতে করতে একেবারে ক্লান্ত হয়ে গেছে। সকাল থেকে তার কোন রকম খাওয়া দাওয়া নাই। ভেবেছিল রাতে মেহের ফিরলে দুজন মিলে একসাথে খাবে। কিন্তু কী অদ্ভুত বিষয়।মেহের ফিরে এসে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমোতে চলে গেল অন্য একটি ঘরে।
হেমা জিজ্ঞেস করলো,’খাবে না?’
মেহের বললো,’নাহ।’
‘কেন?খাবে না কেন?’
‘বাইরে খেয়ে এসেছি।’
হেমার ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে।তার মেহের রাত দিন পরিবর্তন হয়ে গেছে। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে কেমন। কান্না পাচ্ছে তার।
মেহের যখন ও ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে তখন হেমা বললো,’ও ঘরে যাচ্ছো কেন?’
মেহের সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো।বললো,’ঘুমাতে।’
‘এই ঘরে কী হয়েছে? এখানে কী সমস্যা?’
‘দুদিন পর যার সাথে কোন সম্পর্ক থাকবে না তার কাছাকাছি থেকে এখন মায়া বাড়ানোর কী প্রয়োজন? এরচেয়ে দূরে থাকার ট্রাই করাই ভালো!’
বলে চলে গেল মেহের।
হেমা ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে আঁচলে মুখ চেপে কাঁদতে শুরু করলো।

পরদিন সকাল বেলা হেমা ওর কাছে গেল। গিয়ে বললো,’আজ বাবা আসবেন। তুমি একটু লেইট করে অফিসে যেও।’
মেহের শক্ত মুখে বললো,’ইনি কেন আসবেন হঠাৎ? তাছাড়া এলেই বা আমার সাথে কী?’
হেমা বললো,’তোমার সাথে কথা বলতে চান।’
মেহের বললো,’অফিসে পাঠিয়ে দিও।আমি লেইট করতে পারবো না। অফিসে আজ আমার অনেক কাজ পড়ে আছে!’
এরপর নাশতা করার আগে সমিরনকে ডাকলো মেহের।ডেকে বললো,’এখন থেকে তুমি আমায় নাশতা দিবে। দুপুরে আমি বাইরে খাবো। রাতেও বাইরে খেয়ে ফিরবো। তুমি শুধু সকালের নাশতা দিবে।রোজ দিবে।অন্য কেউ দিলে কিন্তু ছুঁড়ে মারবো তার নাকে মুখে।মনে থাকে জেনো!আর
সকালে আমি কী কী খাই জানোই তো তুমি!’
সমিরন বললো,’বউমণি যদি কিছু বলে?’
মেহের বললো,’বিরক্ত করো না তো বুয়া!সে আর তোমার বউ মণি না। এখন যাও এখান থেকে।’
সমিরনের অত কথা বলার সাহস নাই এখানে।সে এই বাড়ির কাজের লোক। কাজের লোক কী আর কোন প্রশ্ন করতে পারে তার মনিবকে!
তাই সে চুপচাপ ও ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে এসে দেখে দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে হেমা।সব শুনেছে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে সে। এখন কাঁদছে।
সমিরন কিছু বলতে যাবে তাকে তার আগেই তাকে থামিয়ে দিলো হেমা।বললো,’যাও ‌। এখান থেকে যাও। আমার সাথে কোন কথা বলবে না।আমি এ বাড়ির কেউ না।কেউ না!’

দুপুর বারোটায় আজমল হোসেন এসেছেন মেয়ের বাড়িতে।হেমা বাবাকে দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়েছে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে গলা ছেড়ে কাঁদছে।
আজমল হোসেন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,’কেঁদো না মা। কেঁদো না।ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।আমরা মানুষ। আমাদের ভাগ্যের উপর কোন হাত নাই।আমি মেহেরের সাথে কথা বলবো।যদি আমার কথা সে শুনে তবে তো আলহামদুলিল্লাহ।যদি না শুনে তবে তোমাকে শক্ত হতে হবে মা।মেহেরেরও কিন্তু সন্তানের পিতা হবার অধিকার আছে।তার দ্বিতীয় বিয়েতে আমরা বাঁধা দিতে পারি না। তাকে আমরা বুঝাতে পারি।এ দেশে অনেক পুরুষ আছে, অনেক মহিলাও আছে যারা কি না তাদের সন্তান হবে না জেনেও দ্বিতীয় বিয়ে করছে না। একসাথে থাকছে। সবাই তো আর এক রকম না মা!যদি মেহের বিয়ে করতেই চায় তবে করুক। তুমি শক্ত থাকো।আমি তোমার বাবা।আমি তোমাকে চিনি। আমার দোয়া আছে তোমার উপর। তুমি জয়ী হবে মা।মেহেরের ভালোবাসা একদিন তুমি পাবে। ইনশাআল্লাহ পাবে!’
আজমল হোসেন মেয়েকে কথাগুলো ঠিকই মুখের উপর বলে ফেললেন। কিন্তু ভেতরটা তার ফেটে যাচ্ছে। হাহাকার এসে জায়গা করে নিয়েছে বুকে।চোখ দুটোও জ্বালা করছে। সম্ভবত তার কান্না আসছে!
হেমা কান্না থামিয়ে বললো,’বাবা, তুমি বাড়ি ফিরে যাও।ওর সাথে কথা বলার কোন প্রয়োজন নাই!’
হেমা হয়তোবা রাগ দেখাচ্ছে তার বাবার প্রতি।ভাবছে বাবাও পুরুষদের মতো করে কথা বলছে।পক্ষ নিচ্ছে মেহেরের। কিন্তু সত্যি বলতে আজমল হোসেন নিয়তির কাছে বড় অসহায়। অসহায় আজব দুনিয়ার কাছেও। কদিন বা বাঁচবেন তিনি আর।স্ত্রীও আজ মরে কাল মরে অবস্থা।ছেলেটাও আর তার বলয়ে নাই। মেয়েকে যদি তিনি সাহস করে বাড়ি নিয়ে যান তবে তো মেয়ে বিপদে পড়বে দু’দিন পর। তিনি মরে গেলে তার আশ্রয়দাতা কে হবে?কে ছায়া দিয়ে আগলে রাখবে তাকে? এই জন্যই তিনি চাচ্ছেন না হেমার ডিভোর্স হোক। তিনি চাচ্ছেন হেমা এখানে থাকুক। এখানে থাকলে বাইরের বিপদ থেকে তো অন্তত সে মুক্তি পাবে!
আজমল হোসেন মেয়েকে বোঝ দিতে চায়লেন। বললেন,’মাগো, পাগলামি করো না। তুমি একদিন সুখি হবে গো মা!’
হেমা রাগী রাগী গলায় বললো,’জ্বি বাবা।আমি সুখি হবো। জাহান্নামের আগুনে পোড়েও মানুষ যেমন সুখে থাকে তেমন সুখে থাকবো আমি।’
কথাগুলো বলে সে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। এবং দরজা বন্ধ করে ভেতর থেকে বললো,’বাবা তুমি চলে যাও। এখানে আর কখনো এসো না।এখন থেকে সব সময় মনে করবে, তোমার মেয়ে মৃত। তোমার তো ছেলেও নাই। এবার মেয়েকেও হারালে। তুমি আঁটকুড়ে বাবা হয়ে গেলে!নিঃসন্তান বাবা হয়ে গেলে!’
কথাগুলো কাঁদতে কাঁদতে বললো হেমা।
আজমল হোসেন নিজের চোখের জল মুছলেন পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে। তারপর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাতর গলায় বললেন,’মাগো, তোমার বাবা নিরুপায় মা। তুমি এটা এখন বুঝবে না কেন আমি তোমায় এখানে রেখে যাচ্ছি। কিন্তু সময় হলে ঠিকই বুঝবে। তখন বলবে,বাবাই ঠিক ছিলো।বাবারা কোনদিন ভুল করে না। সন্তানের অমঙ্গল চায় না। তুমিও এটা মনে রেখো মা!’
আজমল হোসেন মেয়ের বাড়ি থেকে সরাসরি চলে গেলেন মেহেরের অফিসে। ওখানে গিয়ে প্রায় দু’ঘন্টা বসে রইলেন বাইরে।মেহের আজ খুব ব্যস্ত।ইন্টারভ্যূ নিচ্ছে রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে রিটেনে উত্তীর্ণদের।দু ঘন্টা পর এসে দপ্তরি বললো,’এখন দেখা করতে পারেন।স্যার পনেরো মিনিট ব্রেক দিয়েছেন আপনার সাথে কথা বলবেন বলে।’
আজমল হোসেন অফিসে ঢুকতেই মেহের বললো,’বসুন।’
আজমল হোসেন বসতে বসতে বললেন,’কেমন আছো বাবা?’
মেহের বললো,’ভালো আছি। কিন্তু আপনি হঠাৎ অফিসে! কোন সমস্যা হয়নি তো না?’
আজমল হোসেন বললেন,’বাবা তোমার সাথে আমি কিছু কথা বলতে চাই!’
মেহের বললো,’দশ মিনিট সময় আছে।দ্রুত বলুন। আচ্ছা আপনি চা খাবেন?’
আজমল হোসেন হেসে বললেন,’না বাবা। আমার ডায়েবেটিকসের সমস্যা।চা খাই না!’
মেহের বললো,’আচ্ছা তবে বলুন শুনি কী বলতে চান।’
আজমল হোসেন বললেন,’বাবা, আমার মেয়েটা তোমায় খুব ভালোবাসে। তোমার জন্য সে তার জীবন কুরবান করে দিতে পারে!বাবা তুমি যে ডিসিশন নিছো এটা আরেকবার ভেবে দেখো!মেয়েটা নয়তো খুব কষ্ট পাবে!’
মেহের খানিক সময় চুপ করে রইলো। তারপর বললো,’আপনি তো শিক্ষিত মানুষ।জ্ঞানী মানুষ। এবার আপনি বলুন,আমি কেন শুধু শুধু সারা জীবন নিঃস্বন্তান থাকবো?কেন আঁটকুড়ে থাকবো বলুন? মানুষ আমায় নিয়ে নানান কথা বলে।পৌরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে!আমি নিজ কানে শুনেছি আমার ফ্যাক্টরির সাধারণ লাইন ম্যানের মুখেও এমন কথা! এইগুলো কেন আমি সহ্য করবো?হ্যা আপনি বৃদ্ধ এবং সম্মানিত মানুষ এসেছেন আমার কাছে। আপনাকে আমি সম্মান করি।আমি চাই আপনি আপনার মেয়েকে বোঝাবেন।সে আমার দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিক।আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি হেমার জায়গাটা আর কেউ দখল করতে পারবে না।এতে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন!’
আজমল হোসেন আর কী বলতে পারেন এখানে? তিনি বললেন,’তোমার যা ইচ্ছা বাবা। কিন্তু আমার মেয়েটা বড় দুঃখী!সারা জীবন কষ্ট পেয়ে পেয়ে বড় হয়েছে। তুমি তাকে আঘাত দিও না বাবা।ও তো ফুলের মতো পবিত্র একটা মেয়ে। তাকে তুমি কষ্ট দিও না!’
বলে চলে গেলেন আজমল হোসেন। কিন্তু আজমল হোসেনের এমন নাক কান্নায় তো আর মেহেরের মন গলবে না।তার গা জ্বলছে। এই আজ সকাল বেলায়ই তার অফিসের লাইন ম্যান সিরাজ উদ্দিন খবির খা কে বলছে,খবির ভাই,আমরার ছার উপরে দিয়াই খালি ষাঁড়ের লাহান কিন্তু ভিতরে তার কিছুই নাই।সে আসলে একটা বলদ।
খবির খা অট্টহাসিতে মেতে উঠেছিল কথাটি শুনে। তারপর বলেছিল,মেডাম তো একদিন আসছিলো।দেইখা তো ভালোই মনে হয়ছে।মা হওয়ার যোগ্য মেয়ে। পাঁচ বছর হয়ছে বিয়ার। তবুও কাম ঘটাইতে পারলো না স্যারে।আর কোনদিন মনে লয় না যে পারবো!
সিরাজ উদ্দিন বললো,আমরাই ভালা। ষাঁড় গরুর লাহান শরীল নাই আমরার ঠিকাছে। তবে বচ্ছর বচ্ছর বাচ্চা পয়দা করন মিস্ নাই আমরার।এইগুলারে কই পুরুষ মানুষ। পুরুষ মানুষ খালি নামে পুরুষ হইলে হয়বো না।কামেও হওন লাগবো!কী কন খবীর ভাই?
খবীর খা এরপর কী বলেছিল তা আর শোনার ধৈর্য্য ছিল না মেহেরের।সে
ওদের কথোপকথন শোনেছিলো অফিসে যাওয়ার পথে।যখন বুঝতে পারলো তাকে নিয়েই কথা হচ্ছে তাই আড়ালে থেকে সব শুনলো। তারপর আর সহ্য করতে না পেরে অন্য একটি পথ দিয়ে সে অফিস কক্ষে চলে গেল। এখান দিয়ে গেলো না। তাদের সামনে পড়তে ওর লজ্জা করছিলো বরং! তবে পরবর্তীতে এদের কিছু বলতেও পারেনি মেহের।তার মনে হয়েছে ওরা ভুল কিছু বলেনি। ঠিকই বলেছে। এরপরই সে একেবারেই পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। দ্বিতীয় বিয়েটা সে করবেই। এবং সন্তানের পিতা হয়ে সে দেখিয়ে দিবে সেও একজন পুরুষ।নামে পুরুষ না কাজে পুরুষ।
কিন্তু সমস্যা হলো ওই মেয়েটি এখনও ইন্টারভ্যূ দিতে আসছে না।পনেরোজনের মধ্যে
চৌদ্ধজন এসেছে। এদের থেকে একজন পুরুষ সে বেছে নিয়েছে।আর তেরো জন ক্যান্সেল।এই তেরো জনের ভেতর মেয়ে ছিল পাঁচ জন।ওরাও ক্যান্সেল।বাকী একটি আসন খালি আছে।আর ক্যান্ডিডেট আছে একজনই। সেই একজন সাঁজবাতি।সাঁজবাতির জন্যই মেহের আর কাউকে আসনটি দেয়নি।সে আগে ভাগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে এই আসনটা সে সাঁজবাতিকে দিবে। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো এই সাঁজবাতি আজ ইন্টারভ্যূ দিতে আসছেই না!
মেহেরের দুশ্চিন্তা হচ্ছে খুব।তার কেবল মনে হচ্ছে এই মেয়েটি কী তবে আজ আসবেই না ইন্টারভ্যূ দিতে!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে