উত্তরাধিকার (পর্বঃ-১৫)

0
1004

উত্তরাধিকার (পর্বঃ-১৫)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
***********************
এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকেনা এ মন…
হমহমহমহহমহ………
বধূ তোমার নিমন্ত্রণ….!”
খালিগায়ে একটা ওশন ব্লু কালারের ট্রাউজার পড়ে গুনগুন করে গানের কলি ভাজছে রাফিজ।সে স্কুলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বেলা চৌধুরী বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে ছেলের ঘরে ঢুকলেন।
-“কি রে?গান ? তাও তোর মুখে? আমি হেমন্ত শুনি দেখে সেদিনই না বললি গান শুনলে কানে গরম সীসা ঢেলে দেয়া হবে?”
রাফিজ হকচকিয়ে গেলো-“ওহ্,স্যরি মা! কখন গুনগুনিয়ে ফেলেছি খেয়াল করিনি।অজান্তে এমনটা হয়েছ!এই মুখ বন্ধ করলাম!”
রাফিজ মনোযোগ দিয়ে শার্টের বাটন খুলতে লাগলো গায়ে দেবার জন্য !
বেলার মনে হচ্ছে এ তার ঝড়ের তান্ডবে নুব্জ্য বিধ্বস্ত রাফিজ নয়,এটা তার সেই সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া টগবগে যুবক রাফিজ।মাত্র একদিনেই ওর বয়স দশ বছর কমে গেলো কিভাবে?
গতকালও তো ওকে পঞ্চাশ বছরের আধাবুড়োদের মতো দেখাচ্ছিলো!!
বেলা নিজে প্রতিমাসে পার্লার যান,ফ্রুটস ফেসিয়াল করেন তবু তার বয়স ততটা কমিয়ে দেখাতে পারছেননা যতটা তিনি চান।অথচ নাযিয়াত যাবার পর থেকে তার ছেলেকে দেখছেন তুবড়ানো গালে এলোমেলো দাড়ী,চুলগুলো কয়দিনের না আঁচড়ানো কে জানে আর সেই ছেলে আজ একেবারে ব্যাকব্রাশ করে জেল টেল লাগিয়ে….?গায়ে মনে হয় বড়ি স্প্রে উপুড় করে দিয়েছে।পুরো ঘরটা ম্যাক্সফ্যাক্টরের গন্ধ ম’ ম’ করছে।
একদিনেই কি এমন হয়ে গেলো যে ও এতো বদলে গেলো ?তাছাড়া গত কয়েকদিন ধরে সে অফিসও করছেনা।বেলা খবর পেয়েছেন।
সে আজকাল গাড়ী না নিয়ে রিক্সা দিয়ে যেন কোথায় যায়!
হায় আল্লাহ্,শোকে দুঃখে ছেলে আবার বাজে কারো পাল্লায় পড়লো না তো?পুরুষ মানুষের এমন ভঙ্গুর মুহূর্তে অনেক সুবিধাবাদীরা সুযোগ নিতে দেরী করেনা।বিশেষ করে কিছু ফটকিবাজ মেয়েরা!তাছাড়া তার ছেলে ধনী পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকারী,লোভ তো হতেই পারে।
বেলা সন্ধিগ্ন কন্ঠে প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করলেন-
-“কি হয়েছে রে তোর?”
রাফিজ ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো! কিছুটা অবাক হয়ে বললো-“কিসের কি হয়েছে?”
-“বললেই হলো?আমি তোকে চিনিনা?তুই এই ক’দিন ধরে অফিসে যাচ্ছিস না!!যাস কোথায় তুই বলতো ?”
রাফিজ এবার সত্যিই বিব্রতবোধ করলো।মা হঠাৎ এভাবে এ্যাটাক করবে ভাবেনি।
কিছুক্ষণ ভেবে মুচকি হেসে বললো–
-“একটা মিশনে নেমেছি মা।সাকসেস হয়েই তোমাকে জানাবো।আপাতত কিছু জানতে চেওনা মা প্লিজ!”
-“খারাপ কিছু না তো?”গলার স্বর কিছুটা খাদে নামিয়ে বললো বেলা।রাফিজ ঘুরে মায়ের দিকে তাকালো-“তোমার কি মনে হয়,তোমার ছেলে খারাপ কিছু করতে পারে?”
-“,না,তা না…!কিন্তু…..!”
-“কোনো কিন্তু না মা।তোমার দুশ্চিন্তার কোনো কারন নেই।অফিসে না গেলেও যোগাযোগ রেখেছি।সাইদ সাহেবকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি।আর দুটো দিন তারপর দেখবে সব ঠিক,ইনশাআল্লাহ্!


রাফিজ টিচার্সরূমে ঢুকেই একনজরেই চারপাশ দেখে নিলো।নাহ্,নাযিয়াত নেই!কি ব্যাপার? আসেনি নাকি আজকে?
রাফিজ চেয়ারে বসতেই পাশে মিস নাযিয়াত এসে বসলো-“হাই…?”
রাফিজ সামান্য মুখ ফিরিয়ে মিস নাযিয়াতের উপস্থিতি টের পেয়ে মনোযোগ দিয়ে ট্রেবুলেশন শিট লিখতে লাগলো!
মনে মনে বিরক্তও হলো,কারন সে খোঁজে মিসেস নাযিয়াতকে আর মিস নাযিয়াত খুঁজে ওকে!
একেই বলে ভাগ্য!
তবু রাফিজ বিরক্ত বোধ করলেও হাবেভাবে ওকে নির্বিকার মনে হলো!
মিস্ নাযিয়াত পাশ থেকে বকবক করেই যাচ্ছে।এখন প্রসঙ্গ চলছে রাফিজের হাতের লেখা নিয়ে।
রাফিজ হঠাৎ মুখ তুলে বললো-“সব লেডি টিচাররা কি এখানে বসেন না নাকি ?মেলদের জন্যে কি আলাদা বসার ব্যবস্থা?
-“না…না..সবাই আমরা একসাথেই বসি।কারন আমাদের এখানে মেল পার্সন মাত্র তিনজন!আপনি,ড্রিল টিচার আর প্রিন্সিপ্যাল ম্যামের হাজবেন্ড মানে আমাদের চেয়ারম্যান স্যার!
-“ওহ্….চেয়ারম্যান স্যারকে তো কখনো দেখিনি!উনি কোথায় বসেন?”
-“প্রিন্সিপ্যাল ম্যাম পাশের কামরাটা !আপনি ওনাকে এখনো দেখেননি কারন উনি ওমরা করতে গেছেন!আজ কালের মধ্যেই চলে আসবেন! ভদ্রলোক খুবই অমায়িক!
আর বয়স…আপনার মতোই হবে।”
রাফিজ কথা শেষ করার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো!
মিস নাযিয়াত মুখ তুলে তাকালো–“ক্লাসে যাচ্ছেন?”
-“জ্বী!”সংক্ষেপে উত্তর দিয়েই রাফিজ গেটের দিকে এগোলো আর ঠিক তখনি মিসেস নাযিয়াতের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে হতে রয়ে গেলো!রাফিজের সমস্ত শরীরে অজস্র দমকল যেন ঘন্টা বাজাতে লাগলো!
রাফিজ থেমে গিয়ে মৃদুস্বরে বললো-“এই নিয়ে দ্বিতীয়বার!”
নাযিয়াত ঝট করে বিস্ফোরিত নেত্রে মুখ তুলে তাকালো!অবাক বিস্ময়ে সব ভুলে তাকিয়ে রইলো।ও কি সত্যি দেখছে না এটা তার ভ্রম?সে তার চারপাশে শুধু রাফিজকেই দেখে।মানুষটা নাহয় ভ্রম!কিন্তু তার বলা কথাটা?
রাফিজ কাতর দৃষ্টিতে নাযিয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে।ওর চোখ জোড়া যেন চঞ্চল প্রজাপতির মতো নাযিয়াতের মুখে কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে।রাফিজের মনে হচ্ছে সময়টা যেন থমকে গেছে দুজনের মাঝে।আহা,যদি এভাবেই কাটিয়ে দেয়া যেত কয়েকঘন্টা!
-“ওনার কথাই বলছিলাম!”
পেছন থেকে মিস নাযিয়াতের কথায় দুজনেরই সম্বিত ফিরলো।রাফিজ ভদ্রতা দেখিয়ে সরে দাঁড়ালো।নাযিয়াত ভেতরে প্রবেশ করে এককোণের চেয়ার দখল করে বসলো!আড়চোখে আরেকবার রাফিজের দিকে তাকাতে গিয়ে চোখাচোখি হয়ে গেলো।রাফিজ এখনো হা করে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।নাযিয়াত মুখ নামিয়ে ব্যাগ থেকে খাতা বের করে সামনে রাখলো।মিস নাযিয়াত পরিচয় করিয়ে দেবার ভঙ্গিতে রাফিজকে বললো-“উনিই আরেকজন নাযিয়াত! ওনারই বাচ্চা অসুস্থ ছিলো বলে একসপ্তাহ ধরে আসতে পারেনি!”
রাফিজ নাযিয়াতের দিকে তাকিয়ে ব্যগ্র কন্ঠে বললো-“এখন কেমন আছে রণ?”
মিস নাযিয়াত চমকে উঠে বললো-
-“আরে,আপনি কিভাবে জানলেন যে উনার বাবুর নাম রণ?”
নাযিয়াতও একবার ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে মুখ নামিয়ে নিলো।রাফিজ আমতা আমতা করে বলে উঠলো-
–“মমম,আপনিই তো গতকাল বললেন উনার একটা বাবু আছে নাম রণ!”
মিস নাযিয়াত কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে বললেন-“বলেছিলাম বুঝি?কি জানি মনে নেই!চলুন,ক্লাসে যাই!”
-“আপনি যান, আমি আসছি এক মিনিট!”
বলে রাফিজ নিজের বক্স খুলে অযথাই কিছু খাতা বের করলো!মিস নাযিয়াত “ওকে’ বলে পা বাড়াতেই নাযিয়াত(রণর আম্মু) হঠাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রূম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো!রাফিজ বোকার মতো সেদিকে চেয়ে রইলো!
পরের ক্লাসগুলো রাফিজ একটা ঘোরের মধ্যে করলো!বারবার মনের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।নাযিয়াত ওকে রুমে থামতে দেখে বেরিয়ে গেলো কেন?সে কি রাফিজের উপর রাগ?রাফিজের সাথে কথা বলতে চায়না নাকি কেউ দেখে ফেলার ভয়….. কোনটা?”
ছুটির সময়ও রাফিজ সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো নাযিয়াত বেরোলে ওর পিছু পিছু বেরিয়ে ওকে রাস্তায় হায়ার করবে কিন্তু ছুটির দশ মিনিট আগেই ও যে কখন লাপাত্তা হয়ে গেলো রাফিজ টেরই পেলোনা।
ধৈর্য্য ধরাটা রাফিজের জন্য ধীরে ধীরে অসহনীয় হয়ে পড়ছে।নাযিয়াতের সঙ্গে কথা বলার জন্য ওর মনটা ছটফট করছে।একেকটা দিন পাহাড়ের মতো কাটছে।বিশেষ করে দেখা হবার পর থেকে অস্থিরতাটা আরো বেড়েছে।একটুখানি সুযোগের অপেক্ষায় রাফিজ যেন মরমে মরে যাচ্ছে।
অবশেষে সুযোগ মিললো!
পুরো টিচার্স রুম খালি!নাযিয়াত এক কর্ণারে বসে খাতা দেখছিলো।সম্ভবত ওর এখন কোনো ক্লাস নেই!রাফিজ ভাবলো এটাই মোক্ষম সুযোগ।
একেবারে নাযিয়াতের সামনে সোজা হাজির!
-“কি ব্যপার? আমাকে দেখেও পালাই পালাই করছো কেন?”
নাযিয়াত চট করে মুখ তুলে তাকালো।ওর চেহারা মুহূর্তের মধ্যে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।রাফিজের কথার জবাব না দিয়ে ওর পেছন দিয়ে রুমটা একবার দেখলো।কেউ নেই দেখে নাযিয়াত দ্রুত খাতা ভাঁজ করে উঠে দাঁড়াতেই
রাফিজ ওর কব্জি চেপে ধরলো!
-“কি হলো?কথার জবাব না দিয়ে কোথায় যাচ্ছো?”রাফিজের কন্ঠে দৃঢ়তা!
নাযিয়াত হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে বললো-
-“আরে কি করেন?কেউ এসে পড়লে কি ভাববে?”
-“যা খুশি ভাবুক আমার কিছু যায় আসেনা,নিজের বউয়ের সাথে কথা বলার সময় এতো ভেবে চলতে পারবোনা।তুমি আগে আমার কথার উত্তর দাও নইলে যেতে দেবোনা!”
-“এসব কি ছেলেমানুষী রাফিজ?পরেও তো কথা বলা যায়!”
-“পরে কখন কোথায় স্থান কাল সব বর্ণনা করো!”
নাযিয়াত মুখ খুলতে গেলেই দরোজায় কারো ছায়া পড়তে দেখে রাফিজ সেদিকে তাকাতেই নাযিয়াত দ্রুত রাফিজকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো!”
তার পরের দিনের পরের দিন!
সেদিনর পর থেকে নাযিয়াত পারতপক্ষে একা রুমে বসে না! কাউকে আসতে দেখলে আগেই নিজের পাততাড়ী গোটায়!ওর কেবলি মনে হয় এই বুঝি রাফিজ এলো!
অবশেষে একদিন সত্যি সত্যিই রাফিজ ওকে আবার একা পেয়ে ধরলো!
-“বাসার ঠিকানা দাও!”
নাযিয়াত অভিমানাহত চোখে চেয়ে বললো-“এতোদিন কোথায় ছিলেন?”
রাফিজ নাযিয়াতের দিকে গভীর চোখে তাকালো-“প্রশ্নটা বনলতা সেন করেছিলো জীবনানন্দ কে…!”
-“হেয়ালী রাখুন আর পথ,ছাড়ুন!কেউ দেখলে কেলেঙ্কারীর সীমা থাকবেনা!”
-“ঠিকানা বা ফোন নম্বর দাও নইলে পথ ছাড়বো না!”
-“উফ্…..লিখুন!”নাযিয়াত গড়গড় করে আওড়ে গেলো নাম্বারটা।তারপর সরে যেতে চাইলে রাফিজের বাঁহাতটা চট করে ওর সামনে বাড়ীয়ে ধরায় নাযিয়াত বাধা পেলো।নাযিয়াতের মনে হলো এক কারেন্টের শক লেগে ওর সমস্ত শরীর থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো!
-“রাফিজ,সরুন প্লিজ!”
রাফিজ মুচকি হেসে হাত সরিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে মিস নাযিয়াতের মুখোমুখি পড়ে গেলো!

মিস নাযিয়াত বড় বড় চোখে আশাহতের বেদনামাখা দৃষ্টিতে রাফিজের দিকে তাকিয়ে আছে।
রাফিজ সামান্য কেশে নির্বিকার চিত্তে “এক্সকিউজ মি”…. বলে বেরিয়ে গেলো !
রাফিজ চলে যাবার পর নাযিয়াত অসহায় চোখে মিস নাযিয়াতের দিকে তাকালো।
মিস নাযিয়াত জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওকে একবার দেখে বেরিয়ে গেলো!
ছুটির আগ দিয়ে নাযিয়াতের ডাক পড়লো প্রিন্সিপ্যালের রুমে।
ভীরু পায়ে প্রিন্সিপ্যালের রুমে আসতেই দেখলো রাফিজ সেখানে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে আছে!নাযিয়াত সালাম দিয়ে প্রবেশ করতেই প্রিন্সিপ্যাল ওকে বসতে ইশারা করলেন!
নাযিয়াত অপরাধীর মতো মুখ করে বসে রইলো!
প্রিন্সিপ্যালই নিস্তদ্ধতা ভাঙ্গলেন!
খুক খুক করে কেশে বললেন –“মি.রাফিজ আমি আপনাকে নিতান্তই একজন ভদ্রলোক ভেবেছিলাম।জীবনে চলার পথে আমাদের কাউকে ভালো লাগতেই পারে,তারমানে এই না যে,আপনি বিদ্যালয়ের মতো একটি পবিত্র স্থানে আপনার ভাবাবেগের সীমারেখা অতিক্রম করবেন।দ্বিতীয়তঃ মিসেস নাযিয়াত একজন বিবাহিতা ও একজন পুত্র সন্তানের জননী এবং……!”
-“এবং……..এবং সে আমার স্ত্রী!”রাফিজের ভারী কন্ঠস্বরে তার দৃঢ়চেতা অভিব্যক্তি চরমভাবে ফুটে উঠলো!সে বলে চললো–
-“আর আমার স্ত্রী’র সাথে কথা বলার জন্য কোনো সীমারেখার বাঁধা মানতে আমি বাধ্য নই!প্রশ্ন হলো,স্কুলের মতো পরিবেশে এটা কতটা সঙ্গত!আমার মনে হয়না আমি এমন কোনো আচরণ করেছি যা স্কুলের পরিবেশ নষ্ট করতে পারে!যে এই কথাটা আপনার পর্যন্ত পৌঁছেছে এটা তার উর্বর মস্তিষ্কের অনুর্বর কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না!”
প্রিন্সিপ্যাল কিছুক্ষণ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন-“কে আপনার স্ত্রী?”
-“মিসেস নাযিয়াত চৌধুরী।যিনি আপনার সামনে বসে আছেন।”
নাযিয়াত সেই যে মুখ নিচু করেছে আর মুখ তুলেনি।প্রিন্সিপ্যাল কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই গেটে স্কুলের চেয়ারম্যান স্যার এসে দাঁড়ালে নাযিয়াত তাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো।
প্রিন্সিপ্যাল কিছু বলার আগেই চেয়ারম্যান হঠাৎ রাফিজের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে তর্জনী তাক করে বললেন-“রাফিজ,তুই এখানে?”
রাফিজের চেহারার বিমর্ষভাব কেটে গিয়ে সেখানে বিরাজ করলো একরাশ আনন্দাভা।রাফিজের গোটা মুখ আলোকিত হয়ে উঠলো!
-“আসিফ….তুই?”
চেয়ারম্যান আসিফুজ্জামান দুই হাত বাড়িয়ে দিলেন রাফিজের দিকে।প্রিন্সিপ্যাল পর্যায়ক্রমে একবার রাফিজের দিকে আরেকবার তার স্বামী আসিফুজ্জামানের দিকে তাকাতে লাগলো!তার মাথায় কিছুই ঢুকছেনা।এই রাফেজ আসলে কে?”



প্রিয়ন্তীকে নেবার জন্য শওকত চৌধুরী নিজেই এয়ার পোর্টে এলেন!
বাড়ী পৌঁছে প্রিয়ন্তী সোজা ফারিকের রুমে চলে এলো!যা ভেবেছিলো তারচে ভিন্ন পরিস্থিতি দেখে প্রিয়ন্তী যারপরনাই অবাক হলো!ছয়ফিট লম্বা টগবগে তরুন ফ্রিক এখন বিছানায় শায়িত এক রোগাক্রান্ত মৃত্যপথযাত্রী!
প্রিয়ন্তী চোখের পানি ধরে রাখতে পারলোনা।ওকে দেখে ফারিক হেসে বললো-
–“খুব বেশী মন খারাপ হলো?”
প্রিয়ন্তী মাথা নেড়ে মৃদুহাস্যে ফারিকের শিয়রে বসে বললো–“অনেক!”
-“আমাকে দেখে?”
-“হমম…!”
-“জানতাম….বিয়েটা করার জন্য তোর আফসোস হবে!”
-“আফসোস হচ্ছে, তবে বিয়ে করার জন্য নয়!এখানে দেরীতে আসার জন্য!”
ফারিক অবাক হয়ে তাকালে প্রিয়ন্তী ওর মুখে হাত বুলিয়ে বললো-“দাঁড়ীতে তোকে নুরানী লাগছে!”
ফারিক লজ্জিত হেসে বললো-“মৃত্যুর প্রস্তুতি নিচ্ছি!”
প্রিয়ন্তীর চোখ ভিজে এলো।ও নির্দ্বিধায় ফারিকের বুকে মাথা রাখলে ফারিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো-“আমার এলার্জিটা কিন্তু পুরোপুরি সারেনি!তুই এতো কাছে আসিস না!”
-“কেন,এলে কি হবে?”
-“তোরও হয়ে যাবে!”
-“সবাইকে সেকেলে বলিস,তুই নিজেই তো সেকেলে কথাবার্তা বলছিস!কিছু হবেনা আমার!”
-“তুই হঠাৎ আমার প্রতি এতো ঝুঁকে পড়লি কেন,বলবি?আমি তো আগের মতো সুন্দর নেই!”
-“কিন্তু তোর মনটা আগের চেয়ে অনেক বেশী সুন্দর হয়েছে বরং আগে তুই সুন্দর থাকলেও তোর মনটা কুৎসিত ছিলো।” বলে প্রিয়ন্তী ফারিকের দিকে তাকালো–“আমার নিজের ভুলে একবার ভালোবাসা হারিয়েছি।আরেকবার নিজের আরেকটি ভুলে তোকে হারাতে পারবোনা!”বলে প্রিয়ন্তী ফারিকের বুকে মাথা রাখলো!
ফারিক বিহ্বল হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলো!


স্কুলে আজ সাজসাজ রব পড়ে গেছে।রাফিজ পুরো স্কুলে মিষ্টি আনিয়ে খাইয়েছে।
প্রিন্সিপ্যাল বারবার ক্ষমা চাইতে লাগলেন রাফিজ আর নাযিয়াতের কাছে।
আসিফুজ্জামান রাফিজের পিঠ চাপড়ে বললো-“তুই এখনো আগের মতোই আছিস!দুষ্ট আর রোম্যান্টিক।বউ এর খোঁজে নিজের কোটি টাকার শিল্পপ্রতিষ্ঠান ফেলে রেখে শেষমেষ কিনা কিন্ডারগার্টেনে?হা হা হা….!”
প্রিন্সিপ্যাল অমায়িক হেসে বললেন-“মিসেস নাযিয়াতকে নিয়ে একদিন বাসায় আসেন!”
রাফিজ হাসলো।
মিস নাযিয়াত সেই যে মুখ লুকিয়েছে আর সামনে আসেনি!
…..
(আগামী খন্ডে শেষ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে