উত্তরাধিকার (পর্বঃ-১৩)

0
977

উত্তরাধিকার (পর্বঃ-১৩)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
***********************f
বিয়ে হয়ে যাবার পর প্রিয়ন্তী ফারিকের সাথে কথা বলতে চাইলো! ওদেরকে একান্তে কথা বলার সুযোগ দিয়ে বড়রা সরে গেলেন!
ফারিক কাতর স্বরে বললো-“এবার তো তোর সন্তানের নাম পেলি!এভাবে বিয়ে করার কোনো মানে হয়না।কি হতো বিয়ে না হলে?কিছু শব্দ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সন্তানটা হালাল হয়ে গেলো?তোদের এসব সিলি ইমোশন আমি বুঝিনা!”
প্রিয়ন্তী ভেজা কন্ঠে বললো-“তোর এই কথাগুলো একদিন আমিও বলেছিলাম।কি হয় বিয়ে করে?কিছু শব্দ উচ্চারন আর পায়ে বেড়ী ফেলে স্বাধীনতাকে হরণ করা।একজনের পছন্দ অপছন্দ মেনে নিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়া।এটার কোনো মানে আছে?কথাটার জবাব আমার ভাই প্রান্তিক দিয়েছিলো। ওই জবাবটা শোনার পর আমার মনে হলো এই শব্দগুলোর দ্বারা আমি আমার সন্তানটাকে অভিশাপমুক্ত করতে চাই।এই শব্দ(কালিমা)গুলোর প্রয়োজন আছে।
প্রান্তিক বলেছিলো,ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য!আমরা যে ভাতটা খাই সেটা পথে দাঁড়িয়ে কাঁচা চালটাই কিনে কখনো চিবিয়ে খাইনা, সেটাকে মূল্য দিয়ে কিনে এনে ধুয়ে রান্না করে এর সাথে নিজের সাধ্যমতো কিছু ব্যঞ্জনাদি যোগ করে তবে সেটাকে পরিতৃপ্তির সাথে আহার করি।তাতে পেটও ভরে স্বাস্থ্যও রক্ষা হয়।
একই ভাবে পথের একটা মেয়েকে দেখেই বিছানা খোঁজা পশুর কাজ!সেই মেয়েটাকে তার অভিভাবকের কাছ থেকে সসম্মানে এনে পবিত্র কলেমার উচ্চারণে তাকে নিজের করে নেবার পর নিজের সাধ্যমতো উপকরণ দিয়ে তাকে সাজিয়ে সংসার করি!
তাতে মনও ভরে বংশও রক্ষা পায়।
পথেঘাটের খোলা খাবার খেলে যেমন বিভিন্ন ভাইরাস এ্যাটাক করে তেমনি বিয়ে না করে খোলাবাজারে যে কোনো মেয়ের সাথে এ্যাফেয়ার করলেও শরীরে রোগ বাসা বাঁধে।
বাইরের কোন খাবার তা যতই দামী হোক না কেন, ঘরের যত্ন আর ভালোবাসা থাকেনা,ওগুলো পেট ভরায় ঠিকই কিন্তু জীবনটাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়!
আমি জানি,আমার অনাগত সন্তান আমার ভুলের ফসল কিন্তু আমি চাইনা আমার ভুলের কারনে আমার সন্তানের জীবন নষ্ট হোক তাই ঐ পবিত্র শব্দগুলোর আশ্রয় আমাকে নিতেই হলো।সবাইকে নিতে হয়।বিয়েটা নারী পুরুষের পবিত্র একটা বন্ধন।”
ফারিক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো-“একথাগুলো আমি আরো আগে কেন জানিনি রে…?তাহলে আমার জীবনটা এমন হতো না।অখাদ্য খেয়ে খেয়ে শরীরটা পচিয়ে ফেলেছি!এখন বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছি!”
প্রিয়ন্তী খুব অবাক হলো যখন অনুভব করলো ওর চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে ওর হাতের উপর পড়লো!
ফিসফিসিয়ে বললো-“আমার মধ্যে আবেগ জিনিসটা কম তবু কেন যেন মনে হচ্ছে নিজেকে তোর পাশে দেখতে পেলে ভালো লাগতো!”
-“কে জানে, তুই আসার আগেই…….!”
-“এমন হবেনা!আমি আল্লাহর কাছে দোয়া চাইবো,স্বামী হিসেবে একটি দিনের জন্যে হলেও যেন তোর মাথার কাছে বসতে পারি।জানিনা কেন যেন,যে আবেগ রাফিজের বেলাতে কাজ করেনি সেটা তোর বেলাতে কেন কাজ করছে!তোকে পাবার জন্য একটা বড় মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছি রে..!”
-“কি সেটা?”
-“আমার অনেক আগেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে এবরশন হয়ে যায়।আমি তোর সন্তানটাকে বাঁচাতে পারিনি!
ফারিক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো-
–“অসুখী বাবা মায়ের সন্তানরা ভালোভাবে বেড়ে ওঠেনা! এটাই আল্লাহর ইচ্ছা!কিন্তু এভাবে আমার জীবনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে কেন নিজেকে শেষ করে দিচ্ছিস?”
-“আমি জানি না,শুধু জানি তোকে না পেলে চলবেনা!”
ফারিক চুপ।
প্রিয়ন্তী মৃদু স্বরে বললো-
–“আজ তোর মতো আমারও বলতে ইচ্ছে হচ্ছে জীবনের মূল্য আরো আগে কেন বুঝলাম না!আমি যে সত্যিই একজন সন্তানের মা হতে চাই!জানিনা পাবো কিনা।”
ফোনের দুপ্রান্তে দুজন নিঃস্ব মানুষের একরাশ বুকভরা হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলোনা!
****★****
পরদিন রাফিজ খুঁজে বের করলো সেই স্কুলটা।তারপর গাড়ী একপাশে পার্ক করে ভেতরে ঢুকতে গেলে দারোয়ান বাঁধা দিলো!
-“ভিতরে কই যাবেন?”
-“ইয়ে…মানে একটু কাজ ছিলো!”
-“কার কাছে যাবেন,কি কাজ,সব বলতে হবে নাইলে ভিতরে যাইতে দেবার নিয়ম নাই!”
রাফিজ দুহাত কোমড়ে রেখে ভাবলো,তাইতো।সে এখানে কার কাছে এসেছে? উম্মে রণ তো কারো নাম নয়।এটার অর্থ রণর আম্মু।সে রণর আম্মুকে কিভাবে চাইতে পারে?দারোয়ান একহাত কোমড়ে দিয়ে রাফিজের দিকে কটমটে চোখে তাকিয়ে আছে।রাফিজ কিছুটা বিব্রত বোধ করলো।দারোয়ান তাকে ছেলেধরাই না ভেবে বসে।রাফিজ ফ্যাকাসে হাসি দিয়ে বললো-“প্রিন্সিপ্যালের সাথে দেখা করবো!”
-“ও….তা আগে কইবেন তো।নতুন টিচার হিসেবে যোগ দিতে আসছেন?”
রাফিজ বিভ্রান্তের মতো উত্তর দিলো–“আ…হ্যাঁ..হ্যাঁ….!”
-“এই দিক দিয়া আসেন।”
অবশেষে দারোয়ান একজন বুয়াকে ডেকে রাফিজকে প্রিন্সিপ্যালের রুমে পাঠিয়ে দিলো।রাফিজ কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করছে।নাযিয়াতকে খোঁজার চক্করে ঘোরের মধ্যে এ পর্যন্ত তো এসে পড়েছে।এবার প্রিন্সিপ্যালকে কি বলবে ও।বলবে,আমার বউয়ের সাথে বিচ্ছেদের আগে কথা হয়েছিলো আমাদের অনাগত সন্তানের নাম রণ রাখবো। বউ হারিয়ে যাবার পর ফেসবুকে উম্মে রণ নামের একজনকে পেয়েছি যে আপনার বিদ্যালয়ের শিক্ষক!তাকে একটু ডাকেন চেক করে দেখি সে আমার হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী কিনা…?
এসব বলবে? প্রিন্সিপ্যাল তখন কি উত্তর দিবে রাফিজের জানা আছে।দু জায়গায় ফোন করবে, একটা থানাতে আরেকটা মেন্টাল হসপিটালে।
-“কি ব্যাপারে এসেছেন বলুন?”প্রিন্সিপ
্যালের ডাকে রাফিজের সম্বিত ফিরলো!
রাফিজ অবাক হয়ে দেখলো ও স্বাভাবিক ভাবেই বলতে পারছে-“আমি আপনার বিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটা জেনেই এসেছি!”
-“অহ্,তাই নাকি।আসুন,বসুন।কোথায় পড়াশোনা করেছেন?”
রাফিজ সহজ সুরে কথা বলতে লাগলো।
প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম সব শুনে মাথা নাড়লেন!রাফিজের দিকে ভালো করে তাকালেন!রাফিজ হালকা কেশে নড়েচড়ে বসলো।ইস্,আরেকটু কমদামের একটা শার্ট পড়ে এলে ভালো হতো!
প্রিন্সিপ্যাল বললেন-
-“এতো ভালো কোয়ালিফিকেশন নিয়ে আপনি কিন্ডারগার্টেনে জব খুঁজছেন?আপনাকে তো অন্যরকম লাগছে!তাছাড়া আপনার বয়সটাও ঠিক সাপোর্ট করছেনা!আপনি এবাভ থার্টি হবেন, তাই না?তো অন্য কোথাও চাকরী না খুঁজে…….”
-“আসলে আমার এ মুহূর্তে এই চাকরীটার প্রয়োজন খুব বেশী!”
-“আচ্ছা…বাচ্চাদের সাথে বাচ্চাদের মতো মিশতে হবে কিন্তু,পারবেন ধৈর্য্য রাখতে?”
–“ইনশাআল্লাহ্!”
-“বেতন কিন্তু খুব কম।কিন্ডারগার্টেনে যেরকম হয় আরকি!”
–“না দিলেও চলবে!”মনে মনে এটা বললেও মুখে বললো-“এটুকুতেই চলবে!”
-“সাধারনত এই সেক্টরে আমরা আরো বাছাই করে লোক নেই,কিন্তু আমাদের দুজন টিচার অসুস্থ!আমার নিজেকে ক্লাস নিতে হচ্ছে।আপনি আপাতত সাব্সটিটিউট হিসেবে কাজ শুরু করুন, আপনার পারফরমেন্স দেখি তারপর আপনার ব্যপারে ভাববো।আর এই হিসেবে আপনি পার ক্লাস হিসেবে একটা অনারিয়াম পাবেন!
পার্মানেন্ট হলে স্যালারি এন্ড আদারস।ওকে?”
-“ইয়েস,থ্যাংকস আ লট!”
-“আজ ক্লাস নিতে পারবেন?”
-“আজ??জ্বী জ্বী…খুব পারবো।”
-“,আসুন,ক্লাস দেখিয়ে দিচ্ছি। আগামী কাল আপনার সার্টিফিকেটস গুলোর একটা করে কপি করে জমা দেবেন!”
-“জ্বী!”
লম্বা বারান্দাটা পেরিয়ে একটা ক্লাসে ঢুকলো রাফিজ।ওর মনে হলো একটা মাছের বাজারেও সম্ভবত এতো ক্রাউডি হয়না।বাচ্চারা বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে,নেচে গেয়ে হুড়োহুড়ি করে একাকার করেছে।প্রিন্সিপ্যালকে দেখে সবগুলো সোজা হয়ে দাঁড়ালো!প্রিন্সিপ্যাল কড়া কন্ঠে বললেন-
-“তোমাদের ক্লাস টিচার কে?”
-“নাযিয়াত মিস্…!”সমস্বরে বাচ্চারা চেঁচিয়ে জবাব দিলো।আর তা শুনে রাফিজের হ্রৎপিন্ড কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে গিয়েছিলো।ও ঠিক শুনছে তো?এই নাযিয়াত কি ওর নাযিয়াত?ওর রণর আম্মু?রাফিজের ভেতরে উথালপাথাল ঢেউ।নিজেকে সংযত রেখে নির্বিকারে দাঁড়িয়ে রইলো সে!
প্রিন্সিপ্যাল রাফিজের দিকে তাকিয়ে বললেন-“আপনি এই ক্লাসটা হ্যান্ডেল করুন।”
রাফিজ নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে উঠলো-“এই ক্লাসের মিস কি অসুস্থ?”
প্রিন্সিপ্যাল খানিকটা চমকে রাফিজের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন-“না না ওর বাচ্চাটা অসুস্থ।ও গতকালই আমাকে বলে ছুটি নিয়ে গেছে!”
-“ওহ্,আচ্ছা।”
“তো,ঠিক আছে,আপনি ক্লাস শেষে আমার রুমে দেখা করবেন!”
-“জ্বী!”
রাফিজ ক্লাসে ঢুকে প্রথমেই বাচ্চাদের সালাম দিলে বাচ্চারা সব চুপ হয়ে গেলো।রাফিজ হাসিমুখে বললো-“কই,সালামের জবাব দিন!”
বাচ্চারা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো-“ওয়াআলাইকুমুসসালাম…..বা
রাকাতুহ্!”
রাফিজের মুখে হাসি! নিজেকে নাযিয়াতের সাব্সটিটিউটর হিসেবে মন্দ লাগছেনা।
…….
চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে