আলো আঁধার পর্ব-০৯

0
1163

#আলো_আঁধার

পর্ব ঃ- ০৯
~আঁখি দেব তৃপ্তি

৫ বছর পর,

শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত আর্ট এক্সিবিশন শুরু হয়েছে কয়েকদিন হলো। এক্সিবিশনে লোক সমাবেশ বেশ চোখে পড়ার মতোই। বিকেল বেলা একাডেমির সামনে একটি গাড়ি এসে থামলো। কয়েকজন ছেলেমেয়ে নামলো গাড়ি থেকে। তারপর এক্সিবিশন দেখতে ঢুকে পড়লো একাডেমির ভেতরে । ঈশান, নিলয়, দিয়া, প্রমি ও শ্রাবণ ওরা ৫ বন্ধু। ওদের বন্ডিং খুবই ভালো। কিন্তু তাও কিছু ক্ষেত্রে হিংসে ও আছে পরস্পরের মধ্যে। মারামারি, ঝগড়া ঝাটিরও অন্ত নেই তাদের মধ্যে তাও দিন শেষে খুব সহজেই এক হয়ে যায় তারা আবার।

ঈশান- বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে। লাইফস্টাইল ফাস্ট ক্লাস। দেখতে লম্বা, ফর্সা, হ্যান্ডসাম। অনেক সুন্দরী মেয়েদের লাইন আছে ওর পেছনে। ঈশান আবার মহান মনের মানুষ কাউকেই সে নিরাশ করে না! ফ্রি টাইম বের করে একটু একটু করে কথা বলে সবার সাথে। তার শখ পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো।

নিলয়- শান্ত মেজাজের ভদ্র ছেলে। হাইট মিডিয়াম, গায়ের রং শ্যামলা, চোখে চশমা আর একটু বোকা বোকা চেহারা। ওর প্রধান কাজ হচ্ছে বাকিদের ঝগড়া মিটিয়ে দেওয়া। শখ পড়াশোনা। তবে একাডেমিক বই নয়। উপন্যাস, গল্প, কবিতা নিয়েই মেতে থাকে সারাক্ষণ। ওর কাছে আর কিছু পাওয়া যাক না যাক বই একটা থাকবেই। ক্লাসে ও বাসায় পড়ার সময় বইয়ের ভেতর গল্পের বই রেখে পড়ায় মগ্ন থাকে ও। সবাই বইকেই তার প্রেমিকা বলে। নিলয়ের মায়ের একটাই আক্ষেপ – ছেলে সারাদিন এতো পড়াশোনা করেও কেনো যে রেজাল্ট ভালো করে না!

দিয়াঃ- লম্বা, টুকটুকে ফর্সা আর অসম্ভব মিষ্টি চেহারার শান্ত, ক্লাসি মেয়ে দিয়া। সবসময় বাঙালী পোশাক পড়ে সে। শাড়ি পড়া তার খুব পছন্দের। খুব ভালো গান গায় দিয়া। গানই তার শখ ও নেশা।

প্রমিঃ- দিয়ার ঠিক উল্টো স্বভাবের মেয়ে প্রমি। প্রমি প্রচন্ড রাগী, খিটখিটে, উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের ও স্টাইলিস। ও সবসময় শার্ট, জিন্স, টপ্স এইরকম পোশাক পড়ে। শাড়ি পড়া তো দূরের কথা দেখলেই ওর কীরকম একটা লাগে। ওর একটাই আপসোস ও কেন দিয়ার মতো লম্বা হলো না। ওর শখ ডান্স করা। যেকোনো হিট গান রিলিজ হওয়ার পড়ের দিনই ও সেটা নিজে করে ফেলে। আগে বাঙালী ক্লাসি নাচ করতো কিন্তু এখন নাকি ওসব আর ওর ভালো লাগে না।

শ্রাবণ ঃ- মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে শ্রাবণ। নিজের পড়াশোনার খরচ টিউশন করে ওকে নিজেই চালাতে হয়। দেখতে লম্বা, হ্যান্ডসাম, গায়ের রং খুব বেশি ফর্সা নয় কিন্তু রাগলে ও পুরো লাল হয়ে যায়। পছন্দের কাজ ফটোগ্রাফি। বিভিন্ন প্রোগ্রামের ফটোগ্রাফি ও করে সে। তার ছবি তোলার হাত খুব ভালো।

এতো আলাদা আলাদা স্বভাবের মানুষগুলোও যে খুব ভালো বন্ধু হতে পারে এর উত্তম উদাহরণ হচ্ছে ওরা। একে অপরের সুখ দুঃখে, হাসি আনন্দে সবসময় পাশে থাকে ওরা।

এক্সিবিশনের ছবিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিল সবাই। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটি ছবির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো শ্রাবণ। সবাই এদিক-ওদিক ঘুরছে কিন্তু শ্রাবণ ওই একটি ছবির সামনেই দাঁড়িয়ে রইলো।

চারিপাশে অতল জলরাশি। খোলা নীল আকাশ আর কিছু গাছপালার ছায়া জলের তরঙ্গে দুল খাচ্ছে। এই স্বচ্ছ জলের মধ্যখানে একটি কালো মেয়ের বিজর্সন। তার মায়াবী মুখখানির অর্ধেকের বেশি জলের নিচে আর একটুখানি উপরে ভাসছে। তার খোলা লম্বা চুল ছড়িয়ে পড়েছে জলের মধ্যে। লাল রংয়ের শাড়ির আঁচলও ভাসছে । তার চোখ দুটি লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে জলে তলিয়ে যাচ্ছে সে!

“কীরে শ্রাবণ এক দৃষ্টিতে কী এতো দেখছিস?”-প্রমি।

প্রমির ডাকে ঘোর কাটলো শ্রাবণের। এতোটাই প্রানবন্ত ছিল ছবিটা যে শ্রাবণের ঘোর লেগে গিয়েছিল। মনে হচ্ছে যেন ক্যামেরায় তোলা কোনো ছবি। কেউ এতোটা নিখুঁত ভাবে এরকম ছবি আঁকতে পারে এই ভেবে অবাক হচ্ছে শ্রাবণ।

” ছবিটা দেখ কী প্রানবন্ত লাগছে তাই না?”

“আমি ছবির অতো সতো বুঝি না। তবে ছবিটা সুন্দর। মেয়েটা সুন্দর হলে আরো ভালো হতো। বেশ কালো লাগছে।”

“সুন্দরের তুই কী কিছু বুঝিস?”

“না আমি বুঝি না সব তুইই বুঝিস। যত্তসব ঢং, কালোকেও নাকি সুন্দর বলতে হবে!”

“এবার কিন্তু বারাবাড়ি করছিস প্রমি।”

“বাহ বাহ তোর এতো লাগছে কেন! মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেলি নাকি? হা হা হা।”

প্রমির হাসিতে রেগে লাল হয়ে গেল শ্রাবণ। কী বলবে আর খুঁজে পাচ্ছে না।

“কী হলো? তোরা আবার ঝগড়া শুরু করলি?”- নিলয়।

” ঝগড়া কীসের? ছবির এ মেয়েটাকে কালো বলায় শ্রাবণের ফাটছে। প্রেমে পড়ে গেছে বেচারা হা হা হা।”

“প্রমি এবার কিন্তু আমি…”- শ্রাবণ।

” হয়েছে থাম তো তোরা। আর প্রমি সবকিছুতে এরকম ফাইজলামি করিস কেন? ছবিটা সত্যিই সুন্দর। “- নিলয়।

” হ্যা হ্যা বুঝেছি সব ভালো মানুষ, আর আমি কিছু বললেই ফাজলামি। দুজনে এই ছবিতে ডুবে ডুবে পানি খা আমি গেলাম। “- বলে রেগে চলে গেল প্রমি।

” ছবিটা ইন্টারেস্টিং না নিলয়?”

“হুম, নিখুঁত আঁকা। কালো মেয়েকে এতো সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলতে আমি এই প্রথম দেখলাম।”

“দাঁড়া এটা ফোনে ফটো তুলে রাখি। “- বলে শ্রাবণ নিজের মোবাইল ফোন বের করে কয়েকটি ফটো তুললো।

” হয়েছে তো তোলা এবার চল দেরী হয়ে যাচ্ছে। আমাদের তো এখান থেকে আরেকটা জায়গায় ঘুরতে যাবার কথা।”

“এই ছবিটি যে এঁকেছে তার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হচ্ছে। ”

“ছবি দেখে মন ভরলো না তোর শিল্পীকেও দেখতে হবে!”

“তুইও প্রমির মতো শুরু করলি?”

“হাহা, আচ্ছা দেখি এখানের দায়িত্বে যারা আছেন তাদের জিজ্ঞেস করে শিল্পী এখানে আছেন কিনা। ছবির নিচে কী নাম লিখা দেখ তো।”

“আরে ছবির নিচে যে নাম লিখা আছে তা এতোক্ষণ খেয়ালই করি নি।”

শ্রাবণ ছবির নিচের নামটি পড়লো -“আলো-আঁধার। ”

“এ আবার কেমন নাম?”-নিলয়।

” আমিও তাই ভাবছি।”

“আচ্ছা তুই দাঁড়া এখানে আমি অফিসে জিজ্ঞেস করে আসছি।”

“আচ্ছা।”

নিলয় চলে যাবার পর শ্রাবণ আবার ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলো একমনে।

“কী রে শ্রাবণ অনেকক্ষণ ধরে দেখছি তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস?”-ঈশান।

“ছবিটা দেখ ঈশান, কতো প্রানবন্ত। ”

“আর বলিস না ভাই মেয়েদের জ্বালায় ছবিগুলো ঠিকমতো দেখতে পারলে না। একেকজন গায়ে পড়ে কথা বলা শুরু করে দেয়। আমি তো আবার কাউকে সহজে ইগ্নোর করতে পারি না।”

” হয়েছে তোর ভাব-সাব এখন রাখ আর ছবি দেখ। আমি আছি দেখি কোন মেয়ে তোর গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে।”

ছবিটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ঈশান বললো- “দোস্ত দারুন একটা ছবি। আমি কী ভাবছি এখন বল তো?”

“কী?”

“এরকম একটা কালো মেয়েকে বিয়ে করে ফেলবো এতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে চারপাশে তাও কারো প্রতি মন থেকে কোনো টান আজও ফিল করলাম না!”

“তোর মন থাকলে না ফিল করবি।”

“কী বললি তুই? আমার এতো মহান মনকে তুই অপমান করলি যা আমি তোদের দেখিয়ে দিব একদিন ঈশান কী জিনিস। ”

“হাহাহা দেখা আছে ও আমার।”

“মজা নিস না। আমাদের লেইট হয়ে যাচ্ছে নিলয় কোথায়?”

“এ ছবির আর্টিস্ট এর খুঁজ করতে গেছে।”

“বাহবাহ! ছবি দেখতে দেখতে এখন তোরা কে এঁকেছে তাও খুঁজতে শুরু করে দিলি?”

“এ ছবি সত্যি অন্যরকম তাই দেখার ইচ্ছে সেই প্রতিভাবান ব্যক্তিকে এইটুকুই।”

“ও আচ্ছা তা দেখি তো শিল্পীর নাম কী?”- বলে ঈশান ছবির নিচে তাকিয়ে বললো- ” ওমা এ তো মেয়ে শিল্পী মনে হচ্ছে কিন্তু আলো-আঁধার এ আবার কেমন নাম।”

নিলয়কে আসতে দেখা গেল। কাছাকাছি আসতেই ঈশান জিজ্ঞেস করলো- “কীরে নিলয় সেই নারীর দেখা পেলি?”

“না, উনি নাকি আরও পরে আসেন সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে আবার নাও আসতে পারেন।”

“তাহলে তো আর দেখা হলো না। চল সবাই আমাদের তো একটা জায়গায় যাবার কথা ভুলে গেলি?”

“আমার যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না তোরা যা।”- শ্রাবণ।

” কী? তা তোমার কী ইচ্ছে হচ্ছে শুনি? সেই রমনীর অপেক্ষা করা এখানে বসে হা হা হা।”-ঈশান।

“বাজে বকিস না ঈশান।”- শ্রাবণ।

” তুই যাবি না তোর ঘাড় যাবে।”- বলে ঈশান টেনে টেনে শ্রাবণকে এক্সিবিশনের বাইরে নিয়ে এলো।

সবাই মিলে গাড়িতে মজা করতে করতে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যে। কিন্তু শ্রাবণ সবকিছুর মধ্যে থেকেও অন্যমনস্ক হয়ে আছে। তার মাথায় এখনো ঘুরছে সেই প্রানবন্ত চিত্রটি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে