আলো-আঁধার পর্ব-০৯

0
853

#আলো-আঁধার🖤
#লেখিকা: সালসাবিল সারা
৯.
গতকালের ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়টা রাণীকে জেঁকে ধরেছে।রাণীর মনে এক অদ্ভুত ভয় কাজ করছে।সত্যিটা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়।এতিম খানায় রাণীকে অপছন্দ করে এমন মানুষের অভাব নেই।আর এই এতিম খানায় বেশিরভাগ মানুষই অন্যর দোষ খুঁজে বেড়ায়।তাই গতকালের কথা কোনো ভাবে ফাঁস হলেই,রাণীকে এর বদনাম সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।রাণী তো এতিম খানার বাজে মেয়েদের মতো না।রাণীর চরিত্র নিয়ে কেউ মিথ্যে বলে বেড়ালে রাণীর সেটা মোটেই ভালো লাগবে না। গত রাতটা কাটিয়েছে রাণী বেশ চিন্তায়। ভোরের দিকে রাণীর ঘুম ভেঙে যায় এক ভয়ংকর স্বপ্নে।কিন্তু আবারও গতকালের কথা ভাবতে ভাবতে রাণী আবারও ঘুমিয়ে পড়েছিল।এখন রাণীর ঘুম ভাঙলো গলায় কারো স্পর্শ পেয়ে।ধরফর করে ঘুম থেকে উঠে সে দেখতে পেল কলি তার দিকে তাকিয়ে আছে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে।রাণী নিজের গলা ঢেকে ফেললো ওড়না দিয়ে।ঘুমের ঘোরে কখন তার গলা থেকে ওড়না সরে গেলো এটা রাণী বুঝতেই পারেনি।
নাস্তা খেতে যাওয়ার জন্যে,রাণীকে ডাকতে এসে কলি দেখলো রাণীর গলায় কিছু ক্ষত দেখা যাচ্ছে।সেই ক্ষত ছুঁয়ে দেখতেই রাণী জেগে গেলো।রাণীর চোখে ভয় আর এই ক্ষত ঢাকতে দেখে কলি রাণীকে প্রশ্ন করলো,” গলায় কি হয়েছে তোর? কাল তোর এমন কোনো ক্ষত আমার চোখে পড়েনি!” রাণী জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললো।কলিকে খাটে বসিয়ে কলির হাত ধরে গতকালের সব ঘটনা বুঝিয়ে বললো রাণী কলিকে।কলির বুক ধুক করে উঠে প্রিয় বান্ধুবির জন্যে।তবে সে আল্লাহ্ এর কাছে শোকরিয়া করছে,তার বান্ধুবীর তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি তাই।রুম থেকে বেরুনোর আগে রাণী কলির সামনে হাত জোড় করে বললো,”আমি জানি কাল যা হয়েছে,সেখানে আমার কোনো দোষ নেই।সব দোষ ঐ মুটি সাবিনার ছেলের।কিন্তু আমরা তো এতিম।তাদের সাথে লড়াই করার মতো শক্তি বা সামর্থ্য আমাদের নেই।তোর কাছে একটাই রিকুয়েস্ট করছি,কেউ যেনো এই ঘটনা সম্পর্কে না জানে।তুই জানিস,এতিম খানার সবার মন মানসিকতা কেমন!আমি জানি,ম্যাডাম সবটাই জানে কালকের ঘটনা।আমার সাথে এইসব ব্যাপারে কথা বললে সব জানাজানি হয়ে যাবে,তাই ম্যাডামও চুপ করে আছে।” রাণীর হাতজোড়াতে কলি হাত রেখে বলল,”আল্লাহ্ এর কাছে শোকরিয়া,তোর বড় কোনো ক্ষতি হয়নি।ভাগ্যিস,তুই এই ঘটনা আড়াল করছিস সবার কাছ থেকে।এতিম খানার অন্য মেয়েরা কেমন আমি ভালো করেই জানি।তার উপর রাহেলা খাতুন এই বিষয়ে জানলে সে নিজেই তোকে বদনাম করে ছাড়বে।অন্য লোকের সাথে তোকে রাত কাটানোর কথা বলতেও মহিলাটি দুইবার ভাববে না।তুই চিন্তা করিস না।কথাটি আমার পেটে থাকবে।” রাণীর মুখের ভয় আরো বেশি বাড়লো।হাত, মুখ ধুয়ে কলির হাত ধরে রাণী রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।ক্যান্টিন থেকে প্লেটের চামচের শব্দ আসছে অনেক দূর থেকেই।ক্যান্টিনে ঢুকতেই রাণীকে সিমি হাত দেখিয়ে ডাকলো।রাণী মুখে হাসি ঝুলিয়ে সেদিকে গেলো কলির সাথে।রিয়া রাণীর জন্যে খাবার এনে দিলো।রাণী খুব ধীরে খাবার মুখে দিচ্ছে।এই দেখে ফারিয়া রাণীকে বললো,”কি ব্যাপার!আজ রাণী এতো চুপচাপ কেনো?কি হয়েছে তোমার?” রাণী একটু মলিন হাসলো ফারিয়ার কথায়। “আমি ঠিক আছি।কিছুই হয়নি আমার”,রাণী বললো। ফারিয়া মাথা নাড়িয়ে নিজের খাবারে মন দিলো। হঠাৎ করে চিল্লিয়ে ক্যান্টিনে ঢুকলো রাহেলা।আজ তার গলায় বেশ তেজ শোনা যাচ্ছে।একপাশে মুখের পান ফেলে রাহেলা বলে উঠলো,”কই সে গুণবান মাইয়্যা,যে দিনের বেলায় দেহ ব্যবসা কইরা ঘুরে বেড়ায়?” ক্যান্টিনের সবাই চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে রাহেলার দিকে।রাহেলা ধপ ধপ পায়ে এগিয়ে আসছে।এর মধ্যে কিছু মেয়ে বলে উঠলো,”নাহ,খালাম্মা।আমরা তো আপনার দেওয়া কাস্টমারের কাছেই যায়।আর তাতেই আমরা খুশি।” মেয়েগুলোর কথায় রাহেলা খেঁকিয়ে বললো,”তোরা না।এইডা হ‌ইলো মুখোশের আড়ালে দুশ্চরিত্র মানুষ।যে অন্যের সামনে ভালো সাইজা থাকে আর ভেতরে ভেতরে দেহ ব্যবসা ক‌ইরা বেড়ায়।” রাহেলার কথায় সিমি বলে উঠলো,” কে সেই দুশ্চরিত্রা?” রাহেলা হলকা হাসলো।তার আঙ্গুল রাণীর দিকে ইঙ্গিত করে বলে উঠলো,
” রাণীর গলা থেকে ওড়না সরিয়ে দেখ।” সিমি তার হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে রাণীর কাছে গেলো।রাণী তার ওড়না শক্ত করে ধরে রয়েছে।চোখে পানি টলমল করছে রাণীর। রাণী,সিমিকে ওড়না না সরানোর জন্যে ইশারা করছে।কিন্তু সিমি সেইসব না বুঝে এক টান দিয়ে রাণীর ওড়না খুলে নিলো।রাণী চিল্লিয়ে উঠলো আতংকে।রাণীর গলায় এমন আঁচড়ের দাগ দেখে সবাই কানাঘুষা করা শুরু করে দিলো।সিমি আহত কণ্ঠে রাণীকে বললো,
“তোর গলায় এইসব কি?” রাণীর গলা আটকে আসছে কান্নার কারণে।রাণী কিছু বলতে যাবে এর আগেই রাহেলা বলে উঠলো,”এইসব হইলো,তার নষ্টামির নমুনা। কাল নাকি শান্তি মহলে গেছিল রাণী।সেখানেই ছোট সাহেবের সাথে দিন কাটায় আইছে এই মাইয়্যা।আমার কথা হইলো,আমি যখন তারে এইসব কথা বলতাম সে নাক সিটকাইতো।আর এহন দেখো,মাইয়্যা তো তলে তলে আরো বাজে কাম করতাছে।” রাণী জোরে চিল্লিয়ে উঠলো রাহেলাকে,” চুপ করুন, নোংরা মহিলা।আমি এইসব কিছুই করিনি। ঐ সাবিনার ছোট ছেলে আমার সাথে খারাপ কাজ করতে চেয়েছিল।কিন্তু বড় সাহেব মানে তূর্যয় আমাকে বাঁচিয়ে ফেলেছিলেন, আমার উপর কোনো দাগ বসার আগেই।আমার গলার এইসব আঁচড় ঐ নরপশুর সাথে হাতাহাতি করার সময় লেগেছিল।এর বেশি কিছু না।” রাহেলা হেসে উঠলো কিটকিটিয়ে।সে চেয়ারে বলে হেসে বললো,”শিখাস আমারে? ঐ তূর্যয় বড় সাহেব তোরে বাঁচানোর লাইগা সেই বাসায় সারাদিন বইসা ছিল,তাই না? তা,তুই কি লাগোস তার? ভালো ভালো পোলা বেডিরে নির্মমভাবে মারে তূর্যয় সাহেব।আর উনি কিনা তোরে,এক এতিমরে বাঁচাইসে!হাহাহা,
বড্ড হাসি আইলো।আচ্ছা, বাদ দে এতো কথা।আজ রাইত থেকে আমি তোরেও সাপ্লাই দিমু।রেডি থাকিস।নষ্ট একবার হয়েছিস,এখন বারবার নষ্ট হইলে কিছুই যায় আসবো না।” রাহেলার কথায় রাণী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।রাণীর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।সে কান্না মাখা কণ্ঠে বলল,” আমি নষ্ট না।আমার গায়ে কোনো অপবিত্র ছোঁয়া লাগেনি।বিশ্বাস করুন সবাই আমার কথায়।” রাণী কান্না করতে লাগলো কথাগুলো বলে।
“বিশ্বাস করি।অনেক বেশি বিশ্বাস করি আমি তোকে।অন্যদের কথা জানিনা।তবে আমি তোকে বিশ্বাস করি।”
সালেহার এমন কথায় রাণী এক দৌড়ে সালেহাকে জড়িয়ে ধরলো।রাণীকে জড়িয়ে ধরে সালেহা আবারও বলল,”কিন্তু আমি তারে বিশ্বাস করি না।সাবিনা মালকিন আমার খাঁজ মানুষ।আমি তারে অবিশ্বাস করমু না।আজ থেইকা এই মাইয়্যা কামে যাইবো।এই মাইয়্যা নষ্ট না হইলে আমি কখনোই এরে জোর করতাম না এইসব কামে আসার লাইগা।কিন্তু এখন তো সে নষ্ট হইয়া গেছে।আপনার কথাও আমি শুনমু না ম্যাডাম।” রাহেলার এমন কথা শুনে মাথা ঘুরছে রাণীর।আজ যেনো রাণী তার মুখ খুলতে পারছে না।তার শরীর গলা সবকিছুই ভার লাগছে।এইভাবে তার না করা পাপের বোঝা রাণী বহন করতে মোটেও প্রস্তুত নয়।রাণী সালেহা থেকে সরে এলো।সে রাহেলার উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো,”আপনি কি যা তা বলছেন?আপনি বলবেন আর হয়ে যাবে?আমি যাবো না কোথাও।আপনি নিজেই বের হয়ে যান এই জায়গা থেকে।” রাণীর গলায় রাগ স্পষ্ট।রাণীর কথায় অন্য মেয়েরা বলে উঠলো,”নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ কর,এরপরই আমরা সবাই তোর কথা বিশ্বাস করবো।তোর জায়গায় আমরা হলে তুই কি প্রমাণ ছাড়া আমাদের বিশ্বাস করতিস?জীবনেও করতিস না।তাই বেশি কথা না বলে প্রমাণের ব্যবস্থা কর।নাহলে আমরা নিজেরাই তোকে আমাদের সাথে জোর করে নিয়ে যাবো কাস্টমারের কাছে।” রাণী আবারও বিপাকে পড়লো।এই এতিম খানা তার নিজের ঘর হলে রাণীর আজ কাউকে কোনো প্রমাণ দেখাতে হতো না, এমনটাই রাণী ভাবছে।এই এতিম খানায় তার প্রিয়জন আছেই বা কয়জন! রাণী চুপ করে রইলো।এর মাঝে সিমি বলে উঠলো,
” তূর্যয়,বড় সাহেব যখন তোকে উদ্ধার করেছে;তাই তুই উনাকে নিয়ে আয় এইখানে প্রমাণের জন্যে?এই কাজটাই তো করতে পারিস।উনি এসে সবটা বললেই সবার সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে।” সিমির কথা কেনো রাহেলার পছন্দ হলো।কারণ,রাহেলা জানে তূর্যয়কে পাওয়া এতো সহজ নয়।তাই সিমির এই পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে বৃথা যাবে আর রাণী হবে তার ব্যবসার অন্যতম শিকার। রাহেলা হেসে বললো,”বাহ্,সুন্দর কথা।তাহলে এইটাই করা যাক।কিছুদিন সময় দিলাম তোরে।এরমধ্যেই নিজেরে নির্দোষ প্রমাণ করবি। নাইলে তোরে আমার ব্যবসায় ঢুকাইতে আমার এক মিনিটও দেরী হইবো না।এমনি তো রাহেলা কাউকে এইসবে জোর করে না।কিন্তু ,তুই নষ্ট; তাই তোর কোনো ভবিষ্যত হবে না। আমিই তাই তোর আয় রোজকারের ব্যবস্থা করি দিমু।” রাণীর গা ঘিনঘিন করে উঠলো।সিমির আইডিয়াটাও রাণীর ভালো লাগলো না।তূর্যয় রাণীকে সাহায্য করবে বলে রাণীর মনে হয় না।রাণী ক্যান্টিন থেকে দৌড় দিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে।অন্যদিকে সালেহা সবাইকে চিল্লিয়ে বললো,”রাণীর ব্যাপারে আর কেউ কিছু বলবে না।সময়ের সাথে সবাই সব কিছু দেখতে পাবে।রাণীকে এই নিয়ে কেউ কিছু বললে বা মজা করলে তাকে এই এতিম খানা ছাড়তে হবে।আর রাহেলা খাতুন আপনি আমার অফিসে আসুন।” সালেহার পেছনে পেছনে রাহেলা যেতে লাগলো।রাণী তাদের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।মুখে হাত দিয়ে সে বসে পড়লো দরজার পাশে।আপনমনে কান্না করে রাণী বলে উঠলো,”পরিবার কি কখনোই জানতাম না।এই এতিম খানার সবাইকে আপন ভাবতাম।কিন্তু এইসব শুধু আমার মনের ধারণা।পর কখনো আপন হয় না, কথাটা একদম সত্যি।আমার কিছু বান্ধুবি আর ম্যাডাম ছাড়া আমাকে কেউ আর বিশ্বাস করছে না।আমার নিজের পরিবার কি আমাকে এমন করে ছোট করতো?প্রশ্ন করতো?আমাকে অবহেলা করতো? করতো না।বাবা,মা তোমরা কেনো আমার সাথে এমন করেছো?কেনো?আমার কি দোষ ছিল?” রাণীর কান্নার মাত্রা বাড়তে লাগলো।পরক্ষণে সে ভাবলো,”আমি দোষ করিনি,তাহলে আমি কেনো কান্না করবো? তূর্যয়ের কাছে যেতে হবে আমার। একমাত্র উনিই পারবেন আমাকে সাহায্য করতে।উনার অফিস আর সবকিছুর খবর আমাকে শুধু নাজিম ভাই দিতে পারবেন।” রাণী উঠে দাঁড়ালো।দরজা খুলে সে সামনের দিকে যেতে লাগলো নাজিমের কাছে।

দুই তলার একটা জমিদার বাড়ি উপর নিচ ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখছে তূর্যয়। সমুদ্র পাড় থেকে বাড়ি যাওয়ার সময় এই বাড়ি নজরে আসে তূর্যয়ের। প্রথম দেখায় বাড়িটি ভালো লাগে তার।খবর নিয়ে সে জানতে পারলো,বাড়িটি জমিদার বাড়ির নকশায় করানো হয়েছে আর বাড়িটি সম্পূর্ণই বিক্রি করা হবে। এই বাড়ি থেকে সমুদ্র বেশ কাছেই।পুবের দিকের ব্যালকনিতে দাঁড়ালে স্পষ্ট সমুদ্র দেখা যায়। সমুদ্রের শব্দ বেশ ভালো করেই শোনা যায় সম্পূর্ণ ঘর জুড়ে। এই জিনিসটাই বেশ মুগ্ধ করেছে তূর্যয়কে। তাই তূর্যয় ভাবছে দিনের যে সময় সে শান্তি মহলে কাটে সেই সময়টা সে এই বাড়িতে কাটাবে।আর রাতের জন্যে সে শান্তি মহলে যাবে।কারণ একটাই,তার মায়ের কাছে তূর্যয় এই ব্যাপারটাই ওয়াদাবদ্ধ।হ্যারি তূর্যয়ের সাথে এই বাড়ির সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।এই বাড়িটা হ্যারিরও বেশ ভালো লেগেছে।হ্যারি খুশি হয়ে তূর্যয়কে বললো,”তোমার জন্যে এই হাউজটা জোস হবে, ব্রো।এইখানে তুমি তোমার সিক্রেট মিশনগুলো ইজিলি করতে পারবে।নিয়ে নাও এই বাড়ি।” তূর্যয় হাসলো হ্যারির কথায়।হ্যারির কাঁধে হাত রেখে তূর্যয় হ্যারিকে বললো,”হ্যাঁ,ঘরটা আসলেই সুন্দর। ঐ শান্তি মহল থেকে আমি এইখানে বেশি শান্তি অনুভব করছি।সমুদ্রের এই শব্দ বড্ড মনোরম।” তূর্যয় কথাগুলো বলে চোখ বন্ধ করতেই তার চোখে রাণীর চেহারা ভেসে এলো।বুকের মধ্যে তীব্র শব্দ হওয়ার সাথে সাথে অস্থির লাগতে শুরু করলো তূর্যয়ের।রাণীর চেহারাটা ইদানিং বড্ড ঘুরঘুর করে তূর্যয়ের চোখে।এইযে যেমন কাল রাতটা তূর্যয়ের কেটেছে রাণীর চিন্তায়।এইদিকে সে বড্ড হিংস্রতা দেখায় সবার সাথে আর সে সামান্য রাণীর ঐ রক্তমাখা গলার ক্ষতের ছবি ভুলতে পারছিল না। রাণীর কথা আবারও মনে আসতে তূর্যয় নিজের হাত মুঠ করে নিলো।আপনমনে সে বলতে লাগল,”ভুলে যা তার কথা, তূর্যয়।তুই হিংস্র।তোর মনে কারো জন্যে দরদের জায়গা নেই।” কথাগুলো ভেবে তূর্যয় হ্যারি থেকে সিগারেট নিয়ে সেটিতে আগুন ধরিয়ে সিগারেট ফুঁকতে লাগলো।
একটু আগে হ্যারি নিচে নেমেছিল বাড়ির কাগজ আর পেমেন্ট সবকিছু সামলাতে।তূর্যয় বাড়ির দাম চুকানোর জন্যে চেকে নিজের সিগনেচার দিয়ে দিয়েছিল। মূলত হ্যারি সেটাই দিতে গিয়েছিল বাড়ির পূর্বের মালিককে।টাকার লেনদেনের মাধ্যমে বাড়ির বর্তমান মালিক হয়ে গেলো তূর্যয়।এখন শুধু বাড়ির কাগজগুলোতে তূর্যয়ের নাম বসানো দরকার। হ্যারি তার হাতের কাগজগুলো তূর্যয়ের হাতে দিয়ে বলল,” এইগুলো দিয়েছে, ওল্ড ম্যান।টেক ইট।” তূর্যয় পেছনে না ফিরেই বলে উঠলো,”স্টপ ইট,রাণী!” হ্যারি চোখ বড় করে ফেললো। সে জোরে বললো,”আই অ্যাম হ্যারি। নট রাণী।রাণী কে?ওহ,ঐযে জঙ্গলের মেয়েটা!” তূর্যয় নিজেও হতবাক নিজের কথায়।সে চুপ করে রইলো।সিগারেটের একটা বড় টান দিয়ে তূর্যয় হ্যারিকে বলে উঠলো,”শাট আপ,হ্যারি।দাও কাগজগুলো।” হ্যারি চেয়েছিল তূর্যয়কে আরো কিছু বলতে।কিন্তু তূর্যয়ের চড়া মেজাজ দেখে হ্যারি আর কথা আগালো না।তবে, হ্যারি নিশ্চিত হয়ে নিলো রাণী নামের মেয়েটার কথা তূর্যয়ের মনে এখনো দাগ কেটে আছে।অন্যদিকে নিজের এমন কান্ডে নিজেই রাগে ফেটে যাচ্ছে।হাতের কাগজগুলোতে মুঠ করে ধরে তূর্যয় আপনমনে বলে উঠলো,”শেষ পর্যন্ত এই মেয়ের নাম হ্যারির সামনেই নিতে হলো!না চাওয়া সত্বেও এই মেয়ের কথা বারবার কেনো মনে আসছে আমার!” তূর্যয় খুব জোরেই ঘুষি দিলো ব্যালকনির রেলিং এ।

রাণী সব খবর নিয়ে নিলো তূর্যয়ের অফিস সম্পর্কে।তূর্যয়ের অফিস বেশ দূরে তাদের এতিম খানা থেকে।সকালে ঘুম থেকে উঠে মাটির কিছু জিনিস বানিয়ে নিলো রাণী তার বন্ধুবীদের সাহায্য।এরপর বাকি কাজ তাদের বুঝিয়ে দিয়ে রাণী রেডি হয়ে নিলো।তাদের কেনা মোবাইলটা নিলো না রাণী।যদিও সবাই তাকে মোবাইল নিতে বলেছিল,কিন্তু রাণী এতে অমত জানালো।রাণী একটা কাগজে তূর্যয়ের অফিসের ঠিকানা লিখে নিলো।এরপর সে লোকাল গাড়ি করে সেই ঠিকানার উদ্দেশ্যে যাচ্ছে।সেখানে পৌঁছে রাণী সামনের দিকে হাঁটছে।এতো বড় অফিস দেখে রাণীর মনটা ঘাবড়াতে লাগলো।রাণী নিজের মাথায় ভালো করে কাপড় দিয়ে দিলো যেনো গলার কোনো ক্ষত দেখা না যায়।অফিস গেটের সামনে আসতেই রাণীকে দারোয়ান নানান প্রশ্ন করতে লাগলো।তূর্যয়ের অফিস সাধারণ অফিস না।এইখানে মেয়েদের আনাগোনা একদমই নেই।দারোয়ান তাই সন্দেহ করে তাকে প্রশ্নের সাগরে ভাসিয়ে নিচ্ছে। রাণী নিজেই বিপর্যস্ত হয়ে আছে দারোয়ানের প্রশ্নে।তখনই তাকে হ্যারি “রাণী” বলে ডাক দিল।হ্যারি মাত্রই এসেছে অফিসে।রাণীকে গেইটে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে হ্যারি নিজের গাড়ি থেকে নামলো।সে হেসে রাণীকে বললো,”হেই কুইন।তুমি এইখানে?” রাণী অবাক হলো তূর্যয়ের সাথে থাকা বিদেশীদের মতো দেখতে লোকটিকে দেখে।তার উপর লোকটি তার নামকে ইংরেজিতে উচ্চারণ করে বলছে।তবে হ্যারিকে দেখে রাণীর ভয়ের জায়গায় উল্টো ভালো লাগলো।রাণী কাঁপা কণ্ঠে বললো,” তাশরীফ তূর্যয়ের সাথে একটু দরকার ছিল।” হ্যারি যেনো তার প্ল্যানের কোনো ইঙ্গিত পাচ্ছে রাণীকে দেখে। হ্যারি রাণীকে আবারও বললো,”আচ্ছা চলো ভেতরে।তূর্যয়ের সবকিছু আমিই সামলায়।ব্রো এখন একটু রেস্ট করছে।এক ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসবে। ইউ ক্যান টেল মি দা প্রব্লেম। আমি তোমাকে হেল্প করার ট্রাই করবো।” রাণী মাথা নাড়ালো হ্যারির কথায়।এরপর সে হ্যারির সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছে।রাণী ধীরে ধীরে তার সব কথা হারিকে জানাচ্ছে। হ্যারি সবকিছু মনযোগ দিয়ে শুনছে।রাণীর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা সে আগে থেকেই জানে।তাও সে রাণীর সব কথা শুনছে।হ্যারি মনে মনে অন্য একটা প্ল্যান করছে।হ্যারির মুখে ঝুলে আছে আপনজনের জন্যে ভালো কিছু করার আশার হাসি।

তূর্যয় একটা বড় রুমে দুইজনকে বেঁধে রেখেছে।এই দুইজন কিছুদিন আগে এক বাচ্চাকে খুন করেছে পারিবারিক শত্রুতার জের ধরে।বরাবরের মতো খুনীরা বিত্তবান হওয়াতে টাকার জোরে থানা থেকে কিছুদিনের জন্যে ছাড়া পেয়েছিল।এর মধ্যে বাচ্চাটির বাবা তূর্যয়কে এই মিশন দেয়।নিরীহ বাচ্চার খুনের কথা শুনে তূর্যয়ের মেজাজ বেশ খারাপ হলো।তাই দেরী না করে তূর্যয়ের লোকেদের মাধ্যমে সেই খুনিদের উঠিয়ে এনেছে তূর্যয়।সকাল থেকেই নানা টর্চার করেছে তূর্যয় তাদের।লোকগুলো হাতজোড় করে প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছে।কিন্তু শেষ মাইরের আগে তূর্যয় তাদেরকে বলে উঠলো,” বাচ্চাটিকে খুন করার আগে তোদের বুক কি একবারও কাঁপলো না?সেই নিরীহ বাচ্চা কি ক্ষতি করেছিল তোদের?তোর শত্রুতা তার বাবার সাথে।তার বাবাকেই নাহয় দুনিয়া থেকে বিদায় করতিস।কিন্তু সেই বাচ্চাটির কি দোষ?বাচ্চা আর মেয়ে মানুষের জন্যে আসা মিশনে আমি কোনো দয়া দেখায় না।তাই মর এইবার তোরা।”
তূর্যয়ের দুই হাতের ধারালো ছুরি প্রবেশ করলো দুই খুনীর বুকে।অনবরত ছুরি বসিয়ে চললো তূর্যয় তাদের বুকে।লোকগুলো তীব্র আর্তনাদ করে একসময় একদম চুপ হয়ে গেলো।তূর্যয়ের সব চুল চোখের সামনে এসে পড়েছে।তূর্যয় তার লোকের ধরে রাখা পানির বোলে ভালো করে হাত ধুয়ে নিজের চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে ঠেলে উপরে উঠিয়ে নিল।এরপর সে চেয়ারে বসে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো।তূর্যয় চিল্লিয়ে বলতে উঠলো,
“অপরাধীদের কখনোই ক্ষমা করে না তূর্যয়।আমার মনে কোনো দয়া নেই।আমি নির্দয়, আমি পাষাণ।আমি শুধু হিংস্রতা চিনি আর কিছুই না।আমার জীবনে কোনো মেয়ের প্রবেশ নিষেধ।সেই রাণী মেয়েটিরও না।” শেষের দিকে বলা নিজের কথা শুনে তূর্যয় নিজেই অবাক হয়ে গেলো।এমন একটা হিংস্রতার মুহূর্তেও তার রাণীর কথা মাথায় আসছে।রাগে তূর্যয়ের শরীর যেনো এখনই ছিড়ে যাবে।তূর্যয়ের মাথায় এটাই আসছে না,তার সব কথা ঘুরে ফিরে সেই রাণী নামের মেয়েটিতেই কেনো ঠেকছে? রাগের মাথায় একহাতে তূর্যয় নিজের চুল টেনে ধরলো।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে