আম সন্দেশ পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
1373

#আম_সন্দেশ
#পর্ব_১০( শেষ পর্ব)
#রিমি_ইসলাম

কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনা,

বলেই ঝটকে দূরে সরে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে টেনে ডাইনিংয়ে নিয়ে এলেন। সেখানে বাবা আর দাদি সোফায় বসা। মা রান্নাঘরে। তানিয়া আপু, লিনা আপু বিপরীত পাশের সোফায় বসে ফোনে মগ্ন। প্রভাত ভাই অল্প কেশে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে সবাই তাঁর দিকে তাকায়। তাঁকে আজকের মতো এতো সিরিয়াস কখনো দেখিনি।
বাবা থতমত মুখে বললো,

___’ কিছু বলার আছে?’

প্রভাত ভাই বেতাল কথায় না জড়িয়ে সোজা মূল প্রসঙ্গে চলে গেলেন।

___’ আমাদের বিয়েটা আজকে দেওয়া হোক।’

বাবা সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে ধমকের সুরে বললো,

___’ ” দেওয়া হোক” এটা কেমন ধরনের কথা? তুমি কি আমাকে অর্ডার করছ?’

বাবার চেঁচামেচিতে উপস্থিত সকলের মুখে ভয়ার্ত ভাব ফুটে উঠলো। মা রান্না ফেলে দৌড়ে এলো। তবে এত কিছুর পরও প্রভাত ভাই নির্বিকার। যাকে ঘিরে সবার উদ্বেগের সৃষ্টি, সে-ই ঠান্ডা। তিনি ফ্যাকাসে হেসে বললেন,

___’ মামা, আপনি আমাকে ভালোমতোই চেনেন। আপনার মেয়ে বাইরে কি করে না করে সব খবর জানি। এবং জানার পরেই এই সিদ্ধান্তে এসেছি বিয়েতে এক মুহূর্ত কাল বিলম্ব আমার সইবে না। আপনি এটা জানেন আমি অনেক কিছুই করার ক্ষমতা রাখি। সিদ্ধান্ত আপনার।’

বাবা ভড়কে গেলেন। অসহায়ত্ব স্পষ্ট তার চোখে মুখে। প্রভাত ভাই বাবাকে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করবেন ভাবতেও পারছি না। আর আমি বাইরে এমন কোনো কুকর্ম করিনি যে তিনি তা দিয়ে ভয় দেখাবেন। তবে? এসব কিসের ইঙ্গিত?
বাবার সিদ্ধান্ত চরম ঘোষণা করে আমাদের বিয়ে আজকে দেওয়ার ব্যবস্থা হলো। ঘন্টা খানেকের মধ্যে ফুফা,ফুপি এসে হাজির। ব্যস, ঘরোয়া লোকজনের মাঝেই বিয়ের শুভ কাজ সম্পন্ন হয়ে গেল।

বর্তমান,

বাসর বলতে কোনো জিনিস রইল না। স্বাভাবিক ভাবে প্রভাত ভাইয়ের রুমে বসিয়ে দিয়ে লিনা আপু চলে গেছে। আমার সাথে এসেছে দাদি আর লিনা আপু। বিয়ের পর থেকে দাদির সাথে কথা বলার সৌভাগ্য হয়নি। এমনকি লিনা আপুর সাথেও না। সবার মাঝে এক অদ্ভুত ব্যস্ততা লক্ষ্য করছি। হয়তো তাড়াহুড়োর বিয়েতে এমনই হয়। বিদায় বেলায় বাবার মুখে যে ক্লেশ দেখে এসেছি তা ভুলতে পারছি না। প্রভাত নামক মানুষটা আমার জীবনে আপদ থেকে দূর্ভাগ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। চাপা আর্তনাদ বুকজুড়ে ভর করছে। শব্দ করে কাঁদতে চাইছি। সবস্ত গ্লানি, কষ্ট ঝেড়ে মুছে হাল্কা হতে চাচ্ছি, পাচ্ছি না। এই ভয়ানক পরিস্থিতি আমাকে আরও দগ্ধ করছে ভেতরে ভেতরে।

প্রভাত ভাই এলেন। খুব সুন্দর করে ফ্রেশ হয়ে এসেছেন। তাঁর আসা মাত্র ঘরময় এক সুন্দর গন্ধে ছেঁয়ে গেছে। আমি ফ্রেশ হবার সুযোগ পেয়েছি তবে ইচ্ছে করেনি বলে ঠায় সেভাবেই বসে আছি। তাঁর পরনে…..মাত্র একটা প্যান্ট। গা খালি। আড়চোখে দেখে সরাসরি তাকানোর মতো দুঃসাহস দেখাতে পারছি না। যদিও এই মুহূর্ত থেকে তিনি আমার জন্য হালাল। সুতরাং তাঁর দিকে তাকানো বৈধ। তবুও এক আড়ষ্টতা ভর করেছে আমাতে। জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারছি না। আজ যে অবস্থায় আমার বিয়ে হয়েছে, সেখান থেকেই এই মানুষটা আমার মনে বিষ হয়ে উঠেছে। এই বিষ ঝাঁড়তে কতদিনে পারব জানি না।
তিনি উশখুশ করছেন। বিছানার একপাশে বসে সেখানে বোধ হয় যুতসই হলো না। তাই উঠে হেলান দিয়ে বসলেন। তারপর আবার উঠে সটান বসে বললেন,

___’ উফ…. বিয়ে না করেই ভালো ছিলাম। তোর সামনে চরম আনইজি ফিল করব এটা কখনো ভাবিনি৷ এ্যঁই একটু সহজ হ তো আমার সাথে! তুই এমন কঠিন পাথর হয়ে থাকলে আমি সহজ হব কিভাবে? তাকা আমার দিকে ঠিক মতো। দেখি তোকে কেমন লাগছে?’

আহামরি কোনো সাজ সজ্জা নেই। খুব সিম্পলভাবে সাজের পাট চুকিয়েছি। যদিও লিনা আপুর ইচ্ছে ছিল ভিন্ন। তোয়াক্কা করিনি সেসবের। জীবনটা আমার। সব তো জলাঞ্জলি দিয়েছি। প্রভাত ভাইকে বিয়ে করতে চাইনি, কিন্তু বাবার অমতেও যেতে পারিনি।
তিনি আমায় খুঁটে খুঁটে দেখে মুখ ভোতা করে বললেন,

___’ আজব! এইটা কোনো সাজ হলো? এর চেয়ে তো বাসায়-ই তুই বেশি সেজে টইটই করে ঘুরতি। বিয়েটা কি তোর কাছে ফাজলামো মনে হয়েছে?’

প্রচন্ড আক্রোশে এবার আর চুপ করে থাকা গেল না। বলেই ফেললাম।

___’ এতকিছুর পর বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে কেউ নিতে পারবে? আমি কি যন্ত্র মানব? যার শরীর আছে তবে মন নেই? একটা প্রশ্ন করি, সঠিক উত্তর আশা করছি। কেন এমন করলেন? সাদিফ নামক ছেলের সাথে কোনো সম্পর্কে না জড়িয়েও অপবাদ দিলেন। এসব কি?’

আমার বলা কাঠ কাঠ কথায় লোকটার মাঝে কোনো হেলদোল হলো না। না মুখের রঙ পাল্টালো। অতি সরল। যেভাবে বসে ছিলেন ঠিক সেভাবে থেকেই বললেন,

___’ তোকে বিয়ে করতে সব করতে পারি বলেছিলাম তো! আমি জানতাম, সাদিফ নামক ছেলে তোকে পছন্দ করে কিন্তু তুই না। সেই রাগে তোকে বিয়ে করিনি। ‘

___’ তবে কি ট্যুর ক্যান্সেলের শাস্তি হিসেবে এসব করলেন?’

প্রভাত ভাই নির্লিপ্ত গলায় বললেন,

___’ বলতে পারিস। আজ হোক বা কাল বউ তো তুই আমারই হতিস। আর এভাবে অন্যদিকে মুখ ফিরে না থেকে একটু দেখ আমার দিকে। ‘

তার গায়ে এখনো কোনো শার্ট ওঠেনি। তাকাই কিভাবে? বললাম,

___’ আগে কিছু পরে আসুন। ‘

প্রভাত ভাই ড্যাবড্যাব করে কতক্ষণ আমাকে দেখে তারপর নিজের দিকে চেয়ে বললেন,

___’ ওই তুই কি পর কেউ যে এভাবে বলছিস? যা পরবো না কিছু। কি করবি? সারারাত এভাবে মুখ ঘুরিয়ে বসে কাটিয়ে দিবি? ‘

___’ তাই দেবো। আচ্ছা, আমার বাবার মতো জমকে আপনি বিয়েতে রাজি করিয়েছিলেন কিভাবে? প্রশ্নটা আপনাকে এর আগে করেও উত্তর মেলেনি। এবার অন্তত আমার মনের কৌতুহল দমন করেন!’

প্রভাত ভাই উঠে আলমারি থেকে একটা শার্ট বের করে পরলেন। ফিনফিনে আকাশি রঙা শার্ট। তারপর আমার সামনে মুখোমুখি বসে বললেন,

___’ হয়েছে এবার? তাকা দেখি!’

আমি নিতান্ত অনিচ্ছায় চোখ তুলে চাইলাম তাঁর পানে। মুহূর্তে আমার মুখের ভাব পাল্টে গেল। লোকটাকে একটু আলাদা লাগছে। অন্যদিনের চেয়ে ভিন্ন। খুব সুন্দর লাগছে দেখতে। তিনি এবার চোখে চোখ রেখে আমার হাতে হাত রেখে বললেন,

___’ একটা মেয়ের বাবাকে রাজি করানো খুব কি কঠিন? তোর বাবা জমের মতন হোক হিংবা আমের মতন হোক, বাবা তো! মেয়েকে নিয়ে শত শত টেনশন আছে। মনে আছে তুই একরাত বাইরে ছিলি আমার সাথে? ভাবতে গেলে এটা কিছুই না তবে সমাজের লোকদের মুখরোচক গল্প বানানোর ভালো উৎস বটে। মামাকে বেশি কিছু বলতে হয়নি, বোঝাতে হয়নি। জাস্ট বলেছিলাম, মেয়েকে ভবিষ্যতে বিয়ে দিতে চাইলে এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। পাত্র হিসেবে ছেলে আমি মন্দ নই। ভালো ফ্যামিলি আছে। রিসেন্ট বাবার ব্যবসায় হাত দিয়েছি। আর কি চায় আপনার? তাছাড়া আরও দুইটা বড় মেয়ে আছে ঘরে। ছোট মেয়ের কোনো বদনাম ছড়ালে তাদের উন্নত ঘরে বিয়ে দিতে পারবেন?
ব্যস, এইটুকুই যথেষ্ট ছিল। ‘

আমি হা করে তাঁর কথা গিলছিলাম। আমার বাবার মতো লোককে পরোক্ষভাবে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার!
প্রভাত ভাই, না ভাই বলাটা এখন থেকে সচীচীন হবে না। যাক গে, প্রভাত আমার আরও কাছে এগিয়ে এসে বললেন,

___’ আমাদের জুড়িটা পারফেক্ট বুঝলি! ঠিক আম-সন্দেশের মতো। আমি হলাম আমের মতো টক, মিষ্টির কম্বিনেশনে তৈরি। আর তুই একদম মুখ তিরতির করা মিষ্টির মতো। আমাদের মধ্যে এই টক ভাব না থাকলে সম্পর্কই টিকবে না। আমার একটু টক মিষ্টিতে আমাদের মধ্যে তিক্ততা এলে তোর পূর্ণ মিষ্টিতে ডুব দেবো। নিজের টকভাব কমাতে। যদিও তাৎক্ষণিক কমলেও পরে আবার চলে আসবে। তুই জানিস আমি একটু অন্যরকম। ‘

তাঁর কথায় যে কেউ হাসতে বাধ্য। আমিও এর হেরফের করলাম না। আজ থেকে শুরু আমাদের আম-সন্দেশের সংসার।

#সমাপ্ত
( কেমন লাগলো বলবেন। বর কিন্তু প্রভাতকেই রেখেছি। আর হ্যাঁ, এটার আর কোনো সিজন হবে না। তাই কেউ সিজন টু চাইবেন না প্লিজ। পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে