আমি রাবা

0
707
আমি রেবা। দেখতে সুন্দরী তো নই’ই সুশ্রীও নই। গায়ের রং কুচকুচে কালো। সাইজে বেঁটে। চোখগুলো ছোট কুঁতকুঁতে। তাতে কি যুবতী বলে কথা। শরীরের বাঁধুনি ভালো থাকায় যৌবনের ঘাটতি নেই। উপচে পড়া যৌবনের তাড়নাই সদা চিন্তিত আমার শাশুড়ি মা। চারদিকে শোনা যাচ্ছে যুদ্ধের কথা। গ্রামে গ্রামে হানা দিচ্ছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। কখন এই গ্রামে হামলা দিবে তার ঠিক নেই। শাশুড়ি মা ঠিক করলেন আমাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। আমি তো হেসেই কুটি কুটি। শাশুড়ি মাকে বললাম, মা আমার দিকে কেউ ফিরেও চাইবে না। আপনি শুধু শুধু ভাবছেন। শাশুড়ি মা চোখ দুটো বড় বড় করে একটু রাগতো স্বরে বললেন, বউমা, পুরুষ মানুষের কাছে যৌবনদীপ্ত শরীরটাই আসল। তোমার তাতে কোনো ঘাটতি নাই। তোমাকে আমি কালকেই পাঠিয়ে দেবো তোমার বাবার বাড়ি। শাশুড়ি মায়ের কথার উপর আর কথা বলতে সাহস পেলাম না। বুকটার মধ্যে ধক করে উঠলো আজাদকে (আমার স্বামী) ছেড়ে থাকতে হবে ভেবে। ওকে ছাড়া আমার পৃথিবীটা অন্ধকার মনে হয়। তারপর শুনছি ও মুক্তিযুদ্ধে যাবে। মনের মধ্যে কেমন যেনো হুহু করে উঠলো।
তিনমাসের বাচ্চা নিয়ে চলে এলাম বাবার বাড়ি। এখানে এসে সবকিছু স্বাভাকিক মনে হলো। সবাই সেই আগের মত শান্তিতে জীবন-যাপন করছে। ওদের কান অব্দি এখনো যুদ্ধের কথা পৌঁছায়নি। আমাকে দেখে সবাই খুশি। বিশেষ করে আমার বাচ্চার জন্য। আমাদের বাড়িতে কোনো বাচ্চা নেই। তাই আমার বাচ্চাই পরিবারের মধ্যোমণি। এভাবেই কেটে গেলে বেশ কিছুদিন। একদিন আমরা সবাই বসে আছি ঠিক এ সময় পাশের বাড়ির একজন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বললো, আমাদের গ্রামের কয়েক গ্রাম পর মেলিটারি নেমেছে। বেশ কিছু লোককে মেরে ফেলেছে আর যুবুতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কথাটা শুনে শাশুড়ি মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। মনে মনে ভাবলাম শাশুড়ি মা তাহলে ঠিকই আন্দাজ করেছিলো। দেখতে দেখতে পুরো গ্রামের মধ্যে আতংকের দাবানল ছড়িয়ে পড়লো। বেশ কিছুদিন পর,
—- কিরে এতদিন হয়ে গেলো জামাই এখনও এলো না। তার ওপর দেশের এ অবস্থা কেমন আছে কে জানে। তুই আসতে বলিসনি? — মা ও এতদিনে যুদ্ধে চলে গেছে। —- কি বলছিস ? তুই জেনেও নিষেধ করিসনি? —কেনো মা? যুদ্ধে না গেলে দেশটাকে শত্রু মুক্ত করবে কে? —–রেবা! যদি কিছু হয়? —যদির ভয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকা উচিত মা? তাছাড়া ভাইয়াও যুদ্ধে গিয়েছে। —- কি বলছিস! ওতো বললো পলাশের সাথে ওর বোনের বাড়িতে গেছে। —— মা তুমি কান্নাকাটি করবে জন্য বলেনি। আমাকে আর বাবাকে বলে গেছে। তাছাড়া দেয়ালেরও কান আছে তাই এসব কথা বলাবলি না করাই ভালো। চোখের পানি মুছে ফেলো মা। আল্লাহর কাছে দোয়া করো। ওরা যেনো বীরের মতো যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে আসে। মায়ের চোখের পানি বাঁধ ভাঙা নদীর মত বেয়ে চলছিলো দু গাল বেয়ে। আমি আর নিষেধ করিনি। মায়ের চোখের জলও এক ধরণের যোদ্ধা , দেশ স্বাধীন করার শক্তি আছে এতে। ঝড়ুক জল, ঝড়ুক রক্ত। তবু স্বাধীনতা চাই। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে চাই। আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো বাবার আর্তচিৎকারে। —–কই গো তোমরা? তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। শুকনো খাবার সাথে নিও।
—– বাবা কি হয়েছে? —— ওরা জেনে গেছে আমার ছেলে আর জামাই মুক্তিযুদ্ধে গেছে। আর এক মূহুর্ত এখানে থাকা ঠিক হবে না। যেকোনো সময় চলে আসবে মেলেটারিরা। সেদিন বাবা-মা আর আমার ছেলে জয় ঠিকই পালিয়ে যেতে পেরেছিলো। কিন্তু আমি আর পালাতে পারিনি। জয়ের কাপড়ের ব্যাগ ঘরে ফেলে বেড়িয়ে এসেছিলাম। মনে পড়তেই কাপড়ের ব্যাগ আনতে বাড়িতে গিয়ে আসার পথে সদর দরজায় ওদের হাতে ধরা পড়ে যাই। সেদিনের পর থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত ওদের হাতে আমি নির্যাতিত হয়েছি। ওদের নির্যাতনের চিহ্ন স্বরুপ আমার গর্ভে সন্তান আসে। একটু একটু করে আমি ওর প্রাণের স্পন্দন টের পাচ্ছিলাম। আমার শরীরে পরিবর্তন দেখা দিচ্ছিলো। তবু ওই পাষণ্ডরা আমাকে রেহাই দেয়নি। ধীরে ধীরে আমার শরীর কঙ্কালে পরিণত হলো। পেটটুকু ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। তবু ওরা এই শরীরটাকেই খুবলে খেতো। কি অসহ্য নরক যন্ত্রণা তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এভাবেই একদিন চারদিকে বিজয় মিছিলের আওয়াজ পেলাম। কিন্তু সেদিন আমার বিজয়ের মিছিল দেখার ক্ষমতা ছিলো না। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলাম আমার স্বামী, মা আর জয় আমার পাশে বসে আছে। জয় বেশ বড় হয়েগেছে। স্বামীর মুখে শুনলাম সেদিন ওনারা আমি যেখানে ছিলাম ওখানেই যুদ্ধ করে সকলকে পরাজিত করে আমাকে উদ্ধার করেন। সেদিনই দেশ স্বাধীন হয়। আজাদের কাছে শুনলাম আমার বাবা,ভাই, শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই মারা গেছেন। একসময় আমার গর্ভে বেড়ে ওঠা সন্তান জন্ম নিলো। নাম রাখা হলো বিজয়। আজাদ নিজের পরিচয়ে ওকে বড় করতে লাগলো। আজাদ একজন সুদর্শন পুরুষ ছিলো তাই বিজয়ের সাথে বেশ মানিয়ে গিয়েছিলো। মানুষটা বড্ড ভালো মানুষ তা না হলে কেউ এমন সন্তানকে নিজ পরিচয়ে মানুষ করে!.ও বলতো শিশুরা নিষ্পাপ হয় তাই তাদেরকে সুন্দর জীবনে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হয়। বিজয়ের জন্ম পরিচয় লুকোনোর জন্য বিজয়ের জন্মের আগেই আমাদের গ্রাম ছেড়ে অনেক দূরের একটি গ্রামে চলে আসি । সেখানেই জন্ম বিজয়ের। দু সন্তানকে নিয়ে সুখের সংসার গড়ে উঠে আমার। প্রথম প্রথম মা একটু আপত্তি করলেও পরে বিজয়কে মেনে নেয়। দেখতে দেখতে ছেলে দুটো বড় হলো। জয় দেখতে আমার আদল পেলেও বিজয় অন্যরকম প্রায় ছয়ফিট লম্বা, খুব ফর্সা গায়ের রং কাকতালীয় ভাবে মিলে যায় আজাদের চেহারার সাথে। তবু বিজয়ের চোখে চোখ পড়লেই আমার মনের আঙিনায় সেই বিভৎস স্মৃতি দোলা দিয়ে যেতো। নিরবে চোখের পানি ফেলতাম। ওদের বিয়ে দিয়ে লাল টুকটুকে বউ ঘরে নিয়ে এলো আজাদ। নাতি- নাতনী দিয়ে ঘর ভরে উঠলো। হঠাৎ করে মা মারা যায়। মা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর আজাদ মারা যায়। দু মাসের মধ্যে দুটো মৃত্য আমাকে বড্ড একা করে দেয়। মনের দিক দিয়ে একেবারে ভেঙ্গে পড়ি। ঠিক সে সময়ে আমার জীবনে ফেলে আসা ভয়ংকর অতীত সামনে চলে আসে। আমার ছেলেরা জানতে পেরে যায় আমি বীরঙ্গনা। জয় স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিলেও বিজয় মেনে নিতে পারেনি। সে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে বলে, একজন ধর্ষিতা অপবিত্র মহিলার গর্ভে জন্ম নিয়েছি এটা ভাবলেই গা গুলোচ্ছে তারপর এটা ভেবে আরও ঘৃণা হচ্ছে যে ওই গর্ভেই পাকিস্তানি সেনাদের সন্তানের ভ্রণের জন্ম হয়েছিলো ছিঃ। তোমার ছোঁয়ায় আমার সন্তানদের অকল্যাণ হোক এটা আমি চাই না। বিজয়ের মুখে সব কথা শুনে মুখে মৃূদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো। মনে মনে ভাবলাম পুরো সত্য এখনো প্রকাশ হয়নি তবে হবে হয়তো কখনও। —-বুড়ি মা, আপনি তখন কেনো বিজয়ের আসল পরিচয় বললেন না? না বলে রাগ করে বেড়িয়ে এলেন! এ বয়সে ভিক্ষা করে আপনার দিন কাটাতে হচ্ছে। —-বলতে পারিনি। ধর্ষিতা হলেও আমি যে মা। আমি চাইনি সত্যিটা জানার পর কেউ ওর দিকে আঙুল তুলে বলুক, ওই যে দেশের শত্রুর সন্তান। চাইনি ওর সন্তানেরা ওকে ঘৃণা করুক। তার চেয়ে এই ভালো ও ভালো থাক। সন্তানের সুখেই মায়ের সুখ। (সমাপ্ত)