আমি পদ্মজা পর্ব-১৯+২০+২১

0
1667

আমি পদ্মজা – ১৯
____________
সূর্যের প্রখর তাপে সমস্ত প্রকৃতি যেন নির্জীব হয়ে ওঠেছে। উপস্থিত সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। রমিজ আলি,হারুন রশীদ নামক ধূর্ত মানুষগুলোর চোখ ছানাবড়া। মজিদ মাতব্বর ধীর শান্ত কণ্ঠে বললেন,’আপনারা চাইলে সময় নিতে পারেন। আজ এখানে…’

হেমলতা কথার মাঝে আটকে দিয়ে বললেন,’আপনি বিয়ের তারিখ ঠিক করুন।’

মজিদ মাতব্বরের প্রস্তাবের চেয়ে এই প্রস্তাবে হেমলতার রাজি হওয়াটা যেন কোলাহল মুহূর্তে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল। পদ্মজা হতবাক, বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! মোর্শেদ চোখ বড় করে হেমলতার দিকে দৃষ্টিপাত করেন। আশপাশ থেকে ফিসফিসানি ভেসে আসছে। মজিদ মাতব্বর মৃদু হাসলেন। এরপর আনন্দসহিত সবাইকে নিমন্ত্রণ করলেন,’আগামী শুক্রবার আমার ছেলের সাথে মোর্শেদের বড় মেয়ের বিবাহ। আপনাদের সবার নিমন্ত্রণ রইল।’

কথা শেষ করে হেমলতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,’দিন তারিখ ঠিক আছে?’

হেমলতা সম্মতি জানালেন। মোর্শেদ অবাকের চরম পর্যায়ে। কোনো কথা আসছে না মুখে। পদ্মজা ঢোক গিলে ব্যাপারটা হজম করে নিল। মুহিবের সাথে যখন তার বিয়ের আলোচনা হলো তখন সে ভারি অবাক হয়েছিল। লিখন শাহ নামে একটা মানুষকে মনে পড়েছিল। এখন তেমন কিছুই হচ্ছে না। অনুভূতিগুলো ভোঁতা। যা হওয়ার হবে। সেসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। বিচার সভা ভেঙ্গে গেল। মজিদ মাতব্বর আলাদা করে মোর্শেদের সাথে কথা বলেন। তিনি আগামীকাল নিজ স্ত্রী এবং বাড়ির অন্যান্য বউদের নিয়ে পদ্মজাকে দেখতে আসবেন। মোর্শেদ, হেমলতা সমস্বরে অনুমতি দিলেন। বাড়ি ফেরার পথে অনেকের কটু কথা কানে আসে। পদ্মজা, আমির দুজনেরই চরিত্র খারাপ। এজন্যই বিয়ে হচ্ছে। মাতব্বর ক্ষমতাবান বলে,পুরো ব্যাপারটা ঘুরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু,তলে তলে তো নিজেরা জানে তাদের ছেলেমেয়ে কেমন। তাই তাড়াতাড়ি করে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন খুব বিশ্রীভাবে পদ্মজাকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ কে জানে, মনে কয়তো ছেড়ি পেট বাঁধাইছে। রাইতে বাপ মারে দিয়া পায়ে ধরাইয়া বিয়া ঠিক করছে।’

পদ্মজার মন তিক্ত হয়ে উঠে। হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এতো নোংরা মন্তব্য সহ্য করা খুব কঠিন। মিথ্যে অপবাদ চারিদিকে। বোরখার আড়ালে পদ্মজার চোখ দু’টি ছলছল করে উঠল। খুব কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। হেমলতা পদ্মজার একহাত শক্ত করে চেপে ধরেন। মানুষদের ছায়া ছেড়ে ক্ষেতের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে তিনি বললেন,’জীবন খুব ছোট। এই ছোট জীবনে ঘটে অনেক ঘটনা। যে ভাল তার সাথে যে শুধুই ভালই হবে তা কিন্তু ঠিক না, উচিতও না। ভাল খারাপে মিলিয়েই জীবন। তাই বলে,সেই খারাপকে পাত্তা দিয়ে সময় নষ্ট করতে হবে তার কোনো মানে নেই। খারাপটাকে পাশে রেখে ভাল মুহূর্ত তৈরি করার চেষ্টা করবি। ভালটা ভাববি। শুধুমাত্র কয়জনের কথায় কী আসে যায়? পুরো গ্রামবাসী জানে,তুই কেমন। পুরো অলন্দপুরের যত মানুষ আজ এসেছে তাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই মনে মনে তোর গুণগান গেয়েছে। তারা মনে মনে বিশ্বাস করে তুই নির্দোষ। কিন্তু চুপ ছিল। যারা খারাপের দলে তারা সংখ্যায় কম বলে কোলাহল করে নিজেদের দাপট দেখাতে চেয়েছিল। সবার অগোচরে বোঝাতে চেয়েছিল,আমরা অনেকজন। কিন্তু পারেনি। কোলাহল কোনো কিছুর সমাধান নয়। এখন যারা নিন্দা করলো তারা নিজেদের নীচু মনের পরিচয় দিয়েছে, সেই সাথে আমলনামায় পাপের সংখ্যা বাড়িয়ে দিল। তাদের শাস্তি পৃথিবী এবং আখিরাত দুটোতেই হবে। একদিন এদের শাস্তি হবেই,এই কথাটা ভেবে খুশি হ। সব ভুলে যা। বাকি জীবন পড়ে রয়েছে। সেসব নিয়ে ভাব। চোখের জল অতি আপনজন এবং আল্লাহর জন্য ফেলা উচিত। এদের মতো কু-মানুষের জন্য না।’

পদ্মজা হুহু করে কেঁদে উঠল। আচমকা হেমলতাকে মাঝপথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে,কান্নামাখা কণ্ঠে বলল,’তুমি জাদুকর আম্মা। তুমি জাদু জানো।’

হেমলতা পদ্মজার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। মোর্শেদ পদ্মজাকে কান্না থামাতে বলতে চাইলে,হেমলতা ইশারায় চুপ করিয়ে দেন। পাশেই বিস্তীর্ন ক্ষেত। গ্রীষ্মের দুপুরের রূপ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। মোর্শেদের কপাল বেয়ে ঝরঝর করে ঘাম ঝরছে। তার দৃষ্টি থমকে আছে হেমলতার দিকে। একটা অপ্রিয় সত্য সম্ভাবনার কথা মনে হতেই চোখ দুটি ছলছল করে উঠল। তিনি দ্রুত চোখ সরিয়ে, বড় করে নিঃশ্বাস ফেলেন। জীবনের লীলাখেলায় তিনি নিঃস্ব। পদ্মজার কান্না থামার লক্ষণ নেই। হেমলতা ছদ্ম গাম্ভীর্যের সহিত বললেন,’এতো কাঁদলে কিন্তু মারব।’

__________
আকাশ জুড়ে তারার মেলা। জানালা গলে চাঁদের আলো পদ্মজার মুখশ্রী ছুঁয়ে দিচ্ছে। সে বারান্দার ঘরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। বুকটা কেমন করছে। অনবরত কাঁপছে। হেমলতার উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত উঠে বসল। হেমলতা পদ্মজার দিকে মুহূর্ত কাল তাকিয়ে রইলেন। পদ্মজা নখ খুঁটছে। হেমলতা বললেন,’ঘুম আসছে না?’

পদ্মজা মাথা দুই পাশে নাড়াল। হেমলতা আর কিছু বললেন না। পদ্মজা পিনপতন নীরবতা কাটিয়ে বলল,’মেজো আপার বিয়ের তারিখ পড়ছে?’

হেমলতা পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। বিছানার উপর বসে পদ্মজাকে টেনে কোলে শুতে ইশারা করেন। পদ্মজা শুয়ে পড়ল। মায়ের কোলটা তার এখন ভীষণ দরকার ছিল। হেমলতা পদ্মজার প্রশ্ন এড়িয়ে অন্য কথা তুললেন। বললেন,’আমি জানি না কোনো মা তার মেয়ের কাছে নিজের বিয়ে সম্পর্কিত আলোচনা করেছে নাকি। কিন্তু আমি আমার বিয়ের গল্প তোকে বলতে চাই। শুনবি?’

পদ্মজা সায় দিল। হেমলতা পদ্মজাকে বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলার জন্য অতীতে নিয়ে যান,’সেদিন রাতে আব্বা এসে বলল, তিনদিন পর আমার বিয়ে। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। কষ্ট হয়েছিল। আমি আরো পড়তে চেয়েছিলাম। এরপর শুনলাম, যার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে তার পড়াশোনা নেই। জ্ঞানও যথেষ্ট কম। রাগচটা লোক। এসব তথ্য জেনে রাগ,মন খারাপ কিছুই হয়নি। ভয় হয়। না জানি কেমন যাবে সংসার! বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। তোর আব্বাকে তখনো আমি দেখিনি। বিয়ের দিন আয়নায় প্রথম দেখি। কালো একটা মুখ। চোখ দু’টি গভীর। কখনো না দেখা মানুষটাকে, প্রথম দেখেই মনে হয় আমার সবচেয়ে আপন একজন মানুষ। সব ভয় কেটে গেল। বিদায়ের সময় সবাই বলছিল,দুজনকে খুব মানিয়েছে। রাজযোটক। একজন হিন্দু দিদি বলেছিলেন,সাক্ষাৎ রাম সীতা। আটপাড়ায় যদি একজন ছয় ফুট লম্বার মানুষ থাকে তবে সেটা তোদের আব্বা ছিল। বিয়ের পর জানতে পারি,তোর আব্বাকে বিয়ে করার জন্য অনেক মেয়েই পাগল ছিল। নিজেকে খুব সৌভাগ্যবতী মনে হতো। অশিক্ষিত ভেবে নাক কুঁচকেছিলাম। সেই আমি তোর আব্বার জন্য দিনকে রাত, রাতকে দিন মানতে রাজি ছিলাম। এতোটাই ভালবাসা হয়ে গেছিল যে, তোর আব্বা ছুরি নিয়ে রক্তের আবদার করলে আমি আমার বুক পেতে দিতাম…।”

পদ্মজা মাঝপথে আটকে দিয়ে বলল,’তাও তো আব্বা তোমাকে ভালোবাসেনি আম্মা।’

হেমলতার হাসি উজ্জ্বল মুখটা নিভে গেল। অপ্রতিভ হয়ে উঠলেন। তিনি দৃষ্টি এলোমেলো রেখে বললেন,’তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছিল।’

পদ্মজা চুপ করে রইল। হেমলতাও নিশ্চুপ। দরজার পাশে মোর্শেদ বসেছিলেন। বিড়ি ফুঁকছিলেন। হেমলতার প্রতিটি কথা বুড়ো হয়ে যাওয়া মনটাকে দুমড়ে, মুচড়ে দিল। তিনি বিড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান চৌরাস্তার উদ্দেশ্যে। চৌরাস্তার পাশে একটা বড় ব্রিজ আছে। ব্রিজে দখিনা হাওয়ার তীব্রতা খুব বেশি। সেখানেই এসে দাঁড়ান। ফেলে আসা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ চোখ বুজে মনে করার চেষ্টা করেন।

বেশ কিছুক্ষণ পর পদ্মজা বলল,’আম্মা, প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর প্রশ্ন করব না। তবুও…’
‘বলব একদিন।’

পদ্মজা আর জিজ্ঞাসা করল না,কোনদিন বলবে। নিশ্চুপতার অবস্থানে ফিরে গেল। মুহূর্ত কাল স্থির থেকে হেমলতা বললেন,’পূর্ণা খুব কান্নাকাটি করে দেখলাম। মেয়েটা এতো দূর্বল কী করে হলো?’
পদ্মজা হেমলতার এক হাত মুঠোয় নিয়ে আশ্বস্ত করল,’আমি আছি আম্মা। সামলে নেবো।’
‘ঘরে যা। রাত হয়েছে অনেক।’

পদ্মজা উঠে বসল। ওড়নাটা ভাল করে টেনে নিয়ে,জুতা পরল। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। হেমলতা বিছানার শেষ অংশ থেকে বালিশ টেনে নেন। বালিশের নিচে দুটি কাগজ ভাঁজ করা ছিল। হেমলতা হাত বাড়িয়ে নেন। পদ্মজার উদ্দেশ্যে বলেন,’পদ্মজা,এগুলো কী?’

হেমলতা ভাঁজ খুলেন। পদ্মজা ফিরে তাকায়। হেমলতার হাতে লিখনের চিঠি দুটি দেখে সর্বাঙ্গে বৈদ্যুতিক কিছু একটা ছড়িয়ে পড়ে,শরীর কাঁপিয়ে দিল। মাটি যেন দুই পা টেনে ধরল। হেমলতা প্রথম লাইন পড়ে বেশ অবাক হোন। পদ্মজার দিকে একবার চকিতে তাকান। এরপর এক নিঃশ্বাসে দুটো চিঠি পড়ে শেষ করেন। পড়া শেষে থম মেরে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। ভয়ে পদ্মজার দুই চোখ বেয়ে জল পড়ছে। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হেমলতা ধীর পায়ে হেঁটে আসেন পদ্মজার কাছে। দু ভ্র প্রসারিত করে, শান্ত অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলেন,’ এসব কবে হয়েছে? আমাকে জানাসনি কেন?’

পদ্মজা প্যাচপ্যাচ করে কেঁদে বলল,’যখন উনারা শুটিং করতে আসেন।’ পদ্মজার মনে হচ্ছে এখুনি সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুতেই হচ্ছে না। মনে মনে প্রার্থনা করছে,যেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে পারে সে। তাহলে এই লজ্জা থেকে বাঁচা যাবে। হেমলতা পদ্মজাকে পরখ করে নেন। পদ্মজা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। বার বার নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরছে। পদ্মজা হেমলতাকে চুপ থাকতে দেখে বলল,’তুমি যা বলবা তাই হবে আম্মা। আমার উপর রেগে যেও না।’

চলবে….
®ইলমা বেহরোজ

আমি পদ্মজা – ২০
____________
আজ যেন শুধু মোড়ল বাড়ির মাথার উপরেই সূর্যটা উঠেছে। সকাল থেকে আত্মীয় আপ্যায়নের প্রস্তুতির তোড়জোড় চলছে। সবাই ঘেমে একাকার। বাড়ির প্রতিটি মানুষ ব্যস্ত। মোর্শেদ হিমেল ও প্রান্তকে নিয়ে বাজার করে ফিরেছেন সূর্য উঠার মাথায়। লাহাড়ি ঘরের পাশে বড় উনুন করা হয়েছে। সাধারণ চালের পরিবর্তে সুগন্ধি (কাটারিভোগ)সিদ্ধ চালের ভাত রান্না করা হয়েছে। ফিরনি, রাজ হাঁসের মাংস রান্না হচ্ছে। বাড়িজুড়ে রমরমা ব্যাপার। একদিন আগের ঘটনা ধামাচাপা পড়েছে ৯৫ ভাগ। ছোট ছোট দরিদ্র ছেলেমেয়েরা খাবারের ঘ্রাণ পেয়ে ছুটে এসেছে মোড়ল বাড়ি। সবার মধ্যেই নতুন উত্তেজনা,নতুন অনুভূতি। শুধু পূর্ণা এখনো সেদিনের ঘটনা থেকে বেরোতে পারছে না। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ঘরে। পদ্মজা মনজুরা আর শিউলির মাকে কাজে সাহায্য করছিল। হেমলতা ধমকে ঘরে পাঠিয়ে দেন। পদ্মজা ঘামে ভেজা কপাল মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করে। পূর্ণার দুচোখ জলে নদী! পদ্মজা বিছানার উপর পা তুলে বসল। পূর্ণা পদ্মজার উপস্থিতি টের পেয়ে, হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছল। পদ্মজা কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলল,’চোখের জল কী শেষ হয় না?’

পূর্ণা নিরুত্তর। পদ্মজা অভিজ্ঞ স্বরে বলল,’দেখ পূর্ণা, এসব মনে রাখলে তোরই ক্ষতি। দেখছিস না,আমি একদিনের ব্যবধানে সব ভুলে হবু শ্বশুরবাড়ির মানুষদের জন্য রান্নাবান্না করছি। তুইও ভুলে যা। তোর বন্ধুরা আসছে। তুই নাকি তাদের ধমকে দিয়েছিস? এটা কিন্তু ঠিক না।’

পূর্ণা পদ্মজার দিকে তাকাল। দৃষ্টি ভীষণ শীতল। পদ্মজাকে বলল,’সত্যি ভুলতে পেরেছো আপা?’
পদ্মজা সঙ্গে,সঙ্গে উত্তর দিল,’ভুলিনি। কিন্তু সহ্য করতে পেরেছি। তোর মতো চোখের জল অপাত্রে ঢালছি না।’
পূর্ণা উঠে বসে,একটা বালিশ বুকে জড়িয়ে ধরে দায়সারাভাবে বলল,’তুমি অনেক শক্ত আপা। আমি খুব দূর্বল। আমি ভুলতে পারছি না।’

পদ্মজা আর এই বিষয়ে কথা বাড়াল না। পূর্ণার গাঁ ঘেঁষে বসে,ফিসফিসিয়ে বলল,’গতকাল রাতে কী হয়েছে জানিস?’
‘কি হয়েছে?’
পদ্মজা চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলে,’তোর নায়ক ভাইয়ের চিঠি আম্মার হাতে পড়েছে।’
পূর্ণা আঁতকে উঠে বলল,’সেকী! কখন? কীভাবে?’

‘আর বলিস না! সেদিন তুই নানাবাড়ি ছিলি। তখন চিঠি দুইটা বের করেছিলাম। বারান্দার ঘরে বালিশের নিচে রেখে দেই। আর মনে নেই। এরপরেই অঘটন ঘটে। এরপরদিন বিচার বসল। চিঠির কথা ভুলেই গেলাম। বারান্দার ঘরে ছিলাম রাতে,তবুও মনে পড়েনি। আর আম্মা পেয়ে গেল।’

উত্তেজনা, ভয়ে পূর্ণার গলা শুকিয়ে গেছে। প্রশ্ন করল,’আম্মা কী বলছে?’

পদ্মজা ঠোঁট দুটি উল্টিয়ে কী যেন ভাবে। এরপর ব্যথিত স্বরে বলল,’তেমন কিছুই না। এজন্যই আরো ভয় হচ্ছে।’
‘কিছুই না?’
‘কখন হলো এসব জিজ্ঞাসা করেছে। আমি বললাম,তুমি যা বলবে তাই হবে। এরপর আম্মা অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।’
‘তারপর?’
‘বলল, ঘুমা গিয়ে। শেষ।’

দুই বোন একসাথে চিন্তায় পড়ে গেল। কপাল ভাঁজ করে কিছু ভাবতে শুরু করে। পূর্ণা বলল,’আম্মা তোমার মুখ দেখে বুঝে গেছে তুমি লিখন ভাইকে ভালোবাসো না।’
পদ্মজা অন্যমনস্ক হয়ে বলল,’মনে হয়।’
পূর্ণা খুব বিরক্তি নিয়ে বলল,’লিখন ভাই এতো সুন্দর, তোমাকে এতো ভালোবাসে তবুও কেন ভালবাসোনি আপা? লিখন ভাইয়ের চিঠি তো ঠিকই সময় করে করে পড়তে। বিয়ে করতে কী সমস্যা?’
‘আম্মা দিলে তো করবই। সমস্যা নেই।’
‘তোমার এই ন্যাকার কথা আমার ভাল লাগে না আপা।’

পদ্মজা হেসে ফেলল। পূর্ণার রেগে কথা বলা দেখে। পদ্মজা পূর্ণার এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল,’গতকাল রাতে আম্মা আব্বার প্রতি ভালোবাসাটা আমাকে বলছে। প্রথম দেখেই নাকি আপন,আপন লেগেছিল। আব্বার জন্য আম্মা দিনকে রাত,রাতকে দিন মানতেও রাজি ছিলেন। এতোটা ভালোবাসতেন। আমার তেমন কোনো অনুভূতি হয়নি তোর নায়ক ভাইয়ের জন্য। প্রথম প্রথম কোনো পুরুষের চিঠি পেয়েছিলাম, সবকিছু নতুন ছিল। তাই একটা ঘোরে গিয়ে নতুন অনুভূতির সাক্ষাৎ পাচ্ছিলাম। আম্মার ভালবাসার কথা শোনার পর থেকে মনে হচ্ছে আমি উনাকে ভালোবাসিনি। সবটা মোহ ছিল। দূরে যেতেই উবে গেছে। তবে, উনি খুব অসাধারণ একজন মানুষ। আম্মা উনার হাতে তুলে দিলে আমাকে, কোনো ভুল হবে না। কিন্তু এটা এখন কল্পনাতীত। পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’

পদ্মজার এতো কথা উপেক্ষা করে পূর্ণা কটমট করে বলল,’তোমার কী কালাচাঁদরে দেখলে আপন আপন লাগে?’
পদ্মজা চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞাসা করল,’কালাচাঁদ কে?’
পূর্ণা মিনমিনিয়ে বলল,’তোমার হবু জামাই।’
তারপরই গলা উঁচিয়ে বলল,’আমিও কালা জানি। কিন্তু আপা,তোমার জন্য লিখন ভাইয়ের মতো সুন্দর জামাই দরকার।’
পদ্মজা এক হাতে কপাল চাপড়ে বলল,’এখনও লিখন ভাই! যা তোর সাথে তোর নায়কের বিয়ে দিয়ে দেব। এখন আয়,ঘর থেকে বের হ। মুক্তা,সোনামণি,রোজিনা আসছে। তোর সাথে কথা বলবে। আয় বলছি…আয়।’

পূর্ণাকে টেনে নিয়ে বের হলো পদ্মজা।
____________
সূর্য মামার রাগ কমেছে। মোড়ল বাড়ির মাথার উপর থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সদর ঘর ভর্তি মানুষ। হাওলাদার বাড়ির বউদের গ্রামবাসী শেষবার তাদের বিয়েতেই দেখেছে। আবার দেখার সুযোগ হওয়াতে দল বেঁধে মানুষ এসেছে। লোকমুখে শোনা যায়, হাওলাদার বাড়ির মেয়ে-বউদের সারা অঙ্গে সোনার অলংকার ঝলমল করে। মগা-মদন সহ আরো দুজন ভৃত্য মোড়ল বাড়ির গেইটে দাঁড়িয়ে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। পদ্মজাকে শাড়ি পরাচ্ছেন হেমলতা। পদ্মজা এর আগে কখনো শাড়ি পরেনি। পূর্ণা, প্রেমা ছোট হয়েও পরেছে। পদ্মজার কখনো ইচ্ছে করেনি।তাই সে হেমলতাকে বলল, ‘প্রথম শাড়ি তুমি পরাবে আম্মা।’

শাড়ি পরানো শেষে, চোখে কাজল এঁকে দেন। ঠোঁটে লিপিস্টিক দিতে গিয়েও,দিলেন না। মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি করে চুল খোঁপা করতেই,পূর্ণা ছুটে আসে। হাতে শিউলি ফুলের মালা। হেমলতা মৃদু ধমকের স্বরে বলেন,’এতক্ষণ লাগল!’

হেমলতার কথা বোধহয় পূর্ণার কানে গেল না। পূর্ণা চাপা উত্তেজনা নিয়ে বলল,’আল্লাহ! আপারে কী সুন্দর লাগছে!’

পদ্মজা লজ্জায় মিইয়ে গেল। চোখে মুখে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে। হেমলতা পদ্মজার খোঁপায় ফুলের মালা লাগিয়ে দিয়ে বললেন,’শুধু রূপে চারিদিক আলোকিত করলে হবে না,গুণেও তেমন হতে হবে।’

পদ্মজা বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। তখন হুড়মুড়িয়ে সেখানে উপস্থিত হলো লাবণ্য। দৌড়ে এসে পদ্মজাকে জাপটে ধরে। এক নিঃশ্বাসে বলেও ফেলল,’আল্লাহ, পদ্ম তুই আমার ভাবি হবি। আমার বিশ্বাসই হইতাছে না। মনে হইতাছে স্বপ্ন দেখতাছি। ইয়া…মাবূদ। শাড়িতে তোরে পরী লাগতাছে। বাড়ির সবাই ফিট খাইয়া যাইব। দেহিস।’
পদ্মজা কি বলবে ভেবে পেল না। শুধু হাসল। হেমলতা পদ্মজার মাথার ঘোমটা টেনে দেন। লাবণ্যকে বলেন,’তোমার সইকে নিয়ে যাও।’
পদ্মজা হেমলতার হাতে হাত রেখে অনুরোধ করে বলল,’আম্মা,তুমি আসো।’
হেমলতা হাসেন। পদ্মজার মাথায় এক হাত রেখে বলেন,’কয়দিন পর থেকে এরাই তোর আপন। মা পাশে থাকবে না।’

পদ্মজার চোখ দুটি ছলছল করে উঠে। ছলছল চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। পদ্মজাকে নতুন বউ রূপে দেখে হেমলতার বুকে ঝড় বইছে। মেয়েটা কয়দিন পর আলাদা হয়ে যাবে। দুই মাস আগে হলে তিনি সাত রাজার ধনের বিনিময়েও মেয়ের বিয়ে দিতেন না।

‘আমি আসছি। লাবণ্য যাও তো নিয়ে যাও। পূর্ণা তুইও যা।’

লাবণ্য পদ্মজাকে নিয়ে যায়। পদ্মজার বুক ধড়ফড় করছে। মায়ের যেন কী হয়েছে! সে পিছন ফিরে তাকায়। সাথে সাথে হেমলতা অন্য দিকে ঘুরে তাকান। চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। তিনি দ্রুত তা মুছেন।
সদর ঘর কোলাহলময় ছিল। পদ্মজা ঢুকতেই সব চুপ হয়ে গেল। লাবণ্য পদ্মজাকে ছেড়ে ভারী আনন্দ নিয়ে বলল,’আম্মা,কাকিম্মা,ভাবি,আপারা এইযে পদ্মজা। আমার নতুন ভাবি।’

পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল। অলংকারে জ্বলজ্বল করা পাঁচ জন নারীকে দেখে যেন চোখ ঝলসে গেল তার। সবাই তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা চোখ নামিয়ে ফেলল। তখন কোথা থেকে আবির্ভাব হলো আমিরের। সদর দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল পদ্মজা। পদ্মজাকে দেখে থমকে গেল সে। পদ্মজার পরনে খয়েরি রংয়ের জামদানি শাড়ি। শাড়িতে কোনো মেয়েকে এতো সুন্দর মনে হতে পারে এর আগে অনুভব করেনি আমির। আমিরের লজ্জা খুব কম। সে উপস্থিত গুরুজনদের উপেক্ষা করে পদ্মজাকে বলল,’মাশাআল্লাহ। দিনের বেলা চাঁদ উঠে গেছে।’

লজ্জায় পদ্মজার রগে রগে কাঁপন ধরে। এতো লজ্জাহীন মানুষ কী করে হয়! আমিরের মা ফরিনা ধমকের স্বরে বলেন,’বাবু,এইনে বয় আইসসা।’

আমির পদ্মজাতে দৃষ্টি স্থির রেখে মায়ের পাশে গিয়ে বসল। হেমলতা সদর ঘরে প্রবেশ করতেই আমির ধড়ফড়িয়ে উঠল। ছুটে এসে হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করল। হবু শ্বাশুড়ির প্রতি আমিরের এতো দরদ দেখে ফরিনা খুব বিরক্ত হলেন। পাশ থেকে ফরিনার জা আমিনা ফিসফিসিয়ে বললেন,’মেয়ের রূপ আগুনের হুল্কা। বাবু এইবার হাত ছাড়া হইলো বলে।’

আমিনার মন্ত্র ফরিনার মগজ ধোলাই করতে পারল না। পদ্মজার রূপে তিনি মুগ্ধ। আমির কালো বলে তিনি ছোট থেকেই আমিরকে বলতেন,’বাবু তোর জন্যি চান্দের লাকান বউ আনাম।’ আর সেই কথা রক্ষার পথে। তিনি শুধু পছন্দ করছেন না শ্বাশুড়ির প্রতি আমিরের এতো দরদ! কী দরকার ঝাঁপিয়ে পড়ে পায়ে ধরে সালাম করার। আমির হেমলতাকে ভক্তির সাথে প্রশ্ন করল,’ভালো আছেন?’

হেমলতা মিষ্টি করে হেসে বলেন,’ভালো আছি। যাও গিয়ে বসো।’

আমির বাধ্যের মতো মায়ের পাশে গিয়ে বসল। মজিদ মাতব্বর, মোর্শেদের সাথে বাইরে আলোচনা করছেন। আর কোনো পুরুষ আসেনি বাড়িতে। তারা বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত। মুহূর্তে পদ্মজার সারা অঙ্গ সোনার অলংকারে পূর্ণ হয়ে উঠল। রূপ বেড়ে গেল লক্ষ গুণ। যার কোনো সীমা নেই। যার সাথেই পদ্মজা কথা বলেছে, সেই এগিয়ে এসে বালা নয়তো হার পরিয়ে দিয়েছে। কি অবাক কান্ড!
সবাই আড্ডা দিচ্ছে। পদ্মজা চুপ করে বসে আছে। কেউ কিছু প্রশ্ন করলে উত্তর দিচ্ছে। লাবণ্য একজনকে উদ্দেশ্য করে বলল,’রানি আপা,বাড়ির পিছনে যাইবা?’
রানি খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,’যাব।’

তার খুশির কারণ লাবণ্য কিছুটা ধরতে পেরেছে। রানির একজন প্রেমিক আছে। তাই শুধু সুযোগ খুঁজে দেখা করার। যেখানেই দাওয়াত পড়ে সেখানেই তার প্রেমিক উপস্থিত হয়। লাবণ্য সবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে পদ্মজা,পূর্ণা,রানিকে নিয়ে বাড়ির পিছনে আসে। রানি বাড়ির পিছনে এসেই ঘাটের দিকে ছুটে যায়। একটা নৌকা এসে ভীরে। নৌকায় কে ছিল দেখা যায় না। রানি নৌকায় উঠে পড়ে। কারো সাথে বিরতিহীন ভাবে কথা বলছে শোনা যায়। পূর্ণা লাবণ্যকে প্রশ্ন করল,’লাবণ্য আপা? রানি আপা কার সাথে কথা বলে?’

‘আবদুল ভাইয়ের সাথে।’
‘কোন আবদুল?’
‘যার কথা ভাবছিস।’ কথা শেষ করে লাবণ্য চোখ টিপল। পূর্ণা অবাক হয়ে বলল,’মাস্টারের সাথে!’
লাবণ্য হাসে। রানি এগিয়ে আসে। লাবণ্য বলে,’কথা শেষ?’
‘হ চইলা গেছে।’
রানি পদ্মজার দিকে তাকিয়ে বলল,’মাশাআল্লাহ, তুমি এতো সুন্দর। আমার কোলে নিয়া আদর করতে মন চাইতাছে।’
পদ্মজা মুচকি হেসে বলল,’আপনি খুব শুকনা। আমাকে কোলে নিতে পারবেন না।’
‘শুকনা হইতে পারি। শক্তি আছে।’

রানির কথা বলার ঢংয়ে সবাই হেসে উঠল। পূর্ণা আমিরকে দেখে পদ্মজার কানে কানে বলল,’আপা তোমার কালাচাঁদ আসছে।’
পদ্মজা পূর্ণাকে চোখ রাঙিয়ে বলল,’কীসব কথা! উনার বোনরা আছে।’

‘লাবণ্য,রানি যা এখান থেকে।’ আমিরের আদেশ শুনে রানি,লাবণ্য খুব বিরক্ত হলো। রানি কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,’দাভাই,থাকি না।’
আমির চোখ রাঙিয়ে তাকাল। ধমকের স্বরে বলল,’যেতে বলছি যা।’
লাবণ্য বিরক্তিতে, ইশশ! বলে পদ্মজাকে বলল,’আয় অন্যখানো যাই।’
‘পদ্মজা থাকুক। তোরা যা।’ আমিরের কথা শুনে বেশি চমকাল পদ্মজা। লাবণ্য ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল,’কেন? কেন?’

পদ্মজা, পূর্ণা অন্যদিকে ফিরে আছে। আমির দৃষ্টি কঠোর করতেই লাবণ্য,রানি চলে গেল। পূর্ণা চলে যেতে চাইলে পদ্মজা পূর্ণার হাত চেপে ধরে। পূর্ণা পদ্মজার হাত ছাড়িয়ে, ধীরকণ্ঠে বলল,’একা থেকে তোমার কালাচাঁদের ভালোবাসা খাও।’
‘ছিঃ।’
পূর্ণা ছুটে চলে গেল। আমির পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়াতেই পদ্মজা বলল,’বিয়ের আগে গুরুজনদের না জানিয়ে এভাবে একা কথা বলা ঠিক নয়।’
‘কী হবে?’
পদ্মজা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,’কলঙ্ক লাগবে।’
‘আর কী বাকি আছে?’
‘পরিমাণ না বাড়ানোই ভাল।’

পদ্মজার কথা বলতে একটুও গলা কাঁপেনি। বাড়ির ভেতর চলে আসার জন্য পা বাড়াতে আমির পদ্মজার এক হাত থাবা দিয়ে ধরে,আবার ছেড়ে দিল। পদ্মজা ছিটকে দূরে সরে গেল। আমির বলল,’তুমি সত্যি একটা পদ্ম ফুল পদ্মবতী। এজন্যই লিখন শাহর মতো সুদর্শন যুবক তোমার প্রেমে পড়েছে।’

দেখা হওয়ার পর এই প্রথম পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল। পরপরই চোখের দৃষ্টি সরিয়ে ছুটে বাড়ির ভেতর চলে গেল। আমির অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। এবার আত্মীয় বিদায়ের পালা। যাওয়ার পূর্বে লাবণ্য একটা কাগজ পদ্মজার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল,’দাভাই দিছে।’

ঘুমাবার আগে পদ্মজা কাঁপা হাতে কাগজটির ভাঁজটি খুলল। কাগজটিতে যত্ন করে লেখা-

সারা অঙ্গ কলঙ্কে ঝলসে যাক
তুই বন্ধু শুধু আমার থাক।

চলবে….
®ইলমা বেহরোজ

আমি পদ্মজা – ২১
___________
সারা বাড়ির সব কাজ শেষ করে, হেমলতা ক্লান্ত পায়ে হেঁটে ঘরে আসেন। মোর্শেদ সবেমাত্র শুয়েছেন। হেমলতা বিছানার এক পাশে কাত হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করেন। মোর্শেদ হেমলতার দিকে ফিরে ধীরকণ্ঠে বলেন,’ধানের মিলটা পাইয়া যাইতাছি।’

মোর্শেদের গলা দূর্বল হলেও খুশিতে চোখ চকচক করছে। হেমলতা মৃদু হেসে বলেন,’মাতব্বর কী যৌতুক দিচ্ছেন?’

মোর্শেদ হেসে বলেন,’ সে কইতে পারো। সে আমারে কী কইছে জানো?’
‘কী?’
‘কইলো, শুনো মোর্শেদ…আইচ্ছা আগে শুনো আমি কিন্তু শহুরে ভাষায় কইতে পারুম না। আমি আমার গ্রামের ভাষায় কইতাছি।’
হেমলতা মোর্শেদের কথা বলার ভঙ্গি দেখে আওয়াজ করেই হাসলেন। বললেন,’আচ্ছা,যেভাবে ইচ্ছে বলো।’

মোর্শেদ খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে বললেন,’কইলো,শুনো মোর্শেদ তোমার এই মোড়ল বাড়ি হইতাছে একটা বিল। যে বিলে একটাই পদ্ম ফুল আছে। এই পদ্ম ফুলডার জন্যই এই বিলটা এতো সুন্দর। আর আমি সেই পদ্ম ফুলডারে তুইললা নিয়া যাইতাছি। এই বিলে পদ্ম ফুলডার চেয়ে দামি সুন্দর আর কিছু নাই। তাই আমার আর কিছু লাগব না। বিনিময়ে আমি এই খালি বিলডারে ধানের মিল দিয়ে দিলাম। বুঝলা লতা? মাতব্বর মানুষটা সাক্ষাৎ ফেরেশতা। মন দয়ার সাগর।’
‘হুম।’ হেমলতা বললেন,ছোট করে। পুনরায় বললেন,’একটা কথা।’

মোর্শেদ জিজ্ঞাসু ইশারা করেন ভ্রু উঁচিয়ে। হেমলতা উঠে বসেন। বলেন,’লিখনকে মনে আছে? সে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল তোমাকে?’
মোর্শেদ লেশমাত্র অবাক হলেন না। দায়সারাভাবে বললেন,’এতদিনে জানলা? আমি মনে করছি কবেই জাইননা ফালাইছো।’
‘আমি তো আর সবজান্তা নই। আমাকে বলোনি কেন?’
‘বইললা কি হইতো? ছেড়ি বিয়া দিতা? আর ছেড়াডা নায়ক। কত ছেড়ির লগে ঘষাঘষি করে। ছেড়িগুলাও নষ্টা। নষ্টাদের সাথে চলে এই ছেড়ায়।’
‘মুখ খারাপ করো না। ছেলেটার মধ্যে আমি তেমন কিছু দেখিনি। তুমি আমাকে জানাতে পারতে। নিশ্চিন্তে ছেলেটা সুপাত্র। বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, সে মা বাবা নিয়ে আসলে আমি ফিরিয়ে দিতাম না। থাক…এসব কথা। এখন বলেও লাভ নেই। পদ্মজার মন স্থির আছে। পরিস্থিতি, ভাগ্য সেখানে নিয়ে যাচ্ছে,সেখানেই গা ভাসিয়ে চলুক। ঘুমাও এখন। ভোরে উঠে গোলাপ ভাইয়ের বাড়িতে যাবা। কত কাজ বাকি! বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে কী সামান্য কথা!’

হেমলতা একা কথা বলতে বলতে অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পড়েন। কিছু সময়ের ব্যবধানে ঘুমিয়েও পড়লেন।

____________
সকাল থেকে পূর্ণার দেখা নেই। পদ্মজা পূর্ণাকে খুঁজে বাড়ির পিছনে আসে। পূর্ণা সিঁড়িঘাটে বসে উদাস হয়ে কী যেন ভাবছে। পদ্মজা পা টিপে হেঁটে আসে। পূর্ণা বোনের উপস্থিতি টের পায়নি। পদ্মজা পূর্ণার পাশে বসে। তবুও পূর্ণা টের পেল না। পদ্মজা পূর্ণাকে ধাক্কা দিল। পূর্ণা চমকে তাকাল। বুকে ফুঁ দিয়ে বলল,’ভয় পাইছি।’

‘উদাস হয়ে কী ভাবছিস?’
‘কিছু না।’
‘আবার ওইসব ভাবছিস! কতবার না করলে শুনবি বল তো?’
পূর্ণা নতজানু হয়ে রইল। ক্ষণকাল পার হওয়ার পর ভেজা কণ্ঠে বলল,’নিজের ইচ্ছায় মনে করে কষ্ট পেতে আমার ইচ্ছে করে না আপা। মনে পড়ে যায়।’
‘চেষ্টা তো করবি। আর ভুলতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। এছাড়া অমানুষগুলো তাদের শাস্তি তো পেয়েছেই।’
পূর্ণা চোখের জল মুছে আগ্রহ নিয়ে বলল,’আম্মা তিন জনকে কী করে মারল আপা?’
‘জানি না।’
‘জিজ্ঞাসা করবা আম্মাকে?’
পদ্মজা ভাবল। এরপর বলল,’করব। আজ না অন্য একদিন।’
‘বিয়ে করে তো চলেই যাবা।”

পদ্মজা অভিমানী হয়ে তাকাল পূর্ণার দিকে। বলল,’আর কী আসব না? ফিরে যাত্রা আছে। আবার এমনিতেও আসব। কয়দিন পর পর।’
‘তাহলে কালাচাঁদের সাথে বিয়েটা সত্যিই হচ্ছে?’
‘তুই কী মিথ্যে ভাবছিস?’
পূর্ণা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলল। বলল,’লিখন ভাইয়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে।’

লিখন নামটা শুনে পদ্মজা অপ্রতিভ হয়ে উঠল। নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হয়। তাই সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,’উনাকে পছন্দ না তাই কালা বলিস, ঠিক আছে। কিন্তু চাঁদ কেন বলিস বুঝলাম না।’

পূর্ণা আড়চোখে পদ্মজার দিকে তাকায়। এরপর যান্ত্রিক স্বরে বলল,’পাতিলের তলার মতো কালা হয়ে আমার চাঁদের মতো সুন্দর বোনকে বিয়ে করতেছে বলেই কালাচাঁদ ডাকি। নয়তো কালা পাতিল ডাকতাম। আবার দরদ দেখিয়ে বলিও না,উনি তো এতো কালা না। শ্যামলা।’ কথা শেষ করে পূর্ণা ঠোঁট বাঁকাল।

পদ্মজা শব্দ করে হাসতে শুরু করল। কিছুতেই হাসি থামছে না। পূর্ণা পদ্মজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলল,’তুমি খুব কঠিন আপা। খুব ধৈর্য্য তোমার,ঠিক আম্মার মতো।’

পদ্মজা হাসি থামিয়ে পূর্ণার দিকে তাকাল। সময়টা শুধু দুই বোনের। পদ্মজা মায়াবী স্বরে বলল,’আর তুই ঠিক আম্মার বাহ্যিক রূপের জোড়া পর্ব।’

প্রান্ত,প্রেমা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে নদীর ঘাটে। পদ্মজার উদ্দেশ্যে বলে,’বড় আপা দুলাভাই আসছে।’

আমির আসার খবর শুনেই বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে পদ্মজা নিজের ঘরে চলে গেল। এই লোকটা এতো বেহায়া আর নির্লজ্জ! গতকাল সকাল-বিকাল বাড়ির সামনে ঘুর ঘুর করেছে। সেই খবর পদ্মজা পেয়েছে। আজ একেবারে বাড়িতে! বিয়ের তো আর মাত্র তিন দিন বাকি। এতোটুকু সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা কী সম্ভব নয়? পদ্মজা কপাল চাপড়ে বিড়বিড় করে,’এ কার সাথে বিয়ে হচ্ছে আল্লাহ।’

উঠানে হেমলতা ছিলেন। আমির বাড়ির ভেতর ঢুকেই হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করল। এরপর নতজানু হয়ে বলল,’কেমন আছেন আম্মা?’

হেমলতার চক্ষু চড়কগাছ! আমিরের সাথে মগা এসেছে। মগার হাতে মাছের ব্যাগ, মাথায় ঝুড়ি। তাতে মশলাপাতি সাথে শাকসবজি। বিয়ের আগে এতো বাজার আবার আম্মাও ডাকা হচ্ছে। অপ্রত্যাশিত ব্যাপার স্যাপার! হেমলতা ঢোক গিলে ব্যাপারটা হজম করে নেন। ধীরেসুস্থে বলেন,’ভালো আছি। তুমি ভালো আছো? বাড়ির সবাই ভালো আছে?’
‘জি,জি। সবাই ভালো।’

আমির মগাকে ইশারা করল। মগা বারান্দায় মাছের ব্যাগ, মাথার ঝুড়ি রাখল। হেমলতা আমিরকে বললেন,’এতসব বিয়ের আগে আনার কী দরকার ছিল? পাগল ছেলে।’
আমির হেসে ইতস্ততভাবে নতজানু অবস্থায় বলল,’এমনি।’
‘যাও ঘরে গিয়ে বসো।’
‘আম্মা…’
হেমলতা চলে যেতে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়েন। আমির বলল,’আম্মা, ক্ষমা করবেন। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হবে।’
‘কোনো দরকার কী ছিল?’
‘আ..আসলে আম্মা। পদ্মজার সাথে একটু কথা ছিল।’

আমির উসখুস করছে। খুব অস্থির। হাত,পা এদিকওদিক নাড়াচ্ছে। কিন্তু চোখ মাটিতে স্থির। হেমলতা আমিরকে ভাল করে পরখ করে নিয়ে বললেন,’ঘরে আছে নয়তো ঘাটে।’

অনুমতি পেয়ে ব্যস্ত পায়ে হেঁটে গেল আমির। হেমলতা আমিরের যাওয়ার পানে চেয়ে থেকে ভাবেন,ছেলেটার সাথে এখনও চোখাচোখি হয়নি। সবসময় মাথা নত করে রাখে। কিন্তু কথাবার্তায় মনে হলো,লাজুক নয় এই ছেলে। হয়তো গুরুজনদের সামনে মাথা নিচু করে রাখা ছোটবেলার স্বভাব। হেমলতা মুচকি হেসে লাহাড়ি ঘরের দিকে এগিয়ে যান।

পদ্মজার ঘরের শেষ প্রান্তে বারান্দা আছে। বারান্দা পেরোলেই বাড়ির পিছনের দরজা। আমির আসছে শুনে ঘর আর বারান্দার মাঝ বরাবর দরজায় পর্দা টানিয়ে দিল পদ্মজা। আমির ঘরের পাশে দাঁড়াল। পদ্মজা বারান্দার দিকে। পর্দার কাপড় পাতলা,মসৃণ। আমির স্পষ্ট পদ্মজার অবয়ব দেখতে পাচ্ছে। তিরতির করে বাতাস বইছে। সেই বাতাসে পদ্মজার কপালে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো উড়ছে অবাধ্য হয়ে। আমির ডাকল,’পদ্মজা?’
‘হু?’
‘কেমন আছো?’
‘ভালো। আপনি?’
‘ভালো।’
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা! পদ্মজা বলল,’কী বলবেন বলুন।’
‘মায়াভরা চোখগুলো দেখার সৌভাগ্য কী হবে?’

আমিরের কণ্ঠে আকুতি! তৃষ্ণা! পদ্মজার অস্বস্তি হচ্ছে। বেহায়া মানুষ বড়ই বিপদজনক। সে পালানোর জন্য পা বাড়াতেই আমির হই হই করে উঠল,’কসম লাগে পালাবে না।’
পদ্মজা মাথার ওড়না টেনে নিয়ে বলল,’দরকারি কথা থাকলে বলে চলে যান।’
‘তাড়িয়ে দিচ্ছো?’
‘ছিঃ না।’
‘তোমায় না দেখলে আজ আর প্রাণে বাঁচবো না। রাতেই ইন্না লিল্লাহ…’
‘রসিকতা করবেন না। কাউকে না দেখে কেউ মরে না।’
‘পদ্মবতীর রূপ যে পুরুষ একবার দেখেছে সে যদি বার বার না দেখার আগ্রহ দেখায় তাহলে সে কোনো জাতেরই পুরুষ না। একবার দেখা দাও। কসম লাগে…’
‘বার বার কসম দিয়ে ঠিক করছেন না।’
‘আচ্ছা,কসম আর কসম দেব না। একবার দেখা দাও।’

পদ্মজার দুই ঠোঁট হা হয়ে গেল। কী বলে মানুষটা! কসম করেই বলছে আর কসম দিবে না। আমির ধৈর্য্যহারা হয়ে বলল,’পদ্মবতী অনুরোধ রাখো…’
‘এভাবে বলবেন না। নিজেকে ছোট লাগে।’
‘পর্দা সরাব?’

পদ্মজা ঘামছে। বাতাসে অস্বস্তি। নিঃশ্বাসে অস্বস্তি। তবুও সায় দিল। আমির পর্দা সরিয়ে খুব কাছে পদ্মজাকে দেখতে পেল। কালো রঙের সালোয়ার কামিজ পরা পদ্মবতী। কপাল অবধি টেনে রাখা ঘোমটা। পদ্মজা চোখ তুলে তাকাতেই আমির বলল,’জীবন ধন্য।’

পদ্মজা হাসি সামলাতে পারল না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসল। আমির বলল,’এ মুখ প্রতিদিন ভোরে দেখব। আর প্রতিদিনই জীবন ধন্য হবে। এমন কপাল কয়জনের হয়।’
পদ্মজা কিছু বলল না। আমির আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল,’আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমার হাতে খুন হয়ে যাই।’
পদ্মজা চমকে উঠল। আশ্চর্য হয়ে বলল,’আপনি পাগল।’
আমির কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,’তোমার উপস্থিতি আমার নিঃশ্বাসের তীব্রতা কতটা বাড়িয়ে দিয়েছে টের পাচ্ছো?’
পদ্মজা দূরে সরে গেল। মনে মনে বলল,’উফ! আল্লাহ আমি পাগল হয়ে যাব। এ কার পাল্লায় পড়লাম। জ্ঞানবুদ্ধি,লাজলজ্জা কিছু নেই।’
আর মুখে আমিরকে বলল,’পেয়েছি। এবার আসি।’

আমিরকে কিছু বলতে না দিয়ে পদ্মজা বারান্দা ছাড়ল। বাড়ির পিছনে মগাকে পেল।মগার পথ আটকে বলল,’মগা ভাই।’
মগা সবগুলো দাঁত বের করে হাসল। বলল,’জ্বে ভাবিজান।’

মগার মুখে ভাবি ডাক শুনে পদ্মজা বিরক্ত হলো। কিন্তু প্রকাশ করল না। বিরক্তি লুকিয়ে বলল,’লিখন শাহর কথা আপনি উনাকে বলেছেন?’
‘উনিটা কে?’
‘আপনার আমির ভাই।’
‘জ্বে ভাবিজান।’

মগার অকপট স্বীকারোক্তি! পদ্মজা এ নিয়ে আর কথা বাড়াল না। মগাকে পাশ কেটে চলে গেল। মগা দৌড়ে এসে পদ্মজার পথ রোধ করে দাঁড়াল। ফিসফিসিয়ে গোপন তথ্য দিল। আগামী দুই দিনের মধ্যে লিখন শাহ আসছে। তার বাবা মাকে নিয়ে। খবরটা মগা গত সপ্তাহ পেয়েছে। পদ্মজার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। ঢোক গিলে নিজেকে আশ্বস্ত করে নিল। সে তো কথা দেয়নি বিয়ে করার। আর না কখনো চিঠি দিয়েছে। লিখন শাহ নিরাশ হলে এটা তার দোষ নয়,লিখন শাহর ভাগ্য। তবুও পদ্মজার খারাপ লাগছে। অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। জীবনে আবার কী কিছু ঘটতে চলেছে? বুক ধড়ফড়,ধড়ফড় করছে। পদ্মজা ঘাটের সিঁড়িতে বসে রইল ঝিম মেরে।

চলবে…
®ইলমা বেহরোজ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে