আমরা ভালো আছি

0
980
তুমুল ঝগড়ার এক ফাঁকে শাশুড়ি মাকে বললাম, – আপনার জন্য অতিরিক্ত আর একটি টাকাও খরচ করতে পারবো না। কথাটা শুনে আমার গালে ঠাটিয়ে এক চড় মেরে বসলেন আমার মা, – লেখাপড়া শিখিয়েছি এই জন্য? এতোবড় হয়েও জানোনা কিভাবে একজন মাকে সম্মান করতে হয়, ছি! এতো অধঃপতন তোমার! শাশুড়ির সামনে মায়ের হাতের চড় খাওয়াটা আমাকে লজ্জায় মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে। না পারছি তাদের সামনে থেকে চলে যেতে না পারছি কিছু বলতে। আমার নিজেকে কেমন নিথর মনে হচ্ছে। শাশুড়ির দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, – এবার তোমাকে বাড়ি ছাড়া করবো। একবার..
বাকি চিন্তা করার আগেই আমার গালে ঠাস করে আরেকটি থাপ্পড় পড়লো। হতবম্ভ হয়ে গেলাম, এই থাপ্পড়টাও মা দিয়েছে, বলছে, – চোখ গেলে দেবো, এইভাবে কেউ মুরুব্বিদের দিকে তাকায়? প্রচন্ড রাগ হলো আমার, কিন্তু কিছুই বলতে পারছিলাম না, শেষে চুলের মুঠি ধরে মার শুরু করে দেয় কিনা এই ভয়ে। আমার মা বেজায় দজ্জাল এক মহিলা, তাকে দিয়ে কোন ভরসা নেই। আমার শাশুড়িও মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছেন। মা শাশুড়ির পাশে গিয়ে বললেন, – আচ্ছা আপা, আমরাওতো এককালে বউ ছিলাম, আমরাতো কোনদিন শ্বশুর শাশুড়ির সাথে এমন করি নি। আর আমাদের পেট থেকে এগুলা একেকটা কি বের হয়েছে? ছি.ছি.ছি.লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। এসব কোন ব্যবহার! ৭৫ ইঞ্জি টিভি কিনতে পারে, নিত্য নতুন ফ্লাট বুকিং দিতে পারে, নতুন মডেলের গাড়ি কিনে, দামী দামী শাড়ি কিনে আর বাপ মাকে দেয়ার বেলায় ওদের সংসারে দুর্ভিক্ষ নামে।
কথাটা বলতে বলতে মা আবার আমার দিকে তেড়ে আসে, এবার আর রক্ষা নেই! আমি ভয়ে দৌড়ে গিয়ে শাশুড়ি মায়ের পেছনে লুকাই। মা রীতিমতো লাঠি খুঁজছেন, আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম, – মা, এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। শ্বশুরবাড়িতে আমার একটা প্রেস্টিজ আছে। – কার বাড়ি? – শ্বশুরবাড়ি। – তাহলে শাশুড়িকে কেন বললি অতিরিক্ত টাকা দিতে পারবিনা? – রাগের মাথায় বলে ফেলেছি। – এতো কিসের রাগ তোমার, হুম? তোর রাগের কপালে ঝাটা মারি। আয়, এদিকে আয়। নিরুপায় হয়ে শাশুড়ি মাকে বললাম, – আপনার সামনে আপনার ছেলের বউকে মারছে আর আপনি চুপ করে দেখছেন? শাশুড়ি মা একটু নড়েচড়ে বসলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। এই সুযোগে মা খপ করে আমার হাত টেনে ধরলেন, – আয়, চিপা থেকে বের হ.. – উফ! মা.. – আজ তোকে দেখাচ্ছি মজা। অনেকদিন ধরে তোমার মুখ থেকে শ্বশুরবাড়ির বদনাম শুনছি। – বদনাম কই করলাম, যা ঘটেছে তাই বলেছি। – যা ঘটেছে তাই বলেছো, কই, তুমিতো আমায় বলোনি যে তুমি শাশুড়িকে রোজ রোজ ঠান্ডা খাবার খেতে দাও, তাকে দিয়ে সংসারের কাজ করাও, তারা মা ছেলে কথা বললে আড়াল থেকে কথা শুনার চেষ্টা করো। তুমি বলেছো এসব? – আমি এসব করিনি। – আমি সব নিজের চোখে দেখেছি। তুমি কি ভেবেছো? আমি বেড়াতে এসেছি? আমি এসেছি তোমার কীর্তিকলাপ দেখতে। আজ তোকে মেরেই ফেলবো.. মা টানছে আমার হাত, আমি টানছি শাশুড়ির হাত। ধ্বস্তাধস্তির এক পর্যায়ে শাশুড়ি মা বলছেন, – আপা, থাক না, যা হবার তাতো হয়েছেই। মা সাথে সাথে আমার হাত ছেড়ে দিলেন। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে শান্তভাবে গিয়ে বসলেন সোফায়। আমি যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলাম, ওড়না দিয়ে ঘাম মুছছি, পিপাসায় গলা ফেটে যাচ্ছে। পাশ থেকে লুকিয়ে কাজের মেয়ে আমাকে দেখছে। আমি ইশারায় ওকে সরে যেতে বললাম। ধীরে ধীরে টেবিলের কাছে গিয়ে গটগট করে পানি খেয়ে নিলাম। মা মৃদুস্বরে বলছেন,
– আমার ছেলেটা যখন বউ নিয়ে আলাদা বাসায় গেলো আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। অতো বড় একটা বাড়িতে একা থাকতে দম বন্ধ লাগতো। রাতের পর রাত ঘুমাতে পারিনি। আমাদেরতো কোন অভাব ছিলো না, ওদের বাবা যা রেখে গেছে তাই ছিলো অনেক। এই বুড়ো বয়সে শুধু একটু কথা বলার জন্য নিজের একটা লোক দরকার ছিলো। তবুও ছেলেটা চলে গেলো, আলাদা হয়ে গেলো, ওদের নতুন সংসারে প্রাইভেসি নষ্ট হয়। দিনে একবার ফোন করে, ব্যাস..মায়ের প্রতি সব দায়িত্ব ঘুচে গেলো। আমি বুড়ো মানুষ, আমাকে ওদের সাথে রাখলে পোষাবে না। কষ্ট পেয়েছিলাম, তবুও ছেলের সুখের কথা ভেবে মেনে নিলাম। বিয়ে করিয়েছিতো সংসার ভাঙ্গার জন্য নয়। মায়ের গলাটা কেঁপে উঠছে, কন্ঠস্বর ভারি হয়ে আটকে যাচ্ছে। আমি একগ্লাস পানি নিয়ে মায়ের কাছে গেলাম। মা আমার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে চুকচুক করে পানি খেলেন। পরক্ষনেই অঝোরে কেঁদে ফেললেন, – তুই তোর শাশুড়িটাকে একলা করে দিস না মা। আমার টাকা পয়সা সব আমি তোকে দিয়ে দেবো, তাও তুই মানুষটাকে একলা করে দিস না, সারাজীবন স্বামী সন্তান নিয়ে যুদ্ধ করে শেষ বয়সে একা থাকার কষ্ট মেনে নেয়া যায় না। আমিতো তোর মা, কতো মেরেছি, বকেছি তবুওকি পেরেছিস আমাকে ভুলে যেতে? শাশুড়িকে একবার মা ভাবতে পারিস না? মায়ের কান্নাটা একবার নেকামী আরেকবার দুঃখের মতো লাগছিলো। বুঝতে পারছিলাম না কি বলবো? মা আমার বিচক্ষণ মানুষ। তিনি আবার বললেন, – আমি জানি আমাদের সমাজের মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে নানাভাবে নির্যাতিত হয়, ওরা সম্মান পায় না, সুখ পায় না। ওই নির্যাতিত বউটার পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবার যেমন কর্তব্য তেমনি তোদের মতো বউদের হাতে যেই শ্বশুর শাশুড়ি নির্যাতিত হয় তাদের পাশে দাঁড়ানোওতো আমাদের কর্তব্য বল? তুই আমার মেয়ে বলে আমি তোর অন্যায় মেনে নেবো, এটা কি ঠিক হবে? তোর ভাই বাসা থেকে চলে যাবার পর তোর শাশুড়ির সাথে আমার রোজ কথা হতো। আমি কিন্তু তার মুখে কোনদিন তোর নামে খারাপ কথা শুনিনি আর তুই, প্রতিটি মুহূর্ত শুধু শাশুড়িকে নিয়ে অভিযোগ করেছিস। জানিস, তোর ভাইয়ের বউটাও ঠিক তোর মতো করেই আমাকে নিয়ে অভিযোগ করতো। তারপর একদিন আমাকে রেখে চলে গেলো। যে একাকীত্বের কষ্টে আমি তিল তিল করে মরছি, আমি চাইনি আমার মেয়ের হাত ধরে তার শাশুড়ি মাও সেই কষ্টে মরুক। তোর ভাইয়ের বউকে নিজের অজান্তে কতো অভিশাপ দিয়েছি, আমি চাইনি আমার মেয়েটাকে কোন মা অভিশাপ দিয়ে বসুক। আমার মতো তোর শাশুড়িরতো আর বিশাল সম্পত্তি নেই, ভয় হচ্ছিলো, তোরা যদি তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসিস? আমরা সত্যি শাশুড়ি মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখার প্লান করেছি। এতে অবশ্য শিহাব রাজি ছিলো না, অনেকটা জোর করে, কৌশলে শাশুড়ি মাকে দিয়েই শিহাবকে বলিয়েছি, “তিনি বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে চান, এই বাড়িতে তার বয়সি কেউ নেই, তিনি মন খুলে গল্প করতে পারেন না।” মায়ের জোরাজুরিতে শিহাব মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে রাজি হয়। আমার শাশুড়ি মা যে সত্যিই আমার মাকে আমার সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে খারাপ কিছু বলা দূর থাক, যতোটুকু খারাপ তার সাথে করেছি সেটুকুও বলেনি তা মায়ের কথা শুনেই বুঝেছি। আমার গর্ভধারিণী মা যতোই দজ্জাল হোক, সততায়, কোমলতায় তার এতোটুকু শূন্যতা নেই। সে কারণেইতো এই দজ্জাল মায়ের এতো মার খেয়েও তাকে প্রচন্ড ভালোবাসি। শাশুড়ি মা ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে আমাদের মা মেয়ের মাঝে দাঁড়ালেন। আমার হাতে একটি গলার হার আর একটি কানের দুল দিয়ে বললেন, – তোমার শ্বশুরের সখ ছিলো তার ছেলের বউকে যাতে আমি এই গয়নাটা দেই। একটা কানের দুল কোথায় যেনো হারিয়ে ফেলেছি, এই ডিজাইনের আরেকটি কানের দুল বানানোর জন্যই টাকা চেয়েছিলাম।ভেবেছিলাম তোমাদের বিবাহবার্ষিকীতে উপহার দেবো। তাতো আর হলো না। দুলটা তুমিই গড়িয়ে নিও। বৃদ্ধাশ্রম থেকে ফোন দিয়েছে, আজই নাকি উঠতে হবে। আমি আসছি। শাশুড়ি মা ব্যাগ নিয়ে হেটে যাচ্ছেন। মা আমার দিকে ঘৃণা ভরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লাল লাল, বড় বড় চোখ জোড়া নিয়ে তাকিয়ে। বুঝতে পারছিলাম, এই পৃথিবীতে মা বেঁচে থাকা সত্ত্বেও আমি আর শিহাব মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছি। আমার শরীর জুড়ে কি যেনো ছুটোছুটি শুরু করলো, মাথাটা অসহ্য ব্যথা হচ্ছে। আর কয়েক কদম এগুলেই শাশুড়ি মা ঘরের চৌকাঠ পেড়িয়ে যাবেন। আমি ছুটে গিয়ে শাশুড়ি মায়ের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লাম, – আপনি যাবেন না মা। বাহিরে গাড়ির হর্ণ বাজলো। শিহাব এসেছে। আমি মায়ের পা ছাড়ছি না। মা বলছেন, – উঠো, উঠো, শিহাব চলে এসেছে। আমি তবুও ছাড়ছি না। শিহাব ঘরে ঢুকে আমাদের অবস্থা দেখে। মা হাসতে হাসতে বলে উঠলেন, – তোর বউ কেমন পাগলামি শুরু করেছে দেখ। আমাকে ছাড়া ও নাকি থাকতে পারবেন না। তাই বৃদ্ধাশ্রমে যেতে দিতে চাইছে না। – ও তো ঠিকই বলেছে মা, তুমি শুধু শুধু জেদ করছো। আমাদের সাথেই থেকে যাও না। – দেখি মা, পা ছেড়ে একবার উঠো। আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। লজ্জায়, ঘৃণায়, অনুতাপে শিহাবকে সমস্ত সত্যিটা জানিয়ে দেয়ার প্রেষণায় উঠে দাঁড়িয়েছি। আমি যেই বলতে গেলাম, – শিহাব, মাকে আমিই.. মা আমাকে থামিয়ে বুকে জড়িয়ে বললেন, – বড় ভাগ্য করে এমন বউ পেয়েছিস শিহাব। ওকে যত্নে রাখিস। শিহাব নিত্য দিনের মতো ফ্রেশ হতে চায়। শাশুড়ি মা আমার চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, – সংসারের সব মেয়েলি ব্যাপার পুরুষদের বলতে নেই। আমি শিহাবের মা, তুমি ওর স্ত্রী, আমরা দু’জনেই ওর প্রিয়। আমাদের নামে বদনাম শুনলে ওর মনে কতোটা কষ্ট হবে জানো? তোমার দজ্জাল মা তোমাকে এসব শিখায় নি? আমি বোকা বোকা ভাবে হেসে বললাম, – দজ্জাল মা সব শেখালে কোমল মা শেখাবে কি? আমার দজ্জাল মা পাশ থেকে বললেন, – এ জন্যই কারও ভালো চাইতে নেই। নিজেরা মিলেমিশে এখন আমাকে কেমন দূরে রেখেছো দেখো। আমিও বলে রাখছি, মেয়ের মা ভেবে আমাকে দূরে রাখা চলবে না। আমি বুড়ো মানুষ..আমারওতো গল্পস্বল্প করতে ইচ্ছে করে নাকি? লিখাঃ রোমানা আক্তার শুদ্ধবালিকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে