আপনিময় বিরহ পর্ব-০৯+১০

0
906

#আপনিময় বিরহ (০৯)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________

হার্ট বিট বাড়ার সাথে সাথে মুহুর্তেই শ্বাসকষ্টও বেড়ে যায় প্রিয়তার। উত্তেজনায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। প্রিয়ম প্রথমে না বুঝলেও প্রিয়তার অস্বাভাবিক ভাব দেখে দ্রুত ছেড়ে দেয়। তারপর প্রিয়তাকে দুহাতে আগলে বসিয়ে দেয় বিছানায়। হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে দেখে প্রিয়ম আরো বেশি ভয় পেয়ে যায়। বার বাার প্রিয়তাকে ডাকতে থাাকে। যখন বুঝতে পারে প্রিয়তা কেন এমন করতেছে তখন নিজেকে সামলে বলে,

‘কাম ডাউন টুনটুনি। শান্ত হ। আমি জাস্ট মজা করেছি। সত্যি বলছি। তুই শান্ত হ।’

প্রিয়তা তবুও জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে যায় প্রিয়ম। দ্রুত উঠে ড্রয়ার চেইক করে। কারণ প্রিয়তা যা কেয়ারলেস তাতে যে সে ইনহ্যালার সাথে করে ঢাকাা নিয়ে যায়নি তা প্রিয়মের বুঝতে বাকি নাই। প্রিয়ম খুঁজে নিয়ে দ্রুত প্রিয়তার মুখের সামনে ধরে। যাদের হার্ট + এ্যাজমা এক সাথে হয় তাদেরকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইনহ্যালার দেওয়া হয়। প্রিয়তা শান্ত হতেই প্রিয়ম আগে এক গ্লাস পানি খায়। তারপর রাগী চোখে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ইডিয়ট একটা। কি সমস্যা তোর? না বুঝেই লাফ দিস কেন? তোর মতো হাজারটা প্রিয়তা আমার পিছে ঘুরে আমার তোকে প্রপোজ করা লাগবে? তোরে আমার মন চায়…

রেগে বেড়িয়ে যায় প্রিয়ম। প্রিয়তা থতমত খায়। এ কেমন লোক? নিজেই প্রথমে গোল্ডেন ওয়ার্ড বলে উত্তেজিত করে দিলো আর এখন নিজেই তাকে দোষ দিচ্ছে? খা’টাশ একটা। প্রিয়তা মনে মনে কয়েকদফা বকা দিলো প্রিয়মকে। তারপর উঠে ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়লো।

__________________

সেদিনের পর কেটেছে অনেকগুলো দিন। প্রিয়ম আর উদয় নিজেদের পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার ছোটখাটো বিজনেস দেখতেছে। এসব নিয়েই দুজন ব্যস্ত থাকে। দুজনের দিনই ভালো কাটছে। প্রিয়তাও নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে অনেকটা। প্রিয়তাদের রেজাল্টও পাবলিশড হয়ে গেছে। প্রিয়তা আর তনিমা দুজনেই প্লাস মার্ক পেয়েছে। তনিমা এখনো তাদের বাড়িতে। উদয়কে ভালোবেসে সে পুড়ছে আরেক দহনে। লোকটা তাকে ভালোবাসে না কিন্তু প্রিয়তা বলে বাসে। এমন দেবদাসের প্রেমে সে পড়লো কেমনে আল্লাহ মালুম। তনিমা বসে বসে আকাশ দেখছে আর উদয়ের কথা ভাবছে। ঠিক সেসময়েই ফোনটা বিকট এক শব্দে বেজে উঠলো। তনিমা বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফোনের দিকে একবার তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিলো। সে জানে এখন প্রিয়তা ছাড়া কেউ কল দেবে না। মন খারাপ আর আলসেমিতে উঠে গিয়ে কল ধরে না। পরপর কয়েকবার ফোন বেজে কেটে যায়। পরের বার বিরক্তিতে গিয়ে ফোন তুলতেই চোখ ছানাবড়া। উদয়! তাকে এতো বার কল দিছে কেন হঠাৎ! তার ভাবনার মাঝেই ফোন আবার বেজে ওঠে। ভয়ে ভয়ে ফোন উঠাতেই উদয়ের ঝাড়ি। তনিমা ভয়ে বুকে থু থু দিয়ে বলে,

‘এ-এমন ঝাড়ি মারো কেন? আজব।’

‘না তোরে ঝাড়ি মারবো কেন! তোরে তো আদর করবো।’

তনিমা বিড়বিড় করে বলে, ‘সেইটা তোমার দ্বারা কখনোই হবে না।’

উদয় ধমক দিয়ে বললো, ‘বিড়বিড় করিস কেন? জোড়ে বল।’

‘আব না মানে কিছু না৷ তুমি কল দিচ্ছো যে হঠাৎ?’

‘তোরে নিয়ে আসবো। থাকবো না আমি। আগে ভাগে রেডি হয়ে থাক। আমি ট্রেনে আছি।’

তনিমা লাফায় উঠে। উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘সত্যি বলতেছো?’

উদয় সন্দিহান কন্ঠে বলে, ‘এতো খুশি হয়লি কেন?’

‘আজব খুশি হবো না! কত্তো দিন পর সবাইকে দেখবো।’

‘হয়ছে নাচিস না। জলদি রেডি হ, আমি চলে আসছি কাছাকাছি।’

‘ওকে’ বলেই তনিমা ফোন কেটে নাচতে নাচতে রেডি হতে গেলো। ফোন কেটে নিঃশব্দে হাসে উদয়৷ মেয়েটা অনেক দুষ্টু কিন্তু মনটা ভীষণ রকমের ভালো৷

প্রিয়তা আর তনিমা দুজনেই ভাগ্য ভালো থাকায় একই ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে গেছে। কাল থেকেই তাদের ভার্সিটি লাইফ শুরু। প্রিয়ম আর উদয়ও সেই ভার্সিটিতেই আছে। তনিমার বাবা মা যেতে দিতে না চাইলেও তনিমার জেদ আর প্রিয়তার বাবার জন্য যেতে দিতে বাধ্য হলেন। উদয় বাড়িতে একটুও দেড়ি করেনি৷ শুধু তনিমাকে নিয়েই বের হয়ে আসছে। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। তনিমার ভীষণ মায়া লাগলো। বললো,

‘ভাইয়া একটু রেস্ট নিয়ে বের হও।’

‘না দ্রুত যাওয়া লাগবে। চল। টিকেট কাটা আছে। প্রয়োজন হলে স্টেশনে বসা যাবে।’

তনিমা আর কথা বাড়ায় না। উদয়ের সাথে পা মিলিয়ে হেঁটে আসে। এরপর দুজনে স্টেশনে এসে শোনে আরো আধাঘন্টা পর ট্রেন আসবে। তাই দুজনেই অপেক্ষা করে বেঞ্চে বসে। তনিমা নিজের মতো বসে আশপাশ পর্যবেক্ষণ করছে আর উদয় ফোনের ভেতর ব্যস্ত। অন্য সময় হলে তনিমা অনেক জ্বালাতো উদয়কে। কিন্তু উদয়কে দেখে তার আর জ্বালাতে মন চাইলো না। এমনিতেই সেই চট্টগ্রাম থেকে জার্নি করে এসে আবার এখনি যেতে হচ্ছে। ক্লান্ত নিশ্চয়! তনিমার ভাবনার মাঝেই একটা মেয়ে ছুটে এসে উদয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তনিমা ভয়ে লাফ দিয়ে উঠে। উদয় হেঁসে দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। তনিমা মেয়েটার হাত ধরে টেনে তুলে। বলে,

‘এসব কি ধরনের অসভ্যতা? চোখে দেখেন না নাকি! মানে ছেলে দেখলেই আপনাদের ঝাঁপাই পড়াা লাগে!’

মেয়েটা কিছু বলার আগেই উদয় তনিমার থেকে মেয়েটার হাত ছাড়িয়ে নেয়। রাগী কন্ঠে বলে, ‘সিনক্রিয়েট কেন করছিস? লোকজন দেখছে।’

তনিমা মুহুর্তেই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। মেয়েটা যখন ঝাপাই পড়লো তখন সেটা কিছু ছিলো না আর সে বলতেই সেইটা সিনক্রিয়েট হয়ে গেলো! কিছু বলতে যাবে তখনই উদয় আবার বললো, ‘আর ‘ও’ আমার গার্লফ্রেন্ড সো আমার ওপর ঝাঁপাই পড়বে নাকি অন্য কিছু করবে এতে তোর নাক গলানোর দরকার নাই।’

মুহুর্তেই চোখ ছলছল করে উঠে তনিমাার। এটা তাহলে তার উদয় ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড! তনিমা বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে নেয়। নিভু কন্ঠে মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘সরি আপু। বুঝতে পারিনি।’

রিনি বিরক্তি স্বরে বলে, ‘ইট’স ওকে। নেক্সট টাইম কাকে কি বলতেছো বুঝে বলো।’

তনিমা মাথা নাড়াতেই ট্রেনের আওয়াজ শুনতে পায়। রিনি আর উদয় গল্প করতে করতে হাঁটা লাগায়। তনিমা মাথা উচু করে সেদিকে তাকিয়ে চোখ মুছে নেয়। একটু এগিয়ে পেছন থেকে বলে, ‘ভাইয়া আমি বাড়ি চলে যায়! আসলে ভালো লাগতেছে….

কথা শেষ করার আগেই উদয় বলে, ‘আজব! এখন কি রাস্তাতেও তোর ঢঙ দেখা লাগবে!’

তনিমা হয়তো প্রথমবারের মতো উদয়ের বলা কথাগুলোতে কষ্ট পেলো। এর আগেও বহুবার বহু কথা বললেও তা কখনোই গায়ে লাগায়নি সে। আজ হঠাৎ করেই ছোট মনে এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? তনিমা মুচকি হেঁসে বলে,

‘যাতে ঢঙ দেখতে না হয় তাই জন্য বাড়ি ফিরে যেতে চাচ্ছি।’

‘দেখ এমনিতেই আমি অনেক ক্লান্ত। এসব ছেড়ে চুপচাপ চল প্লিজ।’

তনিমা একবার উদয় আর একবার রিনির দিকে তাকালো। তারপর কোনো কথা না বলে চুপচাপ নিজের লাগেজ নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লো। উদয় আর রিনি পাশাপাশি বসেছে। তনিমা উদয়ের সামনে বসে চুপচাপ কানে হেডফোন লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। হয়তো চোখ খুললেই টুপ করে চোখ থেকে জল গড়াবে। কানে হেডফোন লাগানো অবস্থাতেই ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ভেসে উঠে। মনে মনে আওড়ায়,

‘আজ নিজেকে বড্ড বেহায়া মনে হচ্ছে উদয় ভাই। এতোদিন তোমার হাজার কথা শুনেও আমি মজা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছি, যা আমার নিজেকে কোনো কালেই মনে হয়নি আজ তা মনে হচ্ছে। সবার একটা করে আপনিময় বিরহ থাকে। আজ বুঝি তা টের পাচ্ছি। প্রিয়তার যেমন শিশির ভাইকে নিয়ে বিরহ তেমনই আমার তুমিময় বিরহ। এ বিরহ কাঁটার নয়।’

_____________

তনিমাদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। তনিমা পুরো সময় চোখ বন্ধ করে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। চোখ মেলতেই সামনে দৃষ্টিগোচর হয় তার হৃদয় পোড়ানো এক দৃশ্য। রিনি সযত্নে তার মাথা উদয়ের ঘাড়ে দিয়ে আছে আর উদয় তা আবেশে আগলে নিয়ে আছে। রিনি ঘুমন্ত। উদয় জেগে আছে। তাদের স্টেশন আসতেই উদয় আস্তে করে রিনিকে ডাকে। এরপর ৩ জন নেমে বাড়িতে আসে। প্রিয়তা তনিমার আশায় লিভিং রুমে বসে আছে। প্রিয়মও আছে। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় তাহেরা বেগমও চলে এসেছে। তাঁরা বেগম আর তাহেরা বেগম গল্প করছে। প্রিয়তা কার্টুন দেখতেছে। প্রিয়ম ফোন ঘাটতেছে। সে সময় কলিং বেল বেজে ওঠে। প্রিয়তা দৌড়ে গিয়ে খুলে দিতেই দেখে উদয় আর তনিমার সাথে সাথে রিনিও দাঁড়িয়ে আছে। তনিমার মুখটা শুকনো। তনিমা মলিন মুখেই হাসি দিলো। প্রিয়তা তনিমাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর এতো এতো কথাা বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে। রিনিকে এতো রাতে বাড়িতে দেখে তাঁরা বেগম এগিয়ে আসেন। বিনয়ের সাথে বলে,

‘আরে রিনি তুমি এতো রাতে! এখানে!’

রিনি আহ্লাদী কন্ঠে বলে, ‘আন্টি আমি তো ঢাকা গিয়েছিলাম। আজ উদয়ও গেছিলো তাই ওর সাথেই ফিরলাম। এতো রাতে আর বাড়ি যাবো না। আজ তোমাদের এখানে থাকলে কি খুব প্রবলেম হবে?’

তাঁরা বেগম হেঁসে বলেন, ‘আরেহ না। সমস্যা নেই মা। তুমি থাকো।’

প্রিয়তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘প্রিয়তা ওকে রুম দেখিয়ে দাও।’

প্রিয়তা চোখ মুখ কুঁচকায়। এই মেয়েকে তার মোটেই সহ্য হয় না। গায়ে পড়া মেয়ে একদম। তার ভাই যে এমন একটা বান্ধবী পুষে কেমনে আল্লাহ মালুম। প্রিয়ম ভ্রু কুঁচকে তাকায় রিনির দিকে। উদয়ের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝায় ‘আজ তোমারে একবার হাতে পাই চান্দু এরপর বুঝবা।’ উদয় সরাসরি সে দৃষ্টি উপেক্ষা করে তাঁরা বেগমকে বলে,

‘আম্মু খায়তে দাও। ফ্রেশ হয়ে আসতেছি।’

প্রিয়তা তনিমাকে নিজের রুমে যেতে বলে রিনিকে রুম দেখিয়ে দিয়ে আসে। এসে দেখে তনিমা তখনো ওভাবেই বসে আছে। অন্যমনস্ক বুঝেই প্রিয়তা তনিমার কাছে আসে। ঘাড়ে হাত রাখতেই চমকে তাকায় তনিমা। প্রিয়তাকে দেখে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলে,

‘আরে তুই! আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। দাঁড়া ফ্রেশ হয়ে আসি।’

তনিমা চলে যেতে নিলে প্রিয়তা আটকায়। শান্ত স্বরে বলে, ‘কি হয়ছে তনু? মন খারাপ কেন তোর?’

কান্না গুলো উগড়ে আসতে চাইলে অনেক কষ্টে নিজেকে আটকায় তনিমা। হেঁসে বলে, ‘ধুর যা। কি বলিস! মন কেন খারাপ হবে? ঠিক আছি আমি। ছাড়!’

প্রিয়তা হুট করেই তনিমাকে জড়িয়ে ধরে। তনিমা আর না পেরে ফুঁপিয়ে উঠে। প্রিয়তা মাথায় হাত বুলাতে থাকে। তনিমাকে কিছুটা সময় দিয়ে বসায়। তারপর নিজে ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে বলে, ‘কান্না করছিস কেন তনু? কি হয়ছে? বল।’

তনিমা কান্না করতে করতে মলিন হেঁসে বলে, ‘তোর মতো আমারও বিরহ এসে গেছে রে।’

ধ্বক করে ওঠে প্রিয়তার বুক। ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলে, ‘কি বলছিস এসব? পাগল হলি নাকি!’

তনিমা উত্তর দেয় না। প্রিয়তার হাত সরিয়ে নিজের জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলে, ‘তার জীবনে এখন ভালোবাসার মানুষ আছে। তার কাছে সবার ভালোবাসার মূল্য আছে শুধু আমার নেই। আমার ভালোবাসা, কষ্ট, অনুভূতি সবকিছুই তার কাছে ঢঙ ব্যতীত অন্য কিছু নয়।’

আর এক মুহুর্তও দাঁড়ায় না তনিমা। ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। প্রিয়তা বাকরুদ্ধ হয়ে বসে পড়ে ফ্লোরে। তার ভাই অজান্তেই এই মেয়েটার মন ভেঙে গুড়িয়ে দিলো না তো?

গভীর রাত অথচ ঘুম নেই ক’জন মানুষের চোখে। একই পরিবারের ৬ জন নিরবে কষ্ট চাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যার যার কষ্ট মেলে দেওয়ার জায়গায়। সবারই একটা করে আপনিময় বিরহ। কারো না পাওয়ার, কারো পেয়ে হারানোর, আবার কারো নিজের ভুলের আফসোস। এদের মাঝেও যোজন যোজন দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে ২ জন। সবারই নিরবতা জানান দিচ্ছে অনেক অনেক কথা। কিন্তু কেউ কাউকে বলতে পারছে না।

_______________

সকাল সকাল উঠে প্রিয়তা আর তনিমা রেডি হয়ে নিলো। প্রিয়ম, উদয় আর রিনিও যাবে। তনিমা কাল যতটা চুপচাপ ছিলো আজ আবার চঞ্চল হয়ে উঠেছে। প্রিয়তার থেকেও তো বড় শক সে পায়নি। উদয় তো তার কখনো ছিলোই না আর শিশির তো প্রিয়তার ছিলো তবুও ওদের বিচ্ছেদ হয়েছে। প্রিয়তা নিজেকে সামলে উঠতে পারলে সে কেনো পারবে না? হোক অভিনয় তবুও সে নিজের অস্তিত্ব বিলীন করবে না। উদয়, রিনি, তনিমা, প্রিয়তা নাস্তা শেষ করে উঠতেই প্রিয়ম হাজির। কফি কালার শার্ট পড়ে আছে। উপরের দুইটা বাটন খোলা। সিল্কি চুল গুলো কপালের ওপর পড়ে আছে। যে কেউ দেখলেই একদফা ক্রাশ খেয়ে পেট ভরাবে। আজকাল প্রিয়ম বেশি একটা প্রিয়তাকে জ্বালায় না। আগের চেয়ে গম্ভীর হয়ে গেছে। এমন গম্ভীর তো সে রেগে গেলে হয় তবে আজকাল কেনো গম্ভীর থাকে তা প্রিয়তার অজানা। প্রিয়তা শার্টের বাটনের দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে বলে,

‘শার্টের বাটন খুলে রেখে কি মেয়েদের ইমপ্রেস করার চেষ্টা করতেছেন নাকি নিজেকে গু’ন্ডা প্রমাণ করতেছেন?’

প্রিয়ম গম্ভীর মুখেই ফোনে স্ক্রল করতে করতে বললো, ‘তোর জানার কি দরকার? নিজের কাজ কর। আর তাহসিন প্রিয়ম কখনো মেয়েদের ইমপ্রেস করতে যায় না। যার ইচ্ছা সে এমনিতেই ইমপ্রেস হয়ে যায়।’

বলেই উল্টো ঘুরে গটগট করে বেড়িয়ে যায়। তনিমা ‘থ’ মেরে যায়। একটু জোড়েই বলে ফেলে, ‘এটা কি সত্যিই প্রিয়ম ভাই ছিলো? না মানে এতো গম্ভীর টাইপ কবে হলো?’

উদয় ভ্রু কুঁচকে তাকায় তনিমার দিকে। প্রিয়তা ভেংচি কেটে তনিমাকে বলে, ‘এতো জেনে কি করবি? চল তো।’

তনিমা ঠোঁট উল্টে প্রিয়তার সাথে পা বাড়ায়। বাইরে প্রিয়ম গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতেছে। প্রিয়মকে দেখেই প্রিয়তা ভেংচি কাটে। সোজা গিয়ে পেছনে বসে পড়ে। একে একে সবাই গাড়িতে উঠতেই একটা মেয়ে দৌড়ে আসে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

‘প্রিয়ম ভাই মামি বলছে তোমার সাথে ভার্সিটি যেতে কিন্তু এখানে তো জায়গা নাই। তাহলে?’

প্রিয়ম শান্ত দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একবার প্রিয়তার দিকে তাকায়। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। প্রিয়ম উদয়কে বলে,

‘তুই ওদের নিয়ে যা। আমি সিমিকে নিয়ে বাইকে করে আসতেছি।’

উদয় কিছু বলতে গিয়েও বলে না৷ শুধু মাথা নাড়ায়। সিমি তো খুশিতে লাফ দিয়ে উঠে। প্রিয়তা বিড়বিড় করে বলে, ‘ঢঙ দেখলে বাঁচি না।’

তনিমা ঠোঁট চেপে হাসে। তারপর আস্তে করে বলে, ‘বাহ বাহ উদয় ভাইয়ের রিনি আর প্রিয়ম ভাইয়ের সিমি।’

প্রিয়তা রাগী দৃষ্টিতে তাকায় তনিমার দিকে। তনিমা ফিক করে হেঁসে দেয়।

ভার্সিটিতে প্রিয়তাদের আগেই প্রিয়ম চলে আসছে। সিমিকে নিজের ক্লাস দেখিয়ে দিয়ে এসে দেখে প্রিয়তারা চলে আসছে। প্রিয়মের কাছে আসতেই একদল ছেলে মেয়ে এগিয়ে আসে। উদয় রিনিকে বিদায় করে প্রিয়তাদের কাছে এগিয়ে আসে। প্রিয়ম চোখ মুখ খিচে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। তার মধ্যেই একটা ছেলে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে হেঁসে বলে,

‘প্রিয় না?’

প্রিয়তা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই ছেলেটা হেঁসে বলে, ‘না মানে প্রিয়তা!’

প্রিয়তা অবাক কন্ঠে বলে, ‘আপনি জানলেন কেমনে? আর প্রথমে প্রিয় বললেন কেন?’

‘প্রিয়’ ডাকটা শুনেই প্রিয়তার সেসব চিঠির কথা মনে পড়ে। প্রশ্নের ঠ্যালায় মাথায় জট পেকে যায়। কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রিয়ম সেখান থেকে চলে যায়…

চলবে…

#আপনিময়_বিরহ (১০)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________

ক্যান্টিনের টেবিলে গোল হয়ে বসে আছে প্রিয়তা, তনিমা আর সাইমা। প্রথম দিন ক্লাসেই সাইমার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে প্রিয়তা আর তনিমার। তনিমা আর সাইমা ধুমছে গল্প করতেছে কিন্তু প্রিয়তার মন এখনো সকালের ঘটনায়। যে ছেলেটা তাকে ‘প্রিয়’ বলে ডাকলো সেই ছেলেটার নাম সাদাফ। সাদাফ হচ্ছে প্রিয়মের ফ্রেন্ড। এতো শতো কথা মাথার মধ্যে প্যাচ লাগায় দিচ্ছে। প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই ঠাস করে প্রিয়ম এসে তাদের টেবিলে বসে। সাইমা ভয়ে লাফায় উঠে। তারপর থু থু করে বলে,

‘আরে প্রিয়ম ভাই আপনি এখানে?’

প্রিয়ম শান্ত গলায় বললো, ‘আসতে কি বারণ নাকি?

‘না তা না। আপনি তো ফ্রেন্ডদের ছাড়া কোথাও যান না তো এখন একা একা ঘুরতেছেন যে!’

প্রিয়ম কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে আরেকটা কন্ঠ ভেসে আসে। সবাই সেদিকে তাকিয়ে দেখে সাদাফসহ প্রিয়মের গ্যাঙ দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়ম রাগে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে নেয়। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে সবার দিকে তাকিয়ে আছে। সাদাফরা এগিয়ে এসে পাশাপাশি একটা টেবিলে বসে। তারপর প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘কি রে দোস্ত একা একা ছোট আপুদের সাথে বসে আছিস! চিনিস মনে হয়। তা আমাদের সাথে পরিচয় করাবি না?’

প্রিয়ম রাগে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে আছে। কপালের নীল রগ স্পষ্ট। প্রিয়তা প্রিয়মের মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝে যায় প্রিয়ম রেগে আছে। কিন্তু হঠাৎ রেগে গেলো কেন? রাগার মতো কি এমন হলো এখানে! প্রিয়তা কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রিয়ম গম্ভীর কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত শান্ত গলায় বললো,

‘তোরা যখন এসেছিস তখন নিজেরাই জিজ্ঞেস করে নে।’

সাদাফ হেঁসে বলে, ‘উহু। এগুলো তোর বাড়ির লোক তাই তুই পরিচয় করা।’

রাগটা যেন তরতর করে বাড়তে থাকলো। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে কোনো কথা না বলে হাতের আঙুলের সাহায্যে ইশারা করে বললো, ‘এটা প্রিয়তা, এটা….

প্রিয়মকে থামিয়ে দিয়ে সাদাফ বললো, ‘তোর টুনটুনি?’

বলেই একদফা হাসলো। প্রিয়ম তবুও কিছু বললো না। ঝামেলা করতে চাইছে না বিধায় চুপ করে আছে। সাদাফের কথা এড়িয়ে গিয়ে ফের বলতে শুরু করলো, ‘এটা তনিমা আর এটা সাইমা।’

সাদাফ হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে দিলো প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা সামান্য চমকে প্রিয়মের দিকে তাকায়। প্রিয়ম ততক্ষণে মাথা নিচু করে নিয়েছে। প্রিয়তা হাত এগোলো না। সাদাফ নিজে থেকেই বললো,

‘হেই প্রিয়..তা। আ’ম সাদাফ সায়মান।’

প্রিয়তা কিছু বললো না। লোকটা তাকে বার বার প্রিয় বলে কেন? এটা কি সেই চিঠি দেওয়া লোকটা? নাকি এমনি ডাকে! প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই বাকি সবাইও পরিচয় দিয়ে দেয়। রিমা, নিতু, নোমান, সামি। সবার পরিচয় শেষে সাদাফ প্রিয়তার উদ্দেশ্যে বলে,

‘তোমাকে একটা কথা বলি?’

প্রিয়তা ঘাড় কাত করে বোঝায়, ‘হ্যা’। সাদাফ হেঁসে বলে, ‘আমি তোমাকে প্রিয় বলে ডাকলে কি তোমার কোনো সমস্যা আছে?’

এ পর্যায়ে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না প্রিয়ম। নিজের প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে কিছু বলতে না পেরে সামনে থাকা টেবিলে জোড়ে লা’থি দিয়ে বসে। রাগে চোখ মুখ ভয়ংকর হয়ে আছে। প্রিয়তা প্রিয়মের রাগ দেখে ভয়ে বুকে হাত দিয়ে সরে দাঁড়ায়। শুধু যে প্রিয়তা তা না উপস্থিত সবাই জানে প্রিয়মের রাগ কতোটা! তাই সবাই ভয় পেয়ে যায়। শুধু সাদাফ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে। প্রিয়ম গটগট করে হেঁটে যায় প্রিয়তার সামনে। কিছু বলার আগেই জোড়ে হাত চেপে ধরে প্রিয়তার। তারপর টেনে নিয়ে ক্যান্টিনের বাহিরে চলে যায়। প্রিয়ম চলে যেতেই পিছন পিছন সাইমা আর তনিমা দৌড় দেয়। সাদাফ শব্দ করে হেঁসে দেয়। রিমা এগিয়ে এসে বলে,

‘কি সমস্যা তোর সাদাফ? তুই প্রিয়মের প্রিয় জিনিসটা কেড়ে নিতে উঠে পড়ে লেগেছিস কেন? প্রিয়ম প্রিয়তাকে কতটা ভালোবাসে তা নিশ্চয় তোর অজানা নয়?’

সাদাফ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। তারপর শক্ত গলায় বলে, ‘প্রিয়তা আমার মানে শুধু আমার।’

তারপর দুই পা এগিয়ে গিয়ে গান গাইতে শুরু করে, ‘তোমার কেনো জ্বলে রে বন্ধু তোমার কেনো জ্বলে!’

নিতু হতাশার শ্বাস ফেলে বলে, ‘এদের মধ্যে এমন যুদ্ধ কেন শুরু হলো!’

________________

প্রিয়ম প্রিয়তাকে নিয়ে কোথায় গেছে তা জানে না তনিমা। সাইমাকে দাড়াতে বলে ছুট লাগিয়েছে উদয়ের কাছে। কাজের সময় এই গোবরপড়া লোককে পাওয়া যায় না। উদয়কে বকতে বকতে দ্রুত আবার ক্যান্টিনের মধ্যে আসে। এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে রিমাদের কাছে জিজ্ঞেস করে,

‘উদয় ভাইকে দেখছেন আপনারা?’

নোমান ভ্রু কুঁচকে তনিমার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘আগে এটা খেয়ে শান্ত হও।’

সাথে সাথেই তনিমার এক রাম ঝাড়ি, ‘ধুর মিয়া। আপনি পড়ে আছেন শান্ত হওয়া নিয়ে? ওদিকে আপনার বন্ধু আমার বোনরে না জানি কাঁচা চিবাইয়া খাইতাছে!’

‘ওই মেয়ে ঠিক করে কথা বলো। আমরা কিন্তু তোমার সিনিয়র।’

তনিমা নিজেকে শান্ত করে নরম গলায় বলে, ‘সরি ভাইয়া। আসলে চিন্তায় রুঢ় বিহেভ করে ফেলছি। প্লিজ যদি জানেন উদয় ভাই কই আছে তাড়াতাড়ি বলে দিন। প্রিয়ম ভাইয়ের যা রাগ তাতে সে প্রিয়তার সাথে কি করবে কে জানে! মেয়েটা এমনিতেই অনেক ডিপ্রেশড এরপর উল্টা পাল্টা কিছু হলে নিজেকে সামলাতে পারবে না।’

সামি বলে, ‘আচ্ছা তুমি শান্ত হও আর আমাদের বিল্ডিং এ যাও। ওখানেই আমি উদয়কে দেখছি।’

তনিমা ‘থ্যাঙ্কস’ বলেই দৌড়। ছুট লাগিয়েছে মাস্টার্সের বিল্ডিংয়ের কাছে। ২ তালায় আসতেই দেখে সব ফাঁকা। সেখানে সিড়িতে বসে আছে উদয় আর রিনি। রিনিকে দেখে খারাপ লাগলেও তা আর পাত্তা দিলো না তনিমা। ছুটে আসে উদয়ের কাছে। উদয় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তনিমা গড়গড় করে বললো,

‘প্রিয়ম ভাই রেগে প্রিয়তাকে নিয়ে কোথায় গেছে কিছু জানি না। আপনি তো জানেন প্রিয়ম ভাইয়ের রাগ কেমন! দ্রুত দেখেন প্রিয়ম ভাই কোথায়?’

প্রিয়ম রেগে প্রিয়তাকে নিয়ে গেছে শুনেই কলিজা শুকিয়ে আসে উদয়ের। কিছু না বলে তনিমার হাত ধরে নিচে আসে। পেছন থেকে রিনি অনেকবার ডাকলেও তা পাত্তা দেয় না উদয়। আসতে আসতে তনিমাকে পুরো ঘটনা বলতে বললে সে তা বলে। উদয়ের বুঝতে বাকি নেই প্রিয়ম কতোটা রেগে আছে! দ্রুত তনিমাকে নিয়ে পার্কিং এ এসে দেখে শুধু ওর বাইকটা আছে গাড়ি নেই। তনিমাকে বাইকে বসিয়ে যেখানে যেখানে যেতে পারে সব জায়গায় খুঁজে। বাড়িতেও একবার কল দিয়ে জিজ্ঞেস করছে কোনো লাভ হয়নি।

প্রিয়ম প্রিয়তাকে নিয়ে শহর ছেড়ে অনেকটা দুর চলে এসেছে। পুরোটা সময় ভয়ে কিছু বলতে পারেনি প্রিয়তা। প্রিয়ম রাগে গাড়ির সাথে হাতে কয়েকবার আঘাত করছে। হাত কেটে রক্ত পড়তেছে তবুও প্রিয়মের কোনো হেলদুল নেই। প্রিয়তা এতক্ষণ ভয়ে চুপ থাকলেও কি করবে না করবে ভেবে আমতা আমতা করে বললো,

‘ভা-ভাইয়া আপনার হাত থেকে র-রক্ত পড়তেছে। প্লিজ কিছু দিয়ে হাতটা বেঁধে নিন।’

প্রিয়ম ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকায় প্রিয়তার দিকে। ভয়ে ঢোক গিলে প্রিয়তা। প্রিয়ম ছুটে এসে নিজের সাথে চেপে ধরে তাকে। প্রিয়তা ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়৷ কোনোরকমে বলে, ‘কি করছেন ভাইয়া?’

‘হাতের রক্তক্ষরণ তোর চোখে পড়তেছে আর আমার মন যে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে তা কখনো বুঝার চেষ্টা করেছিস?’

বলেই ঝটকা দিয়ে ছেড়ে দেয়। প্রিয়তা আহম্মকের মতো তাকিয়ে থাকে প্রিয়মের দিকে। সে কি করলো? সে তো কিছু করেনি। ভয়ে আর কিছু জিজ্ঞেসও করেনি। নিজের মতো সামনে তাকাতেই দেখে তারা শহর ছেড়ে অনেকটা দুর গ্রামের দিকে চলে এসেছে। পিচঢালা রাস্তার ওপারে সবুজের সমোরোহ। প্রিয়তা ভয় ভীতি এক নিমিষেই ভুলে খানিকটা এগিয়ে যায়। মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে দৃশ্য। প্রিয়ম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রিয়তার দিকে। একবার নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে গাড়ি থেকে ফোন বের করে। আসার সময়ই ফোন অফ করে দিয়েছিলো সে। তাই অন করে নেয় প্রথমে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যের পথে প্রায়। প্রিয়ম উদয়ের ফোনে কল দেয়। সাথে সাথেই রিসিভ হয়। হন্তদন্ত হয়ে উদয় জিজ্ঞেস করে,

‘প্রিয়ম প্রিয়তা কোথায়? তোরা ঠিক আছিস তো? রেগে কোথায় চলে গেলি? সব জায়গায় খুঁজে আমি হয়রান।’

প্রিয়ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘এতো চিন্তা করিস না। তোর বোন ঠিক আছে।’

‘আর তুই?’

প্রিয়তা প্রিয়মের কথা শুনে উল্টো ফিরে তাকায়। উদয়ের প্রশ্নের উত্তরে প্রিয়ম প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে ছোট করে বলে, ‘আমি! ঠিক আছি কি না তা ভাবার মতো কেউ নাই। বাই দ্যা ওয়ে মামনি আর আঙ্কেলকে বল চিন্তা না করতে আমরা আসতেছি। হয়তো রাত হতে পারে। অনেক দুর চলে আসছি।’

উদয় চিন্তিত স্বরে বলে, ‘ঠিক আছে। সাবধানে আয়।’

প্রিয়ম কল কেটে দেয়। প্রিয়তা প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমরা কি বাড়ি ফিরবো এখন?’

‘হুম।’

প্রিয়তা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভয়ে ভয়ে বলে, ‘আপনার হাত থেকে অনেকটা রক্ত পড়তেছে এখনো প্লিজ বেঁধে নিন না।’

প্রিয়ম আর কথা বাড়ায় না। হাতও বাঁধে না। গাড়িতে বসে পড়ে। প্রিয়তা নিজের কপাল চাপড়ে গাড়িতে উঠে। এতো জিদ কেন এই ছেলের? যে হাতে প্রিয়ম ব্যাথা পেয়েছে প্রিয়তা রাগে সেই হাত চেপে ধরে৷ প্রিয়ম অস্ফুটে স্বরে আর্তনাদ করে উঠে। মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নেয়। প্রিয়তা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘এখন আর্তনাদ করেন কেন? রাগ দেখানোর সময়, জিদ করার সময় মনে থাকে না!’

প্রিয়ম হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে প্রিয়তা শক্ত করে চেপে ধরে। তাতে আরো ব্যাথা পায় প্রিয়ম। হাতের ব্যাথায় টনটন করে উঠে৷ প্রিয়তা নিজের ব্যাগ থেকে রুমাল নিয়ে সযত্নে হাত বেঁধে দেয়। প্রিয়ম কিছু বলে না। মেয়েটা যে নিজের অজান্তেই তার ওপর অধিকার খাটাচ্ছে এটা হয়তো মেয়েটা নিজেও জানে না। প্রিয়ম চুপচাপ গাড়ি স্টার্ট দেয়। প্রিয়তা নিজের মতো গাল ফুলিয়ে গাড়ির বাইরে তাকায়। যেতে অনেকটা সময় লাগবে ভেবে চোখ বন্ধ করে নেয়। প্রকৃতির বিশুদ্ধ বাতাস গায়ে লাগার সাথে সাথেই কেঁপে উঠে। প্রকৃতি দেখতে দেখতে অনেকটা সময় চলে যায়। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানে না। সন্ধ্যা পেড়িয়ে তখন রাত। বাতাসে ঘুমের মধ্যেও প্রিয়তা কেঁপে উঠতেছে দেখে গাড়ি রাস্তার ধারে থামায়। আস্তে করে প্রিয়তার সিটবেল্ট খুলে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে নেয়। আরামের জায়গা পেয়ে প্রিয়তা আরো শান্তিতে ঘুমায়। প্রিয়ম প্রশান্তির হাসি হাসে।

____________

বাড়ি পৌছাঁতে পৌঁছাতে রাত ৯ টা পার হয়ে যায়। প্রিয়তা তখনো ঘুমে। ডাকবে নাকি নিজে নিয়ে যাবে বুঝে উঠতে পারে না। প্রথমে কোলে করে নিতে চাইলেও পরে অনেককিছু ভেবে প্রিয়তাকে নিজের থেকে সরিয়ে দেয়। তার বুকে মাথা রেখে পুরো রাস্তা প্রিয়তা এসেছে এটা না হয় সে আর তার প্রশান্তিতে ভরে যাওয়া বুকটাই জানুক। প্রিয়তাকে আস্তে করে ডেকে তুলে। প্রিয়তা লাফিয়ে উঠে। দ্রুত বলে,

‘হ্যাঁ? চলে এসেছি?’

প্রিয়তার কথার উত্তরে প্রিয়ম শুধু মাথা নাড়ায়। তারপর গাড়ির দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়। প্রিয়তাও হাই তুলতে তুলতে বেড়িয়ে আসে। বাড়ির কলিংবেল বাজাতেই ছুটে এসে দরজা খুলে দেন তাঁরা বেগম। মেয়েকে সামনে দেখেই তিনি জড়িয়ে ধরেন। প্রিয়তা মুচকি হেঁসে মা’কে জড়িয়ে ধরে। প্রিয়ম কোনো কথা না বলে লিভিং রুমে এসে বসে। তাহেরা বেগম কড়া কন্ঠে বলে,

‘এতো রাত পর্যন্ত মেয়েটাকে নিয়ে তুমি কোথায় ছিলে প্রিয়ম?’

প্রিয়ম নিজের মায়ের মুখের দিকে তাকায়। তাহেরা বেগমের বুক ছলাৎ করে উঠে। এ কি অবস্থা তার ছেলের? চোখে মুখে মলিনতার ছাপ, ক্লান্তির ছাপ। প্রিয়ম মাথা এলিয়ে দেয় সোফায়। প্রিয়তাও ততক্ষণে বাড়িতে ঢুকে গেছে। প্রিয়তা বসতেই সিমি এসে প্রিয়মের হাত ধরে আতঙ্কিত কন্ঠে বলে,

‘এ কি! তোমার হাতে কি হয়ছে প্রিয়ম ভাই? এটা এমন লাল হয়ে আছে কেনো? দেখি!’

‘দেখি’ বলতে বলতেই হাতের বাঁধন খুলে দেয় সিমি৷ প্রিয়ম কিছু বলার সুযোগই পায় না। তনিমা প্রিয়তার পাশে বসে। তাহেরা বেগম ছেলের হাত দেখে দ্রুত তার পাশে বসে পড়ে। ব্যস্ত স্বরে বলে, ‘আব্বা তোমার হাতে কি হয়ছে? এতোটা কাটলো কি করে?’

তাঁরা বেগম এগিয়ে আসে প্রিয়মের দিকে। প্রিয়ম মুচকি হেঁসে বলে, ‘ঠিক আছি আম্মু। চিন্তা করো না।’

তাহেরা বেগমকে কিছু বলতে না দিয়েই সিমি বললো, ‘ঠিক আছো বললেই হলো? কতোটা কেটে গেছে! অনেক কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়। দাঁড়াও আমি ওষুধ লাাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।’

‘আরে দরকার নাই। ঠিক আছি বললাম তো আমি। আর তুই এখানে কেন?’

তাহেরা বেগম বললেন, ‘আমার সাথে আসছে। তোর কোনো সমস্যা?’

প্রিয়ম আর কিছু বলে না। তাঁরা বেগম দ্রুত ফাস্ট এইড বক্স এনে দেয়। সিমি তা একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে নিজেই ব্যাান্ডেজ করতে শুরু করলো। প্রিয়ম আর কিছু বললো না। প্রিয়তা সিমির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে, ‘দরদ দেখো! যেনো ওইটা ওর জামাই। ঢঙ দেখলে দেয়ালে মাথা ঠুকে দিতে মন চায়। যত্তসব!’

তনিমা পাশে থাকায় প্রিয়তার বিড়বিড় গুলো স্পষ্ট শুনতে পায়। ফিক করে হেঁসে দেয়। সবাই তনিমার দিকে তাকায়।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে