আপনিময় বিরহ পর্ব-০৭+০৮

0
999

#আপনিময় বিরহ (০৭)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________

রাস্তার পাশে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা আর শিশির। দুজনের মুখেই কোনো কথা নেই। প্রিয়ম তাদের থেকে কিছুটা দুরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশিরকে দেখে প্রথমে রাগ লাগলেও পরে সব হজম করে সে একটু দুরে গিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে চিল মুডে গান শুনতেছে। শিশির যত যায় বলুক সে আর প্রিয়তাকে কখনোই শিশিরের লাইফে ফিরতে দেবে না। তার জন্য যা করতে হয় করবে। প্রিয়তা প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে দাঁড়াচ্ছে। শিশির কাতর কন্ঠে প্রথমেই শুধায়,

‘তুমি সত্যি সত্যি আমাকে ছেড়ে বিয়ে করে নিলে প্রিয়ু? একটা বার আমার কথা মনে পড়লো না তোমার? আমাকে ভুল বুঝে তুমি বিয়ে করে নিলে!’

প্রিয়তা অবাকের সপ্তম পর্যায়ে। সে কি আগে বিয়ে করছে? না তো। এমনিতে তো সে বিয়েই করেনি এখনো তবুও তাকে কি সব দোষ দিচ্ছে শিশির! প্রিয়তা কিছু বলতে যাবে তার আগেই শিশির বলে,

‘কেনো অনিমাকে বিয়ে করলাম তা যদি একটাবার জিজ্ঞেস করতে তাহলে হয়তো ভুল বুঝতে না। সেদিন তোমার ব্যাাপারে মা’কে বলতেই মা সরাসরি মানা করে দিলো। আমি অবাক হলাম। মা’কে জিজ্ঞেস করলাম কেনো সে তোমাকে বিয়ে করাবে না। কারণ হিসেবে সে বললো, ‘প্রিয়তা উড়নচণ্ডী একটা মেয়ে। ওসব মেয়ের ঘর সংসার হয় না বুঝেছিস। আর তাছাড়া তোর বউ হিসেবে আমার অনিমাকে পছন্দ। ওকেই বিয়ে করবি তুই।’ আমি আরেকদফা অবাক হলাম। তুমি শুধুমাত্র চঞ্চল স্বভাবের বলে মা তোমাকে পছন্দ করে না। মায়ের চাপে পড়ে তোমার সাথে দুরত্ব বাড়ালাম। এরপর মায়ের কসমের জন্য অনিমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হলাম। কিন্তু অনুষ্ঠান করে বিয়ে করলে তুমি ঝামেলা করবে ভেবে মা আমাকে জোড় করে অনিমার কাছে পাঠায়। অনিমা আমাকে বিয়ে করবে না সাফ সাফ জানিয়ে দেয়। এরপর অনেক রকম কথা বলে, তোমার নামে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করলাম। আমি তখনও জানতাম না এসবের পেছনে আসলে কে কে আছে! বিয়ের পর জানতে পারি অনিমা আমাকে ভালোবাসতো তাই ওর বাবা মা আর আমার মা মিলে দুজনের বিয়ের এরকম প্ল্যান করেছে। আমি সেদিনও চাপে পড়ে অনিমাকে বিয়ে করেছি ওকে ভালোবেসে নয়। আমি আজো ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে। তুমি আমাকে ভুল বুঝে ওই ছেলেকে কেন বিয়ে করলে?’

প্রিয়তা বাকরুদ্ধ হয়ে শিশিরের দিকে তাকিয়ে রইলো। আপন মানুষগুলো এভাবে তাকে ঠকিয়েছে! অনিমাও ভালোবাসে শিশিরকে! কিছুক্ষণ সেভাবেই তাকিয়ে রইলো শিশিরের মুখের দিকে। তারপর হুট করেই শব্দ করে হেঁসে উঠলো। শিশির বুঝলো না প্রিয়তা হাসছে কেনো? সে কি হাসার মতো একটাও কথা বলেছে? প্রিয়তা কিছুক্ষণ ওভাবেই হাসতে থাকলো। ইসস বিষাদের হাসিটুকুও আজ কত সুন্দর। চোখ ভর্তি পানি জমা হয়ে গেছে আর ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে রয়েছে। প্রিয়ম প্রিয়তার দিকে তাকাতেই এভাবে পাাগলের মতো হাসতে দেখে দ্রুত এগিয়ে আসে। ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পায় চোখের জল। প্রিয়ম প্রিয়তার বাহু ধরে বলে,

‘এমন পাগলের মতো হাসছিস কেন? কি হয়ছে প্রিয়?’

প্রিয়তা যেনো হুশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তাই প্রিয়মের ‘প্রিয়’ ডাকটাও খেয়াল করেনি। শিশির শুধু প্রিয়মের অস্থিরতা খেয়াল করলো। প্রিয়ম রক্তচক্ষু নিয়ে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কি বলেছিস তুই? ও এমন করছে কেন? ওর কিছু হলে তোকে আস্ত পুঁ’তে ফেলবো আমি।’

প্রিয়তাকে আগলে নেয় প্রিয়ম। প্রিয়তা হাসি থামিয়ে প্রিয়মের থেকে খানিকটা সরে এসে সজোড়ে থা’প্পড় বসায় শিশিরের গালে। হতভম্ব শিশির এবং প্রিয়ম। দুজনের কেউই ভাবেনি প্রিয়তা এমন কিছু করতে পারে। এতটুকুতেই ক্ষ্যান্ত হয়নি প্রিয়তা। রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে গেছে। চিৎকার করে বলতে লাগলো,

‘ভালোবাসা! আপনি আমাকে ভালোবাসেন? আরে লজ্জা লাগে না কথাটা বলতে! আপনি আমাকে হাজারটা স্বপ্ন দেখিয়ে বিয়ে করেছেন কাকে? অনু আপুকে। আমার হৃদয়ের খুব কাছের একটা মানুষকে। আপনার মায়ের আমাকে পছন্দ না কারণ কি? আমি চঞ্চল, উড়নচণ্ডী। আরে আমাদের মতো হাজারটা মেয়ে আছে যারা সুন্দর ভাবে সংসার করে। আর কি বললেন আপনি বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছেন! বিয়ে করার আগে একটা বার আমাকে বলেছেন কিছু? আপনি আসলে আমাকে কখনোই ভালোবাসেননি। ভালোবাসলে অন্তত এত নিচু একটা কাজ করতেন না। এত নিচে নামার আগে একটা বার আমার সাথে কথা বলতেন। দুজনে মিলে সমাধান করতাম। আন্টি আজ মানতো না কাল মানতো। কাল না হয় পরশু। কিন্তু আপনি তো চেয়েছিলেন অন্য কাউকে বিয়ে করতে তাই আপনি একটা বার আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। আমাকে বলেননি কিছু্। আর এখন আপনি যখন শুনেছেন আমার বিয়ে হয়ে গেছে তখন আমাকে দোষ দিচ্ছেন? বিয়েটা আপনি করেছেন আর সব দোষ আমার। আমি কেন ভুল বুঝলাম? আপনাকে আমার দুইটা চোখে সহ্য হচ্ছে না। আপনার মতো কিছু লোক থাকে জানেন যারা নিজেরা দোষ করে সব দোষ চাপায় অন্যের ঘাড়ে। আপনি আমার সামনে থেকে যান। আপানকে দেখলেই আমার গা ঘিনঘিন করতেছে।’

প্রিয়তার এতো ঘৃণা শিশিরের সহ্য হলো না। চুপচাপ চলে গেলো। প্রিয়তা ওখানেই বসে পড়লো কাঁদতে কাঁদতে। প্রিয়ম নিজেই কিছু বলার মতো ভাষা পেলো না। মানুষ এতো নিচ মনের হয় কিভাবে? প্রিয়ম নিজেও নিচে বসে প্রিয়তাকে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে। ভরসার বুক পেয়ে প্রিয়তা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে প্রিয়মের বুক ভাসায়। প্রিয়ম বুকের বাম পাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে। প্রিয়তার মাথায় হাত বুলাতে থাকে। প্রিয়তা অনেকটা সময় কাঁদতে কাঁদতেই জ্ঞান হারিয়ে প্রিয়মের বুকে লুটিয়ে পড়ে। প্রিয়ম আতঙ্কিত স্বরে প্রিয়তাকে ডাকতে থাকে। প্রিয়তার সাড়া না পেয়ে দ্রুত কোলে উঠিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। ভয়ে প্রিয়মের প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। বলতে দ্বিধা নেই এই মেয়েটি তার মনের অনেকটা জুড়ে বাস করছে। কিছু কিছু মানুষ আমাদের জিবনে অনেক বেশি জায়গা নিয়ে থাকে। প্রিয়তাকে বাড়ি নিয়ে ঢুকেই ‘মামনি’ বলে চেঁচাতে থাকে। তাঁরা বেগম প্রিয়মের এমন অস্থির ডাক শুনে দ্রুত নিচে নেমে আসে। উদয়, তনিমা আর পলক সাহেবও আসে। প্রিয়তাকে চুপচাপ সোফায় শুয়ানো দেখেই বুঝে যায় কিছু হয়েছে। সবাাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রিয়তাকে নিয়ে।

ডক্টর এসে প্রিয়তাকে জ্ঞান ফিরার সাথে সাথে ঘুমের ইনজেকশন দেয়। প্রিয়তা সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ে। মেয়েটার ওপর অনেক কিছু গেছে এখন একটু ঘুম দরকার। প্রিয়তা ঘুমাতেই প্রিয়মকে সবাই চেপে ধরে কি হয়ছে তা নিয়ে। প্রিয়ম শুধু প্রিয়তার বলা কথা গুলোই ক্লিয়ার করে বলে। শিশির কি বলেছে তা সে জানে না। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে প্রিয়তাকে নিয়ে। এখানে এসে আবারও ক্ষত তাজা হলো। সবাই চলে যেতেই প্রিয়ম তাঁরা বেগমের সামনে হাটু মুড়িয়ে বসে পড়ে। চোখে পানি চিকচিক করছে। তাঁরা বেগম মুচকি হেঁসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘চিন্তা করো না বাবা। প্রিয়তার কিছু হবে না।’

প্রিয়ম মাথা গুজে দেয় তাঁরা বেগমের কোলে। মানুষটা কে কেন জানি কিছু বলতে হয় না। মনের কথা সহজেই বুঝে যায়। প্রিয়ম ধরে আসা কন্ঠে বলে, ‘প্রিয়তা মানসিকভাবে অনেক ভেঙে পড়েছে।’

তাঁরা বেগম কিছু বলে না৷ তার আদরের মেয়েটার ওপর দিয়ে কি যাচ্ছে তা তো সে ছাড়া কেউ জানে না।

____________

শিশির বাড়িতে এসে কারো সাথে কোনো কথা বলে না। অনিমা খাওয়ার জন্য শিশিরকে ডেকে গেছে। শিশির শুনেও না শোনার মতো করে চুপ হয়ে আছে। প্রিয়তা তাকে থা’প্পড় মে’রেছে বিষয়টা মানতে পারছে না৷ মেয়েটা তাকে ভীষণ ভালোবাসতো তবে কি ভালোবাসা বদলে গেছে! হাজারটা চিন্তার মধ্যেই অনিমা এসে শিশিরকে আবার ডাকে। শিশির বিরক্তির দৃষ্টি নিয়ে অনিমার দিকে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি শীতল করে আনে। কাতর কন্ঠে অনিমাকে শুধায়,

‘আমি কি খুব খারাপ অনি?’

হঠাৎ এমন প্রশ্নে কিছুটা ভড়কে যায় অনিমা। তারপর নিজেকে সামলে হেঁসে বলে, ‘হঠাৎ এ প্রশ্ন?’

‘বলো না!’

অনিমা কেমন করে হাসে। তারপর কন্ঠে বিষাদ এনে বলে, ‘যারা একটা নিষ্পাপ মেয়েকে ভেতর থেকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয় তারা কিি ভালো শিশির ভাই? কত বড় অন্যায় এটা জানেন! হ্যাঁ তাদের মধ্যে আমিও পড়ি। আমার জন্যই নিষ্পাপ মেয়েটার স্বপ্ন ভেঙেছে। আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। একটা পাপ আমাকে আজীবন তাড়া করে বেড়াবে। তবে আপনি কাজটা ভালো করেননি শিশির ভাই। ওকে এতো বেশি ভালোবাসেন যখন তখন বিয়ে করার আগে একটা বার ওর সাথে কথা বলা উচিত ছিলো। নিজের মায়ের কথা ভেবেছেন ভালো কিন্তু একবার ওর কথা ভাবলে কি খুব ক্ষতি হতে? আপনি যদি ওর কথা ভাবতেন তাহলে আজ আমাকে স্বার্থপর বলা হতো না। বোনের সংসারের স্বপ্ন ভেঙে নিজের সংসার গড়তে হতো না। প্রিয়তাও ভেতর ভেতর এতো ক্ষত বিক্ষত হতো না।’

অনিমা আর দাঁড়ায় না। নিঃশব্দে বেড়িয়ে যায়। এ সংসারে তার সময় ফুরিয়ে এসেছে। হোক পবিত্র সম্পর্ক তবুও এ সম্পর্কের দাম তো নেই। শিশির আর শিলা বেগমের একটা কড়া শাস্তি দরকার। কিন্তু আদৌও এরা নিজেদের ভুল কখনো বুঝবে নাকি আবার নতুন করে সংসার গড়বে! অবশ্য এদের দ্বারা সব সম্ভব।

____________

সকাল সকাল প্রিয়তা ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। আজ তার প্রথম পরীক্ষা অথচ সে সারারাত পড়েই নি। আগে যা পড়া ছিলো সেটুকুই আছে। মনে মনে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ফ্রেশ হয়ে সরাসরি লিভিং রুমে আসে। সেখানে প্রিয়ম, উদয়, তনিমা, পলক সাহেব এক সাথে বসে আছে। তাঁরা বেগম নাস্তা বানাচ্ছেন। প্রিয়তা লাজ লজ্জার কথা ভুলে সরাসরি পলক সাহেবকে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,

‘আব্বু আমার এক্সাম শেষ হলে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করো। আগেই বললাম কারণ তোমাদের ছেলে খুজতেও সময় লাগবে।’

প্রিয়তার কথা শুনে প্রিয়ম শুধু মুখেই বিষম খায়। পলক সাহেব কিছুটা কেশে গলা পরিষ্কার করেন। উদয় আর তনিমা হা করে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা সব কিছু উপেক্ষা করে নিজের রুমে চলে গেলো। প্রিয়ম গালে হাত দিয়ে বলে,

‘এটুকু মেয়ের বিয়ের শখ জাগছে। হায় আল্লাহ তুলে নাও আমারে।’

চলবে…

#আপনিময়_বিরহ (০৮)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________

প্রিয়তার সব গুলা এক্সাম ভালো ভাবে শেষ হয়ছে। প্রথম দিন বিয়ের কথাটা নিয়ে অনেক কথা হলেও এখন সবই ঠান্ডা৷ ঝড়ের আগের পূর্বাভাস যাকে বলে। প্রিয়তা ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেছে। তার মধ্যে আর চঞ্চলতার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না। এ নিয়ে তনিমা জিজ্ঞেস করাতে উদাস কন্ঠে একটাই কথা বলেছিলো,

‘যে চঞ্চলতা আমার ভালোবাসাটাই কেড়ে নিলো সে চঞ্চলতা না-ই বা থাকলো।’

তনিমা এ কথার পৃষ্ঠে কি বলবে খুঁজে পায় না। এ কয়দিন থাকাকালীন প্রিয়তা আর শিশিরকে দেখেনি। দেখতেও চাইনি। যে মানুষ তাকে সুখের সংসার পাওয়ার জন্য ছেড়ে গেছে তাকে দেখাটাও কষ্টের। প্রিয়তা পুরো বাড়ি ভুতের মতো কয়েকবার চক্কর দিলো। তারপর অনেক ভেবে অনিমার রুমে গেলো৷ এই রুমে তাদের অনেক স্মৃতি। চোখের কোণে জলকণা চিকচিক করে উঠে। ঠিক সে সময়েই তার মাথায় কেউ গাট্টা মারে। প্রিয়তা পেছনে ফিরতেই দেখে প্রিয়ম দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তা চোখ মুখ কুঁচকে তার দিকে তাকাতেই বললো,

‘কি সমস্যা আপনার? সব সময় আমাকে জ্বালান কেন? আজব!’

প্রিয়ম পাত্তাই দিলো না প্রিয়তার কথা। হাতে থাকা আপেল কামড়াতে কামড়াতে বললো, ‘আমার একটাই টুনটুনি তাকে জ্বালাবো না তো কাকে জ্বালাবো? তোর সমস্যা হলে তুই আউট হ।’

এই ঘাড়ত্যাড়া লোককে কিছু বলে যে লাভ নেই তা ভালোই জানা হয়ে গেছে প্রিয়তার। তাই কথা না বাড়িয়ে নিজের মতো রুমে বার বার ঘুরতে লাগলো। প্রিয়ম ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘ভুতের মতো ঘুরছিস কেন?’

প্রিয়তা কিছু না বলে চুপ করে থাকে৷ পড়ার টেবিলের কাছে এসে ধুলো পড়া একটা ডায়েরী দেখতে পেয়ে আগ্রহে সেটা তুলে নিলো। প্রিয়ম নিজেও এগিয়ে আসে। প্রিয়তা চেয়ার টেনে বসে পড়ে। প্রথম পৃষ্ঠা খুলতেই দেখে সেখানে বড় বড় অক্ষরে অনু, প্রিয়ু, তনু লিখা। প্রিয়তা কয়েকবার সে লিখায় হাত বুলায়। চোখ ভরে আসে। প্রিয়ম প্রিয়তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকায়। তার মা আর মামনির পর এই একটা নারীর চোখের পানি বড্ড পীড়া দেয় তাকে। চোখ বন্ধ করে বড় করে শ্বাস নেয়৷ প্রিয়তা ততক্ষণে ডায়েরীটা পড়া শুরু করেছে। প্রথমেই তাদের দুষ্টু মিষ্টি সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা৷ তারপরের একটা পৃষ্ঠাতে সুন্দর করে লিখা শিশিরকে নিয়ে তার অনুভূতি। প্রিয়তা আটকে যায় সেখানেই। অনু আপু সত্যি শিশির ভাইকে ভালোবাসতো! পরের পৃষ্ঠা গুলো পড়ার মতো সাহস সে পায় না। ডায়েরীটা ফেলেই ছুটে আসে নিজের রুমে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব প্রিয়ম। কি এমন হলো যার কারণে প্রিয়তা ছুটে চলে গেলো! ডায়েরী হাতে নিয়ে নিজে ঘাটতে থাকে কয়েক পৃষ্ঠা। বুঝতে পারে প্রিয়তার ছুটে যাওয়ার কারণ। নিজেও ডায়েরী ফেলে দ্রুত প্রিয়তার রুমের দিকে আসে। পুরো রুম ফাঁকা দেখে খানিকটা ভয় পেয়ে যায়। পুরো রুম ভালো করে দেখে প্রিয়ম ছাঁদের দিকে হাঁটা লাগাায়। ছাঁদে এসে দেখে এক কোণে বসে আছে প্রিয়তা। প্রিয়ম ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখে। প্রিয়তা চোখ তুলে তাকায়। প্রিয়মকে দেখেই তার কান্না পায়। ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে তাকায়। প্রিয়মও প্রিয়তার পাশে বসে পড়ে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,

‘এতটুকু বিষয়ে ভেঙে পড়লে চলবে টুনটুনি?’

প্রিয়তা জবাব দেয় না। প্রিয়ম আবার বলে, ‘একজন মানুষকে দুইটা ব্যক্তি ভালোবাসতেই পারে এটা স্বাভাবিক তবে দুবোন যদি একজনকে ভালোবাসে সেটা অনেক কষ্টের। তবুও কিন্তু অনিমা তোকে সাহায্য করেছিলো শিশিরের সাথে সম্পর্কের জন্য। পরে কি হয়ে কি হয়েছে তা আমার থেকে তুই ভালো জানিস। তুই অন্যের জন্য নিজের সত্তাকে বিলীন করে দিচ্ছিস এটা কি বুঝিস? তোর মতো মেয়েকে গম্ভীরতায় মানায় না চঞ্চলতাতেই মানায়। আর যারা মনে করে চঞ্চল স্বভাবের মেয়েরা সংসার করতে পারে না নিজের মধ্যে চঞ্চলতা রেখেই তাদের দেখিয়ে দে চঞ্চল মেয়েদেরও সংসার হয়। আর একটা কথা মনে রাখবি প্রকৃতি ছাড় দেয় ছেড়ে দেয় না।’

প্রিয়তা তাচ্ছিল্যের সুরে হেঁসে বলে, ‘কিন্তু দিনশেষে বেইমানরাই ভালো থাকে।’

প্রিয়মের বুকটা ছলাৎ করে উঠে। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পায় না। প্রিয়তা একরাশ বিষাাদ কন্ঠে নামিয়ে ধীরে বলে, ‘সৌন্দর্যই নাকি সব। কিছু ছেলেরা নাকি সৌন্দর্যের টানেই আটকে থাকে অথচ আমার দেখা সব থেকে সুন্দরী মেয়েটাও একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছটফট করেছে। আমার দেখা এমন অনেক সুন্দরী আপু আছে যারা দিনশেষে ব্যর্থ হয়ে ফিরেছে। হাজার আকুতি মিনুতিও পারেনি প্রিয় মানুষটাকে ফিরাতে। আচ্ছা প্রিয়ম ভাই সবাই বলে আমি দেখতে ততোটাও খারাপ নয় যে কোনো ছেলে নাকি আমার সৌন্দর্যে ফিদা হবে তাহলে কেন শিশির ভাই থাকলো না আমার হয়ে! নাকি আমার সৌন্দর্যও তার কাছে ফিকে পড়ে গেছে ঠিক আমার ভালোবাসার মতো!’

প্রিয়ম যেন মুহুর্তেই নিজের বুকের ব্যাথাটা অনুভব করলো। নিজের ভালোবাসার মানুষের পাশে বসে তার ভালোবাসার মানুষের কথা শুনছে সে। ইসস এই মুহুর্তটা কি কেউ বুঝবে! প্রিয়ম আর বসে না। উঠে চলে যায়। প্রিয়তা শূণ্যদৃষ্টিতে সেদিকে তাকায়।

প্রিয়তারা আজ ফিরে যাবে আবার। প্রিয়তার মনে একটাই প্রার্থনা এ শহরে আর যেনো পা রাখতে না হয়। কিছু স্বার্থপর, বেইমানদের মুখ না দেখায় ভালো। প্রিয়তার মাঝে আজ আর একটুও গম্ভীরতা নেই। উল্টো আগের সেই চটপটে প্রিয়তা যেনো ফিরে এসেছে। সে কেনো কিছু স্বার্থপরের জন্য নিজের সত্তা হারাবে সে যেমন সে তেমনই থাকবে। এভাবেই দেখিয়ে দেবে তার সংসার হয় কি না। সব গোছগাছ শেষ করে প্রিয়তা তনিমার রুমে যায়। তানিমাকে এবার আর তার বাবা মা যেতে দেবে না। পলক সাহেব বলেছেন ৩ মাস পর যখন ভার্সিটির ভর্তি চলবে তখন তনিমাকে নিয়ে যাবে। ওখানকার ভার্সিটিতে ভর্তি করে দেবে৷ তবুও ভীষণ মন খারাপ তনিমার। প্রিয়তা হাই তুলতে তুলতে তনিমার পাশে এসে বসে বললো,

‘কিরে খাটা’শনি তোর মুখ এমন খাটা’শের মতো করে রাখছিস কেন? জামাই ম’রছে নাকি?’

তনিমা হা করে প্রিয়তার দিকে তাকায়। গালে কপালে হাত দিয়ে বলে, ‘কি রে কি হয়ছে ভাই তোর? মানে তুই ঠিক আছিস? জ্বর টর তো নাই তাইলে কি মাথার তার ছিড়ে গেলো!’

প্রিয়তা তনিমার মাথায় গাট্টা মেরে বলে, ‘আমার ভাইকে ছেড়ে থাকতে হবে ভেবে তোর মাথার তার ছিড়ে গেছে।’

তনিমা মাথায় হাত দিয়ে কনফিউজড গলায় বলে, ‘হ্যাঁ হতেও পারে। আরে না না ধুর। তুই তো এভাবে কথা বলিস না। কিছু জিজ্ঞেস করলেই হু হা করিস। আজ হঠাৎ আগের মতো বিহেভ করছিস ব্যাপার কি?’

প্রিয়তা হাসে। তারপর বলে, ‘তুই সেসব ছাড়। মন খারাপ কেন করছিস? ৩ মাসই তো। আর ভাইয়ার থেকে তোর একটু দুরে থাকা উচিত। তোর প্রতি ওর অনুভূতিগুলো ওরও বোঝা দরকার।’

তনিমা মন খারাপ করে বলে, ‘বলছিস ও বুঝবে? কিন্তু তোর ভাই যা ঢেড়স৷ তাতে মন হয় না সে বুঝবে।’

প্রিয়তা ঠাস করে তনিমার পিঠে থা’প্পড় দিয়ে বের হতে হতে বলে, ‘কম বুঝ। বুঝবে বুঝবে ঠিক বুঝবে। তুই চিল মুডে থাক।’

তনিমা পেছন থেকে প্রিয়তাকে বকা দিয়ে উদ্ধার করে ফেলেছে। প্রিয়তা হাসতে হাসতে বাড়ি থেকে বের হয়। শিশিরদের বাড়িতে বেল বাজাতেই শিলা বেগম দরজা খুলে দেয়। প্রিয়তা হাসি মুখে সালাম দেয়। শিলা বেগম অবাক হয়। প্রিয়তা হাত নাড়িয়ে বলে,

‘আন্টি ভেতরে আসতে বলবেন না? এটা কিন্তু আমার আপুর শ্বশুরবাড়ি।’

শিলা বেগম যেনো আকাশ থেকে পড়লো। এ মেয়ে এতো সহজে মেনে নিলো! অনিমা কে এসেছে তা দেখতে রুম থেকে বের হয়ে আসে। প্রিয়তাকে এ বাড়িতে দেখে ভীষণ অবাক হয়৷ প্রিয়তা হাাসি মুখেই বলে,

‘আরে মিসেস শিশির আহমেদ যে! আসুন আসুন। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’

অনিমা অবাক হয়ে এগিয়ে আসে। আজ বুঝি সবার অবাক হওয়ার পালা। প্রিয়তা আরাম করে বসে বলে, ‘আজকে আমি পুরোপুরি আপনাদের শান্তির সংসার দিয়ে এ শহর ছেড়ে বিদায় নিচ্ছি। আপনার স্বামী সংসারের মাঝে আমি আর কাটা নাই। আপনার ওই সাধু জামাইকে বলে দিয়েন তার মতো মা ভক্ত স্বার্থপর ছেলের আমার জিবনে কোনো জায়গা নাই। আর আন্টি আপনি যেনো কি বলছেন? আমার মতো উড়নচণ্ডী মেয়ের সংসার হবে না? উমমম কিছু বলবো না। সময় হোক নিজেই দেখতে পাবেন। আসি ভালো থাকেবন। আল্লাহ হাফেজ।’

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে যায় প্রিয়তা। শিলা বেগম রাগে ফোসফাস করতে থাকে। অনিমা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে হো হো করে হেঁসে উঠে। শিলা বেগম রেগে তাকালেন তার দিকে৷ অনিমা হাই তুলতে তুলতে বলে, ‘বাহ দারুণ উত্তর দিয়ে গেছে বোনটা।’

শিলা বেগম রাগে গজগজ করতে করতে চলে যায়।

___________________

প্রিয়তারা এসেছে সন্ধ্যার দিকে। এসেই প্রিয়তা ক্লান্তিতে শুয়ে পড়েছে। সে সময় হুড়মুড় করে রুমে ঢোকে প্রিয়ম। প্রিয়মকে দেখে প্রিয়তা উঠে দাঁড়ায়। সে মুহুর্তেই প্রিয়ম জাপ্টে ধরে প্রিয়তাকে। হতভম্ব হয়ে যায় প্রিয়তা। প্রিয়ম নিভু নিভু কন্ঠে বলে,

‘আই লাভ ইউ প্রিয়তা।’

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে