আগন্তুক পর্ব-১০

0
782

আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস

পর্ব – ১০

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেক অনেকক্ষণ। বর্ষার আকাশে আজ মেঘ নেই। দুপুর গড়িয়ে আর বৃষ্টি আসেনি। আবার শুরু হয়েছে উত্তাপ। ফ্যানের নিচে বসেও ঘামছিলো অন্তু। বাসায় ফিরতে হবে। কিন্তু তনিমার দেখা নেই৷ সেই যে বাসায় ফিরে বেডরুমে ঢুকেছে, পাক্কা পয়তাল্লিশ মিনিট পরও সে নিখোঁজ। উডবি মাদার ইন ল এসে চা দিয়ে গেছে। হালকা পাতলা গল্পসল্প করে উঠে গেছেন। তারপর আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়? নাহ! আর সম্ভব না! এবার যাওয়া দরকার ভেবে বসা থেকে উঠে দাড়াতেই, তনিমা দরজা খুলে বেরিয়ে এলো।

– কি হলো? দাঁড়িয়ে আছো যে?

অন্তু মুখ ফেরালো।

– আমাকে এখানে বসিয়ে রেখে কখন গিয়েছ খেয়াল আছে?

– সরি! গোসল সারতে দেরী হয়ে গেল! এত টায়ার্ড লাগছে! তুমিও যাও না, ফ্রেশ হয়ে আসো। রাতে খেয়ে ফিরবে।

অন্তু চোখ বড় বড় তাকালো।

– পাগল নাকি? টায়ার্ডনেস শুধু তোমার আছে, আমার নেই? কি বলবে বলে ফেলো তো। এই বসলাম আমি।

অন্তু ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। তনিমাও এসে প্রায় তার গা ঘেঁষে বসলো। তারপর গভীর ভাবে তাকিয়ে বললো,

– তুমি না অন্তু, কেমন যেন!

তনিমার চুল থেকে ভুরভুর করে শ্যাম্পুর গন্ধ আসছে। খুব অচেনা একটা ঘ্রাণ । সহজাত কারো থেকে পাওয়া যায়না এই গন্ধটা। শুধু তনিমা ছাড়া! কেমন যেন নেশা নেশা লাগে এই ঘ্রাণটা পেলে৷ অন্তু একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। তারপর ভ্রু কুচকে বললো,

– কেমন?

– কেমন! কেমন! রোমান্টিক না! রোবটিক! এই পুলিশের চাকরিটা তোমাকে দারুণ স্যুট করে! বয়ফ্রেন্ড হবে, আরেকটু অন্যরকম!

– ঠিক তোমার চয়ন ভাইয়ের মতো তাইনা?

অন্তুর চোখেমুখে দুষ্টুমি। তনিমা চট করে তা ধরে ফেললেও সেকেন্ডের জন্য বিব্রত হয়ে গিয়েছিলো। অন্তুর সাথে পরিচয়ের প্রথমদিকে, নানান কথায় তনিমা তাকে চয়নের কথা বলতো। চয়ন দারুণ হ্যান্ডসাম। যেমন লাভিং বয়ফ্রেন্ড ছিলো লাবণ্যর, এখন ঠিক তেমনই কেয়ারিং হাসবেন্ড, কতবার যে বলেছে কথা গুলো। সেই থেকে অন্তু মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে তনিমাকে খোঁচাতে ভোলে না। যদিও তনিমা কখনো বলতে পারবে না, সে সত্যিই চয়নকে একসময় মন প্রাণ দিয়ে চাইতো।

– তুমিও না! সবসময়…কপট রাগ দেখালো সে। তারপরই সুর পাল্টেছে,
– শোনো তোমার কি মনে হচ্ছে, বলো তো?

– কি ব্যাপারে?

– এই যে প্রত্যয় ঠিক কতটুকু জড়িত এই মৃত্যু গুলোর সাথে?

অন্তু হাই তুললো৷ তারপর মুখে হাত চাপা দিয়ে বললো,

– তনি, আমার মনে হয় শুধু একটা ইনফরমেশনের উপর ভিত্তি করে প্রত্যয়কে সন্দেহ করা উচিৎ হবে না। তোমার যুক্তির খাতিরে ধরেই নিলাম, প্রত্যয় কোনভাবে এদের খুন করেছে। কিন্তু কেন খুন করবে? মোটিভ কি?

তনিমা সোফায় হেলান দিয়ে বসলো৷ এই একই প্রশ্ন তো তার মাথাতেও ঘুরছে। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে এই মৃত্যু গুলোর পেছনে কারো হাত নেই, এইগুলো আসলেই আত্মহত্যা!

– আমি আজ উঠি। কোন কিছু জানানো লাগলে ফোন তো আছেই।

অন্তু উঠে দাড়াতেই চট করে তার হাত ধরে থামিয়েছে তনিমা৷

– শোনো, এই কেসটা তো আত্মহত্যা বলেই বন্ধ হয়ে গেছে। আবার রিওপেন করা যায় না?

– রিওপেন করতে হলে একটা হলেও ক্লু লাগবে। যেটা দেখিয়ে আমি রিওপেনের এপ্লাই করতে পারব। কিন্তু তেমন ক্লু পেলাম কোথায়?

– হুম!

অন্তুর হাত ছেড়ে দিলো তনিমা। এলিয়ে পড়লো সোফায় আবার। তার চোখে মুখে হতাশা! আজকের দিনটি খামোখা নষ্ট হলো৷ কাজের কাজ কিছুই করতে পারলো না। অন্তু তার মনের কথা আঁচ করতে পারছিলো। সে আলতো ভাবে হাত রাখলো তনিমার কাঁধে। তারপর বললো,

– আমি আছি তো৷ আপসেট হওয়ার কিছু নেই। নিশ্চয় একটা ব্যবস্থা হবে।

——————————————————

প্রায় পাঁচ মাস লকডাউন থাকার পর খুলে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ। করোনার প্রকোপ প্রায় কমে এসেছে। বিশ্ব জুড়ে কমেছে মৃত্যুর হার। আক্রান্তের সংখ্যাও৷ মানুষ অনেকদিন পর যেন প্রাণ খুলে শ্বাস নেওয়ার সূযোগ পেয়েছে। বিকেলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলো তনিমা। আজ রাজশাহী শহরেও জ্যাম বেঁধে গেছে। অনেকদিন পর খাঁচার পাখি যেন মুক্তি পেয়েছে। রাস্তায় শুধু মানুষ আর মানুষ। কারনে – অকারণে ঘুরছে এদিক ওদিক। অবশ্য এখনো সকলের মুখে মাস্ক, হাতে গ্লোবস। অর্থাৎ জানের ভয় ঠিকই আছে। কিন্তু তবুও ঘরের বাইরে বের হওয়া চায়। আজব পাবলিক সব! খানিকটা ভীড় ঠেলে অবশেষে গন্তব্যে পৌছালো তনিমা । অনেকদিন পর লাবণ্যকে দেখতে এসেছে সে। মাঝে কিছুদিন রাস্তায় এত কড়াকড়ি শুরু হয়েছিলো যে বের হবার উপায় ছিলো না। অবশ্য নিয়মিত সে চয়নকে ফোন করে খোঁজ খবর নিতো। আজ লাবণ্যকে দেখে বুকের ভেতরে ধক করে উঠলো। এ কোন চেহারা হয়েছে তার? চোখের নিচে কালি পড়েছে। ভেঙে গেছে শরীর। বিছানা ছেড়ে ওঠার অবস্থা প্রায় নেই। তনিমাকে দেখে লাবণ্যর মা তাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো!

– দেখছো তনিমা, আমার মেয়েটার অবস্থা দেখছো? চিনতে পারছো, ও তোমার সেই বান্ধবী? কি হয়ে গেল এটা বলো তো? গত চার মাস এইভাবে পড়ে আছে, আমি আর সহ্য করতে পারছি না!

তনিমার কথা আটকে গেছে। কি বলে সান্ত্বনা দেবে সে? তার নিজেরই তো ভাষা হারিয়ে গেছে৷ এত বেশি অসুস্থ কিভাবে হওয়া সম্ভব? শেষ যেবার দেখেছিলো, তখনও তো এমন ছিলো না? অনেক কষ্টে মুখ খুললো,

– আন্টি চয়ন ভাই কোথায় থাকছে?

– চয়ন আসা যাওয়ার মধ্যে আছে। কখনো এখানে, কখনো ওর ফ্ল্যাটে। এখানেই বেশি থাকে। মাঝে মাঝে ও বাড়িতে যায়। একটু আগে অফিস থেকে ফিরলো। কথা বলবে? ওর উপর দিয়েও তো কম ঝড় যাচ্ছে না!

– হুম, আমি বুঝতে পারছি আন্টি। তবে ভাইয়ের সাথে একটু কথা ছিলো৷

– এসো, ওদিকের ঘরে থাকে চয়ন।

লাবণ্যর মায়ের পিছু পিছু এগিয়ে গেল তনিমা। দরজায় টোকা দিতেই চয়ন খুলে দিলো এসে৷

– আরেহ, তনিমা যে? কি খবর? কখন এলে?

তনিমা হাসলো৷

– এই তো চয়ন ভাই৷ আপনি ব্যস্ত? একটু কথা বলতাম।

– না! না! ফ্রি আছি৷ তুমি বসো, আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি৷

তনিমা মাথা নাড়লো৷ তারপর এসে বসলো ড্রইং রুমে। আসার পথে একবার উঁকি দিলো লাবণ্যর ঘরে। সে তখনও ঘুমাচ্ছে।

চয়ন ড্রয়িংরুমে এলো মিনিট পনেরো পর৷ এর মধ্যেই সে গোসল সেরেছে। বেশ চনমনে দেখাচ্ছে তাকে। তবে চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে বেশ অনেকদিন ঠিকমতো ঘুম হয়নি। কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ। তনিমা প্রথমে কথা বললো,

– কি যাচ্ছে আপনার উপর দিয়ে, বুঝতে পারছি চয়ন ভাই! কিন্তু লাবণ্যর কোন উন্নতি নেই কেন? ওষুধে কাজ হচ্ছে না? এক ডাক্তারকে না দেখিয়ে, আমার মনে হয় এবার একটু অন্য ডাক্তার দেখানো উচিৎ৷

– ডাক্তার তো চেঞ্জ করেছি। মেডিসিন প্রফেসর দেখছিলেন প্রথমে। তারপর উনিই একজন সাইকোলজিস্টলে রেফার করলেন। তাকেও দেখালাম৷ কিন্তু কিছুই উন্নতি নেই।

– তনিমা, অতিপ্রাকৃত কিছু বিশ্বাস করো?

তনিমা চমকে তাকালো। লাবন্যর মা ট্রে হাতে নিয়ে ঢুকেছেন। তারপর কফির মগটা তনিমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন,

– কোন ওষুধেই কাজ হবে না৷ আমি জানি, এখানে অন্যকোন ব্যাপার আছে। আমার মেয়েটার উপর কালোছায়া পড়েছে।

– আন্টি, কি বলছেন এইসব? সেসব কিচ্ছু না। লাবণ্য ঠিক হয়ে যাবে। চয়ন ভাই, আন্টিকে বোঝান একটু।

চয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বললো,

– তনিমা, আমার মনে হয় মা ঠিকই বলেছেন। লাবণ্যর এটা কোন রোগ নয়। আমিও বিশ্বাস করতাম না।এইসব। কিন্তু লাবণ্য যা সব করছে! আমাদের এবার অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে।

– আপনি যদি এইসব বলেন, কিভাবে হবে চয়ন ভাই?

– তনিমা, আমরা শুধু লাবণ্যর ভালো চাই। সেটা যেভাবেই হোক!

—————————————————–

তনিমা যখন বাসায় ফিরলো, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। বাসায় ঢুকতেই দেখলো সোফায় বসে পেপার পড়ছে অন্তু।

– কখন এসেছো? ফোন দাওনি যে।

– এই তো কিছুক্ষণ। তুমি নাকি লাবণ্যদের বাসায় গিয়েছিলে, আন্টি বললো। কি খবর ওদের?

– ওই আছে একরকম! তুমি বলো, নতুন কোন খবর আছে?

অন্তু হাই তুললো।

– আছে বইকি!

লাবণ্য সাথে সাথে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এসে বসেছে অন্তুর কাছে।

– কি খবর বলো তো?

– মনে আছে, শ্বেত মহলে গিয়ে একটা ঘড়ি পেয়েছিলাম, ওই যে ওখানে, তুমি যেখানে হোচট খেয়েছিলে।

– মনে আছে। কি হয়েছে ঘড়িটার?

– ঘড়িটা প্রত্যয়ের, জানা গেছে৷ আর দ্বিতীয় খবর হচ্ছে, সে বিয়ে করতে চলেছে। মানে প্রত্যয়।

তনিমা অবাক হয়ে তাকালো।

– বলো কি? বউ মারা যাওয়ার মাস তিনেক পার হতে না হতেই বিয়ে?

অন্তু শিষ দিয়ে উঠলো,

– তাহলে আর বলছি কি ডার্লিং! খোঁজ পেয়েছি মেয়েটার সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিলো প্রত্যয়ের৷

– বাহ! এবার তাহলে খুনের মোটিভ পরিস্কার। এক্সট্রা ম্যারিটাল এফেয়ার! আমরা তো এটা দেখিয়েই কেসটা রিওপেন করতে পারি তাইনা?

অন্তু মাথা নাড়লো৷

– তা তো পারিই। কিন্তু, সবকিছু কি এতই সহজ, মানে আমরা যা ভাবছি? নাকি অন্য কোন রহস্য আছে, যা আমরা ধরতে পারছি না?

( চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে