আঁড়ালে কে নাড়ে কলকাঁঠি পর্ব-০১

0
386

#আঁড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঁঠি
#১ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক

একদিন বিকেলে তরকারি কুটার সময় মা হঠাৎ করেই ভাবীকে বললেন,’ তোমার চোখের উপর এই দাগটা কিসের বউমা? কিভাবে এই দাগ হয়েছে?’
ভাবী আমতা আমতা করে বললো,’ কই দাগ মা?’
এরপর হাত দিয়ে কপালের নিচ দিকে চোখের উপর দাগটায় হাত রেখে বললো,’ অহ্ এটা কিছু না।’
মা তখন কথা বাড়ালেন না। শুধু এটুকু বললেন,’ সবকথা লুকিয়ে রাখতে নেই বউমা।এতে সমস্যা বাড়ে।কমে না!’
ভাবী হাসার চেষ্টা করে বললো,’ আমি পড়ে গিয়েছিলাম মা। এছাড়া কিছুই না।’
মা অবাক হলেন। বললেন,’ কোথায় পড়ে গিয়েছিলে? কিভাবে?’
ভাবি তাড়াহুড়ো করে বললেন,’ বাথরুমে।’
মা আর কিছুই বললেন না।চুপ হয়ে গেলেন।ভাবীও চুপচাপ কাজ করলো।

এর আরো সপ্তাহ দুয়েক পরের ঘটনা।
রাত তখন দুটা বাজে। বাসায় চিকন রিনরিনে গলার একটা কান্না শুনে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানায় বসে ভালো ভাবে খেয়াল করলেই বুঝতে পারলাম কান্না আসছে ভাবীর ঘর থেকে।ভাবী কাঁদছে। কিন্তু সেই কান্নার গলা যেন বড় না হয়, বাইরের কেউ যেন না শুনে এই চেষ্টাও করছে ভাবী।এরিমধ্যে ভাইয়ার গলাও শোনা গেল। কিন্তু কি বলছে তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না।
আমি বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে ভাইয়ার ঘরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। লম্বা সময় দাঁড়িয়ে রইলাম গিয়ে। তখন আর ভাবীর কান্নার গলা কিংবা ভাইয়ার গলা কিছুই আর শোনা গেল না।বড় অবাক হলাম আমি! আচ্ছা তারা কি বুঝে ফেলেছে এখানে এসে আমি দাঁড়িয়েছি যে?
আমি কিছুই বুঝতে পারি না। কিন্তু খুব মন খারাপ হয় আমার। আমাদের হাসিখুশি আর ভীষণ রকম চঞ্চল অপি ভাবী কদিন ধরেই কেমন যেন নিভে গিয়েছে দপ করে। সব সময় চুপচাপ থাকে।কাজ না থাকলে সারাক্ষণ নিজের ঘরেই বসে থাকে। দরজা ভেজিয়ে রাখে।অথচ বিয়ের এই তিন বছরের কোনদিন তাকে এভাবে দরজা ভেজিয়ে নিজের মতো চুপচাপ, মনমরা হয়ে থাকতে দেখা যায়নি। তার সঙ্গে কথা বলতে গেলেও আনন্দ পাওয়া যায় না।’হ্যা বা না’ এই দু’ কথার মধ্যেই ইদানিং সে কথা শেষ করে দেয়।
এছাড়া ওইদিন ভাবীর চোখের উপরে যে একটা দাগ, এই দাগ আমি দেখেছি। এই দাগটা শক্ত কিছুতে আঘাত পাওয়ার। বাথরুমে পড়ে গিয়ে চোখের উপর এভাবে দাগ হবে না নিশ্চয়! আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এটা দরজার চৌকাঠে অথবা টেবিলের কোনায় পড়ে গিয়ে এমন হয়েছে।

এই বিষয়ে পরদিন মার সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম আমি। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো মা আমার সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলতে আগ্রহ দেখালেন না।আমি বিরক্ত হয়ে মাকে বললাম,’ মা, আমি কান্না শুনে আর ভাইয়ার গলা শুনে ওদের ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু —‘
আমি কথা শেষ করতে পারলাম না।এর আগেই মা আমার দিকে চোখ গরম করে তাকালেন। তারপর বললেন,’ অন্যের গোপন বিষয় শুনতে তার ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নোংরামি এবং অসভ্যতা।আমি তোমার কাছ থেকে এমন কিছু আশা করিনি তপু!’
আমি আরো কিছু বলতে চাইলে মা বললেন,’ এখন আমার সামনে থেকে যাও বলছি।আমায় বিরক্ত করবা না দয়া করে।’
রাগ আর অভিমান নিয়ে মায়ের কাছ থেকে চলে এলাম। এরপর ভাবলাম ভাইয়াকে একটু খেয়াল করবো। কোথায় যায় আর কি করে দেখবো।
কিন্তু খানিক পরেই নিজেই নিজের বোকামির কথা মনে করে হাসলাম। ভাইয়াকে কোথায় গিয়ে আমি ফলো করবো? ভাইয়ার সকাল আটটা – বিকেল ছটা পর্যন্ত অফিস। মাঝেমধ্যে মিটিং থাকে। বাসায় ফিরতে আরো দেরী হয়। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ সে।
কিন্তু ভাইয়া -ভাবীর সুখের সংসারে হঠাৎ করে এমন কি হলো যার কারণে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল? আমি কিছুই আর খুঁজে বের করতে পারি না!

এসব সাত- পাঁচ চিন্তায় যখন মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো আমার ঠিক তখনই একটা ফোন এসে আমার মাথা আরো ভীষণ এলোমেলো করে দিলো।আমি দু’ চোখে তখন কেবল অন্ধকার দেখছিলাম।ফোনটা করলো হসপিটাল থেকে। আমার বান্ধবী ফৌজিয়া ফোন করেছে। ফৌজিয়া সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষ করেছে। এখন ময়মনসিংহের গ্রীণ লাইফে চেম্বার করেছে। এখানেই রোগী দেখতে বসে। সে ফোন করে বললো,’ পেশেন্টের প্রাইভেসি গোপন রাখা একজন ডাক্তারের ধর্ম, কিন্তু আমি একটা অপরাধ করে ফেলবো এখন।এটা না করেও পারছি না তপু। কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে এটা কোনদিন প্রকাশ করবে না তুমি। কথা দিতে পারবে? ‘
আমি বললাম,’ আচ্ছা প্রকাশ করবো না। এখন বলো।’
ফৌজিয়া বললো,’ ফোনে কিছু বলবো না। তুমি শুধু আপাতত এইটুকুই জেনে রাখো, বিষয়টা তোমার ভাবীকে নিয়ে। এখন আর কিছুই বলবো না এই বিষয়ে। তুমি সন্ধ্যার পর আমার চেম্বারে আসো। আমি আটটার দিকে তোমার সঙ্গে বেরুবো।কফি খাবো।’
আমি বললাম,’ আচ্ছা।’
ফোন রেখে দিলে আমি খানিকটা অবাক হলাম। ভাবীর সঙ্গে তো ফৌজিয়ার কোনদিন দেখাও হয়নি তাহলে ফৌজিয়া চিনলো কি করে ভাবীকে!
এরপর মনে হলো ফৌজিয়া অনেক অনেক বার ভাবীকে দেখেছে। ছবিতে।তাই ভাবীকে সে চিনতে পেরেছে। কিন্তু ভাবীর সম্পর্কে সে কি জানে? ভাবীর কি বড় ধরনের কোন অসুখ হয়েছে নাকি? কিছুই ভাবতে পারছি না আমি আর!

সন্ধ্যা হবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বেরিয়ে গেলাম। আমার আর কিছুই ভালো লাগছে না। তাড়াহুড়ো করে সব শুনে ফেলতে আমার ইচ্ছে করছে ।

ফৌজিয়া আটটায় বের হতে পারলো না চেম্বার থেকে। শুক্রবার থাকায় রোগীর ঝামেলা বেশি। তাকে বের হতে হলো নটা বিশ মিনিটে। অবশ্য সে ফোন করে আমায় বলেছে, ‘ তপু, আরেকটু অপেক্ষা করো প্লিজ! রোগী বেশি। এদের রেখে চলে যাওয়াটা অমানবিক হবে। অনেক দূর দূরান্ত থেকে এইসব রোগীরা আসে!’
ফৌজিয়ার প্রতি কেমন জানি রাগ হচ্ছে আমার। ওর সঙ্গে স্কুল- কলেজে পড়াশোনা করেছি আমি। পরীক্ষায় আমি ফার্স্ট হতাম সব সময়। ফৌজিয়া সেকেন্ড হতো। আমাকে টপকে যেতে সে সবরকম চেষ্টায় করেছে। কিন্তু স্কুল কলেজের কোথাও আর আমায় উতড়াতে পারেনি। কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় হুট করেই আমার জীবন এলোমেলো হয়ে পড়ে। আমার কাছের এক বন্ধু খু*ন হয় এক রাতে। সেই খু*নের মামলায় আমায় ফাঁসানো হয়।এর জন্য দীর্ঘদিন আমি পলাতক ছিলাম। অবশ্য যখন সবকিছু ঠিক হলো। মূল আসামী ধরা পড়লো।আসামীদের সাজা হলো। আমার উপর থেকে মামলা সরানো হলো। ততোদিনে আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়টা পেরিয়ে গেছে। মেডিক্যালে পড়ার যে তীব্র ইচ্ছে কিংবা স্বপ্নটা আমার ছিল তা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে ততোদিনে। কিন্তু ফৌজিয়া।কি সুন্দর ভাগ্য তার! আচ্ছা আমিও তো ওর মতোই এমন ডাক্তার হতে পারতাম হয়তো। আমার এখানেও রোগীদের উপচে পড়া ভীড় থাকতো এভাবে।আর আমার বন্ধুরা এলে আমিও তাদের বলতে পারতাম, আরেকটু অপেক্ষা করো বন্ধু, আজকে রোগীর ভীষণ চাপ!
ঘড়িটা দেখলাম আমি।নয়টা বেজে গেছে।গাল দুটো কেমন ভিজে গেছে জলে।আমি কি তাহলে কাঁদছি? কাঁদছিই তো। আচ্ছা জীবন এমন কেন? আমি তো কারোর কোন ক্ষতি করিনি।জেনেও না।না জেনেও না। তবুও আমার ভাগ্য এমন কেন হলো? সবচেয়ে সুন্দর ইচ্ছে টা কেন আমার পূরণ হলো না!

ফৌজিয়া এলো নয়টা বিশ মিনিট বাজতেই। কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শে আমি চমকে উঠলাম। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি ফৌজিয়া।
ভাগ্যিস খানিক আগেই রুমাল দিয়ে দু চোখ মুছেছি। নয়তো সর্বনাশ হতো। ফৌজিয়া যদি দেখতো আমার চোখ ভর্তি জল।গাল দুটো ভেজা। চুপসানো। তখন কি হতো! কান্নার কারণ জানতে চাইলে কি বলতাম তাকে আমি?
ফৌজিয়া লজ্জিত হবার ভঙ্গিতে বললো,’ সরি তপু! লেট হয়ে গেছে। এখন চলো যাই।’
আমরা হসপিটালের বাইরে গিয়ে রিক্সায় উঠে বসলাম।
ফৌজিয়া বললো,’ ইদানিং লিখা লিখি কম করছো নাকি? ফেসবুকে পোস্ট করতে দেখি না যে!’
আমি বললাম,’ লিখতে আর ইচ্ছে করে না। ‘
ফৌজিয়া বললো,’ লিখতে হবে।এটা ছাড়া যাবে না। তুমি পয়সার জন্য লিখো না আমি জানি। তুমি যে টপিক নিয়ে লিখো এটা নিয়ে কজন পুরুষ লেখক লিখে? নারীদের তো আজকাল সবাই পুতুল ভাবতে পারলেই বাঁচে। তাদের নামে সব দোষ চাপিয়ে দিতে পারলেই যেন তারা স্বর্গে যেতে পারে।এতো সবের মধ্যে তুমি যে তাদের কথা লিখছো। তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলছো।এটা তো ছোট কিছু না তপু! ‘
আমি এই বিষয়ে আর কথা বাড়ালাম না।আমি টপিক চেঞ্জ করে বললাম,’ ভাবীর কি হয়েছে তা বলো।কি জানো তার সম্পর্কে তুমি?’
রিক্সা থেকে তখন নেমেছি আমরা কেবল। রিক্সার ভাড়া চুকিয়ে আমরা যেই না কফিশপের দিকে পা ফেলবো ঠিক তখনই ফৌজিয়া কথাটা বললো। সে বললো,’ ভাবী গত সপ্তাহে আমার কাছে এসে অ্যাবরোশন করিয়ে গিয়েছেন। তার তিন মাসের প্রেগন্যান্সি ছিল।’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে