অবহেলার শেষে পর্ব-০৩

0
1817

গল্পঃ অবহেলার শেষে
পর্বঃ ৩
লেখকঃ সালাহ উদ্দিন
.
আমি তো ওনার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যাই। আমার শাশুড়িও কি তবে আমার ব্যপারে সব জানে!
আমার শাশুড়ি না থেমে আবারও বলতে থাকে, “শুন মা, পৃথিবীতে যে যা চায় তা কি কখনো পায়! অনেক সময়ই পায় না। আমার ছেলেটা সব সময় খালি আদর ভালোবাসা খুঁজতো, কিন্তু তা পায়নাই। বড় হয়েও আমার পায়ে মাথা রাইখা ঘুমাতো। জানিস ও জমানো টাকা দিয়ে এটা ওটা কিনে লুকিয়ে রেখে দিতো, কিন্তু আমি ঠিক ই দেখে ফেলতাম। আর ওই জিনিস গুলা আর কারোর না। হবু বউয়ের জন্যই হয়তো রাখতো। ওর তো আর কোন বোন নেই। তা আমি ঠিকই বুঝতাম৷ তুই ওর ঘরের আলমারির পশ্চিম পাশের ডয়ারটা খুলে দেখিস, অনেক কিছু কিনে জমাইছে তোর জন্য৷ দেখ আমি ঠিকই বুঝতেছি হয়তো আজ রাতটাই আমার শেষ রাত। তারপর এই বাড়িতে তুই আর সে থাকবি। কতো ভাবতাম ২-১ টা নাতী-নাতনী থাকবে বাড়িতে, ঘর গুলো আবার ভরে যাবে। কিন্তু দেখ, তা দেখার কপাল আমার নেই৷ আর এই জীবনে কষ্ট করছি মনে হলেও আবার বুঝি যে ছেলেটা আমারে কোনো কষ্টে রাখে নাই। কিন্তু আমি পারলাম নারে, আমি পারলামনা ছেলেটারে একটু সুখে রাইখা যাইতে৷ পোলাটা আমার রাইতে ছাঁদে উইঠা একলা একলা কাঁন্দে। আমি দেখেও লুকায়া যাই, যেনো আমারে না দেখে। ও যদি জানতে পারে যে আমি তোদের এই ব্যপারটা জানি, তাইলে ও খুব কস্ট পাইব। তোরে আর কোন কিছু কমুনা, আমারে মাফ কইরা দিস, আমি না বুইঝাই তোরে এই বাড়ির বউ বানায়া আনছি। এখন যা গিয়ে ঘুমা, আমি শেষ বারের মতোন আজকা একটু ঘুমাই। তুই পারলে আমারে একটু ওযুর পানি আইনা দিস, নামাজ পইরা ঘুমাই যদি সকালে সুযোগ না পাই।”
আমি এতোটাই পাষাণ হইয়া গেছিলাম যে, ঐদিন শাশুড়ির পা ধরে মাফ ও চাই নাই। ওযুর মগ’টা হাতে দিয়ে ঘর থেকে বের হতেই দেখি আমার স্বামী শাশুড়ির ঘরের বারান্দা থেকে উল্টো দিকে হাটতেছে। তার মানে উনি এতক্ষণ সব শুনছে। শাশুড়িকে ওজুর পানি এনে দিয়ে আমি আমার ঘরে চলে আসি। উনিও একটু পরে এসে ঘুমিয়ে পরেন।
পরদিন সকালে উঠেই শাশুড়ির ঘরে যাই। দেখি উনি অনেকক্ষণ আগেই উঠেছেন ঘুম থেকে। নামাজ শেষ করে তজবিহ হাতে বসে আছেন।আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আম্মা কিছু খাবেন এখন? চা বানিয়ে দিবো?’

উনি আমাকে না করে দেন। আমিও নামাজ শেষ করে রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পরি। আমার স্বামী ওই দিন অফিসে যায় নি৷ ঘরেই থাকেন একটু পর পর শাশুড়ির খেয়াল করছেন। খোজ নিচ্ছেন। দুপুরে খাওয়ার পরে একটু শুয়ে থাকি।কখন ঘুমিয়ে যাই বুঝতেই পারিনা। ফোনের আওয়াজে ঘুম থেকে উঠে পরি। দেখি আমার বয়ফ্রেন্ড ফোন দিয়েছে। আমি কেনো জানি তখন কথা বলতে সংকোচ বোধ করি। তবুও কথা বলি অনেকক্ষণ। সে আবার’ও আমাকে ডিভোর্স এর ব্যপারটার কথা বলে।

আমি ঘোর এর মধ্যেই বলে ফেলি আমার শাশুড়ি হয়তো আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না। শাশুড়ির মৃত্যুর পরেই ডিভোর্স হয়ে যাবে। তারপর যথারীতি অন্য কথা বলতে থাকি। হটাৎ ই আমি আমার স্বামীর চিৎকার শুনতে পাই। আমি ফোন ফেলে রেখে দৌড়ে বাইরে যাই। দেখি উনি শাশুড়ির ঘরে। আমি ঘরে ঢুকতেই যা দেখি তাতে আমার শিরা-উপশিরা হিম হয়ে যায়। আমার শরীরের লোম গুলো দাঁড়িয়ে যায়।
আমার স্বামী শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতেছেন। আমার শাশুড়ি তখন আর এই পৃথিবীতে নেই।চলে গেলেন ওপারে,,যেখান থেকে কেউ আর শত চেষ্টা করলেও ফিরেনা,, আমি ঘর থেকে বের হয়ে আসি। আমার কানে একটা কথাই বারবার বাজতে থাকে, ‘তুই তো আমার মেয়ের মতোই।’ আর কোনোদিন কেউ হয়তো আমাকে এতো আপন করে নিবে না। ভাবতেই চোখ বেয়ে পানি ঝরতে থাকে।আমারও খুব কান্না আসে,, রুমে এসে বাড়িতে ফোন দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমার ভাবীকে শাশুড়ির মৃত্যুর কথা বলি। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরেই আমার বাবার বাড়ির অনেকে চলে আসে। আব্বু আমার স্বামীকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন। আর উনি কেবল অসহায়ের মতো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন শাশুড়ীর লাশের দিকে।
আছরের নামাযের পরে জানাযা হয়। শাশুড়িকে দাফন করে এসে উনি সোজা শাশুড়ির রুমে চলে যায়। আবার কান্নাকাটি শুরু করে দেন। আমি কি করব কিছুই মাথায় আসছিলো না। শেষে আমার ভাবী আমাকে তাগাদা দেয় যেনো আমি গিয়ে স্বামীকে সান্ত্বনা দেই। আমি তাদেরকে দেখানোর জন্য একটু এগিয়ে গিয়ে ওনাকে কাদঁতে বারণ করি।

রাতের মধ্যেই আমার বাড়ির সবাই চলে যায়৷ রাত ১০ টার দিকে আমার স্বামী ছাঁদে একা বসে আছেন আর আমি ঘরে। তখনই আমার বয়ফ্রেন্ড এর ফোন আসে।ওকে শাশুড়ির মৃত্যুর কথা বলতেই সে খুশি হয়। কিন্তু ব্যপার টা আমার খুব খারাপ লাগে। একটা মানুষের মৃত্যুতে কি খুশি হওয়া যায়??

আমি তাকে বকা দিলেই সে উল্টো আমাকে নানান কথা বলতে থাকে। নানান কথা বলে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। আমি আর বেশী কথা না বাড়িয়ে ওকে আশ্বাস দেই যে খুব তাড়াতাড়িই আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। সে যেনো তার বাড়িতে বিয়ের জন্য আলাপ করে।

শাশুড়ির মৃত্যুর প্রায় দশদিন হয়ে যায় আমরা তেমন কোনো কথা বলি না। একসাথে খেতেও বসি না। ১১ দিনের দিন আমার হটাৎ শাশুড়ির কথা গুলো মনে পরে। উনি তো আমায় বলেছিলো আলমারিতে অনেক গুলো জিনিস আছে আমার জন্য। আমি ওনার প্যান্ট এর পকেট থেকে চাবি নিয়ে ঐ ড্রয়ারটা খুলি।
দেখি পশ্চিম পাশের ড্রয়ার পুরোটা ঠাসাঠাসি ভর্তি। অনেক গুলো সুন্দর সুন্দর শাড়ি। আর কিছু থ্রী পিছ এর কাপড় খুব সুন্দর ডিজাইন করা। অনেক গুলো গহনা আর সুন্দর এক জোড়া পায়েল এবং ১টা সোনালী রঙের ঘড়ি।
আমি ড্রয়ারটা বিছানায় নামিয়ে সব গুলো জিনিস নাড়িয়ে দেখতে থাকি। পায়েল জোড়া খুব পছন্দ হওয়াতে তখনই আমার পায়ে পরে নিই। তারপর আবার সব গুলো জিনিস গুছিয়ে রাখতে যাই। তখন পায়েলের ঝুনঝুন শব্দ পেয়ে উনি ঘরে চলে আসেন।
এসেই আমাকে বকাঝকা শুরু করে দেন।

— “আপনি কোন সাহসে আমার ড্রয়ারে হাত দিয়েছেন? আপনাকে কে অনুমতি দিয়েছে।আপনি এক বার’ও আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন”? বলেই সামনে এসে আমাকে একটা থাপ্পড় মেরে বসে। আজ পর্যন্ত কখনো আমার সাথে ও এমন করেনি। অথচ ঐদিন আমাকে থাপ্পড় দেওয়ার মানেটা আমি আজও বুঝিনি। কিন্তু থাপ্পড় খেয়ে আমার মাথায় রাগ উঠে যায়। আমি উল্টো উনাকে ঝাড়তে শুরু করি,

— “আপনি কোন সাহসে আমার গায়ে হাত তুললেন।আপনি কি ভাবছেন আমি কিছুই বলব না,,আমাকে আর আট-দশটা মেয়ের মতো ভাববেন না”।

উনি ও বলতে শুরু করেন,
— ” তোকে কি ভাবব! আর তুই আট-দশটা মেয়ের মতো হবি কেনো, তুই যে কেমন মেয়ে তা আমি অনেক ভালো করেই বুঝতে পারছি”।
আমিও রাগের মাথায় বলতে শুরু করি
— “হ হইছে আর বলতে হবে না,আমাকে ডিভোর্স দিয়ে মুক্ত করেন এবার, আমি আর আপনার সাথে থাকতে পারব না”।

ওনার মুখ টা শুকিয়ে যায়। তারপর একটু নিচু গলায় উওর দেয়, “তোর ভালো না লাগলে তুই চলে যা। আমি কেনো আগ বাড়িয়ে ডিভোর্স দিতে যাবো,।যা এখনি চলে যা, দেখ তোর কোন দরদী তোকে নেয়”।

আমি ও আর দেরি করিনি তখনই নিজের বাড়ি চলে যাই। ঐদিনের সেই ভূলের মাশুল কি হবে তা আমি আন্দাজ ও করতে পারিনি। কিন্তু আস্তে আস্তে আমার সব বুঝে আসতে থাকে । কিছুদিন পর আমার বাড়িতে ডিভোর্স লেটার চলে আসে। আর সেই লেটারটা সবার আগে আমার বাবার হাতে পরে৷ বাবার হাতে চিঠি টা আসতেই যা বলেন তা ছিল আমার কল্পনার বাইরে।।
…..
….
চলবে…….

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন,,)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে