অবহেলার শেষে পর্ব-০২

0
1910

গল্পঃ অবহেলার শেষে
পর্বঃ ২
লেখকঃ সালাহ উদ্দিন
.
ডাক্তার ওনার কাঁধে হাত রেখে বলেন “সরি স্যার আপনার মায়ের লিভার ক্যানসার হয়ে গেছে, হয়তোবা আর বেশী হলে ৪০ দিন বাঁচবে। পরীক্ষা করলে পুরো শিউর হওয়া যাবে।’
কথাটা শুনতেই আমার শরীরের লোম গুলো দাড়িয়ে যায়। আর উনি যেনো কাঁদতে ভুলে গেলেন। রোবটের মতো মেপে মেপে কয় কদম এগিয়ে এসে আবার চেয়ারটাতে বসেন। হাত দু’টোর কনুই হাঁটুতে ভর দেয়া। দশটা আঙুল দিয়ে পুরো মুখ টা আড়াল করে নিরবে কাঁদতে লাগলেন। আমি এবার আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। গিয়ে ওনার পাশে বসলাম। ওনার কাঁধে হাত দিয়ে বলতে লাগলাম।সরি আই এম ভেরী সরি,প্লিজ প্লিজ। কথা গুলো বলে কাঁদতে কাঁদতে ওনার বাহু জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখলাম।
উনি বলতে লাগলেন “কেনো এমন হয় আমার সাথে, সব সময়ই কেনো এমন হবে, এ জীবনে কি কখনো সুখ পাবোনা আমি। কেনো এমন হয় বার বার? কেনো”,বলতে বলতে উনি কান্নায় ভেঙে পরেন।
আমি ওনার মাথাটা আমার কাঁধে রেখে মাথায় হাত বুলাতে থাকি। আর সান্ত্বনা দিয়ে বলতে থাকি, ‘আম্মার কিছু হবে না।একদম চিন্তা করবেন না।’
হঠাৎ ই উনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে উঠে পরেন। আমিও এগিয়ে যাই ওনার সাথে সাথে। মায়ের জ্ঞান অনেক আগেই ফিরেছে। কিন্তু খুব শিগগিরই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবে হয়তো। তখন রাত প্রায় ১০ টা। আম্মাকে নিয়ে বাসায় আসতে আসতে প্রায় এগারোটা বাজে। উনি নিজ হাতে আম্মাকে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পারিয়ে আমার রুমে চলে আসে।
রাত প্রায় ১ টার দিকে আমার একবার ঘুম ভেঙে যায়। দেখি উনি সোফায় নেই। ঘরের দরজা খোলা। আমি উঠে গিয়ে ওনাকে খুঁজতে থাকি। অবশেষে ছাঁদে গিয়ে ওনাকে পাই। দেখি দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে অঝোরে কাঁদতেছেন। আমি খুঁজে পাইনা উনি এতো কাঁদেন কি করে। একটা ছেলে যে এতো কাঁদতে পারে, উনাকে না দেখলে বুঝতাম ই না। হয়তোবা ছেলে বেলাতেই বাবাকে হারিয়েছে। সারাজীবন সংগ্রাম করে আসছেন একা একা। জীবনের পথচলাতে মা একমাত্র সঙ্গী ছিলো, আর তিনিও ছেড়ে চলে যাবেন এই ভাবনায় এতো কান্না।
আমি ওনার পাশে গিয়ে বসতেই উনি কান্না থামিয়ে চোখ মুছতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। তারপর বলতে লাগল “এতো রাতে ছাদে এসেছেন কেনো?,যান ঘরে গিয়ে ঘুমান”।
আমি কোনো কথা বলিনি, তাই উনিও আর কিছু বলল না ওভাবেই বসে রইলো। আমি ওনার দিকে আরেকটু এগিয়ে গেলাম ওনার হাতটা জড়িয়ে ধরে মাথাটা ওনার কাঁধে রাখলাম। আর উনি সাথে সাথেই উঠে অন্য দিকে চলে গেলো। আমি আবার ও পাশে গিয়ে দাড়িয়ে রইলাম।আমার মন চাইছিলো একবার ওনার বুকে মাথা রেখে চোখের জলে ওনার বুকটা ভিজিয়ে দিতে, এতে যদি উনি আমাকে ক্ষমা করেন। সেই ভাবনা থেকেই উনাকে জড়িয়ে ধরলাম। উনি আমাকে হালকা ধাক্কা দিলেন। আমি আরো জোরে জড়িয়ে ধরলাম, উনিও জোরে ধাক্কা মেরে আমাকে সরিয়ে দিলেন। আমি আবারও এগিয়ে গিয়ে উনাকে জরিয়ে ধরি। উনি এবার আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে হাত উঁচিয়ে আমাকে থাপ্পড় দিতে নেয়। আবার হাতটা গুটিয়ে নিয়ে সরি বলে চলে যায়। সিঁড়ি ঘরের কাছে গিয়ে দেয়ালে দ্রিম করে একটা ঘুসি মারে।
আমি বুঝতে পারি উনি আমাকে থাপ্পড় দিয়ে যেই রাগটা কমাতে চেয়েছিলেন সেটা দেয়ালে ঘুসি দিয়ে কমানোর চেষ্টা করেছেন। আমি চাঁদের আলোতে খোলা ছাদে বসে কাঁদতে থাকি একটু পরে আবার ভয় লাগতে শুরু করে যে এতো রাতে ছাদে একা। তাই ঘরে চলে যাই। এতোক্ষণে উনি আবার ঘুমিয়ে পরেছেন। সোফায় শুয়ে আছেন একেবারে জড়োসড়ো হয়ে। হয়তো শীত লাগছে। ঘরে একটাই কাঁথা, আর সেটা আমিই দখল করে রেখেছি। তাই তিনি কাঁথা ছাড়াই ঘুমাচ্ছেন। আমি কাঁথা এনে ওনার উপরে দিতেই ঘুমের ঘোরে তা টেনে গায়ে জড়িয়ে নেন। খুব নিষ্পাপ লাগছিলো ওনাকে। সারাটা দিনে কেমন জানি মায়া জমে গেছে ওনার প্রতি। সারাদিন কান্নাকাটির ফলে চোখটা ফোলে লাল হয়ে আছে। দেয়ালে ঘুসি দেয়ার ফলে হাতটা কতোটুকু ছিলে গেছে। আমার রুমে ফাস্ট এইট বক্স ছিলো। আমি সেখান থেকে একটু ভায়োডিন নিয়ে তুলা দিয়ে হাতে ঘসতেই উনি নড়ে উঠেন কিন্তু সারাদিন অনেক পরিশ্রম করে ক্লান্ত হয়ে আছেন তাই পুরোপুরি উঠলেন না। কাজ শেষে আমি ওনার কপালে একটা চুমু দিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়ি। সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে যাই। রান্না প্রায় শেষ তখন শাশুড়ী আম্মা রান্না ঘরে আসেন। রান্না কতোটুকু হয়েছে দেখে আমাকে রান্না শেষ হলে ওনার ঘরে যাওয়ার কথা বলে চলে যান।
রান্না শেষ করে শাশুড়ীর রুমে যাই উনি আমার হাত ধরে নিজের পাশে বিছানায় বসান। আর একনাগাড়ে বলতে শুরু করেন “অবন্তী মা’রে আমি কি আর বাঁচব না রে! আমার তো মনে হয় আর বেশীদিন বাঁচব না।জানিসরে মা ছেলেটা সেই ছোট বেলাতে বাবাকে হারায়। জানিস সেই অল্প বয়সেই কষ্ট করে কাজ করে, আবার পড়ালেখাও করে।আমাকে লোকে কতো জোর করে বিয়ে দেয়ার জন্য আমি না করে দিই।ছেলেটাকে নিয়েই বেঁচে থাকি। ছেলেটা আমার আদরের চেয়ে কষ্টই বেশী পাইছে,বাপ মরার পরে এলাকার লোকের আদর ও পায় না,আবার আমার বাপের বাড়ির আদর ও পায় নাই। তারপরও কোনোদিন বলে নাই আমি কষ্টে আছি। আমি যখন যা চাইছি তাই দিছে। যেদিন তোকে দেখতে যাই,অনেক ভালোলাগে তোকে। ছেলেটা একবারও বলেনি আমি আগে দেখে তারপর আমার মত জানাবো। শুধু বলছিলো মা তুমি যা ভালো বুঝ তাই করো, আমার কিছু বলার নেই। তারপর তো তুই এই বাড়ির বউ হয়েই আসলি। আমি তোকে তুই তুই করে বলি, তাই রাগ করিস না আবার। তুইতো আমার মেয়ের মতোই। আমার ছেলেটাকে একটু দেখে রাখিস। কোনো সময় কষ্ট দিসনারে মা। ছেলেটা আমার জীবনেও আদর পায়নি। তুই একটু আদর দিয়ে আগলাইয়া রাখিস দেখবি তোকে মাথায় তুইলা রাখব।আমার জন্য কান্দিস না, আমি তো বুড়া হইয়া গেছি। বুড়া মানুষ তো মরন লাগবেই। কতো জোয়ান মানুষই মইরা যায়।”
আমি ওনার হাজার টা কথার বিপরীতে কি বলব কোনো ভাষা পাইনি সেদিন। ওনাকে জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকি। আমি আমার নিজের মা কেও কোন দিন এতো আপন করে পেয়েছি কিনা জানিনা। উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলো “পাগলী মাইয়া কান্দস কেন,বুইড়া মানুষের লাইগা কাঁদলেই কি হইব।তুই খালি আমার পোলাডারে দেইক্ষা রাখিস।”
তার পর আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে দেয়। তার বদলে আমিও ওনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। নিজের মায়ের থেকেও বেশি আপন তখন ওনাকে মনে হচ্ছিলো।
সেদিনের পর থেকে আমার স্বামীকে সব সময়ই মনমরা দেখতাম। এর কিছুদিন পর আমার স্বামী আমাকে একটা ফোন কিনে দেয়। আমি আবার আমার সেই পুরাতন সিমটা ইউজ করা শুরু করি। একদিন আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে রাতের বেলায় কল দেয়। আর নানান কথা বলা শুরু করে। কবে স্বামীকে ডিভোর্স দিবো। এতোদিন কেনো ফোন দেইনি। কেনো ফোন অফ ছিলো। দুনিয়ার সব কথা। আমি আবারও আমার বর্তমানকে ভুলে ওর সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পরি। আবার তার কথা ভাবতে থাকি। প্রায় আধা ঘন্টা কথা বলার পর হটাৎ ঘরে কারো আসার শব্দ পাই আমি ফোনটা না লুকিয়ে পিছনের দিকে ঘুরতেই দেখি আমার স্বামী অফিস থেকে ফিরছে৷ উনি আমার ফোনে কথা বলার ব্যপারটা দেখে ফেলে। কিন্তু কোন রিয়েক্ট না দেখিয়ে শুধু কাপড় চেঞ্জ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়৷আমি আবারও তার সাথে নিয়মিত কথা বলতে থাকি। আমার বয়ফ্রেন্ড এর প্রতি আবার মায়া বেড়ে যায়। কেননা এমনিতেই আমাদের রিলেশন সেই কলেজ লাইফ থেকে প্রায় ৩ বছরের।
আমি ফোনে কথা বলার সময় প্রায়ই দেখে ফেলতো কিন্তু কিছু বলত না। এভাবে প্রায় ২০ দিন চলে যায়। একদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেছি। উনিও উঠেছেন। হটাৎ ই আম্মা কেমন যেনো করতে থাকে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাই। ডাক্তার বলে দেয় বাড়িতে নিয়ে যান৷উনার সময় একদম শেষ হয়ে আসছে। যা চায় নিয়মিত দিয়েন। হয়তো আর ২-১ দিন আছে৷ ওই দিন দুপুরে বাড়ি চলে আসার পর থেকে আমি উনাকে আর ঠিক মতো খেতে দেখিনি। সারাক্ষণ মুখ ভার করে রাখত, ঠিক মতো কথা’ও বলত না। ঐদিন রাতে শাশুড়ি আমাকে ডেকে বলে “অবন্তী মা রে এদিকে আসতো,শোন তোকে কয়টা কথা বলি।”
আমি বললাম আম্মা বলেন কি বলবেন”।
উনি বলতে শুরু করেন “শোন মা,তোকে আমার পছন্দেই বিয়ে করিয়েছি এটা তুই মনে হয় জানোস।তার পরও আবার বলি শোন। আমি আমার ছেলের কাছে এখনো পর্যন্ত যা চাইছি ও সবটুকু চেষ্টা করে তা জোগাড় করে দিয়েছে।কখনো আমাকে অভাব ছুঁতে দেয়নি। আমি তো তাকে কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না রে৷”
অতপর আমার শাশুড়ি যা বলে তা শোনার জন্য আমি একটুও প্রস্তুত ছিলাম না। শাশুড়ির কথা শুনে আমার হাত পা হিম হয়ে যায়। হতভম্ব হয়ে গুটিশুটি হয়ে বসে থাকি খাটের এক কোণে।
…..

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে