অবশেষে পর্ব-০৪

0
1334

গল্প : অবশেষে | পর্ব : চার

শীতের সকালে পরম মুহূর্তে কতটা সময় কেটে গিয়েছিল তারা কেউই জানে না। দিয়া যখন একটু দূরে সরে গেল, তখন তার চোখের কোলে জল। রোদ বাঁ হাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে বলে, খুব সেয়ানা হইছিস! তবে মনে রাখিস, এই রোদকে বশ করা অত সহজ না। বলে শার্টের কলার ঝাড়া দিয়ে চলে যায়। দিয়া চোখের কোলে জল নিয়ে বসে থাকে। হঠাৎ বিছানার উপরে থাকা মোবাইল ফোনটা মৃদু কম্পন তুলে বেজে উঠে।

হ্যালো, অনু, বল! দিয়া ফোন কানে লাগিয়ে বলে।

ওপাশ থেকে চঞ্চল নারীকণ্ঠ ভেসে আসে, কই রে, আসছিস তো? দশটার মধ্যে রেস্তোরাঁয় পৌঁছতে হবে।

আসছি, আসছি। মনে আছে। বলে ফোন রেখে থম মেরে বসে থাকে দিয়া। আজ তার বান্ধবী অনুর অ্যানিভার্সারী। ম্যারেজ অ্যানিভার্সারী নয়। আজ অনু আর তার বয়ফ্রেন্ডের প্রেম জীবনের এক বছর পূর্ণ হলো। অনুর ধারণা, আজ তার বয়ফ্রেন্ড তাকে বিয়ের প্রপোজাল দেবে। তাই সে একটু টেনশানে আছে। আর এজন্যই দিয়াকে রেস্তোরাঁয় আসতে বলেছে। সে পাশে থাকলে টেনশান কিছুটা হলেও কমবে।

ওঁরা দেখা করার কথা সকাল দশটায়। শহরের কোনো এক গলির ছোটো রেস্তোরাঁয়। রেস্তোরাঁর নাম জেবা ফুড। আজ থেকে এক বছর আগে এক দিন সকাল দশটায় এই রেস্তোরাঁয় দেখা হয়েছিল দু’জনের। তারপর নাম্বার আদান প্রদান। কথা বলা। একসময় প্রেম। সে-সব কথা দিয়া বহুবার শুনেছে। অনু কাল রাতেও পইপই করে বলে দিয়েছে, ঠিক সময়ে চলে আসবি কিন্তু। দেড়ি করিস না। মনে থাকে যেন, সকাল দশটা। শার্প।

দিয়া মুখ ফুলিয়ে বলেছে, কেন রে ভাই? তোর বয়ফ্রেন্ড। তুই দেখা করবি। মাঝখানে আমাকে টানতে যাবি কেন? আমাকে কাবাব-মে-হাড্ডি বানানোর কী দরকার?

অনুর এক কথা, টেনশান হচ্ছে খুব। তুই সঙ্গে থাকলে সেটা কমবে। মানা করিস না। প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!

দিয়া যখন রেস্তোরাঁয় পা রাখল, তখন দশটা বেজে সতেরো মিনিট। দিয়া জিভ কেটে ভেতরে পা বাড়ায়। পুরো রেস্তোরাঁয় ছড়ানো ছিটানো টেবিল চেয়ারগুলো খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। একজন কাস্টমারও নেই। হয়তো পুরোটা বুক করা হয়েছে। দেয়ালে টানানো ডিজিটাল ঘড়িটা জানান দিচ্ছে, দশটা বেজে আঠারো মিনিট। রেস্তোরাঁর একদম শেষ মাথায় বসে আছে দু’জন। একজন অনু। আরেকজন…

অনু চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে বলে, এখন এসেছিস! বলেছিলাম ঠিক দশটায় আসতে। এখন দশটা আঠারো। তোর তো টাইম সেন্স একদম নেই! বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। টেবিলের উপর দুই পাউন্ডের কেক রাখা। কেকে লেখা, হ্যাপি অ্যানিভার্সারী। কিন্তু চেয়ারে বসে থাকা মানুষটা! চেয়ারে বসে থাকা মানুষটা স্বয়ং রোদ!
সহসা দিয়ার বুক ধক করে উঠে। তবে কি রোদই অনুর বয়ফ্রেন্ড? দিয়ার হাত-পা কাঁপতে থাকে। চোখের কোনে জল জমে যায়। সে কাঁপা হাতে ঝাপসা চোখ মুছে নেয়। হাতের পার্সটা মাটিতে পড়ে যায়। সেদিকে খেয়াল নেই। হঠাৎ অনুর স্পর্শে দিয়ার ঘোর কাটে। দিয়া স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পেরে উঠে না৷ তার বুক এত দ্রুত ধুকপুক করতে থাকে যে…

অনু রোদকে বলে, এই হলো আমার বান্ধবী। দিয়া।

রোদ সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে তাকায় এবং বলে, তুই! তুই এখানে কী করতে এসেছিস?

দিয়ার গলা দিয়ে কথা বেরোয় না। অনু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, আপনি চেনেন ওঁকে?

রোদ তাচ্ছিল্য করে বলে, আমার বউকে আমি চিনব না?

অনু যেন আকাশ থেকে পড়ে। বলে, দিয়ার বাচ্চা! তুই বলেছিস তোর বিয়ে হয়নি। এদিকে তোর জামাই আছে! চিটার! লায়ার!

দিয়া হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কী হচ্ছে এসব! রোদ বলে, সে-সব কথা বাদ দিন। আপনার বয়ফ্রেন্ড এখনও আসছে না কেন?

অনু তাচ্ছিল্য করে বলে, শুধু আমার বয়ফ্রেন্ড? আপনার বন্ধু না?

এতক্ষণ দিয়ার মনে হচ্ছিল, বুকের উপর কে যেন পাথর চাপা দিয়েছে। এই মুহূর্তে একটু স্বস্তি মিলল। যাক! রোদ তা হলে অনুর বয়ফ্রেন্ড না! অনুর বয়ফ্রেন্ডের বন্ধু!

এই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস? বোস! রোদ দিয়াকে ধমক দিয়ে বলে।

অনু মৃদু হেসে বলে, আপনি অনুকে তুই করে বলেন! ব্যাপারটা কিউট কিন্ত!

রোদ বলে, আমাদের আরো অনেক কিউট কিউট ব্যাপার আছে। সেসব বললে দিয়া রাগ করবে।

দিয়াও আপনাকে তুই করে বলে নাকি? অনু প্রশ্ন করে।

আমাকে তুই করে বলবে! কান টেনে ছিঁড়ে ফেলব না?

রোদের কথায় দিয়া মুখ ভেঙচায়। অনু বলে, সত্যি ভাইয়া, আপনার কথাবার্তা খুবই কিউট এবং রোমান্টিক। কিন্তু আপনার বউ মোটেও সেরকম না। ওঁ আস্ত একটা লায়ার। না হলে আমি তার এত কাছের বান্ধবী, অথচ তার বিয়েতে আমাকে দাওয়াত দিলো না! বলে কিনা, সে নাকি এখনও আনম্যারেড!

রোদ চোখ রাঙিয়ে বলে, কী রে, এসব বলেছিস তুই?

দিয়া ঠোঁট উল্টে জবাব দেয়, ঠিকই তো বলেছি!

রোদ কোনোকিছু না ভেবেই বলে, তা হলে আজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে গোসল…

দিয়া রোদের মুখে আঙুল দিয়ে বলে, চুপ!

অনু মুখ টিপে হাসে। দিয়া বলে, তুই ভাইয়ার কথা বিশ্বাস করিস না। উনি মিথ্যে বলছে।

অনু অবাক হয়ে বলে, ও-কীরে! নিজের বরকে ভাইয়া বলছিস!

দিয়া ভেঙচি দিয়ে বলে, বর না কচু! হুহ্!

অনুর বয়ফ্রেন্ড যখন আসে, তখন দশটা পঁয়ত্রিশ মিনিট। অনু একশ্বাসে বলে, দশটায় আসার কথা। এখন কয়টা বাজে? তোমার কি একটুও টাইম সেন্স নেই? আজ আমাদের অ্যানিভার্সারী। তুমি আজকেও লেট করলে!

সঙ্গে সঙ্গে রোদ বলে উঠে, শালা! দশটায় আসতে বলে নিজেই সাড়ে দশটায় আসলি? আমার টাইমের ভ্যালু কে দিবে?

কেক কাটার পর রোদ বাহানা করে বেরিয়ে আসে। দিয়াকে বলে, এই, তুই আমার সাথে আয়।

রাস্তায় নেমে এসে রোদ বলে, আজ তোকে একটা বিশেষ জায়গায় নিয়ে যাব।

দিয়া প্রশ্ন করে, কোথায় নিয়ে যাবে?

এত প্রশ্ন করিস না। গেলেই দেখতে পারবি।

তারা যখন রিকশা করে রোদের বাসার সামনে আসে, তখন দিয়া সন্দেহের স্বরে বলে, এই তোমার বিশেষ জায়গা?

রোদ নিশ্চুপ। তার শোবার ঘরে ফ্রেমে বাঁধাই করা বিশাল ছবি দেয়ালের সাথে লেপ্টে আছে। সেই ছবিটা রোদের৷ সেটা ঠেলে দিতেই নতুন প্রবেশ পথ উন্মুক্ত হয়। ভিতরের ঘরটা অন্ধকার। রোদ চোখ টিপে বলে, আমার সিক্রেট রুম। চল তোকে দেখাই।

সুইচ টিপতেই ঘরটা ঝলমলে আলোয় আলোকিত হয়ে যায়৷ ঘরে জিনিসপত্র অনেক। সবার আগে চোখ পড়ে দেয়ালে ঝুলন্ত বাচ্চা শিশুর ছবির দিকে। রোদ ছবিটা দেখিয়ে বলে, এটা কে, বলতে পারিস?

দিয়া অনেক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, এটা কার ছবি?

চিনতে পারছিস না?

দিয়া মুখে আঙুল দিয়ে বলে, না তো! কে ওঁ?

রোদ ছবিতে স্পর্শ করে বলে, ঠোঁটের তিলটা দ্যাখ।

মুহূর্তেই দিয়ার আপাদমস্তকে শিহরণ জাগে। সে বিস্ফোরিত কণ্ঠে বলে, আমার ছবি!

চলবে
মো. ইয়াছিন
#অবশেষে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে