অবশেষে পর্ব-০৮

0
1365

গল্প : অবশেষে | পর্ব : আট

সে-রাতে ঘুম হলো না দিয়ার। পুরো রাত শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলো। ভেতর থেকে উথলে পড়তে লাগল রাগ, ক্ষোভ, অভিমান। মাঝে মাঝে আপনমনে ভাবতে ভাবতে কেঁপে কেঁপে উঠল সে। আবার কখনো সখনো রোদের কান্নাভেজা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই বিষিয়ে উঠল পুরো শরীর।

তারা দু’জনেই পরিবর্তন হয়েছে। রাগী, গম্ভীর রোদ চোখের জল ফেলে কেঁদেছে। আর দিয়া যার নাম শুনলে ভয়ে কুঁকড়ে যেত, যার ছায়া দেখলে থরথর করে কাঁপত, সেই রোদকে সে গালি দিয়েছে। তুই করে বলেছে। রোদ রেগে যায়নি। বাধা দেয়নি। চোখের জল ফেলতে ফেলতে হারিয়ে গেছে।

দিয়ার চোখের সামনে রোদের কান্নাভেজা মুখটা আবার ভেসে উঠে। সেই সঙ্গে উথলে পড়ে রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা।

শেষরাতে সবাই যখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন, তখন দিয়া রোদের নাম্বার ডায়েল করে। ফোন রিসিভ করতেই হড়বড় করে বলে, তুই কোনোদিন আমার সামনে আসবি না।

ওপাশ থেকে কোনোরকম সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। দিয়া আবার বলে, তুই আর কোনোদিন আমাকে ফোন দিবি না।

রোদও সারারাত ঘুমায়নি। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মেঘলা আকাশ দেখছিল। বিষণ্নতার শহরে সে এক ক্লান্ত পথিক। দীর্ঘশ্বাসের বাতাসে মিশ্রিত ধুলো। এতক্ষণ সে বিষণ্নতায় ডুবে ছিল। তাই দিয়ার কথায় নতুন করে কষ্ট পাবার কিছু নেই। সে পাথারের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হাতের স্মার্টফোনটা আলতো করে চেপে রাখে গালের কাছে।

আমি বিয়ে করে নিচ্ছি। ভালো থাকিস তুই।

দিয়া থেমে যাবার আগেই রোদ বলে উঠে, তুই তুই করে বলছিস যে? বড্ড বাড় বেড়েছে না?

একশো বার বলব। হাজার বার বলব। তুই তুই তুই। কী করবি? মারবি? আয়, মার এসে।

দিয়ার এসব কথায় রোদের বিষণ্নতা উবে যায়। সে হাসি চেপে বলে, খুব খারাপ হবে কিন্তু দিয়া। খুব খারাপ হবে বলে দিলাম।

কী করবি? তোকে আমি ভয় পাই নাকি?

কী করব?

হ্যাঁ, কী করবি? তোর দৌড় চড়, থাপ্পড় মারা পর্যন্ত৷ এর বেশি কিছু করার মুরোদ আছে?

রোদ গলা নামিয়ে বলে, খুব যতনে জড়িয়ে ধরব। ভালোবেসে জড়িয়ে রাখব বুকের মাঝে। সহ্য করতে পারবি তো?

দিয়া হয়তো তা-ই চাইছিল। রোদ এমন করে আগলে নিলে সে হয়তো অসহ্য আনন্দে কেঁদেই ফেলত। তবে কি রোদ তার মনের সব কথা জানে? বুঝতে পারে তার আকুলতা?

পরদিন বাবা দিয়াকে ডেকে পাঠালেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এলোমেলোভাবে প্রশ্ন করলেন, আরেকবার ভেবে দেখা যায় না?

দিয়া মলিন মুখে বলে, কী ভাবব বাবা?

তুই কি মাহফুজকেই বিয়ে করবি?

হ্যাঁ।

শোন, তুই এখন বড়ো হয়েছিস। নিজের ভালোমন্দ বুঝার বয়স হয়েছে। অনেক আগে আমরা রোদের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। তবে তোর ভালোর জন্য আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারি। শুধু একটি অনুরোধ, আরো একবার ভেবে দেখ।

ভাববার কী আছে বাবা?

অনেক কিছুই আরে রে মা। সেদিন মাহফুজের পরিবার তোকে দেখে যাবার পর রোদ এসেছিল। ছেলেটা ভালো নেই। একদম ভালো নেই। বলে মাথা ঝাঁকান তিনি।

সে ভালো আছে। খুব ভালো আছে। দিয়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে।

তোদের মধ্যে কী হয়েছে জানি না। কখনো জানতেও চাইব না। তবে এতটুকু বলে রাখি, রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়ে পুরো জীবনটা ধ্বংস করে দিস না।

দিয়া সে-সব কথা কানে নেয় না। উঠে যেতে যেতে বলে, আমি রেগে নেই বাবা। আজই মাহফুজের বাসায় ফোন দাও। আগামী শুক্রবারে বিয়ের কাজটা মিটিয়ে ফেলতে বলো।

তুই তাহলে ভেবে দেখবি না?

ভাববার কিছু নেই বাবা। বলে বেরিয়ে যায় দিয়া।

বিয়ের দিন। অর্থাৎ শুক্রবার দুপুরে যখন দিয়াকে পার্লারে নিয়ে যাওয়া হয়, যখন তাকে নতুন বউয়ের বেশে সাজানো হয়, তখন সে কাঠের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। আজ তার চোখে চঞ্চলতা নেই। মুখে হাসি নেই। চোখ তুলে নিজেকে আয়নায় দেখে নেবার আকুলতা নেই। সে চুপচাপ বসে থাকে। আর নিজেকে, নিজের মনকে সামলে রাখতে চায়। পারে না। ভেতর থেকে উথলে উথলে উঠে কান্নার ঢেউ। চোখ দিয়ে জল আসে না। সেই জল অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। তার কেবল মনে পড়ে রোদের কথা। রোদের সঙ্গে ফেলে আসা স্মৃতির কথা।

দিয়া হঠাৎ ছোটোবেলায় হারিয়ে যায়। যখন সে ছিল। তার পাশাপাশি ছিল রোদ।

সুনামগঞ্জ, সিলেট। যেখানে রোদের ছেলেবেলা কেটেছে। সেখানে আছে হাওড়-খাল-বিল, আছে নৌকো, আছে বিদীর্ণ আবাদি জমি। সেই জমির আলপথ দিয়ে ছুটে বেড়াত তারা। দিয়া আর রোদ। একবার হলো কি, ভর দুপুরে ছোট্ট খাল সেঁচে মাছ ধরছিল রোদ। দিয়া দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। হঠাৎ ইচ্ছে হলো সে-ও মাছ ধরবে। অমনি মাছের খলইটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে বলল, ভাইয়া, আমিও মাছ ধরব।

রোদ তখন হাঁটু সমান কাদায় দাঁড়িয়ে মাছ খুঁজছে। পুঁটি, কৈ, মাগুর, টেংরা এসব। দিয়ার কথা শুনে বাঁ হাতের পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বলল, কাদায় নামলে কিন্তু একটা মার-ও মাটিতে পড়বে না। মেরে একদম পিঠ ভেঙে ফেলব। বলে মাথা নুইয়ে আবারও মাছ ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর কী একটা মাছ ধরে খলইয়ে রাখার সময় দেখল, দিয়ার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। তখন রোদ মুখ বাঁকিয়ে চোঁ-চোঁ শব্দ করে বলল, কিছু বললেই কান্না চলে আসে! আচ্ছা আয়। কিন্তু কাদায় ডুবে গেলে টেনে তুলতে পারব না।

দিয়া মনের আনন্দে তরতর করে কাদায় নেমে যায়। একটু এগোতেই পা-দু’টো হাঁটু পর্যন্ত দেবে যায়। রোদ আগেই বলেছে সাহায্য চাওয়া যাবে না। সুতরাং দিয়া সেখানে দাঁড়িয়েই কাদায় হাত ডুবিয়ে দেয়। একটু দু’টি মাছ হাতে লাগলে খপ করে ধরে ফেলবে।

ভাইয়া, এখানে কী যেন নড়ছে!

মাছ নড়ছে। ধরে ফেল। রোদ মাথা না তুলেই বলে।

দিয়া একসঙ্গে দু’হাত কাদায ডুবিয়ে দেয়। এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা মাছ ধরে ফেলে। মাছটা কেমন যেন। সরু, পিচ্ছিল, লম্বা। সেটাকে কাদার ভিতর থেকে টেনে বের করেই চিৎকার দেয় দিয়া, ও-আম্মাগো!

রোদ সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলে বলে, কী রে?

দিয়া দু’হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, সাপ। সাপ ধরে ফেলেছিলাম।

কামড় দিয়েছে?

না।

তাহলে ভাগ। তোকে মাছ ধরতে হবে না।

এরপর দিয়া আর কোনোদিন কাদায় তো দূর, পুকুরে পর্যন্ত নামেনি।

ফোন বাজছে। পার্লারে বসে বসে কী যেন ভাবছে দিয়া। রোদ একের পর এক ফোন দিয়েই যাচ্ছে। দিয়া ফোন ধরবে না। তার কোনো আগ্রহ নেই।

হঠাৎ পার্লারের স্লাইড ডোর খুলে কে যেন ভিতরে চলে এল। দিয়া সেদিকে তাকাল না। পার্লারের মেয়েটা বলল, স্যার, এখানে পুরুষ প্রবেশ নিষেধ।

কিন্তু আগন্তুক শুনতে নারাজ। সে সোজা এসে দিয়ার কান টেনে ধরে। দিয়া উঃ, মাগো! বলে আর্তনাদ করে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে রোদ তার কান টেনে ধরেছে।

ফোন রিসিভ করছিস না কেন? রোদ উদ্বেগের সঙ্গে বলে।

পার্লারের মেয়েগুলো থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দিয়া কান ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, রিসিভ করব না। কী করবে?

কী করব? তোকে নিয়ে পালিয়ে যাব। হারিয়ে যাব দূরে কোথাও। সেখানে তোকে লুকিয়ে রাখব।

দিয়া নাক ফুলিয়ে বলে, তাহলে মাহফুজের কী হবে?

সে অন্য কাউকে বিয়ে করে নেবে।

এটা কিন্তু ঠিক না।

ভালোবাসায় ঠিক বেঠিক কিছু নেই রে। ভালোবেসেছিস তো মরেছিস। আমাকেই দেখ। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে তোকে নিতে এসেছি।

আমি যদি না যাই?

জোর করে নিয়ে যাব।

যদি চিৎকার করি?

সবার সামনে দিয়ে নিয়ে যাব।

আর যদি মরে যাই?

সহসা দিয়ার মুখ চেপে ধরে রোদ। ফিসফিস করে বলে, তা হলে আমিও মরে যাব।

চলবে
মো. ইয়াছিন
#অবশেষে
গত পর্বের লিংক :
গল্প : অবশেষে | পর্ব : আট

সে-রাতে ঘুম হলো না দিয়ার। পুরো রাত শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলো। ভেতর থেকে উথলে পড়তে লাগল রাগ, ক্ষোভ, অভিমান। মাঝে মাঝে আপনমনে ভাবতে ভাবতে কেঁপে কেঁপে উঠল সে। আবার কখনো সখনো রোদের কান্নাভেজা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই বিষিয়ে উঠল পুরো শরীর।

তারা দু’জনেই পরিবর্তন হয়েছে। রাগী, গম্ভীর রোদ চোখের জল ফেলে কেঁদেছে। আর দিয়া যার নাম শুনলে ভয়ে কুঁকড়ে যেত, যার ছায়া দেখলে থরথর করে কাঁপত, সেই রোদকে সে গালি দিয়েছে। তুই করে বলেছে। রোদ রেগে যায়নি। বাধা দেয়নি। চোখের জল ফেলতে ফেলতে হারিয়ে গেছে।

দিয়ার চোখের সামনে রোদের কান্নাভেজা মুখটা আবার ভেসে উঠে। সেই সঙ্গে উথলে পড়ে রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা।

শেষরাতে সবাই যখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন, তখন দিয়া রোদের নাম্বার ডায়েল করে। ফোন রিসিভ করতেই হড়বড় করে বলে, তুই কোনোদিন আমার সামনে আসবি না।

ওপাশ থেকে কোনোরকম সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। দিয়া আবার বলে, তুই আর কোনোদিন আমাকে ফোন দিবি না।

রোদও সারারাত ঘুমায়নি। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মেঘলা আকাশ দেখছিল। বিষণ্নতার শহরে সে এক ক্লান্ত পথিক। দীর্ঘশ্বাসের বাতাসে মিশ্রিত ধুলো। এতক্ষণ সে বিষণ্নতায় ডুবে ছিল। তাই দিয়ার কথায় নতুন করে কষ্ট পাবার কিছু নেই। সে পাথারের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হাতের স্মার্টফোনটা আলতো করে চেপে রাখে গালের কাছে।

আমি বিয়ে করে নিচ্ছি। ভালো থাকিস তুই।

দিয়া থেমে যাবার আগেই রোদ বলে উঠে, তুই তুই করে বলছিস যে? বড্ড বাড় বেড়েছে না?

একশো বার বলব। হাজার বার বলব। তুই তুই তুই। কী করবি? মারবি? আয়, মার এসে।

দিয়ার এসব কথায় রোদের বিষণ্নতা উবে যায়। সে হাসি চেপে বলে, খুব খারাপ হবে কিন্তু দিয়া। খুব খারাপ হবে বলে দিলাম।

কী করবি? তোকে আমি ভয় পাই নাকি?

কী করব?

হ্যাঁ, কী করবি? তোর দৌড় চড়, থাপ্পড় মারা পর্যন্ত৷ এর বেশি কিছু করার মুরোদ আছে?

রোদ গলা নামিয়ে বলে, খুব যতনে জড়িয়ে ধরব। ভালোবেসে জড়িয়ে রাখব বুকের মাঝে। সহ্য করতে পারবি তো?

দিয়া হয়তো তা-ই চাইছিল। রোদ এমন করে আগলে নিলে সে হয়তো অসহ্য আনন্দে কেঁদেই ফেলত। তবে কি রোদ তার মনের সব কথা জানে? বুঝতে পারে তার আকুলতা?

পরদিন বাবা দিয়াকে ডেকে পাঠালেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এলোমেলোভাবে প্রশ্ন করলেন, আরেকবার ভেবে দেখা যায় না?

দিয়া মলিন মুখে বলে, কী ভাবব বাবা?

তুই কি মাহফুজকেই বিয়ে করবি?

হ্যাঁ।

শোন, তুই এখন বড়ো হয়েছিস। নিজের ভালোমন্দ বুঝার বয়স হয়েছে। অনেক আগে আমরা রোদের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। তবে তোর ভালোর জন্য আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারি। শুধু একটি অনুরোধ, আরো একবার ভেবে দেখ।

ভাববার কী আছে বাবা?

অনেক কিছুই আরে রে মা। সেদিন মাহফুজের পরিবার তোকে দেখে যাবার পর রোদ এসেছিল। ছেলেটা ভালো নেই। একদম ভালো নেই। বলে মাথা ঝাঁকান তিনি।

সে ভালো আছে। খুব ভালো আছে। দিয়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে।

তোদের মধ্যে কী হয়েছে জানি না। কখনো জানতেও চাইব না। তবে এতটুকু বলে রাখি, রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়ে পুরো জীবনটা ধ্বংস করে দিস না।

দিয়া সে-সব কথা কানে নেয় না। উঠে যেতে যেতে বলে, আমি রেগে নেই বাবা। আজই মাহফুজের বাসায় ফোন দাও। আগামী শুক্রবারে বিয়ের কাজটা মিটিয়ে ফেলতে বলো।

তুই তাহলে ভেবে দেখবি না?

ভাববার কিছু নেই বাবা। বলে বেরিয়ে যায় দিয়া।

বিয়ের দিন। অর্থাৎ শুক্রবার দুপুরে যখন দিয়াকে পার্লারে নিয়ে যাওয়া হয়, যখন তাকে নতুন বউয়ের বেশে সাজানো হয়, তখন সে কাঠের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। আজ তার চোখে চঞ্চলতা নেই। মুখে হাসি নেই। চোখ তুলে নিজেকে আয়নায় দেখে নেবার আকুলতা নেই। সে চুপচাপ বসে থাকে। আর নিজেকে, নিজের মনকে সামলে রাখতে চায়। পারে না। ভেতর থেকে উথলে উথলে উঠে কান্নার ঢেউ। চোখ দিয়ে জল আসে না। সেই জল অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। তার কেবল মনে পড়ে রোদের কথা। রোদের সঙ্গে ফেলে আসা স্মৃতির কথা।

দিয়া হঠাৎ ছোটোবেলায় হারিয়ে যায়। যখন সে ছিল। তার পাশাপাশি ছিল রোদ।

সুনামগঞ্জ, সিলেট। যেখানে রোদের ছেলেবেলা কেটেছে। সেখানে আছে হাওড়-খাল-বিল, আছে নৌকো, আছে বিদীর্ণ আবাদি জমি। সেই জমির আলপথ দিয়ে ছুটে বেড়াত তারা। দিয়া আর রোদ। একবার হলো কি, ভর দুপুরে ছোট্ট খাল সেঁচে মাছ ধরছিল রোদ। দিয়া দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। হঠাৎ ইচ্ছে হলো সে-ও মাছ ধরবে। অমনি মাছের খলইটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে বলল, ভাইয়া, আমিও মাছ ধরব।

রোদ তখন হাঁটু সমান কাদায় দাঁড়িয়ে মাছ খুঁজছে। পুঁটি, কৈ, মাগুর, টেংরা এসব। দিয়ার কথা শুনে বাঁ হাতের পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বলল, কাদায় নামলে কিন্তু একটা মার-ও মাটিতে পড়বে না। মেরে একদম পিঠ ভেঙে ফেলব। বলে মাথা নুইয়ে আবারও মাছ ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর কী একটা মাছ ধরে খলইয়ে রাখার সময় দেখল, দিয়ার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। তখন রোদ মুখ বাঁকিয়ে চোঁ-চোঁ শব্দ করে বলল, কিছু বললেই কান্না চলে আসে! আচ্ছা আয়। কিন্তু কাদায় ডুবে গেলে টেনে তুলতে পারব না।

দিয়া মনের আনন্দে তরতর করে কাদায় নেমে যায়। একটু এগোতেই পা-দু’টো হাঁটু পর্যন্ত দেবে যায়। রোদ আগেই বলেছে সাহায্য চাওয়া যাবে না। সুতরাং দিয়া সেখানে দাঁড়িয়েই কাদায় হাত ডুবিয়ে দেয়। একটু দু’টি মাছ হাতে লাগলে খপ করে ধরে ফেলবে।

ভাইয়া, এখানে কী যেন নড়ছে!

মাছ নড়ছে। ধরে ফেল। রোদ মাথা না তুলেই বলে।

দিয়া একসঙ্গে দু’হাত কাদায ডুবিয়ে দেয়। এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা মাছ ধরে ফেলে। মাছটা কেমন যেন। সরু, পিচ্ছিল, লম্বা। সেটাকে কাদার ভিতর থেকে টেনে বের করেই চিৎকার দেয় দিয়া, ও-আম্মাগো!

রোদ সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলে বলে, কী রে?

দিয়া দু’হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, সাপ। সাপ ধরে ফেলেছিলাম।

কামড় দিয়েছে?

না।

তাহলে ভাগ। তোকে মাছ ধরতে হবে না।

এরপর দিয়া আর কোনোদিন কাদায় তো দূর, পুকুরে পর্যন্ত নামেনি।

ফোন বাজছে। পার্লারে বসে বসে কী যেন ভাবছে দিয়া। রোদ একের পর এক ফোন দিয়েই যাচ্ছে। দিয়া ফোন ধরবে না। তার কোনো আগ্রহ নেই।

হঠাৎ পার্লারের স্লাইড ডোর খুলে কে যেন ভিতরে চলে এল। দিয়া সেদিকে তাকাল না। পার্লারের মেয়েটা বলল, স্যার, এখানে পুরুষ প্রবেশ নিষেধ।

কিন্তু আগন্তুক শুনতে নারাজ। সে সোজা এসে দিয়ার কান টেনে ধরে। দিয়া উঃ, মাগো! বলে আর্তনাদ করে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে রোদ তার কান টেনে ধরেছে।

ফোন রিসিভ করছিস না কেন? রোদ উদ্বেগের সঙ্গে বলে।

পার্লারের মেয়েগুলো থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দিয়া কান ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, রিসিভ করব না। কী করবে?

কী করব? তোকে নিয়ে পালিয়ে যাব। হারিয়ে যাব দূরে কোথাও। সেখানে তোকে লুকিয়ে রাখব।

দিয়া নাক ফুলিয়ে বলে, তাহলে মাহফুজের কী হবে?

সে অন্য কাউকে বিয়ে করে নেবে।

এটা কিন্তু ঠিক না।

ভালোবাসায় ঠিক বেঠিক কিছু নেই রে। ভালোবেসেছিস তো মরেছিস। আমাকেই দেখ। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে তোকে নিতে এসেছি।

আমি যদি না যাই?

জোর করে নিয়ে যাব।

যদি চিৎকার করি?

সবার সামনে দিয়ে নিয়ে যাব।

আর যদি মরে যাই?

সহসা দিয়ার মুখ চেপে ধরে রোদ। ফিসফিস করে বলে, তা হলে আমিও মরে যাব।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে