অপরাজিতা – লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি

0
598

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০

ছোটগল্প: অপরাজিতা
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি
ক্যাটাগরি: কষ্টের গল্প
শব্দ সংখ্যা:১৯৯৮

ডাক্তার যখন আমার দিকে ঝুঁকে বললেন,
‘অপরাজিতা! পরাজয় তোমার জন্য নয় বরং জয়ই তোমার মাথার মুকুট।’

আমি করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম ডাক্তারের মুখের দিকে। ভাবছিলাম, আমার নাম তো ঝুম। মা মাঝেমধ্যে আদর করে ঝুম বৃষ্টি বলে ডাকেন। আমার জন্মের সময় না-কি ঝুম বৃষ্টি হয়েছিল তাই। কিন্তু এই ভদ্রলোক আমাকে অপরাজিতা বলে ডাকছেন কেন? সেটাই তো বুঝলাম না! আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে। মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করার জন্য মুখ খুলতে যাব ঠিক তখনই একটা তীব্র ব্যথা যেন নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। আমি কথা বলতে পারছি না। আমার পুরো শরীরে এক অসহনীয় ব্যথা অনুভব করছি। সাথে সাথে চোখ বুজে ফেললাম। আমি আর এই কষ্টটা নিতে পারছি না।

‘অপরাজিতা! ইউ আর আ ব্র্যাভ গার্ল। ডোন্ট লুজ ইওর স্ট্রেন্থ। নেভার এভার ইন ইওর লাইফ!’ কথাটা বলার সময় ডাক্তারের কণ্ঠে আকুতি ঝরে পড়ছিল। কণ্ঠটা যেন কেঁপে উঠল ক্ষণিকের তরে। যেন তিনি নিজেই ধর্ষিত হয়েছেন! যেন তার মুখের উপরেই এসিড নিক্ষেপ করা হয়েছে!

কী আশ্চর্য! আমার নামটা তো ভুল বলছেন। আমার জিজ্ঞাসু চাউনি দেখে ডাক্তার আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘তোমার এই নামটা আমি দিয়েছি। এই নামটাই এখন থেকে ধারণ করবে তুমি, তোমার সমস্ত সত্তা দিয়ে।’ এটুকু বলেই তিনি ধীর পায়ে হেঁটে চলে গেলেন।

তারপর বাবা, মা আর রাফি এসে ঢুকল আমার কেবিনে। সবার চোখেই যেন বর্ষার অথৈ জল। আমার খুব করে উঠে বসতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছি না। সমস্ত যন্ত্রণাগুলো যেন আরও বেড়ে যাচ্ছে। সমস্ত শরীর জুড়ে এক অসহনীয় যন্ত্রণা! মুখের উপর এক দুর্জ্ঞেয় অনুভূতি অনুভব করছি। মনে হচ্ছে ঝলসানো কোনো কিছু দলা পাকিয়ে আছে! এই কষ্ট থেকে রেহাই পেতে হলেও আমার নিজেকে দেখতে ইচ্ছে করছে। অন্তত এক বারের জন্য হলেও। মা আমার কপালে তার হাতের মমতাময়ী আলতো স্পর্শ দিয়ে কান্না ভেজা কণ্ঠে বললেন, ‘আমরা আছি তো মা তোর পাশে। তোর কিচ্ছু হবে না। তোর কোনো কষ্ট হবে না। আমরা আমাদের ভালোবাসা দিয়ে সব ভুলিয়ে দেব।’

বাবা কঠিন হবার ব্যর্থ চেষ্টা করে কম্পিত গলায় বললেন, ‘ঝুম মা! তুই একদম টেনশন করিস না। তোর পড়ালেখা আমি আর বন্ধ করতে চাইব না। একবার সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আয়। তারপর তোর সমস্ত ইচ্ছে পূরণ করব।’

রাফি কান্নার দমকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, ‘ঝুম আপু! আমি তোমার ব্যাগ থেকে আর কখনও না বলে টাকা নিব না। আর কখনও দুষ্টামি করব না। তোমাকে বিরক্ত করব না। নীল শাড়ি তোমার খুব পছন্দের। তাই না? আমার মাটির ব্যাংকে জমানো টাকাগুলো দিয়ে তোমার জন্য একটা সুন্দর দেখে নীল শাড়ি কিনব। কেমন?’

একজন মানুষকে দেখার জন্য আমার চোখ জোড়া উৎসুক হয়ে আছে। তাকে দেখার অসুখ যে আমার আছে। সেটা বোধহয় আরও বেশি জেঁকে বসেছে। আমার মনে পড়ে গেল আজ থেকে দশ দিন আগের ঘটনা।

টিউশন থেকে বাসায় ফেরার পথে প্রতিনিয়ত এলাকার বখাটেদের হেনস্তার শিকার হতে হয়। এই হেনস্থার শিকার কেবল আমি নই, বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সবাই। এই হেনস্থার শিকার বোরখা পরা মেয়েরাও। নাবিল নামের এক বখাটে প্রতিনিয়ত তার সস্তা প্রেমের ডায়লগ ঝাড়বে আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করবে। এটা আমাদের এলাকার এক তিক্ত অথচ ধ্রুব সত্য। অথচ এটা নিয়ে যেন কারো কোনো মাথাব্যথা নেই বা থাকলেও কেউ কখনো সোচ্চার হয়ে উঠে না। আমি এই মাস্তানের প্রস্তাব নাকচ করতেই আমাকে কুপ্রস্তাব দিয়ে বসে। সেদিন আমি নিজের রাগ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তার গালে একটা চড় বসিয়ে দিই। সেটাই আমার এই ছোট্ট সুন্দর জীবনে করা মস্ত বড়ো ভুল ছিল। তার দিন পাঁচেক পরে, টিউশন থেকে ফিরছিলাম। সেদিন রাত হয়ে গিয়েছে। বাচ্চাদের পরীক্ষা তাই নিজের সমস্যার কথা না ভেবেই অতিরিক্ত সময় ধরে পড়িয়েছি। অথচ এর মাশুল আমি নিজের অস্তিত্ব দিয়ে দিয়েছি। শুধু তাই নয়, এই সমাজের নাবিল নামক নোংরা কীট নিজের শরীরের খায়েশ মেটানোর পরে এসিড ছড়িয়ে দেয় আমার মুখের উপর। তারপর শার্টের কলার উঁচিয়ে দাপট দেখিয়ে চলে গেল আমার চোখের সামনে থেকেই। আমি প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলাম। আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছিল অগণিত অসহায়ত্বের জল।

কী বোকাই না আমি! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমি যে অপবিত্র হয়ে গেছি। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমি আমার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছি। তবে কেন আসবে কেউ আমাকে দেখতে! কেন? এতক্ষণে প্রিয়ম নিশ্চয়ই সবটা জেনে গেছে!

নারী! তুমি তো সৌন্দর্যের রানী
পুরুষ সে তো সৌন্দর্যের পূজারী!
পূজার নিমিত্তে কিংবা
তার অশুদ্ধ খায়েশ মেটাতে;
যদি হয় তোমার সৌন্দর্য কিংবা সতীত্বের বিনাশ।
তবে জেনে রাখো, তোমার সৌন্দর্য বিনষ্টকারীর
নেই কোনো পাপ, নেই পঙ্কিলতা!
সতীত্বহীন তুমি! হবে না গৃহীত এই সমাজে।
হবে অবহেলিত, হবে লাঞ্ছিত বারেবারে!
তবুও রবে না কোনো প্রতিবাদের স্বর।
মিলবে না কোনো মুক্তি, নিষ্কৃতি, নিস্তার!
মিলবে শুধু অপমান, মিথ্যে অপবাদ, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা।

আজ জীবন নামক ছোট্ট শব্দটিকে পৃথিবীর সবচাইতে ভারী শব্দ বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। ইশ! কেন যে ওই নরপশুটা আমাকে জানে মেরে ফেলল না! কেন? যদি মেরে ফেলত তবে আজ আমাকে এভাবে জীবন কাটাতে হতো না। এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা অনুভব করতে হতো না।

‘কী হলো, ঝুম?’ মা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘কিছু তো বল মা।’

আমি করুণ চোখে তাকালাম। শরীরের ক্ষত কিছুটা সেরে গেলেও আমার ভেতরটা রিক্ত, ধূ ধূ প্রান্তরের মতো । মস্তিষ্কের মধ্যে সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল। আমার কিছুই থাকল না। না সৌন্দর্য! না সতীত্ব! তবে এই বেঁচে থাকার মানেটা কী!

হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ হওয়ার আগ মুহূর্তে ওই ডাক্তার ভদ্রলোক আবারও এলেন। বিনম্র কণ্ঠে বললেন, ‘অপরাজিতা মামণি! আমি বিশ্বাস করি তুমি হারবে না। তুমি হারা মানে আমার হার। তুমি নিশ্চয়ই তোমাকে ভালোবাসে এমন কোনো একজন পিতৃতুল্য মানুষকে হারিয়ে দিতে পছন্দ করবে না?’

আমি প্রত্যুত্তরে সেদিন কিছুই বলিনি। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলাম ওই মুখের দিকে, আকুতি ভরা চোখের দিকে। কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তার বলা কথাগুলো। আমি উনাকে অনেক প্রশ্ন করতে চাইছিলাম। কিন্তু আমার মনের ভেতরের সমস্ত শব্দেরা কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল । আমি বাকরুদ্ধ হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে দেখছিলাম মানুষটার দিকে। পরে অবশ্য জানতে পেরেছি ডাক্তার ওয়াহিদুল ইসলামই আমার অপারেশন করেছেন। আমার যত্ন নিয়েছেন নিজের বাচ্চার মতো করে। আমাকে এসব কিছুই বিচলিত করতে পারলো না। কারণ , এখন পৃথিবীর কোনোকিছুই আমাকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা রাখে না। অনুপ্রেরণা শব্দটা আমার জন্য ধনীদের বিলাসিতা করার সামিল। আমি ঘরকুনো হয়ে পড়লাম। কোথাও বের হই না। কারও সাথে কথা বলি না। আমার নিজের রুমের ড্রেসিং টেবিলটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। যদি আমার সাথে প্রকৃত এই আমার সাক্ষাৎ হয়ে যায় সেই ভয়ে! আমার তাতেও কোনো আভিযোগ নেই। আমি আর কখনোই নিজের মুখোমুখি হতে পারব না। আমি কারো দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারি না। মানুষের চোখের আয়নাতেও আমার নিজেকে দেখতে ভীষণ ভয় হয়।

আমার শহরটা ছিন্নভিন্ন, এক উটকো ঝড়ে।
সবকিছু হয়ে গেল বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত !
আমার শহরটাতে সুখপাখিরা,
ভুল করেও আসে না ডানা ঝাপটাতে!

আমার চোখ দিয়ে শ্রাবণের বারিধারা বয়ে যাচ্ছে। মুছে ফেলার ইচ্ছে নেই, যেভাবে বয়েছে সেভাবেই শুকিয়ে যাবে, কোনো এক সময়।

মাঝেমধ্যে আত্মীয়স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশীরা বাসায় আসে আমাকে দেখতে। আমি তাদের কারও সাথেই দেখা করি না। যারা ভুলেও এ মুখো হতো না তারাও আজ আমাকে দেখতে আমাদের বাড়ির পথ মাড়ায়! সময়, মানুষকে দিয়ে কতো কিছু করায়! আমি দরজা বন্ধ করে থাকাতে কেউ আমার সাথে দেখা করতে পারে না। এ নিয়ে তারা বেজায় দুঃখী। তবে ধীরে ধীরে বোধহয় আমিও মেনে নিতে শিখেছি। পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কাজ মানিয়ে নেওয়া। এই কাজটা সবাই পারে না, আবার পারলেও আশেপাশের মানুষ তাকে পারতে দেয় না। আমার ক্ষেত্রেও তেমনটাই হলো। ব্যতিক্রম প্রজাতিকে কেউ টিকতে দেয় না, যারা টিকে যায় তারাই স্থায়ী হয়, উদাহরণ হয়।

একদিন পাশের বাসার আন্টি হুট করে আমার রুমে ঢুকে পড়লেন। আমি আচমকা পায়ের শব্দ শুনে তার দিকে তাকাতেই তিনি ভুত দেখার মতো করে চিৎকার করে উঠলেন। পরক্ষণেই চিনতে পারার ভান করে বললেন, ‘ঝুম! তুই এত কুৎসিত হয়ে গেছিস?’

আমি স্তব্ধ, নির্বাক, হতভম্ব। আমি তো নিজেকে এখনও দেখিনি। এই তো কয়েক মাস আগেও ওই আন্টিই আমার সাথে তুলনা করতে করতে নানান বিদেশি প্রসাধনী ব্যবহার করতেন। অথচ আজ তিনি আমাকে এ কী বললেন! আসলেই কী আমি দেখতে এতটা কুৎসিত হয়ে গেছি! মনুষ্যসৃষ্ট এসিড কি তবে মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে এমন বিকৃত করে দিয়েছে?

আমার বেঁচে থাকার আর কোনো ইচ্ছে অবশিষ্ট নেই! সেদিন অনেকেই এলো আমাকে দেখতে। আন্টি পুরো পাড়া করেছেন ব্যাপারটা। আমার মধ্যে আর বিন্দুমাত্র সাহস নেই এইসব মানুষের দৃষ্টি সহ্য করার। তাই আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। কঠিন কারণ ইসলাম তা সমর্থন করে না। আমার সামনে সত্যিই আর কোনো পথ খোলা নেই। আমাকে এবার এই পথেই এগুতে হবে।

জীবনের কাছে আমি হারিনি!
আমি হেরেছি, সমাজের কাছে!
সমাজের কিছু মনুষ্য নামক কীটের কাছে।

এই ভর দুপুরে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এটাই মোক্ষম সময় আমার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের। ঘরে ইঁদুর মারার ওষুধ আছে। এটা খেলেই নিশ্চিত মৃত্যু কোনোপ্রকার রক্তারক্তি ছাড়াই । তাই এটাই সবচাইতে সহজ মনে হলো। হঠাৎ মনে পড়ল, ‘কারো জেতার কারণ তুমি নাইবা হলে হারার কারণ হয়ো না। আমি কি এই প্রতিশ্রুতি পেতে পারি অপরাজিতা?’

আমার চিন্তাশক্তি থমকে গেল। আমার পৃথিবীও থমকে গেল। বাতাসের আণুবীক্ষণিক কণিকাগুলোতে ভেসে ভেসে এই বাক্যদ্বয় আমার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আমি পরাস্ত হলাম মৃত্যুর পথ বেছে নিতে গিয়েও।

আমি হন্যে হয়ে ভাবতে লাগলাম সমস্তকিছু। বারংবার প্রশ্ন করলাম নিজের বিবেককে। উত্তর এলো, ‘তবে এবার না হয় একটা বারের জন্য হলেও অপরাজিতা হয়ে দেখাও। কুৎসিত আর অপবিত্র যাই হও না কেন একটাবার অন্তত অপরাজিতা হয়ে দেখাও।’

আমি যেন এক ঘোরের মধ্যে আবিষ্কার করলাম নিজেকে। অপরাজিতা! অপরাজিতা ! অপরাজিতা! হুম, আমি অপরাজিতাই হব। এর পরের গল্পটা ভিন্ন। রাস্তাটা দুর্গম আর পঙ্কিল।

আমি শত বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে আমার পড়াশোনা শেষ করলাম। পাশাপাশি আমাদের জেলার সকল এসিড নিক্ষেপ ও ধর্ষণের শিকার মেয়েদের নিয়ে নতুন উদ্যমে এক নতুন অধ্যায় রচনাতে মনোযোগ দিলাম।

পাঁচ বছর পর…

ধর্ষণ ও এসিড নিক্ষেপের শিকার হওয়া নারীদের স্বাবলম্বী করার প্রয়াসে আমাকে সম্মাননা দিতে এক বিশাল আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। আজ আমার আর কোনো আক্ষেপ নেই, নেই কোনো হতাশা, গ্লানি কিংবা পিছুটান।

আত্মহত্যা থেকেই না হয় শুরু হোক আমার বক্তব্য। হুম, আমি চেয়েছি, বহুবার চেয়েছি, নিজেকে হত্যা করতে। কিন্তু ডাক্তার সাহেবের বলা সেই কথাটা আমার ততবার মনে পড়ত। কথাটা ছিল, ‘কারো জেতার কারণ তুমি না-ই-বা হলে হারার কারণ হয়ো না। আমি কি এই প্রতিশ্রুতি পেতে পারি অপরাজিতা?’

আমার চিন্তা করার কোনো অবকাশ ছিল না। যখনই এই কথা মনে হতো আমি দিশেহারা হয়ে পড়তাম। তবে এই কথাটাই আমাকে বারবার আত্মহত্যা থেকে বাঁচিয়েছিল। তারপর আমি ভেবেছি, দীর্ঘসময় ভেবেছি, আমি কেন আত্মহত্যা করতে চাই?

উত্তর এলো, কষ্ট কমাতে, কেউ তো আমায় আর ভালোবাসে না, কেউ কেউ করুণা করে, কেউ কেউ তার আসল মুখোশটা আমার অপারগতায় উন্মোচন করেছে। কিন্তু মৃত্যু কি কষ্ট কমাতে সক্ষম? উত্তর এলো, ‘না’। মৃত্যু বড়োজোর দেহ থেকে আত্মার পৃথকীকরণ করতে পারে, তবে কষ্ট কমাতে সক্ষম নয়।

হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, ‘ঝুম! রূপই কি তোমার বেঁচে থাকার এক মাত্র কারণ? ঝুম বৃষ্টি হয়ে কি পারো না অবহেলিতের কষ্ট ঘুচাতে?’

অবশেষে বুঝতে পারলাম নিজেকে হত্যা করতে গিয়ে আমার বিবেক জাগ্রত হয়ে গেছে। তারপর আবার ডাক্তার ওয়াহিদুল ইসলামের সাথে দেখা করলাম।

‘সৌন্দর্যই কি সব? প্রগাঢ় কণ্ঠে বললেন , ‘সৌন্দর্য তো দৃষ্টিতে থাকে। এই যে আমি কতো মিষ্টি একটা মেয়েকে দেখছি। কই আমার চোখে তো কোনো খুঁত ধরা পড়ছে না।’

ডাক্তারের কথা শুনে আমার চোখে সেদিন পানি চলে এলো। আমি সেদিন সারারাত ভাবলাম। সেই রাতটা আমার জীবনের সবচেয়ে ক্লান্তিকর, কষ্টকর রাত ছিল। কারণ সেই রাতে আমি আমার মতো ধর্ষণ ও এসিডের শিকার হওয়া অন্য মেয়েদের কষ্ট, বঞ্চনা, অবহেলা, আত্মহত্যা সমস্ত অনুভব করেছিলাম আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, আমি এই অবহেলিত মানুষগুলোকে নিয়ে কাজ করব।

‘আপনি ততক্ষণ বুঝবেন না যতক্ষণ না আপনি সেই একই কষ্টের শিকার হচ্ছেন। এদের সমব্যথীর দরকার নেই, সমদুঃখীর দরকার।’ মঞ্চের সামনে বসা সকলকে উদ্দেশ্য করে বললাম।

ছয় মাস পর…

আরহান মনোযোগ দিয়ে শুনল ঝুমের অতীতের সমস্ত কথা। অবশেষে সে মুখ খুলল, ‘ভাগ্যিস! ডাক্তার ভদ্রলোক তোমাকে অপরাজিতা বলে ডেকেছিলেন। নয়তো এই অপরাজিতাকে আমি কখনও খুঁজেই পেতাম না। আর সমাজে আরও অসংখ্য অপরাজিতা স্বাবলম্বী হতে পারত না।’

‘শুধু আমাকে না উনার সকল পেশেন্টকেই একইভাবে ট্রিট করেন। এই রহস্য জানতে আমাকে অবশ্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।’

‘কী!’ আরহান অবাক হয়ে বলল।

‘হুম।’ ছোট্ট করে বলল, ঝুম।

‘তবে আপনি কেন আমাকে বিয়ে করলেন সেটা বুঝতে পারলাম না।’ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল ঝুম।

‘সব কিছু বুঝতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই।’

‘এটা শুধু বোঝা না আমার জানাও প্রয়োজন।’

‘যদি বলি ভালোবাসি বলে?’

‘বিশ্বাস করতে বলছেন?’ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চাইল ঝুম।

‘বিশ্বাস করার মতো নয় কি?’ পাল্টা প্রশ্ন আরহানের।

‘করতে মন চাইছে ভীষণ। তবে পারছি না করতে।’ বিপন্ন দেখাল ঝুমকে।

‘মনের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দাও তবে।’ ঝুমের হাতের উপর একটা হাত রেখে বলল আরহান।

‘জানতে তো পারি। তাই না?’

‘না জানলে কি খুব অসুবিধা হবে?’

‘জানলে সুবিধা হতো বুঝতে। এই কুৎসিত চেহারা কারো ভালোবাসা পাওয়ার কি কোনো যোগ্যতা আদৌ রাখে?’ ছলছল চোখে তাকিয়ে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ঝুম।

‘সৌন্দর্য দেখার দৃষ্টির উপর নির্ভর করে।’ ঝুমের চোখের জল মুছে দিয়ে প্রদীপ্ত কণ্ঠে বলল, আরহান।

আচমকা ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। বারান্দায় বসেছিল দু’জন পাশাপাশি, খুব কাছে। বৃষ্টির ছাঁট ওদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে দুটো হৃদয়ে। ঝুম, আরহানের কাঁধে মাথা রেখে ঝুম বৃষ্টি দেখছে।

“অপরাজিতারা হেরে গিয়েও জিতে যায়। হয়তো তাই অপরাজিতা ফুলের গাঢ় নীল রঙ কষ্টের প্রতীক হয়েও সকলের নিকট আকাঙ্ক্ষিত!”

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে