একজন বাবার একাকিত্বের গল্প। – ফারাবী হাসান

0
666

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০
একজন_বাবার_একাকিত্বের_গল্প।
ফারাবী_হাসান

জামান সাহেব গত একমাস ধরে যেন ঝড়ের ভিতরে বসবাস করছে।এ ঝড় যেন তার মাথার উপর দিয়ে তীব্র বেগে ঝরে তার সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে।কারন হলো তার স্ত্রী সামিয়ার ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছে।স্ত্রী আইসিইউ রুমে।বাড়িতে বৃদ্ধ মা,ছোট ছোট দু’জন ছেলেমেয়ে। মেয়ে শিলা জামান,বয়স আট,দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।ছেলে রিয়াদ জামান, বয়স মাত্র পাঁচ।খুব সুন্দর আর সুখী পরিবার সব মিলিয়ে।জামান সাহেবের নিজস্ব ইলেকট্রনিক্সের ব্যবসা আছে।টাকা পয়সা মোটামুটি খারাপ না।কিন্তু এই টাকা পয়সা দিয়ে স্ত্রী কে বাঁচাতে পারবে বলে মনে হয় না।ডক্টররা বলেছেন,একদম শেষ স্টেজে নিয়ে এসেছেন,বাঁচার সম্ভাবনা ২০%। আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করবো।আল্লাহ যদি রেখে যায়, সমস্ত শরীরে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে।
মেয়েদের এই একটা সমস্যা, শরীরে রোগ নিয়ে ঘুরবে কিন্তু কাউকে কিচ্ছুটি বলবেনা।এই না জানানোটা যেন তাদের মহত্ত্ব।রোগটা যদি হয় শরীরের সংবেদনশীল স্থানে তাহলে তো ভুল করেও জানাবে না। এই না বলে চেপে যাওয়াটা যে জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায় বুঝতে পারেনা।
বাংলাদেশে ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য হসপিটাল যেমন সীমিত, ঠিক তেমনি ডাক্তারের সংখ্যাও হাতেগোনা। জামান সাহেব স্ত্রী কে চিকিৎসা করার জন্য সবথেকে ভালো হসপিটালেই নিয়ে গেল।নিয়ে গেলেই বা আর কী হবে,একদম শেষ স্টেজে নিয়ে গিয়েছে।শুরুতেই যদি চিকিৎসা করানো হয় তাহলে ঠিক হয়ে যায়।তারপরেও ডাক্তারা তাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছেন।আর সামিয়া আইসিইউ তে জীবনের সাথে যুদ্ধ করছে।
ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে দু’টোর মুখের দিকে জামান সাহেব তাকাতে পারে না।কলিজা কেঁপে ওঠে,সমস্ত পৃথিবী মূহুর্তে আঁধার হয়ে যায়।সামিয়ার কিছু হলে সন্তানদের কি হবে এটা জামান সাহেব ভাবতে পারে না।
জামান সাহেব সামিয়ার পাশে টোলে বসে আছে।সামিয়া ওর একটা হাত ধরে রেখেছে।সামিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে জামান কান্না করে ফেললো। বাচ্চাদের মত করে কান্না করছো কেন?এখনও ত আমি বেঁচে আছি।মা,শিলা,রিয়াদ ওরা কেমন আছে?জামান কান্না গিলে উত্তর দিলো, ভালো।তুমি আমার কাছে ওদের নিয়ে আসবে?মনে হচ্ছে হাজার বছর ধরে দেখি না।বিকালে নিয়ে এসো ওদের প্লিজ। জামান সম্মতিতে মাথা নাড়লো।আর আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চাই,তুমি ব্যবস্থা কর।সুস্থ হও তারপর নিয়ে যাব।এরই মধ্যে নার্স এসে বললো ভিজিটিং আওয়ার শেষ। জামান সামিয়াকে বললো,একদম চিন্তা করো না,আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন।আমি বিকালে সবাইকে নিয়ে আসব।এই বলে জামাধ বেরিয়ে আসলো।
জামান বাড়িতে আসতেই ছেলেটা দু’হাত বাড়িয়ে দিল।জামান ছেলেকে কোলে নিয়ে চুমু খেল।বাবা,বাবা,আম্মু কোথায়?তুমি একা এসেছো কেন,আম্মুকে নিয়ে আসোনি কেন?জামান সাহেব যেন কিছু বলতে পারেনা।শুধু এটাই বলল, বাবা আমার কান্না করে না,বিকালে আম্মুর কাছে নিয়ে যাব।শিলা এসে বাবার কাছে মন খারাপ করে দাঁড়ায়।জামান এক হাতে মেয়েকে কাছে টেনে নিল। মন খারাপ করো না আম্মু,বিকালে আম্মুর কাছে যাব কেমন।শিলা মাথা নাড়ালো।অন্যদিকে জামানের মাও পাশে দাঁড়িয়ে কান্না করছেন।মা তুমি যদি কান্না করো তাহলে ওদের কে সামলাবে?বাবারে আমার যে কোন মেয়ে নাই,ওরে যে আমি মেয়ে বলে জানি,ওর কিছু হলে যে সহ্য করতে পারবোনা।সারাটা দিন একসাথে থাকতাম কিন্তু মেয়েটা যে এত বড় রোগ নিয়ে ঘুরতেছে একবারও বুঝি নাই।মা আল্লাহ কে ডাকো,তিনি যেন সব ঠিক করে দেন।
বিকালে জামান বাচ্চা দুটো আর মা কে নিয়ে হসপিটালে যায়।বাচ্চা দুটো মা কে দেখে একছুটে মায়ের কাছে চলে যায়।সামিয়াও ওদের দেখে চোখের পানি ছেড়ে দিল।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
এ যেন মা তার সন্তানদের হাজার বছর পর কাছে পেয়েছে। মেয়েটা চোখের পানি মুছে দিল।কেমন আছো আম্মু?আম্মু ভালো আছি।তোমরা কেমন আছো?ছেলেটা বললো,আম্মু আমি তোমার সাথে থাকব।মেয়েটা বললো,তুমি কখন বাসায় যাবে?এইতো খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবো। মা কান্না করবেন না একদম।আমার মা-বাবা চলে যাওয়ার পর আপনাকেই মা বলে মানি।মা আপনাকে একটা কথা বলব?হুম বলো মা।মা আমি যদি না থাকি,আপনে আমার ছেলে-মেয়ে দু্টোকে আগলে রাখবেন।আমার অবর্তমানে ওরা যেন আপনাকে পায়।মারে এভাবে বলো না,সুস্থ হয়ে ঘরের মেয়ে ঘরে যাবে।জানেন মা আমার মনে হয় আমি আর থাকবোনা।এমন অলক্ষুণে কথা মুখে নিয়ো না।কিছু হবে না,আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন।আর আমার নাতি নাতনিকে আমার জীবন দিয়ে আগলে রাখবো।ছেলেমেয়ে দুটো মাকে চুমু খেল।সামিয়া হাত দিয়ে ওদের গালে আদর করে দিলো।সামিয়ার শাশুড়ী রুম থেকে শিলা আর রিয়াদকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।তারপর জামান রুমে গেল।জামান পাশে বসলো।এমন সময় সামিয়া তার হাতে হাত রেখে বলল, একটা কথা দিবে?হুম বলো।আমার যদি কিছু হয়ে যায়,আমি বলব না যে তুমি বিয়ে করো না।শুধু দেখো আমার অবর্তমানে বাচ্চাদের যেন কোন অবহেলা না হয়।তুমি ওদের কখনো কষ্ট পেতে দিয়ো না।বুঝতে দিয়ো না যে ওদের মা পৃথিবীতে নেই।এমন ভাবে দেখে রাখবে ,ওরা যেন মায়ের অভাব বুজতে না পারে।সামিয়া কি পাগলামি হচ্ছে?কিচ্ছু হবে না তোমার।ভিজিটিং আওয়ার শেষে জামানও বেরিয়ে যায়।
সে রাতেই সৃষ্টি কর্তার ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমায় সামিয়া।পুরো পরিবার সামিয়ার শোকে পাথর হয়ে যায়।সামিয়ার মৃত্যু যেন পুরো পরিবারকে শোকের ছায়ায় ডুবিয়ে দিয়ে যায়।তারপরেও যারা বেঁচে আছে তাদের যে বেঁচে থাকার লড়াই টা চালিয়ে যেতে হবে।
ছোট রিয়াদ আর শিলাকে ওর দাদিমা ই দেখে রাখে।প্রথম দিকে রিয়াদকে সামলাতে অনেক কষ্ট হয়েছে।জামান প্রায় অনেকদিন কাজে বের হয়নি।ছেলেটার সাথে সাথে থেকেছে।জামানের মা বয়স্ক মানুষ, তাই জামান একটা কাজের বুয়ার ব্যবস্থা করলো।জামান চেষ্টা করে ছেলে মেয়ে দুটোকে আদর,যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে মায়ের অভাব পূরণ করতে।
নাহ!! জামান আর কোন বিয়ে করেনি।কারণ ছেলে মেয়ে দুটো ওর পৃথিবী। এছাড়াও সামিয়াকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলো।তাই কিছুতেই সামিয়ার জায়গা অন্য কাউকে দেয়া সম্ভব না।অবশ্য পাড়া- পড়শী দেখা হলে যে খোঁচা দেয় না তেমন না।কতজন বলে কি মিয়া এভাবে আর কতদিন থাকবা,যে চলে যাওয়ার সে চলে গিয়েছে,আবার বিয়ে করে নাও।জামান তখন কিছু না বলে নীরবে চলে আসে।
শিলা আম্মু ,
ভাই কোথায়?
ভাই ঘুমিয়েছে।তুমি পড়তে বসেছিলে,হোম ওয়ার্ক ঠিক মত করেছো তো?
হুম বাবা করেছি।দাদিমা কি করে?
নামাজ পড়ে।বিকালে কিছু খেয়েছো? চকলেট আছে না শেষ? হুম খেয়েছি,চকলেট আছে।
কী হলো আম্মু তোমার মন খারাপ?বাবাকে বলো কি চাই,বাবা এক্ষুনি এনে দিব।বাবা আম্মু কেন আমাদের নিয়ে যায়নি?আম্মুর জন্য আমার খুব কষ্ট হয়।আম্মু কি জানতো না,আম্মুকে ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে।আম্মু তোমার আম্মু তারাদের দেশে গিয়েছে, উপর থেকে আমাদের সবসময় দেখে।তুমি যদি মন খারাপ করো,তাহলে আম্মুরও যে মন খারাপ হবে।তোমার আম্মুরও যে কষ্ট হবে।তুমি কি চাও তোমার আম্মু কষ্ট পাক?
শিলা চুপ করে আছে।জামান কুলে নিয়ে আদর করে দিলো।জামান জানে এসব যে মন ভুলানো কথা,কিন্তু কিছু যে করার নাই।জামানেরও যে খুব কষ্ট হয়।
কারন তার অর্ধেক পৃথিবী জুড়ে রয়েছিল সামিয়া ।
জামান যতক্ষণ বাসায় থাকে ছেলে-মেয়ে দুটোকে নিয়েই থাকে।আর যখন থাকেনা তখন দাদিমার সাথে থাকে।খারাপ সময়গুলো এক এক করে চলে যাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে শিলা আর রিয়াদও বড় হচ্ছে। শিলা ছোট ভাইকে আগলে রাখতে শিখে গিয়েছে।দু’জন দু’জনকে চোখে হারায়।জামানও ওর সাধ্যমত চেষ্টা করে বাবা-মায়ের ভালোবাসা একসাথে দিতে।
কপাল খারাপ হলে যা হয়,সামিয়া মারা যাওয়ার পাঁচ বছরের মাথায় জামানের মাও আজ মারা গেল।জামানও এখন আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়ে।এতদিন তো মা বাচ্চা দুটোকে আগলে রেখেছে, ও নিশ্চিন্তে ব্যবসার কাজে ছুটোছুটি করতে পেরেছে। এখন যে একবারে একা হয়ে পড়েছে।যদিও শিলা এখন রিয়াদকে দেখে রাখতে পারে।শিলা ক্লাস সেভেনে আর রিয়াদ ক্লাস থ্রি তে পড়ে।জামান যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে,সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বাড়ি ফিরে। তারপর ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে থাকে।
বাবা,বাবা।হুম আম্মু বলো।বাবা ভাইয়ের জ্বর হয়েছে।কি বলো,চলো দেখি।জামান ছেলের শরীরে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর অনেকটাই বেশি।আম্মু তুমি কি পানি নিয়ে আসতে পারবে?হুম বাবা নিয়ে আসছি।শিলা পানি এনে দিল।জামান ছেলের মাথায় পানি ঢেলে, হালকা খাবার খাইয়ে তারপর ওষুধ খাইয়ে দিলো।রিয়াদ বাবা,ঘুমিয়ে যাও।ঘুম থেকে ওঠে দেখবে তুমি একদম ফিট।আম্মু চলো,রাতের খাবার খাবে।
জামান ব্যবসা আর ছেলেমেয়েদের সমানতালে সামলে যাচ্ছে। শিলা আর রিয়াদ এখন বড় হয়েছে।শিলা এখন একজন পরিপূর্ণ ডাক্তার, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ । আর রিয়াদ সিএসই তে প্রথম বর্ষের ছাত্র।জামান সাহেবের বয়স এখন শেষের দিকে।সেই কবে যে তার প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী তাকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়ে ছিল।ছেলে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে জীবন পার করে দিয়েছেন ।দ্বিতীয় বিয়ে তো দুরের কথা,সামিয়া ছাড়া তার জীবনে আর কাউকে ভাবতেই পারে না।আজ বড্ড অভিমান হচ্ছে তার সামিয়ার উপর।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে