অন্ধকারে এক চিলতে আলো পর্ব-০৪

0
1711

#অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৪

বসার মিনেট দুয়েক পরেই ভয়ে কেঁপে উঠল একটা আওয়াজ পেয়ে। বিকট একটা হাসির আওয়াজ রাস্তার পাশের গাছের আড়াল থেকে আসছে। আলো আঁচমকা হাসির আওয়াজটা পেয়ে কেঁপে গিয়ে বুকে থুথু দিয়ে গাছের আড়ালে নজর দিয়ে দেখতে লাগল বিষয়টা কী। আলোর নজর সেখানে পড়তেই খানিকটা অবাক হলো। একটা মেয়ে আর ছেলে কত অবাধে মেলামেশা করছে। মেয়েটা সিগারেট টেনে ধোয়া উড়াচ্ছে ছেলেটাও সাথে সাথে ধোয়া উড়াচ্ছে। সে সাথে মেয়েটা স্বেচ্ছায় সব বিলিয়ে দিচ্ছে।।দেখে মনে হচ্ছে বেশ বড় ঘরের মেয়ে।

” শহরের অলিগলিতে এমন অনেক ছেলেমেয়েকেই দেখা যায় যারা ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম করে অশালীন হয়ে ঘুরে বেড়ায়। নারী স্বাধীনতা মানে তো এই না যে কোনো ছেলের সাথে বসে অবাধে মিলতে হবে। সিগারেট খেতে হবে। রাত বিরাতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে। নারী স্বাধীনতা মানে এই যে সমাজে ভালো কাজ গুলোতে পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।সাবলম্বী হওয়া। আজকাল অনেক নারীরায় নারী স্বাধীনতা বলতে নেতিবাচক টায় গ্রহণ করে। ”

আলো বিষয়টা লক্ষ্য করার পর সেখানে বসার সাহস পেল না। নেশায় ডুবে থাকা দুটো ছেলে মেয়ের কাছে থাকতেও আলোর বিবেকবোধ নাড়া দিচ্ছে। কখন তারা মানুষ থেকে হায়ানার রুপ নেয় বলা যায় না। কারণ নেশা যেকোনো মানুষের মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটাতে সক্ষম।তাই আলো আস্তে করে উঠে সামনের দিকে আগালো। আগাতে আগাতে অভার ব্রিজটার নীচে আসতেই আলো দ্বিতীয় বারের মতো কেঁপে উঠল একটা মেয়ে আর ছেলেকে অভার ব্রিজের নীচের জায়গায় অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় দেখে। তারা আলোকে দেখেই সেখান থেকে উঠে সামনের দিকে যেতে লাগল। আলো বেশ ভালোই বুঝতে পারল টাকার বিনিময়ে দেওয়া নেওয়া চলছে তাদের। আলোর এবার ভয় হতে শুরু করল। কখন জানি কোন হায়েনা এসে আলোকে খুবলে খায়। এ অন্ধকার শহরের গলিতে একটা যুবতী মেয়ের একা চলাফেরা বেশ আশঙ্কাজনক। আলো যতই সামনের দিকে হাঁটতে লাগল ততই আলোর ভেতরটা কম্পিত হতে লাগল। অনিশ্চিত পথ বরাবর আলো হাঁটছে। আলো জানে না এ অন্ধকার কবে ঘুচবে। রাতের অন্ধকার হয়তো কিছুক্ষণ পর ঘুচে যাবে কিন্তু জীবনের অন্ধকার কবে ঘুচবে। ভাবতে ভাবতে সামনের দিকে আগাল। আলোর চোখ পড়ল একটা মেয়ের দিকে। লক্ষ্য করল মেয়েটা হাতে রেশমি লাল চুরি পড়েছে। কপালে বড় টিপ। চুলগুলো খোপা করা। পরনে পাতলা জরজেট শাড়ি আর স্লিভলেস ব্লাউজ। ঠোঁটে কড়া করে লিপস্টিক দেওয়া। কতক্ষণ পরপর কল ধরছে আর কার সাথে যেন কথা বলছে। আলো এক কোণে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে অবলোকন করতে লাগল। মেয়েটা কল কেটে আবার মুখের সাজগোজ হাত দিয়ে দেখছে। মাঝে মাঝে শাড়ি ঠিক করছে। এমন সময় একটা গাড়ি এসে থামল মেয়েটার সামনে। গাড়ি থেকে বেশ হ্যান্ডসাম ভদ্রলোক বের হয়ে আসলেন। বয়স আনুমানিক ৩০-৩৫ হবে। এসেই মেয়েটার হাত ধরে গাড়িতে তুললেন।

আলো বুঝতে পারলো মেয়েটা এতক্ষণ এ লোকটার সাথেই কথা বলছিল।

“শহরের অন্ধকার গলিতে কতশত অন্ধকার ঘটনা রয়েছে সেটা অন্ধকার পথে না হাঁটলে হয়তো দেখা যেত না। দিনের বেলা যারা মস্ত অফিসের সাহেব রাতের বেলায় তারা কোনো কোনো পতিতালয়ের মেয়ের খদ্দের। দিনের বেলা তারা নারী অধিকার নিয়ে চিল্লায়৷ নারী সম্মান নিয়ে চিল্লায়। রাতের বেলায় তারা নারীর সম্মান ধুলোয় লুটায়। এ হলো আজকের ভদ্র সমাজের দিন আর রাতের কাহিনি।”

আলো যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। আলো এবার সামনের দিকে আগাল। কিছু দূর যেতেই আলোর পিছু নিল এক লোক। আলো তা বুঝতে পেরে জোরে হাঁটতে লাগল। লোকটাও হাঁটতে লাগল জোরে। আর পেছন থেকে জোরে জোরে বলতে লাগল

– আরে যাও কোথাও।এদিকে এসো। ভয় পাওয়ার কী আছে। দুইশো বাড়িয়ে দিব। একদম পুষিয়ে দিব।সুন্দরী এদিকে এসো।

আলো এবার দৌঁড় লাগাল। কারণ নিজেকে আর ভোগের পন্য বানাতে আলোর ইচ্ছা হচ্ছে না। আলোর পেছন পেছন লোকটাও দৌঁড়াতে লাগল। দৌঁড়ানোর এক পর্যায়ে লোকটা আলোকে ধরে ফেলল। আলো নিজেকে ছাড়াবার বেশ চেষ্টা করছিল।তবে পারছিল না। যতই ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল লোকটা ততই আলোর এক হাত চেপে ধরছিল। আলোর পেটের দিক,কোমরের দিকে হাত দিতে লাগল।আলোর এবার অস্বস্থি হতে লাগল। ভাবলো নিজের সম্মান পুনরায় বিসর্জন দেওয়ার থেকে মরে যাওয়া শ্রেয়। তবে এ হায়ানার হাত থেকে ছুটতে পারলে হয়তো মরার চেষ্টা করতে পারবে।ছুটতে না পারলে তো তাও করা যাবে না। কী করবে বুঝতে পারছে না। এদিকে লোকটা দস্তাদস্তি করেই যাচ্ছে।।দস্তাদস্তির এক পর্যায়ে আলো লোকটার চোখ বরাবর আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিল। আলোর হাতে রক্ত মেখে একাকার।লোকটা আলোকে ছেড়ে চোখটা চেপে ধরল।আর আলো সে সুযোগে দৌঁড় লাগাল।

দৌঁড়ানোর এক পর্যায়ে আলো হাঁপিয়ে গেল। লক্ষ্য করলো একটা পার্কে এসে পৌঁছেছে। আলোর তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে।।সারা শরীরে ঘাম দিচ্ছে। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই পার্কের রমরমা দৃশ্য আলোর চোখে পড়ল। টাকার বিনিময়ে চলছে শরীর দেওয়া নেওয়ার খেলা। আলো বুঝতে পারলো এখানে থাকাও আলোর জন্য বিপদ জনক।আলো নিজের রক্ত মাখা হাতটা কাপড়ে মুছে সামনের দিকে দৌঁড়াতে লাগল। আলো জানে না এ পথের শেষ কোথায়।।কোথায় যাবে সে। শুধু জানে অন্ধকারে এক চিলতে আলোর দেখা মিলতেও পারে। প্রায় আধাঘন্টা দৌঁড়ানোর পর আলো রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ল। এবার আলো আরও চমকালো। কারণ সে লক্ষ্য করল সোডিয়াম আলোর নীচে দাঁড়িয়ে আছে অনেক সুদর্শন পুরুষ। সেখানে আবার কিছু কিছু নারী এসে তাদের থেকে একজনকে পছন্দ করে গাড়িতে তুলছে। আলো এবার হাজার কষ্টে থেকেও মনে মনে বিকৃত হাসলো। এ সমাজে শুধু মেয়েরায় ভোগের পন্য না ছেলেরাও ভোগের পন্য। টাকার জন্য তারাও এসব কাজে নামতে বাধ্য হয়। আলো নিজেকে সামলালো।

শহরের অলিগলিতে যতই আলো ছুটছে ততই একেকটা কাহিনি আলোর সামনে পড়ছে। দিনের শহর আর রাতের শহরের মধ্যে কত তফাৎ। অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে রাতের শহরটা হয়ে যায় অন্ধকারে মোড়ানো নষ্ট গলি। আর আলো ফুটার সাথে সাথে শহরটা হয়ে যায় কর্ম ব্যস্তময় প্রাণ চঞ্চল আর সজীব।

আলোর পানির পিপাসাটা বাড়তে লাগল। আলো নিজেকে সামলে নিয়ে সামনের দিকে এগুতে লাগল। আলোর পা টা আর চলছে না। ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে। শরীরে কোনো শক্তি পাচ্ছে না। তবুও কষ্ট করে সামনের দিকে এগুচ্ছে। এগুতে এগুতে একটা গাছের সামনে এসে হেলান দিয়ে বসলো। চোখটা বুজে আসছে আলো। এমন সময় আলো একটা লাঠির স্পর্শ পেল। আচমকা এমন লাঠির স্পর্শ পেয়ে আলো চোখটা মেলে দেখল পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। আলোকে চোখ খুলতে দেখেই জিজ্ঞেস করল

– এখানে কী?

– নাহ তেমন কিছু না স্যার।

– বাসা কোথায়?

– সামনেই।

– তাহলে এখানে কী? রাস্তায় নেমেছিস নষ্টামি করতে নাকি?

– মুখ সামলে কথা বলুন।

– মুখ সামলাবো কেন? এত রাতে রাস্তায় বসে আছি কিছু বুঝি না ভাবছিস। চল থানায় চল।

– আমাকে থানায় নিবেন না স্যার। আপনি যা ভাবছেন আমি তা না।

লোকটা মুচকি হেসে বলল

– তুই বললে তোকে কিছুই করব না। আমাকে একটু খুশি করলেই হবে।

পুলিশটার কথা শুনে আলোর বুকটা কেঁপে উঠল। এদের হাতে নাকি নিরাপত্তার দায়ভার। অথচ এদের থেকে নিরাপদ থাকাটা সবার আগে জরুরী।এরা তো নিরাপত্তা দেওয়ার নামে নিরাপদ মানুষটাকে বিপদে ফেলে। তবে পুলিশ সমাজে এর ব্যতিক্রম ও আছে যারা নিরাপত্তা দিতে তৎপর। তবে তার পরিমাণ সংখ্যালঘু। আলো পুলিশটার কথা শুনে কিছু না বলেই তৎক্ষনাৎ উঠে দৌঁড় দিল। পুলিশটা পিছু নিলেও আলো নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হলো।

আলো দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে কোথায় এসে পৌঁছেছে সে নিজেও জানে না। এ রাস্তায় কোনো সোডিয়াম আলো ও নেই। পুরো রাস্তাটা বিদঘুটে অন্ধকার।এ অন্ধকারটায় আলোর ভয়ের কারণ।অন্ধকারটা এতই প্রখর যে আলো শুধু নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পারছে এছাড়া কোনো আওয়াজ বা কিছু দেখতে পারছে না। আলোর মাথাটা প্রচুর রকমে ঝিমাতে লাগল। তার চোখ গুলো বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। মাথায় অসহ্য ব্যথা সে সাথে পেটের ক্ষুধা। সব মিলিয়ে আলো ক্লান্ত। অন্ধকারে শুধু হেঁটেই যাচ্ছে সে। নীলার কথা মনে পড়ছে তার। জানে না সে নীলা কোথায় আছে। সে কী পেরেছে এসব মোকাবেলা করতে। নাকি সে এতক্ষণে কারও খাদক হয়ে গেছে৷ কথাটা মনে আসতেই আলোর হার্টবিট বেড়ে কম্পন দিতে লাগল। নীলার জন্য খুব মন খারাপ লাগতে লাগল আলোর। কারণ নীলার সাথে থাকলে হয়তো চলার পথটা আরও মসৃন হতো। সামনের দিকে এ অন্ধকারে কোথায় যাচ্ছে জানে না সে। কোথায় থেকে যেন কুকুরের কান্না আসছে। কুকুরের কান্নাটা আলোর বেশ অসহ্য লাগছে৷ সারাশরীর অবশ হয়ে যেতে লাগল। চোখ গুলো শত চেষ্টার পরও খুলতে পারছিল না। একটা সময় মাটিতে নেতিয়ে পড়ল।

অনেক্ষণ পর চোখটা যখন খুলল তখন ভোরের আলো, তার চোখে পড়ল। সে চোখটা খুলে আশপাশ তাকাল। একটা পরিপাটি রুমে সে শুয়ে আছে। আলো বুঝতে পারছে না সে কোথায়। আলো কিছুটা অবাক হয়ে উঠতে নিলেই কেউ একজন পেছন থেকে আলোর মুখটা চেপে ধরল। আলোর ভেতরটা কম্পিত হলো।।ভাবতে লাগল সে কী আবার কোনো নোংরা লোকের পাল্লায় পড়ল। ভাবতে ভাবতেই আলো পেছন ফিরে তাকাতেই ভয়টা তার আরও বেড়ে গেল।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে