অন্ধকারে এক চিলতে আলো পর্ব-০৫

0
1600

#অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৫

ভাবতে ভাবতেই আলো পেছন ফিরে তাকাতেই ভয়টা তার আরও বেড়ে গেল। আলো খেয়াল করল একটা ছেলে তার মুখটা চেপে ধরেছে। ছেলেটার মাথায় ঝাঁকরা কুকড়া চুল। গালে খুচা খুচা দাঁড়ি। গায়ের রঙ শ্যাম বর্ণ। নাক বুচাও বলা যায় না আবার খাড়াও বলা যায় না৷ দুয়ের মাঝে বলতে হবে। চোখ গুলো একটু বড় বড়। ছেলেটাকে দেখে আলোর আশার আলো যেন নিভে গেল। বুঝতে পারল সে আরেকটা হায়েনার কবলে পড়েছে। আলো তার চোখের দিকে তাকাল। কিন্তু একটা হায়েনার চোখ এত নিষ্পাপ কেন মনে হচ্ছে। কেন জানি না এ ছেলেটাকে আলো হায়েনা ভাবতে পারছে না। কেননা একটা হায়েনার চাহুনি তো এত সুন্দর হতে পারে না। সে অপলক দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখে চেপে ধরা ছেলেটার হাতটা নিজের হাত দিয়ে ছুটাতে চাইতে নিলেই ছেলেটা হাতটা ছেড়ে দিয়ে নিজের আঙ্গুল দিয়ে ঠোঁট চেপে আলোকে ইশারা দিয়ে বলল

– চিৎকার চেঁচামেচি করবেন না দয়াকরে। মা বিষয়টা অন্যভাবে নিতে পারে। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না। রাস্তায় আপনি পড়ে ছিলেন। আপনাকে সেখান থেকে তুলে বাসায় এনেছি। মাকে বলেছি আপনি আমার বন্ধুর বোন। এখানে হোস্টেলে থেকে পড়েন। হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আর আমার বন্ধু গ্রামে তাই আপনাকে আমার বাসায় নিয়ে এসেছি। আমার মা অনেক কড়া মানুষ। আপনি যদি বিষয়টা না বুঝে আমাকে ভুল বুঝে চিৎকার করে বসেন তাহলে মা ভুল বুঝবে। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না। এসেছিলাম আপনার জ্ঞান ফিরেছে কী না দেখতে। কারণ গতকাল ডাক্তার দেখে বলল যেকোনো সময় আপনার জ্ঞান ফিরতে পারে। রাতে অনেকবার দেখে গিয়েছি। সকালে এসে দেখলাম আপনার জ্ঞান ফিরেছে। মনে হলো আপনি চেঁচিয়ে উঠবেন। তাই মুখটা চেপে ধরেছি। দয়া করে চেঁচাবেন না।

বলেই ছেলেটা আলোর কাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে বসলো। আলো হালকা দম নিতে লাগল। সে সাথে ঢুক গিলতে লাগল। একটু স্বস্তি যেন আলো পেল। সে মৃদু গলায় ছেলেটাকে জবাব দিল

– আপনার এ উপকারের কথা ভুলব না।আপনি যা বলবেন আমি আপনার মা কে তাই বলব। কিন্তু আমাকে একটা সাহায্য করবেন দয়াকরে। আর আপনার নাম কী?

ছেলেটা মুচকি হেসে বলল

– আমার নাম তানভীর। সবে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি। টুকিটাকি গান করা আমার শখ। সে সাথে আঁকাআঁকির একটা বদঅভ্যাস আছে। দুই ভাই আমার। বড় ভাই বিদেশে থাকে। সেখানেই পড়াশোনা করছে। আর আমি বাংলাদেশে। বাবা মারা গেছেন সে ছোট্ট বেলায়। এরপর থেকে মায়ের হাতে মানুষ। বাবার বিশাল ব্যবস্যা আর আমাদের মানুষ করার দায়িত্বটা মায়ের হাতেই পড়ে। মা খুব কঠিন আবার খুব নরম ও বলতে পারেন। বাবার মৃত্যুর পর মা কঠোর পরিশ্রম করে আমাদের ব্যবস্যাটা বাড়ায়। আর আমাদের মানুষ করে। এ পরিবারে সবকিছু মায়ের কথায় চলে। গতকাল একটা কনসার্টে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় গাড়ির আলোতে লক্ষ্য করলাম কী যেন রাস্তায় পড়ে আছে। একটু ভয় ও লাগছিল কারণ অনেকে বলে রাস্তাটা ভুতূরে রাস্তা।মায়াবী আত্মারা নাকি সে রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়। ভেবেছিলাম কোনো আত্মা হবেন তবে মনে সাহস নিয়ে নেমে দেখলাম আপনি আমার মতো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। এভাবে এত রাতে ঐ রাস্তায় ফেলে আসতে মন সায় দিল না। তাই সাথে করে নিয়ে এসেছি। মাকে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না তাই ঐরকম বলেছি। আরও কিছু বলা লাগবে? আপনি আরও প্রশ্ন করার আগেই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলাম।

আলো শুধু অপলক নয়নে তানভীরের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা কতটা সাবলীল হয়ে এক নিঃশ্বাসে সব বলে যাচ্ছে। আলোর মনে হচ্ছে তানভীরকে সে যুগ যুগান্তর ধরে চেনে। আলোকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তানভীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বলল

– কী হয়েছে কী ভাবছেন? গড়গড় করে কথা বলে যাচ্ছি। আপনি কোনো কথা কেন বলেছেন না? কথা শেষ করে বসে আছি আর আপনি আমার দিকে তাকিয়ে কী দেখছেন? নাকি আমার দিকে তাকিয়ে অন্য কাউকে ভাবছেন?

আলো মৃদু গলায় জবাব দিল

– তেমন কিছু না। আপনি বেশ সাবলীল ভাবে কথা বলছিলেন সেটাই শুনছিলাম। ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য।

– ধন্যবাদ দিতে হবে না৷ আচ্ছা আপনি ঐ রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন কেন? আর আপনার শরীরেও টুকিটাকি আঘাতের চিন্হ আছে। ছিনতাই কারীর কবলে পড়েছিলেন?

আলো তানভীরের এ প্রশ্নের জাবাব কী দিবে বুঝতে পারছে না। তানভীরকে কী সে তার জীবনের সব বলে দিবে নাকি লুকাবে। তার মনে হলো সে যদি তানভীরকে তার কালো অধ্যায়ের কথা বলে তাহলে তানভীরও তার সুযোগ নিতে পারে। তানভীরকে বুঝতে দেওয়া যাবে সে অসহায়। ঘুরিয়ে পেচিয়ে অন্য উত্তর দিবে। আলো হালকা কাশি দিয়ে বলল

– নাহ ছিনতাইকারীর হাতে পড়েনি। বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি।

তানভীর গাল দুটো ফুলিয়ে মুখে সবটা বাতাস ঢুকিয়ে পরক্ষণে তা ছেড়ে দিয়ে বলল

– বাসা থেকে পালিয়ে এসেছেন মানে?

– আমার বাবা আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল।ছেলেটা একদম ভালো না। জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল আর কী।ছেলে আমার থেকে পঁচিশ বছরের বড়। আমার সবে ষোল।( বয়সটা দুই বছর আলো লুকালো কারণ তার মনে হলো সে কমবয়সী সেটা তানভীরকে বললে তানভীর বিষয়টা মিথ্যা মনে করতে পারে) অল্প বয়স তার উপর বিয়ের চাপ নিতে পারছিলাম না। বিয়েতে মোটেও রাজি ছিলাম না। তাই রাজি করানোর জন্য বাবা গায়ে হাত তুলে। আর তার জন্যই শরীরে আঘাতের চিন্হ। গতকাল রাতে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তাই বাসা থেকে পালিয়ে চলে এসেছিলাম। কখন যে জ্ঞান হারালাম খেয়ালেই নেই।

তানভীর অবাক হয়ে বলল

– তাই বলে বাসা থেকে পালাবেন। এত সাহস আপনার?

– আমার মতো পরিস্থিতিতে পড়লে বুঝতেন। আর আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।

– তাহলে তার সাথে পালাতেন। একা পালাতে গেলেন কেন?

– সে তো এ দেশে নেই। সে ও আপনার ভাইয়ের মতো বিদেশ থাকে। তাই বাধ্য হয়ে একা পালিয়েছি। আপনি দয়াকরে আমাকে একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিবেন।

– বেশ মুশকিলে ফেললেন। মাকে কী বলব বুঝতে পারছি না। মা কে তো বলেছিলাম আপনি এখান থেকে সুস্থ হলে চলে যাবেন। চিন্তায় পড়ে গেলাম আপনার কথা শুনে। দেখা যাক কিছু করতে পারি কিনা।

আলো হাতটা জোর করে তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল

– দয়াকরে রাজি করাবেন। আমি জানি আপনি পারবেন। তারপর আমার প্রেমিক চলে আসলে আপনি যা চান তাই দেবো।

– লোভ দেখাচ্ছেন আমাকে?

আলো নিজের জিভে নিজের দাঁত দিয়ে কামড় দিয়ে বলল

– আরে লোভ দেখাব কেন। সত্যি বলছি।

– তাহলে ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

– ঘুষ কেন হবে? সেটা আমি খুশি হয়ে দেবো। আর খুশি হয়ে কিছু দেওয়াকে ঘুষ না হাদিয়া বলে। বুঝছেন?

– বুঝলাম। সাহায্যটা করতাম না যদি সুযোগ্য পাত্রের সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর পালিয়ে আসতেন। যেহেতু বলেছেন পাত্র ভালো না আর পরিবারও আপনাকে সাপোর্ট করছে না তাই যেভাবে হোক মাকে বুঝিয়ে এখানে থাকার ব্যবস্থা করব। তবে আমি যা বলি তাই করবেন। নাহয় মাকে ম্যানেজ করা কষ্ট হয়ে যাবে।

আলো মাথাটা নেড়ে বলল

– আপনি যা বলবেন তাই করব।

কথাটা বলা শেষ করতে না করতেই তানভীরের মা জাহানারা সুফিয়া রুমে প্রবেশ করলেন। জাহানারা সুফিয়া প্রবেশ করার সাথে সাথে তানভীর একদম চুপ হয়ে গেল। আলো লক্ষ্য করল মহিলাটা দেখতে অনেক সুন্দরী। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে অনেক সতেজ। চেহারায় বয়সের কোনো ছাপ নেই। এত বড় বড় দুটো ছেলে আছে উনাকে দেখে কেউ বলবে না। উনার মুখের এক কোণে হাসির বিন্দু পরিলক্ষিত করলো আলো।।সে ভাবতে লাগল তানভীর উনাকে কেন এত ভয় পায়। দেখে মনেই হচ্ছে না উনার মধ্যে কোনো রাগ আছে। আলো পরক্ষণে ভাবলো উনি কতটা ভালো স্বামী মারা যাবার পর নিজের সন্তান নিয়েই বাকিটা জীবন কাটিয়েছে৷ অথচ আলোর মা নিজের স্বামীকে নিজে খুন করেছে। পৃথিবীতে নেতিবাচক দিকের বাইরে এসব ইতিবাচক দিক আছে বলেই হয়তো পৃথিবীটা এখনও সুন্দর,এখনও টিকে আছে। আলোর ভাবনার বিচ্যুতি ঘটল জাহানারা সুফিয়ার ডাকে। উনি নরম সুরে বললেন

– কী অবস্থা এখন? আর শরীর কেমন লাগছে?

আলো মৃদু সুরে জবাব দিল

– অনেক ভালো লাগছে এখন।

– নাস্তা কী কেউ দিয়ে গেছে?

আলো মাথা নেড়ে না বলল। জাহানারা সুফিয়া তানভীরের দিকে কটু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল

– নাস্তা দিতে বলো নি কাউকে কেন?

– মা মাত্রই জ্ঞান ফিরল ওর।

– নাস্তা দিতে বলো। আর আমি অফিসে যাচ্ছি। সে আমাদের অতিথি খালাকে বলবে যত্নের ত্রুটি যেন নাহয়। আর ওর ভাই কী গ্রাম থেকে ফিরেছে?

তানভীর ঢুক গিলতে গিলতে বলল

– নাহ,মা ফেরে নি।

– আচ্ছা আমি গেলাম। ফিরলে আমাকে জানিও।

কথাটা বলে রুম থেকে বের হতে নিয়েও আবার রুমে ঢুকে আলোর দিকে তাকিয়ে বলল

– তুমি কোন স্কুলে পড়ো বা কলেজে? আর নাম কী তোমার?

আলো মৃদু গলায় জবাব দিল

– আমার নাম আলো।

জাহানারা সুফিয়া কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল

– তানভীর বলল তোমার নাম তরী। তুমি বলছো আলো।

মায়ের এমন প্রশ্নে তানভীরও কিছুটা বিভ্রত হয়ে গেল। ভাবতে লাগল ধরা পড়ে যাবে না তো। এর মধ্যেই আলো চট করে জবাব দিল

– আমাকে বাসায় সবাই আলো নামে ডাকে আর স্কুলের সবাই তরী নামে ডাকে।

– ওহ! তাই বলো। কোন স্কুলে পড়ো? আর কোন হোস্টেলে থাকতে?

আলো এবার ঢুক গিলতে লাগল। ভাবতে লাগল কী জবাব দিবে। ধরা পড়ে যাবার উপক্রম। তানভীরও বেশ দুটানায় পড়ে গেল। বুঝতে পারছিল না এর উত্তর কী দিবে? দুজনের মাথায় যেন বাজ পড়ল। আর ধরা পড়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা অনুভব করল। ঠিক এ মুহূর্তে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে