অন্তর্দহন প্রণয় পর্ব-১২

0
1875

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১২।
নিঃস্পৃহ, নিস্তব্ধ আরেকটি দিন কেঁটে গেলো অভিনবের জীবন থেকে। ক্যারিয়ারের পাঁচটি বছর কেঁটে গেলো অগোচরে। ছোট থেকেই ডাক্তার হওয়ার প্রতি ঝোঁক ছিল । বাবা ডাক্তার, মা ডাক্তার। ডাক্তারী পরিবেশেই বেড়ে উঠা। এক সময় শখ তার পর প্রফেশন। অনেকটা রবোটিক্সদের মতো, টাইম মাফিক চলছিলো সব। টাকা, পয়সা, পাওয়ার থাকা শর্তেও কি জানি ছিলো না তার জীবনে। বড্ড রুক্ষ সুক্ষ্ম জীবন। মনে হচ্ছিলো সে এক জন্তু যার হাত পায়ে বেঁধে দেয়া হয়েছে ভাড়ী বন্ধনে। গন্ডিতে টেনে দিয়া হয়েছে অদৃশ্য রেখা৷ রেখা পার কার শক্তিটুকু যেন কেউ কেড়ে নিয়েছে। ঠিক এই বাধ্যবাধকতার জীবনে ভাঁটা ফালিয়ে উদ্দীপ্ত হলো রুফাইদা নাওরিন। লাগামহীন জীবন, হাসোজ্জল মুখ, সরু নাক, পিঠে ঢেউ খেলানো কালো চুল। শুভ্র রং আর ঘন ভ্রু যুগলের নিচে কালো কুচকুচে চোখ জোড়া। কত মায়া, কত গম্ভীর সেই চোখ জোড়ায়। হাসলে মনে হতো তার চোখ জোড়াও হাসচ্ছে। মেয়েটি সব সময় তার থেকে পালিয়ে বেড়াতো। অভিনব এক পলক তার দিকে তাকাতেই সে যেন মুর্ছা যেত। লজ্জাবতী গাছে যেমন স্পর্শ করলেই লজ্জায় গুটিয়ে নেয়? ঠিক তেমনি ছিলো তার রুফাইদা। ডা. অভিনবের বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। ঝংকার ময় কন্ঠ আজ গম্ভীর, আহত, ব্যাথাতুর, কন্ঠনালি বাক্যহীন।

ডা. অভিনব দাঁড়িয়ে আছে তার সুবিশাল প্রকন্ড বাড়ির, দোতালার গোল বারান্দায়৷ দক্ষিণা মুখ রুমটি। নিস্তব্ধ ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে দাড়িয়ে আছে বারান্দার কার্নিষ ঠেষ দিয়ে। পড়নে তার কালো টাউজার আর গায়ে ছাই রঙ্গা গেঞ্জি। উষ্কখুষ্ক চুল। হাতে তার একটি রুপোলী কারুকার্য সম্পন্ন ছবি ফ্রেম। রুমের মাঝে থেকে ভেসে আসা কম আলোয় ঝিলিক দিচ্ছে একটি তরুণীর খিল খিল কিশোরী হাসি। ডা. অভিনব আজওয়াদ এই ছবিটি ক্যাপচার করেছিলেন রুফাইদার অগোচরে। সব সময় গম্ভীর আর রোবট মানুষটিকে প্রাণ দিয়ে গেছিলো এই হাসিটি। চোরা চোখে পর্যবেক্ষন করে যেতে এই রমনীকে। বুঝতেই পারেনি কবে, কখন, কিভাবে এই রমণীর ভালোবাসায় হাবুডুবু খেতে শুরু করে দিয়েছিলেন। সেবার রুফাইদা সাতদিনের গায়েব হওয়াতে পাগল পাগল হয়ে গেছো অভিনব। অথচ আজ একটি বছর এ মেয়েটি নেই। কিভাবে দিন পারি দিচ্ছে অভিনব? তা শুধু সেই জানে?দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে মাস গড়িয়ে বছর পাড় হলো দুয়েক। আজকেই তো নাকি মেয়েটি প্রথম এ পৃথিবীতে প্রথম চোখ খুলে ছিলো? সেতো চাইতো? রুফাইদার প্রতিটি জম্মদিনে তার মুখে দেখেই হবে। সবার আগে জানাবে সে। কিন্তু হায়? চাইলেই কি সব পাওয়া যায়? শুনেছে মরার পরে যাকে বেশি ভালোবাসে পৃথিবীতে সেই রূপ নিয়েই নাকি সাথী হয় কেউ? সত্যি এমন হলে, অভিনব দোয়া করে প্রতিটি নামাজের পর, রুফাইদাই যেন তার সঙ্গী হয়।

এক দমকা হামকা হাওয়ায় বারান্দায় থাকা উইনজারটি নাড়িয়ে দিলো টং টং করে বেঁজে সেটি। দোল খেলে গেলো তার ঝাঁকড়া চুল গুলো। নিস্তব্ধ ঘরটিতে তখন ঢং ঢং শব্দ রাজ্য করতে লাগলো ঘড়ির কাঁটা। ডা. অভিনবের সেদিকে কোনো খেয়াল, ধ্যান নেই। রুফাইদা তার থেকে সব সময় পালিয়ে বেড়াতো, আড়াল করতো নিজেকে। সত্যি সত্যি সে আড়াল করে ফেললো একে বারে। অশ্রুশিক্ত, নিষ্প্রভ চোখে চেয়ে, ছবির ফ্রেমটিতে চুমু খায়। ছবিটিতে অতি আদরে ছুঁয়ে যায় তার হাত। অস্পষ্ট, ধরে আসা গলায় বলে উঠে,

“হেপি বার্থ ডে রূপ! মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দা ডে? সুখে থাকো তুমি। যেখানেই থাকো। মনে রেখো। আই লাভ ইউ। আই মিস ইউ!”

দু ফোঁটা গরম নোনা জল গড়িয়ে পড়ে ছবির ফ্রেমটিতে থাকা রুফাইদার হাস্যোজ্জ্বল মুখে।

——————

“হেপি বার্থ ডে বড়পু!”

সিক্ত চোখ আর ভাঙ্গা হৃদয় নিয়ে তাকিয়ে আছে জয়নব, তাদের বাসার বসার ঘড়টিতে খুব বড় করে টানানো রুফাইদা আর তার বাবা-মার ছবিটির দিকে। কত প্রাণবন্ত এই ছবিটি। ঘরময় যেন গুঞ্জন হচ্ছে খিল খিল করে রুফাইদার হাসি। এই ঘরের প্রতিটি ছবিতে তিন জন ব্যক্তি উপস্থিত। কোনো ছবিতে জয়নব নেই। কেনো নেই? এ প্রশ্নটি সে জানে। আগে না জানলে আজ জানা হয়েছে। আজ রুফাইদা জম্মদিন। নাজমা আজ নিজ থেকে ফোন করে ডেকে এনেছেন জয়নবকে। রুফাইদা মরে যাওয়ার পর তিনি কথা বলতেই যেন ভুলে গেছিলেন। ভুলেগেছিলেন স্বামীর কথাও। সাইফ মরে যাওয়ার পর যেন একে বারে নেতিয়ে গেছেন নাজমা। কিন্তু আজ এত বছর পর মায়ের কন্ঠ শুনে হল ছেড়ে এক প্রকার ছুটেই চলে আসে বাসায়। কিন্তু এখানেই যে তার পুরো দুনিয়া উল্টে যাবে জানা ছিলো না জয়নবের। নাজমার ছোট বাই ওয়াহিদ এসেছেন বিদেশ থেকে। নাজমাকে তার সাথে নিয়ে যাবে। নাজমা নিজেও সায় দিয়েছে। যেখানে মেয়ে আর স্বামী নেই? সেখানে একা পড়ে থেকে কি লাভ? জয়নব এসব শুনে থমকালো কিছুক্ষণ। মাথার নার্ভে নাড়া দিয়ে গেলো একটি প্রশ্ন,” আমি কে তাহলে? মা কি আমাকে ভুলে গেছে? ”

কথাটি কোনো মতেই হজম হলো না জয়নবের এক আকাশকুসুম বিস্ময় আর সঙ্কা নিয়ে জিগ্যেস করলো,

“মা আমি কি তোমার কেউ না? আমাকে একা করে কেন চলে যেতে চাইছো?”

“নাহ্ তুমি আমার সন্তান না। ”

আকাশের বুক ফেঁটে আচমকা এক বাজ যেন পড়ে গেরো জয়নবের মাথায়। ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো। হাসার চেষ্টা করে বলল,

” মা.. মা তুমি আমার সাথে দুষ্টামি করছো তাই না? আমার ভালো মা প্লিজ এ…এমন দুষ্টামি করোনা। কেন মিছে মিছি এসব বলছো?”

নাজমার চোয়াল শক্ত। স্থীর তার দৃষ্টি। শ্যামকায় এই মেয়েটির উপর তাকালেই রাজ্যের ক্রোধ ভর করে তার মাঝে। ছোট বেলায় যখন সাইফ মেয়েটি এনে তার কোলে দিয়েছিলো? নাজমা তখন বড্ড অবাক। ভেবে ছিলো কুঁড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। কিন্তু পরক্ষণেই সাইফের কথা পুরো দুনিয়া উল্টে পাল্টে গেছে। ভেঙে গেছিলো তার মন, বিশ্বাস, সংসার। তবুও সামলে নিয়েছিলো নিজেকে সে। নাজায়েজ বাচ্চাটিকে যতবার চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখলে পিত্তি জ্বলে যেতে। কিন্তু কিছুই বলতেন না তিনি। কিন্তু আজ? আজ বলতে বাধ্য। এই মেয়েটির মা তার এককালের বান্ধবী ছিলেন ঘনিষ্ঠ। সাইফকে সেও নাকি চাইতো। কিন্তু সাইফ তার হৃদয় দিয়ে চেয়েছে নাজমাকে। কিন্তু জয়নবের মা ছলচাতুরী করে একরাতে সাইফকে ড্রাগ দিয়ে দেয়। এবং নিজের কার্য হাসিল করে ফেলে। যার ফল এই জয়নব। কিন্তু কখনো নাজমা বুঝতে দেয়নি এক মাত্র সাইফের জন্য। সে সব সময় এক কথাই জপে গেছে,

“দোষ না হয় ওর মা করেছে। কিন্তু ও তো আমারো সন্তান। সে যেভাবেই হোক!”

এই কথার পর মুখের রং পাল্টে যেত। রাগে গজগজ করতে করতে বিনা কারণে দু ঘা বসিয়েও দিতেন জয়নবের পিঠে। ছোট জয়নব ব্যথায় গোঙানির শব্দ নাজমা যেন পৈশাচিক সুখ পেতেন। এভাবেই দিন যেতে লাগলো। এক ঘঠনায় ধপ করে মনের আগুন নিভে গেছিলো নাজমার। রুফাইদাকে আগুনে পুড়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে মেয়েটি তার মনের কোনে এক শীতল স্পর্শ করেছিলো ঠিকি কিন্তু আজ সব পাল্টে গেলো এক উইলে। সাইফ তার সকল সহায় সম্পত্তি জয়নবের নাম করে দিয়েছে। ওয়াহিদ এটা জানার পর আরো কান পড়া দিয়েছে। সব শুনে নাজমা অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে। তার সকল সহায় সম্পত্তি রুফাইদার নামে ছিলো, রুফাইদা নেই বলেই জয়নবের নাম হয় গেছে এটা তিনি হজম করতে পারছেন না। তার মন চাইছে সব বেঁচে অনাথালয় নয়ত মসজিদ মাদ্রাসায় বিলিয়ে নিঃস্ব করে দিতে মেয়েটিকে। কিন্তু তার হাতে কিছু নেই। সে না চাইতে মেয়েটিকে সহ্য করতে পাড়ছে না। মেয়েটি কেঁদে যাচ্ছে। লাল নাক মুখ। কিন্তু কি সুশ্রী মুখ মেয়েটির ঠিক তার মায়ের মতো যেন। নাজমার রাগ নিভু নিভু হয়েছিলো খানিকটা। জয়নবের মার কথা মনে আসতেই ধাক্কা মেরে জয়নবকে সরিয়ে দেয় তার থেকে। আর কোনো ভনিতা ছাড়াই বলে উঠে,

“না আমি তোমার মা আর না তুমি আমার মেয়ে। আমার মেয়ে একজন ছিলো যে মরে গেছে। আর তার সহায়সম্পদে ঘাপটি মেরে বসে আছো তুমি! আমি এসব কিছুই চাইনি। বাঁচতে চেয়েচিলাম আমার মেয়ে, স্বামী নিয়ে, যখন তারাই নেই তো এখানে আর থেকে কাজ নেই।”

নাজমা উঠে পড়লো। জয়নব হাউ মাউ করে কাঁদছে। এত এত সত্যের ভিতরে মরে যেতে চাইছে সে। বাঁচতে চায় না কোনো রকম। সে নাজমার পা জড়িয়ে ধরলো। হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

” ও মা। ওমা যেয়ো না। আমি মরে যাবো আমাকে একা রেখে যেয়ো মা প্লিজ যেয়ো না।”

নাজমা শুনলেন না। যেন কানের মাঝে তুলো গুঁজে আছেন। পা ছাড়িয়ে যখন পাচিল ছাঁড়াবে তখনি জয়নব চেচিয়ে উঠলো বললো,

“বড়পু বেঁচে আছে মা। আমার জন্য না হয়। বড়পুর জন্য থেকে যাও মা!”

নাজমা থমকালো। পা থেমে গেলো। কিছু মুহূর্ত সময় নিলো বোঝার বুঝতে পেড়েই চকিতে তাকালেন তিনি। উপলব্ধি করলেন তার গা কাঁপছে। তীব্র ব্যাথা অনুভব করছেন বুকে৷ হাহাকার জীবনে এক ফুঁটো সুখে ছোয়া খেলে গেলো নাজমার চোখে মুখে। নাজমা দৌঁড়ে এগিয়ে এলো। জয়নবের সামনে বসে পড়লো। টলমলে চোখে বলল,

“আমার মেয়ে কই জয়নব? কই আমার মেয়ে? নিয়ে আয় ওকে৷ নিয়ে আয়?”

জয়নব বুক ভরা ব্যথা নিয়ে মায়ের মুখে চাইলো। আহ্ কত ব্যাকুলতা তার মায়ের নিজ সন্তানের জন্য। আর তার জন্য? এই মায়ের বুকে নেই ভালবাসা, নেই মায়া, নেই স্নেহ। আছে শুধু অঢেল ঘৃণা। জয়নব বেড়িয়া আসে দীর্ঘশ্বাস সপ্তপর্ণ গিলো নিলো। মায়ের চোখ জোরা মুছে দিয়ে আবেগী গলায় বলল,

“মা তোমার রূপ তোমার কোলে জলদি ফিরে আসবে। আর তার সহায়সম্পদ সব তারই থাকবে। চিন্তা করো না মা। আমি তোমার সন্তানকে তোমার বুকে ফিরিয়ে দিবো। খুব জলদি!”

নাজমা কাঁদতেই লাগলেন। তার মেয়ে বেঁচে আছে এটিই যে বড় শান্তি।

——————

নাজমা ঘুমিয়ে আছেন। ওয়াহিদ অনেক কটু কথা বলে চলে গেছেন। বলে গেছেন সে আবার ফিরবে নিয়ে যাবে তার বোনকে। কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল নেই জয়নবের। সে বসে আছে রুফাইদার রুমটিতে। হাতে তার একটি চিঠি। ঠিকানা হী। রুফাইদাকে আটকে রাখা হয়েছে। কে বা কারা করেছে কিছুই লিখেনি রুফাইদা।রুফাইদা গোটা গোটা অক্ষরের লিখা তার চেনা। হাতে চিঠিটি সে আবার খুললো। সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়লো যেন রুফাইদার শরীরের। জয়নব চিঠিতে নাম লাগিয়ে ঘ্রান নিলো৷ কান্নায় জড়জড়িত হয়ে আবারও পড়লো চিঠিটি,

প্রিয় বাবা,

তুমি হয়তো জানো আমি মারা গেছি। নেই অস্তিত্ব এই দুনিয়ায় আমার। কিন্তু বাবা আমি বেঁচে আছি মরার মতোই। নিত্যদিন মরছি। জানো বাবা? এখানে সবাই মরে প্রতিদিন রাতে। আমিও মরি। আমার গায়ের প্রতিটি আঘাত মরণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। আমি প্রতিদিন ভিক্ষা করি মরণের কিন্তু হয় না। আমাকে বাঁচাও বাবা। রক্ষে করো আমাকে। আমি আবারো তোমার কোলে মাথা রাখতে চাই বাবা। মায়ের হাতে রান্না কত দিন খাই না। যানো বাবা এখানে দু, তিন চলে যায় তারে খেতেও দেয় না।বাবা তোমাকে খুব মনে পড়ে। মাকেও মনে পড়ে। মনে পড়ে সেই ভয়ানক রাতের কথা। বিশ্বাস করো বাবা আমি জানতাম না তারা আমার সাথে ডাবল ক্রস করবে। ভাবিনি বাবা তারা আমাকে এমন এক পৃথিবীর সদস্য করে দিবে যেখানে আলো বাতাসের দেখাও মিলে না। বাবা আমাকে মুক্ত করো। আমি বাঁচতে চাইম মুক্তি চাই এই নরক যন্ত্রনা থেকে। মুক্তি চাই মানুষ খেকো মানুষদের থেকে। মুক্তি চাই!

ইতি,

তোমার রূপ

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে