অন্তর্দহন প্রণয় পর্ব-১১

0
1813

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১১।
সেদিন আমি কেঁদে কুঁটে বাসায় চলে যাই। সাত দিন পর আবার ফিরে আসি মনের সাথে লড়াই করতে করতে। ঠিক সেই দিনেই ঘটলো অদ্ভুত ঘটনা…।আমি ক্লাসে যাচ্ছিলাম। দুতলার শেষের দিকটায় আমাদের ক্লাস। ডান পাশ পুড়োটাই খালি রুম গুলো পড়ে আছে। আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম। বর্ষাকালের স্ব স্ব হীম শীতল বাতাস বইছে। মিষ্টি বাতাস। ওরনা, জমা সব কিছুই এলো মেলো করে দিচ্ছিলো আমার। আমি ওরনা ঠিক করতে করতেই চোখে পড়ে গেল এক পরিচিত মুখ। উষ্কখুষ্ক চুল। কত দিনের অবহেলায় ভরাট দাড়ি-গোঁফ শক্ত চোয়াল জুড়ে। চোখের নিচে রাতের পর রাতে জেগে থাকার ক্লান্তির দাগ। ডা. অভিনবকে খানিকটা রোগা মনে হচ্ছিলো আমার কাছে। ললাটে চিন্তার ভাঁজ ফুঁটিয়ে খুঁজে যাচ্ছেন কিছু! তাকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখালো। আমি চাইনা তার সামনে পড়তে৷ দু হাত সমান পিলেরের পিছনে লুকিয়ে পড়লাম। বুকে ভিতর ধ্রীম ধ্রীম শব্দকরে হৃদপিণ্ড বেড়িয়ে আসতে চাইলো। আমার মনে হলো, স্টুডেন্টদের গুঞ্জন থেকে আমার বুকে বা পাশের শব্দটাই বেশি হচ্ছে?

আমি শুকনো ঢুক গিললাম। এতক্ষণে চলে গেছেন হয়তো উনি! ভেবেই পা বাড়ালাম ক্লাসের দিক। ঠিক তখনি থমকে গেলো আমার পা, এক পুরুষলী শক্ত হাত আমার হাত চেপে ধরলো। ভয়, বিস্ময়, হতবাক হয়ে গেলাম আমি। কিছু বুঝার আগেই লোকটি টেনে নিয়ে গেল বদ্ধ একটি রুমে। ঠেসে ধরলো ধুলোমাখা দেয়ালে। অনেক দিন বন্ধ থাকায় শ্যাত শ্যাত ভাব রুমটিতে। এক পাশে ঠেলে রেখেছে বেঞ্চ। বেঞ্চ গুলো উপর ধুলোবালির স্তুপ। ভ্যাপসা এক গন্ধ ঠেলে ছড়িয়ে পড়লো সুগন্ধী। পরিচিত মানুষের শরীরের ঘ্রান ঘরময় ঘুরো ফিরা করতে লাগলো। আমি ভয়ে কাঠ। গলা শুকিয়ে গেছে। সাত দরিয়ার পানি খেলেও যেন তৃষ্ণা মিটবে না আমার। আমি পিট পিট করে তাকিয়ে দেখলাম ডা. অভিনব নিষ্প্রভ চাহনি মেলে এগিয়ে এসে মুখো মুখি দাঁড়ালো আমার। মনে হলো সেই মুহূর্তে আমার মাথা ফাঁকা, বুকে তীব্র চিন চিন ব্যথা, শিরশিরানি। উফ অসহ্য অনুভূতি।

ডা. অভিনব আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো। পার্থক্য ইঞ্চি সমান। দুহাত দু দিকে দিয়ে আটকে ফেললো । লম্বা দেহখানি নিয়ে ঝুঁকলো। প্রতিটি নিশ্বাস আছড়ে পড়লো মুখ-মন্ডলে আমার। সময় যেন সেখানেই থেমে গেলো আমার। শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে আছি। কাঁপাচ্ছে আমার শরীর, হাত-পা, ঠোঁট। ডা. অভিনব আমার ঠোঁটের দিকে তার দৃষ্টি নিবন্ধ করলো। শীতল বরফ অথচ ধারলো কন্ঠে বলল,

“হোয়াই ডো ইউ ওয়ান্ট টু কিল মি?”

আমি চমকে তাকালাম। আগের থেকে শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত বেগে দৌড়াতে লাগলো। কানের মাঝে চরকির মতো ঘুরতে লাগলো কথাটি। পরক্ষণেই উপলব্ধি করলাম আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসচ্ছে। তাকে আমি কেন মারতে চাইবো? কি বলছেন উনি?এই মুহূর্তে উনিই হয়তো মারতে চাইছেন আমাকে? আমি ভয়ে তোতলানো কন্ঠে বলে উঠলাম,

“কি ব-ল-ছে-ন?”

উনার ঠোঁটে এবার হাসির রেখা ফুঁটে উঠলো। থমথম মুখে মেদুর ছায়া দূরে ঠেলে সূর্যের মতো এক ফালি আলো দেখা গেলো। উনি আরো ঘেঁসে দাঁড়ালেন আমার সাথে। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। কি হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছি না এ মুহূর্তে।

ডা. অভিনব এবার আমার নত মুখ ডান হাতের দুই আঙুল থুতনি রেখে মুখটি উঁচু করলেন। না চাইতে চোখের বাঁধ ভেঙ্গে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা জল। ডা. অভিনব শীতল দৃষ্টিতে এখনো তাকিয়ে, বলল,

“এবার পালালে! আই উইল কিল ইউ!”

আমি আরেকদফক চমকালাম। অসাড় হয়ে আসা শরীরটা সামলে ঠেলে সরিয়ে দিলাম ডা. অভিনবকে। জোড়ে জোড়ে শ্বাস বের হবো তখনি শোনা গেলো আবার তার কন্ঠ। আমার পা সাথে সাথে থমকে গেলো।থমকে গেলো সময়, থমকে গেলো বাতাস। থমকে হেলো নিশ্বাস। অবাকতার শেষ চুড়ান্তে আমি। বন্ধঘর ময় বাড়ি খেয়ে যাচ্ছে এখনো সেই কথাটি,

“আই লাভ ইউ রূপ। আই লাভ ইউ। ”

~জয়নব পেইজ উল্টালো। এর পরের বেশ কিছু পেইজ পোড়া। জয়নব হতাশ হয়। কি উত্তর দিয়েছিলো তার বোন? জানা নেই। তবে লিখা গুলো পড়তে পড়তে সে হারিয়ে গেছিলো। নিজরকে রুফাইদার জায়গায় আর ডা. আদরকে ডা. অভিনবের জায়গায় অজান্তেই কল্পনা করে বসলো। লজ্জায় টুকটুকে লাল গাল গুলো আরোও লাল হয়ে গেলো। নিজের ভাবনাকে ঠেলে দিলো দূরে৷ কয়েকটি পেইজ উল্টাতেই চোখে পড়লো কিছু অদ্ভুত লিখা~

আমাদের মেডিকেল কলেজে ইললিগ্যাল কাজ চলছে। কে বা কারা করছে? এখনো জানা যায়নি। তবে আজ বিষয়টি আমার চোখে পড়েছে। আজ সকালে একজন রোগী আসে। লোকটি স্পট ডেড। মর্গে রাখা হয়েছিলো তাকে। আমি সেদিক দিয়ে আসার সময় দেখলা দুটো ওয়ার্ড বয় চুপি সারে লাশটি নিয়ে ঢুকছে পুরোতন ওটিতে। আমি কিছু বলতেই চাইছিলাম তখনি কেউ পিছন থেকে মুখ চেঁপে সাইডে নিয়ে আসে। আমি চমকে তাকাতেই দেখতে পাই পরিচত এক দেবীমূর্তি। যার চোখ গুলো ডাগর ডাগর প্রতিমার মতো। ঢেউ খেলানো চুল পিঠময় ছেড়ে রেখেছে। পড়নের সুতির জলপাই কুর্তি লতানো দেহে চেপে আছে। অামি অবাক চোখে তাকে দেখছিলাম, মুহূর্তেই রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে ভ্রু কুচকে বলে উঠলাম,

“পূজা তুই!”

পূজার চোখে ভয়, অস্থিরতা। এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা দেখে চাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো,

“মরার শখ না থাকলে ওখানে যাইস না। ”

আমি হতবুদ্ধি। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে বললাম,

“কি বলতে চাইছিস?”

পূজা স্বগতোক্তির মতো বলল,

“এখানে অনেক ইললিগাল কাজ চলছে। আমি আরো নোটিশ করেছি। ইনফ্যাক্ট ৩০৩ নাম্বার রুমটিই হচ্ছে সব নষ্টের মুল। কে বা কারা করছে? ধরতে পারছে না কেউ!”

আমি কিছুই বুঝলাম না। পূজা আমার বন্ধু। দেখকে প্রায় একই রকম আমরা। মাঝে মাঝে হোস্টেলের খালা মামারা আমাদের বোন ভেবেই ভুল করে বসে। আমি অবিশ্বাস্য গলায় বললাম,

“কি যা তা বলছিস?”

“যাতা নয়। এখানে ইললিগাল কাজ চলে, মৃত রোগীদের চোখ, হৃদপিণ্ড, কিডনি এমনকি শরীরের ইম্পর্টেন্ট পাটর্স কেউ বেআইনী ভাবে সেল করে যাচ্ছে।”

“তুই এত কিছু কিভাবে জানলি?”

“তুই ছিলিনা। দুদিন আগে পুলিশের একটি দল আসে হসপিটালে। এক রোগীর পরিবার কমপ্লেন করেছিল। রোগীর সার্টিফিকেটে ছিল নর্মাল ডেড। কিন্তু লোকটির শরীরে কাঁটা ছেঁড়া করা হয়েছে। যেখানে তার অপারেশন হইনি। তারা অন্য হাস্পাতালের ডাক্তারদের দিয়ে পরীক্ষা করেই জানতে পারে লোকটি শরীরে ইম্পরট্যান্ট পার্টস গুলো গায়েব।”

শিউরে উঠলাম আমি। থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। কম্পিত কন্ঠে বললাম,

“এসব কিভাবে সম্ভব? ”

পূঁজা আসলো। পান মাতার মতো মুখ খানায় বিদ্রপের হাসি,

“টাকার জন্য আজ কাল সন্তানকে বেঁচে দিচ্ছে, আর এটা তো সামান্য ব্যাপার!”

স্পষ্ট দেখতে পেলাম পূজার চোখে, মুখে মেদুর ছায়া। সে আবার বলল,

“তুই এসব ঝামলেয় পরিস না এখান থেকে যা।”

“আমি কেন ঝামেলায় পড়ব? আর এসব হচ্ছে প্রন্সিপাল স্যার জানেন? বোর্ড এসবে কোনো পদক্ষেপ কেন নিচ্ছেন না?”

পূজা বলল,

” ইনভেস্টিগেশন চলছে। কারা করছে ধরতেই পারছে না। এই যে ৩০৩ নং রুম হাজার তল্লাশি করেও কিছুই পাওয়া যায় নি। কীংবা তুই এখন গেলেও কিছুই খুঁজে পাবি না। সব হাওয়া!”

আমরা মাথায় কিছুই ঢুকছিলো না। ৩০৩ নং রুমটি পুরোনো ওটি ছিলো। কোনো কারণবশত সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ইনফেক্ট কারো যাওয়া আসা নিষেধ। তাহলে কিভাবে কেউ হসপিটাল ভর্তি মানুষের অগোচরে ভয়ানক তান্ডব লিলা খেলা?এর জন্য পিছনে অবশ্যই বড় কোনো মহানায়ক আছে?

সেদিন আরো জানতে পারলাম পুলিশ পক্ষ আমাদের কলেজে সকলের অগোচরে গোয়ান্দাগিরির জন্য বেঁছে নিয়েছে কিছু লোাক। এবং তার মাঝে আমাদের গ্রুপের মাঝে আছে আয়ান, আঞ্জুমান, পূঁজা। আমি নিজেও তার সাথে যোগ দিলাম। এই ভয়ংকর কর্মকান্ড দূর করার জন্য। সেদিনের পর আরো কিছুদিন কেঁটে যায়। হাসপাতালে সব কিছু রোজকার মতোই চলছে। এর মাঝেই পূজা খবর আসে তার মাসিমা আর নেই। তাকে দ্রুত যেতে হবে তার শহরে। বাবা-মা মরে যাওয়ার পর এই মাসিটিই সব ছিলো তার। মাসি নেই শুনেই ভেঙে পড়ে সে। কলেজের ফর্মালিটি শেষ করে রওনা করে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো তখন যখন পূজার যাওয়ার ১৫ দিন পার হয়ে গেছিলো তার কোনো খোঁজ ছিলো না। উপর থেকে ফেন বন্ধ আসচ্ছিলো। আমাদের সবার মাঝেই ছিলো চিন্তার ছাপ। ১৫ দিয়ে ২০ দিনের মাথায় একটি ফোন কলে শিউরে উঠে আমরা। পূজার মাসিমা ফোন করে আয়ানের কাছে।তখন আমরা মাঠের উপর বসে। একজন মৃত ব্যক্তি কিভাবে ফোন দিয়েছে? ভাবতেই সকলে ভয় পেয়ে গেলাম। পরবর্তীতে জানতে পারলাম পূজার মাসি মরে নি। আর পূজাকেও কেউ গুম করে দিয়ে ছিলো। এই খবর শোনার পর আতঙ্কে সাদা হয়ে গেলো সবার মুখ। পিছিয়ে গেলো মিশন থেকে আয়ান, আঞ্জুমান। রয়ে গেলাম আমি। ঠিক করে ফেললাম আমিই করবো সব।

জয়নব অস্তির হয়ে পড়লো। এর পরের পেইজ গুলো খালি। আর যা লিখা বেশির ভাগ পুড়ে ছাই।
জয়নব কি করবে এখন? তার মাথা ফাঁকা লাগছে। তবে এই হসপিটালের রহস্য কিছুটা সামনে এসেছে। ইলিগ্যাল কাজের জন্যই এত এত মানুষের প্রাণ যাচ্ছে? জয়নব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে ঠিক করলো ৩০৩ নং রুমটিতে সে একবার টু মেরেই আসবে। কি আছে সেই রুমটিতে? কেনোই বা সেখানে ঢুকলেই সব হাওয়া হয়ে যাচ্ছে?

চলবে,

আশা করছি কিছুটা ক্লিয়ার হয়েছেন? 🙆‍♀️🙆‍♀️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে