অনুরক্তি এসেছে তোমার শহরে পর্ব-০২

0
318

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ২
#বর্ষা
ইলিয়ানা অনেকক্ষণ ধরে এপাশ ওপাশ করছে।অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে।লাবিব স্যার ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।আর বন্ধুমহল শয়তানি হাসি হাসছে।ইলিয়ানা বুঝতে পারছে এগুলো কিছু তো একটা করবে।তাই হলো।মেহের একটু জোরেই বললো,

—লাবিব স্যার আমাদের ইলিয়ানা সুন্দরী হয়েছে তা আমরা জানি।তাই বলে আপনি এভাবে আমাদের বান্ধুবীর দিকে তাকিয়ে থেকে নজর লাগিয়েন না।

মেহেরের কথায় সবগুলো ফিক করে হেসে দিয়েছে। ইলিয়ানাও হেসে দিয়েছে।তবে সেই দশবছর আগের এ্যাটিটিউড বজায় রেখে লাবিব স্যার বললেন,

—স্যারদের সম্মান করতে হয়, অপমান নয়!

লাবিব স্যার উঠে যেতে নিবেন ঠিক তখনই অন্তরা খোঁচা মেরে বলে উঠলো,

—সবাই স্যার হওয়ার যোগ্যতা রাখে না,কেউ কেউ তবুও স্যার হয়ে নিজ ক্যারেক্টারের জন্য অপমানিতই হয়।

লাবিব স্যার চলে যাওয়ার সময় ত্যাড়া লুক দিয়ে যায় ইলিয়ানাকে।তাতে অবশ্য ওর কিছুই যায় আসে না।লাবিব স্যার চলে যেতেই ইলিয়ানা বলে ওঠে,

—জানিস লাবিব স্যার বিবাহিত।ওনার একটা ছেলে আছে

—তাও তো ছ্যাছড়ামি কমেনি।এরকম মানুষ কেমনে যে এতো শ্রদ্ধেয় প্রফেশনে যায় আল্লাহ মালুম

আফরোজার কথায় বন্ধুমহলের সবাই ঠিকঠিক করছে।ইলিয়ানা আকাশের দিকে তাকিয়ে। তাঁরারা ঝিলিমিলি করছে।কতই না সুন্দর লাগছে আকাশটা।ইলিয়ানা ঘাসের ওপরেই সুয়ে পড়ে।আড় চোখে তাকায় মেহের,আফরোজা,অন্তরা।তবে অনন্যা,তাসনিম ইলিয়ানাকে সঙ্গ দিয়েছে। উপভোগ করছে তাঁরায় ভরপুর আকাশের সৌন্দর্যতা।এদিকটায় প্রায় শিক্ষক,স্টুডেন্টরাই বসে আছে। অবশ্য রিইউনিয়নের আয়োজন তো হয়েছেই স্কুল মাঠে। তাঁবুতে থাকবে ওরা। অবশ্য যারা দূরদূরান্ত থেকে এসেছে তাদের অনেকের সাথেই ফ্যামিলি আছে।তবে হাতে গোনা চার-পাঁচজন।

ইলিয়ানার ফোন বেজে ওঠে। রিংটোনের মাধ্যমেই বুঝে ফেলে কে ফোন করেছে। কেননা একমাত্র এই নাম্বারের জন্যই সে রিংটোন আলাদা দিয়েছে।ইলিয়ানা ধড়ফড়িয়ে উঠে অন্য পাশে চলে আসে।এপাশটা অনেকটাই অন্ধকার।

—আসসালামু আলাইকুম,কেমন আছো?

—ওয়ালাইকুমুস সালাম, আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?

—আলহামদুলিল্লাহ।কি করছো?

—কোরিয়া থেকে আজকের ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর ফিরছি।তোমাকে অনেক মিস করছিলাম।তাই দ্রুতই ফিরছি।আমার ফেবারিট ডিশ কি কেউ তৈরি করবে?

ইলিয়ানা ভয় পেয়ে যায়। জুনায়েদ চৌধুরী কোরিয়া গিয়েছেন বলেই তো ইলিয়ানা বাংলাদেশে আসতে পারলো।এখন যদি তিনি আজকেই ফ্লাইটে ওঠেন। তবে নিশ্চিত কালকেই তিনি সিঙ্গাপুর।তাহলে কি সে ইলিয়াস চৌধুরীর রাগান্বিত হওয়ার কারণ হতে চলেছে!ইলিয়ানা বুঝে ফেলে সবকিছু বিগড়ে যাওয়ার আগেই ঠিক করতে হবে তাই বলে,

—ডেড আই ওয়ান্ট টু সে ইউ সামথিং

—হোয়াট বেবি?

—আ’ম ইন‌ বাংলাদেশ। প্লিজ ডন্ট বি এংগ্রি।আই প্রমিস ইউ আই উইল বি ব্যাক আফটার টেন ডেইস

—কবে গিয়েছো?

—আজই এসেছি।

—বেবি কেন এমন করো?তুমি তো জানো আমি তোমাকে নিয়ে চিন্তিত থাকি।আমার শত্রুর কমতি নেই।তাহলে আমায় না জানিয়ে কেন বাংলাদেশে গেলে তুমি?

—প্লিজ ডেড..জাস্ট টেন ডেইস..প্লিজ রাজি হয়ে যাও

—ওকে.তবে আমার যোগাযোগে থাকবে। আর শোনো আনহাইজেনিক খাবার খাবে না এবং নিজের খেয়াল রাখবে

—তুমিও।রাখছি তবে আল্লাহ হাফেজ

—আল্লাহ হাফেজ

ইলিয়ানা কথা বলতে বলতে অনেকটাই এগিয়ে এসেছিলো।তবে পেছনের দিকে যেতে এখন মন চাইছে না। কেননা এদিকটা আরো বেশি সুন্দর।একটু ছোটখাটো পুকুর। অবশ্য এটা অনেক বড় একটা পুকুর ছিলো।তবে এখন ভরাট করা হয়েছে। তবুও পুকুরটা ছোট হলেও সৌন্দর্যতা আছে। পুকুরে নামবার যে সিঁড়িটা সেখানের একেবারে উপরের দিকে ইলিয়ানা বসে। মোবাইলে সময় দেখে নয়টা তিপ্পান্ন। চাঁদটা এখানে থেকে বেশ সুন্দর দেখা যায়।ইলিয়ানার মনে পড়ে সেই দশবছর কিংবা তারও আগে যখন সে স্কুল শিক্ষার্থী তখন সে একটা ব্লগ ছেড়েছিলো,যেখানে শুরুটা ছিলো ‘বয়স বাড়ার সঙ্গে মানুষ নিরবতার প্রেমে পড়ে’।সত্যিই যা এখন ইলিয়ানা উপলব্ধি করতে পারে।

—নির্জনে একাকী কি করছো?

ইলিয়ানা পেছনে তাকায়।আহান স্যার যে এসেছে তা বেশ বুঝা যায়।ইলিয়ানা সামনে ঘুরে নিশ্চুপ বসে রয়।আহান স্যার আবারো প্রশ্ন করেন,

—এখানে একাকী কি করছো?

—প্রেম করছি

—কার সাথে?

—নিরবতার সাথে।

—তোমার বেষ্টু কই?ছেলেটা কিন্তু তোমায় বেশ ভালোই বাসতো। স্ক্রিনশটগুলো তো তেমনই ছিলো

ইলিয়ানার সত্যিই হঠাৎ করে রোমানের কথা মনে পড়ে।সময় তো কম হয়নি।দশবছর যাবৎ সে বিদেশ ছিলো।অতীত তো প্রায় মুছেই গিয়েছিলো।তবে আবারো সে বাংলাদেশে আসলো।এস.এস.সির‌ পরপরই তো জীবন বদলে গিয়েছিলো তার।পরিচয়,নাম, বাসস্থান সব বদলে গিয়েছিলো!

—হয়তো বিয়ে করে নিয়েছে

—তা বললে না তো তুমি বিয়ে করেছো কিনা

—সকালেও‌ একটা কথা বলেছিলাম

—কথা‌ না ঘুরিয়ে সরাসরি বলো না

—করিনি।তা আপনার পছন্দের রমনীর সাথে বিবাহ সম্পন্ন করেছেন?

আহান স্যার আর কিছুই বললেন না। চুপচাপ ইলিয়ানার থেকে দূরত্ব রেখে ওইদিকটায় বসলেন।কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙে নিজ থেকেই বললেন,

—বুঝলে ইলিয়ানা কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনের বিরোধিতা করতে হয়।সময় একটা অনেক বড় জিনিস।তখন সময় আসলো যাকে মনের গহীনে লুকিয়ে রেখেছিলাম সে হারিয়ে গেলো।

—বুঝলাম না।

—তুমি ছোট্ট।বোঝার বয়স এখনো হয়নি তোমার।

আহান স্যারের শীতল কথাগুলোর চেয়ে ”তুমি ছোট্ট” কথাটা যেন মস্তিষ্ক উল্টেপাল্টে দিচ্ছে তার।একজন ছাব্বিশ বছর বয়সী রমনীকে সে বলছে নাকি সেই রমনীটা ছোট ভাবা যায়!ইলিয়ানা কিঞ্চিত রাগ দেখিয়ে বললো,

—আপনি জানেন আমার বয়স কত?ছাব্বিশ বছর দুইমাস।আপনি আমাকে কিভাবে ছোট বললেন!

আহান স্যার হাসে।দশবছর আগেও যে এই মেয়েটা এমনি করেই রাগ দেখাতো।তবে তা শুধু তার প্রতিই।অন্য কারো সাথে কখনো সে ইলিয়ানাকে রাগ দেখাতে দেখেনি। অবশ্য বন্ধু-বান্ধব ছাড়া ইলিয়ানা শুধু তার সাথে রাগ,অভিমান, অভিযোগ করতো।তবে সে বুঝেও যে বুঝতো না। কেননা ইলিয়ানা তখন বয়ঃসন্ধিকালে পা দিয়েছিলো।রঙিন চশমা ছিলো চোখে।ভালো লাগতেই পারে যে কাউকে।তাই বলে যে সে ভালোলাগা/ভালোবাসাটা স্থায়ী হবে তার তো কোনো মানে নেই তাই নয়কি!তাছাড়া সমাজ যে মানতো না তাদের বয়সের বিশাল পার্থক্য।বারো বছরের পার্থক্য কি কম নাকি!

—ইলিয়ানা?

—আপনার বউয়ের সাথে পরিচয় করাবেন না?

ইলিয়ানার কথায় কান্নার সংমিশ্রণ।চোখ দু’টো ছলছল করছে। ভালোবাসার মানুষকে কি অন্য কারো সাথে সহ্য করা যায়?সহ্য করা না গেলেও সহ্য করতে শিখতে হয় কেননা অধিকারবোধ বলতে যে কিছুই নেই ভালোবাসার মানুষটির ওপর তার!

—বিয়ে করেনি

—সত্যি?

প্রফুল্ল কন্ঠে ইলিয়ানা চেঁচিয়ে ওঠে।আহান স্যার মাথা ওপর নিচ করে। চাঁদের আলোয় ইলিয়ানার উজ্জ্বল মুখশ্রী নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে।আহান স্যার আপন মনেই বিড়বিড় করে কিছু একটা বলেন।মুখে তার লেপ্টে আছে হালকা হাসি।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে