অনুরক্তি এসেছে তোমার শহরে পর্ব-০৩

0
311

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ৩
#বর্ষা
ইলিয়ানা সকাল সকালই হাঁটতে হাঁটতে স্কুল মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় উঠে এসেছে।প্রাইমারি স্কুল দেখেই স্কুল জীবনের দুষ্টামিগুলো নাড়া দেয় তাকে। ইচ্ছে হয় ক্ষুদ্র দেয়াল টপকে ওপাশে যাওয়ার।তবে একাকী কি আর মজা আছে নাকি।সবাই মিলে যাওয়ার জন্য পেছনে ঘুরতে নিলেই ফোনটা বেজে ওঠে। ইলিয়াস চৌধুরী দিয়ে সেভ করা নাম্বারটা।ইলিয়ানা ডানে-বামে মাথা ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

”ওফ ডেড তোমাকে মামানো তো সহজ ছিলো। কিন্তু এই ব্যক্তিকে আমি কিভাবে মানাই!”

ইলিয়ানা ফোন রিসিভ করে চুপ করে থাকে।কিই বা বলবে।অপরপাশ থেকেও কোনো কথা আসে না।তবে কিঞ্চিত সময় পরই ওপাশ থেকে কেউ গম্ভীর কন্ঠে বলে,

”ইলিয়ানা জেহের চৌধুরীর সাথে কি কথা বলা যাবে?”

ইলিয়ানা বুঝে যায় তাই গুরুগম্ভীর ভাইটা তার সাথে প্রচন্ড রেগে আছে।দ্রুত কলটা কেটে ভাবী এলিনার ফোনে ভিডিও কল দেয়।এলিনা আমেরিকান।ইলিয়াসের সাথে তার প্রেমের বিবাহ।বছর তিনেকের মেয়ে জেনি চৌধুরী।ইলিয়ানা ভাবীকে বললো,

—মাই ডিয়ার ভাবী প্লিজ সে মাই ব্রেদার দ্যাট হিজ সিস্টার উইল বি ক্যাম ইন টেন ডেইস।

এলিনা মুচকি হেসে বললো,

—তুমিই কেনো বলছো না বেবি

এই বলেই এলিনা মোবাইলটা ইলিয়াস চৌধুরীর হাতে ধরিয়ে দেয়।ইলিয়ানা ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া হাসি হাসে। ইলিয়াস বোনকে প্রচন্ড ভালোবাসে।তবে জুনায়েদ চৌধুরীর কারণে বোনের জীবনটা নিয়ে সবসময়ই ভাবনায় থাকে সে। তাইতো ভালোবাসার চেয়ে রাগ,শাসনটাই বেশি প্রকাশিত হয়।

—কার অনুমতিতে গিয়েছো বাংলাদেশে?

—ব্রো আই এম সরি।বাট আমি তো তোমার সিস্টার যে নিজের সুরক্ষা এবং খেয়াল রাখতে পারে।প্লিজ চিন্তা করো না।মাত্র তো দশটা দিন।প্লিজ

—আমি জ্যাককে বলছি সে বাংলাদেশে আসবে এবং তোমার সুরক্ষার দায়িত্বে থাকবে।

—ভাই তুমি তোমার বোনের যোগ্যতায় সন্দেহ করো?

—জেহের আমি কি একবারো তা বলেছি?

—তুমি যদি আমার যোগ্যতায় বিশ্বাস করতে তবে এমনটা বলতে না!তুমি আমার যোগ্যতায় অবিশ্বাস করো।

ইলিয়ানার বাচ্চা ফেস দেখে গলে যায় ইলিয়াস।বোনটাকে মাত্র দশবছর ধরে কাছে পেলেও সম্পর্ক যেন আরো পুরনো।ইলিয়াসের রাগ হয় তার বাবা-মায়ের প্রতি কেন তারা তখন এতোটা কেয়ারলেস হয়েছিলো!কেন তাদের কারণে ইলিয়ানা আর ইলিয়াসের দূরত্ব ছিলো অনেকগুলো বছর!ইলিয়ানা ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে কল কেটে দেয়।ইলিয়াস ইলিয়ানাকে না বলেই জ্যাককে জানায় বাংলাদেশে আসার কথা।জ্যাক বিনা সময়ব্যয়ে টিকিট বুক করে বেড়িয়ে পড়ে ব্যাগ নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।ইলিয়াস বলে,

—জেনি আমার নিকট যতটা আপন।জেহের তুমি যে তার চেয়েও শতাধিকগুণ আপন আমার কাছে।হ্যা আমি জানি বাপ-মেয়ের চেয়ে ভাই-বোনের সম্পর্কটা এতোটা গভীরত্ব পায় না।তবে প্রতিটা সম্পর্কের মাহাত্ম্য প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিটা মানুষের স্থান আলাদা।

—ওই ছেড়ি কই গেছিলি তুই?

মেহের প্রশ্নে ইলিয়ানা ওর কানে কানে বলে,
—দোস্ত চল না ছোটবেলার আশাটা পূরণ করি।

—কোনটা?

—ওই যে দেয়াল টপকে সরকারি স্কুলে যাওয়ার।

মেহের বিরক্তিমাখা এমন একটা লুক দেয় যে ইলিয়ানা অবাকসহ আশ্চর্য। কেননা মেহের মোবাইল থেকে একটা ছবি বের করে ইলিয়ানার সামনে ধরে বলে,

—চিনিস একে?

—সায়মান?

—আমার জামাই।

—তো?

—আমারে ঠেঙাইবো এমন বাঁদরামি করলে।ভাগ্য ভালো শালায় ক্রিকেট খেলার জন্য বিভিন্ন জায়গায় যায় বলে সেই ছুতায় আমিও একটু আকটু ঘোরাঘুরি করতে পারি। নয়তো বাড়িতে থাকলে শাসনে শাসনে পাগল বানায়।

—জামাইকে শালা বলা ঠিক না মেহের

—ওই ছেড়ি জ্ঞান দেওয়া বাদদে।আর ওইটা একটা কথার কথা ছিলো।বিয়ে কর তোর মুখ থেকেও বের হইবো।

মেহের আর কিছু না বলেই ইলিয়ানাকে টেনে একপাশে নিয়ে আসে।ইলিয়ানা অবাক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে।রোমান কি করছে এখানে!রোমান এগিয়ে আসে ইলিয়ানার দিকে। সমবয়সী দুজনই।মেহের চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

—দোস্ত চিনোস নাকি?

—রোমান আহমেদ।

রোমানের নাম শুনেই মেহের ইলিয়ানাকে ফেলে ছুটেছে অন্যদিকে।রোমান এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,

—কেমন আছেন?

—আলহামদুলিল্লাহ,আপনি?

—আছি কোনো মতন।

নিরবতা!ইলিয়ানা মনে মনে ভাবছে রোমান তো তাদের স্কুলের নয় তাহলে সে এখানে কেন!আর কার কাছেই বা খবর পেল যে ইলিয়ানা এসেছে।আর চিনলোই বা কিভাবে! হঠাৎ ইলিয়ানার মনে পড়লো যে সে এবং রোমান এখনো অব্দি ফ্রেন্ডলিস্টে আছে।ইলিয়ানা নিরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করে,

—এখানে কেন?

—আপনি জানেন না?

—না.

—এমনি আসলাম।

—ওহ

—হুম

রোমান চলে যায়।কয়েকবার পিছু তাকাতে গিয়েও পিছু ফেরে না।রোমান বুঝে গেছে এতদিনে যে তার পরিচিত ইলিয়ানা আদৌ কখনো তার পরিচিত ছিল না কিংবা তার হবে না। রোমান মনকে মানানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়। অপেক্ষা করাটা অনেক কষ্টের বিষয়।রোমান তো দশ বছর ধরে কোনো প্রমিস ছাড়াই অপেক্ষা করে আসছে।

রোমান চলে যেতেই মেহের হাজির হয় আধো ঘুমে থাকা তাসনিম,অন্তরাকে নিয়ে।অনন্যা আর আফরোজা তো ছুটে এসেছে আগে আগেই।অনন্যা উৎসাহ সহিত জিজ্ঞেস করে উঠলো,

—কিরে আমরা শুনলাম রোমান এসেছে।কইরে?

— আমাকে এভাবে দেখছিস কেন!আমি কি লুকিয়ে রেখেছি নাকি আমার পেছনে!

ইলিয়ানার রাগান্বিত কন্ঠ শুনেও পাত্তা দেয় না ওর বন্ধুমহল।ইলিয়ানাকে আরো রাগাতে তাসনিম বলে ওঠে,

—পেছনে লুকাবি কেন?লুকাবি তো অন্তরে!

—তাসনিম ইয়ার তুইও!

—আচ্ছা সরি বাবা।চল ব্রেকফাস্টটা করে নেই সবাই।আর কালকে তো জার্নি করে আসায় সবার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়ে ওঠেনি,আজকে করতে হবে।

অনন্যার কথায় সবাই মাথা নাড়ায়।এই মেয়েটা প্রচন্ড ব্রিলিয়ান্ট। একজন গাইনোকলজিস্ট কি কম বুদ্ধিমান হলে হওয়া যায় নাকি!হওয়া যায় তবে তার জন্য প্রয়োজন জঘন্যতম কঠোর পরিশ্রম। বুদ্ধিমত্তা এবং পরিশ্রম দুইটাই ছিলো এ মেয়েটার মধ্যে।অনন্যার কথায় ইলিয়ানাসহ সবাই পার্টি এরিয়া অর্থাৎ মাঠ সংলগ্ন ক্যান্টিনে চলে আসে। অবশ্য ওদের ব্যাচের অনুরোধেই এখানে ক্যান্টিন নির্মাণ কার্য শুরু হয়েছিলো। তবে ওরা ততদিনে এসএসসি পাশ।

ক্যান্টিনে বসা না থেকে স্যান্ডউইচ হাতে বাইরে আসে ইলিয়ানা। চোখ ঘুরিয়ে সবাইকে দেখে নেয়।দূরে সব স্যার-ম্যামদের সাথে আহান স্যার গল্প করছেন। অবশ্য একে গল্প করা নয় বরং মোবাইল হাতে বসে থাকা বলে।ইলিয়ানা ভাবে একটা ম্যাসেজ দেওয়াই যায়;আবার ভাবে না এখন ম্যাসেজ দেওয়া ঠিক হবে না,যদি অন্য কোনো স্যার ম্যাসেজ দেখে নেয় তবে আহান স্যারের সমস্যা হতে পারে।

ইলিয়ানা স্যান্ডউইচ খেতে খেতে স্যারদের সাথে নিকটে যায়। অবশ্য দুই-তিনটা চক্কর দিয়েছে আগে যাতে স্যান্ডউইচ খাওয়া প্রায় শেষের দিকে।শেষ বাইট মুখে পুড়েই গিয়েছে সে দিকে। সুন্দর করে সালাম দিয়েছে।ইলিয়ানার কন্ঠ পেতেই আহান স্যার উপরে তাকিয়েছেন।মুখে লেপ্টে হাসে প্রশস্ত হাসি।

সব স্যার-ম্যামদের সাথেই কথা হলো।কতই না কথা।তার মধ্যে ইলিয়ানার দুষ্টু বান্ধুবীদের পাশাপাশি আরো কয়েকজন যুক্ত হলো।সবশেষ মুহাম্মদ স্যার (তৎকালীন বাংলা শিক্ষক)জিজ্ঞেস করেই ফেললেন,

—বলেছিলে তো ভুলবে না।ম্যাসেজ তো দিলে না।আর না নিলে খোঁজখবর। তাছাড়া গল্প/কবিতাও তো ছাড়তে না।কি হয়েছিলো?

আগ্রহভরা দৃষ্টিতে সবাই ইলিয়ানার দিকেই তাকিয়ে।ইলিয়ানা আমতা আমতা করে বললো,

—গল্প/কবিতা ওগুলো তো কাল্পনিক ছিলো তাই আর লেখা হয়ে ওঠেনি। সময়টা অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে।আর খোঁজ খবরের বিষয়টা? অনলাইনে খুউউউব কম আসা হতো।ধরতে গেলে জাস্ট একটা পিক পোষ্ট করতে আসা।এর বেশি কিছুই না।তাই বলে কিন্তু কাউকেই ভুলে যাইনি।

ইলিয়ানা ওখান থেকে উঠে চলে যায়। মুহাম্মদ স্যার বলেন,
—মেয়েটার জীবনে কি কিছু ঘটেছে?

মুহাম্মদ স্যারের প্রশ্ন শুনে মেহের,আফরোজা,অন্তরা সবাই পেছনে তাকায়।ইলিয়ানার স্কুল মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখে।

রজনীগন্ধা ফুল হাতে ইলিয়ানা দাঁড়িয়ে আছে।ব্লাস করছে সে।একদম ন্যাচারল ব্লাসিং।খুবই প্রিয় মানুষটার পছন্দের ফুল। অবশ্য তার সব পছন্দ আবার ইলিয়ানার পছন্দ নয়। একসময় তার পছন্দের মানুষটারও একজন পছন্দের মানুষ ছিলো। তবে কেন সে বিয়ে করলো না এখনও তেমনই প্রশ্ন‌ রয়ে গেলো!

—এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো?

আহান স্যারের কথায় ইলিয়ানার মুখের হাসি প্রশস্ত হয়।ফুলটা এগিয়ে দেয় আহান স্যারের দিকে।আহান স্যার ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে কিসের জন্য এটা।ইলিয়ানা জোর করে আহান স্যারের হাতে ফুলটা দিয়ে বলে,

—একসময় আপনাকে বলেছিলাম রজনীগন্ধা দিবো।তবে সময়টা আসতে একটু দেরি হলো।

—একটু নয় কিন্তু অনেকটাই

—হুম

আহান স্যার ফুলের সুবাস নিচ্ছেন। দুজনের মাঝেই নিরবতা।ইলিয়ানা নিরবতা ভেঙে হাসতে হাসতে বলে,

—স্যার আপনার পেছনে আমি যতটা ঘুরছি ততটা তো আমার কোনো বন্ধু-বান্ধবের পেছনেও ঘুরি নাই ছোটবেলায়।

আহান‌‌ স্যার অট্টহাসি হাসেন।এনাকে আগে কখনো অট্টহাসি হাসতে দেখেনি ইলিয়ানা।প্রাণ জুড়ানো সেই হাসি। হঠাৎ ইলিয়ানার মনে হলো এটা তো তার কথাকে ফাজলামো হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া।তাইতো কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

—হাসির কথা বললাম বুঝি?

আহান স্যার হাসি থামিয়ে সিরিয়াস হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—ছোটবেলায় ঘুরেনি অন্যদের পেছনে।এখন কি ঘুরো?

—ভাবতে হবে

—তাহলে ভাবো আমি এখানেই আছি। তাড়াতাড়ি ভেবে তাড়াতাড়ি বল..

—স্যার কি বলার কথা বলতাছেন?(মেহের)

মেহেরকে দেখে ইলিয়ানা এমন লুক দেয় যে ”তোর এখনই আসতে হবে”!মেহের হাসে।আহান স্যার কাজের বাহানা দিয়ে অন্যদিকে চলে যান।কি একটা পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন তিনি ভাবা যায়!ইলিয়ানা মেহেরের কান ধরে বলে,

—কেন খুঁজেছিস আমাকে?

—ওমা তোকে খুঁজতে আবার কারণ লাগবে নাকি!

মেহের আর ইলিয়ানার কথার মাঝেই লাবিব স্যারের ছেলেটা এসে ধাক্কা খায় ওদের সাথে।মেহের তো কি সুন্দর করে কথা বলছে। জিজ্ঞেস করছে নাম কি।ছেলেটা ইলিয়ানা ভ্যাংচি মেরে মেহেরের সাথে কথা বলছে।

—আমার নাম লিহাস হাসান নীড়।তোমার নাম কি ?

—বাবু শুনো অচেনা মানুষদের নাম বলতে হয়না।যদি কিডন্যাপ করে নেই।দৌড়ে বাবার কাছে গিয়ে বসে থাকবা।নয়তো ওইযে ওই অন্ধকার দিক থেকে বিরাট বড় কালো ভুত বের হয়ে তোমাকে তুলে নেবে!

নীড় ভয়ে চলে যায় ওখান থেকে।মেহের হাসতে থাকে।ইলিয়ানা কিছুই বুঝতে পারেনা।প্রথমে মিষ্টি তারপর ভয়।এসব ওর বন্ধু-বান্ধবের দাঁড়াই সম্ভব।ইলিয়ানা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেহের বলে,

—ওই লাবিবে আর একেক মেয়ের দিকে এখন তাকাইতে পারবো না।পোলা এখন কোলে উইঠা বইসা থাকবো। তহন বুঝবো মজা কি জিনিস!

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে