অনুরক্তি এসেছে তোমার শহরে পর্ব-০৪

0
264

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ৪
#বর্ষা
ইলিয়ানা ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে।ইশ,কি সুন্দর লাগছে আহান স্যারকে।সব মেয়েরা কেমন করে তাকিয়ে আছে!ইলিয়ানার রাগ হয়। প্রচন্ড রাগ হয়।কেন আহান স্যারের কালো গেঞ্জি পড়তে হবে!হুয়াই?ইলিয়ানা রাগের বহিঃপ্রকাশ করতে ম্যাসেঞ্জারে যায়।ইলিয়ানা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।এখনো অব্দি সে আহান স্যারের রেস্ট্রেক্টড আইডির মাঝেই আছে। তাইতো আজও তাকে সে অফলাইনেই দেখছে।ইলিয়ানা প্রতিবারই ব্যর্থ তাকে তার ভালোবাসা বোঝাতে।এবারও কি ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবে নাকি তাকে আপন করে পেয়ে মাতৃভূমিতেই থাকবে!

—কিরে কি হইছে (আফরোজা)

—ওই তোর মুখ এমন প্যাচার মতো কেন ইলিয়ানা (অন্তরা)

ওদের দুইজনের কথায় বাকিগুলোও ইলিয়ানার দিকে তাকায়।সত্যিই ইলিয়ানার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে।অনন্যা এগিয়ে এসে চেক করতে নিলে সুরসুরি অনুভব হতেই লাফিয়ে ওঠে সে, পাশাপাশি হেসেও দেয়।যে সে হাসি না অট্টহাসি। তাসনিম বলে,

—এই মেয়ে আর চেঞ্জ হয় নাই এখনো!

ইলিয়ানা ওদের সাথে খুনসুটিতে মেতে উঠলেও মনের গহীনে প্রিয় মানুষটার থেকে প্রাপ্ত নতুন ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য ক্ষতটা তো অনেক আগের সৃষ্টি।কিছুক্ষণ খুনসুটিতে মেতে ওরা রান্নার দিকটায় যায়। রিইউনিয়নের দ্বিতীয় দিন। সাতদিনের আয়োজন করা হয়েছে। অবশ্য সবার সহযোগিতা এবং চাওয়াতেই সম্ভব হয়েছে এতো বড় একটা সময়ের রিইউনিয়ন। রান্না-বান্নার দিকটা মেয়েদের।তবে ইলিয়ানা কিছু ধরছে না। রান্না-বান্না বলতে ডেডের প্রিয় ডেজার্ট,ভাইয়ের প্রিয় সালাদ এই যা সে পারে।কখনো শেখার প্রয়োজন বোধ করেনি। অবশ্য দশবছর আগে সে ভালোই রান্না বান্না জানতো।তবে তা তো অনেক পুরনো কথা।

—এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে না দেখে ওদের সাহায্যও তো করতে পারো

লাবিব স্যার নীড়কে কোলে নিয়ে এগিয়ে এসে কথাটা বলে।ইলিয়ানা নীড়কে ওর বাবার কোলে দেখেই বুঝে ফেলে বাচ্চাটা এখনো মেহেরের কথায় ভয়ে আছে।তবে তৎক্ষণাৎ লাবিব স্যারের বলা কথাটা মনে হতেই বলে,

—দুঃখিত।আমি সালাদ মেক করতে পারবো।তবে রান্না-বান্না আমি পারি না।

—এতো বয়স হয়েছে তাও রান্না বান্না পারো না?তোমার জামাই কি তোমাকে তোমার রুপ দেখেই রেখেছে?

ইলিয়ানার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।হাত মুঠো করে নেয় সে।ইলিয়ানা বিয়ে করেনি তা জানে না ঠিক আছে তাতে সমস্যা নেই।তবে তাকে এতো বড় কথা বলার পরও সে কিভাবে চুপ থাকবে।যখনই কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই আহান স্যার গম্ভীর কন্ঠে বলেন,

—ওকে ওর জামাই রুপ দেখে রাখুক কিংবা ভালোবেসে তাতে তো আপনার সমস্যা হবার কথা নয়!আর এটা একদমই ওর পার্সোনাল বিষয় যে ও রান্না বান্না করবে কি করবে না।আর যদি কখনো ওকে কিংবা অন্য কাউকে এভাবে বলতে শুনেছি তো খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু!

লাবিব স্যার ছেলেকে কোলে নিয়ে চলে যায়।আহান স্যার ইলিয়ানার দিকে কিছুক্ষণ রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চলে যান স্কুল মাঠ থেকে।ইলিয়ানা পিছু নেয় ওনার।তবে কিছুদূর গিয়ে আর যায় না।ক্রোধের বশে কেঁদে দেয়।আহান স্যার অন্য একজন রমনীর সাথে কথা বলছেন।এদিকটায় তিনটা স্কুল। ডিসেম্বর মাস চলায় তিনটিই বন্ধ।তাইতো দোকানপাট খোলা থাকলেও ছাত্রছাত্রীদের অভাব অনুভূত। পাশাপাশি রাস্তাটাও অনেকটা নিরিবিলি।ইলিয়ানাকে আহান স্যার দেখে ফেলেন।ইলিয়ানারও চোখ পড়ে স্যারের ওপর।ইলিয়ানা চলে আসে।

দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে ইলিয়ানা রেস্ট নিচ্ছে। হঠাৎ ওর ফোনে একটা নোটিফিকেশন আসে।ইলিয়ানার কষ্ট লাগে অনেক।কেউ একজন আহান স্যারের পাশাপাশি আরেকজন রমনীর পিক দিয়েছে গ্রুপে।বলেছে,কি সুন্দর লাগছে দুজনকে!ইলিয়ানা কষ্টের কথা কিভাবে বলবে!না,ইলিয়ানার তো কোনো অধিকার নেই তার ওপর যে বলবে আপনি কোনো মেয়ের সাথে কথা বলবেন না।ইলিয়ানা যথেষ্ট ম্যাচিউর।তার প্রফেশনটাই ম্যাচুরিটি সম্পন্ন।তবে প্রিয় মানুষদের কাছে ম্যাচুরিটি শব্দ যদি থাকতে হয়/রাখতে হয় তবে কিসের/কেমন প্রিয় মানুষ সে আমাদের!

—মন খারাপ? (আহান স্যার)

—এতো বছর পর বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা মন খারাপ কি হতে পারে?(ইলিয়ানা)

—সেই আগের মতোই আছো দেখছি।প্রশ্নের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন করা ছাড়লে না!

—ছেড়ে দিয়েছে শুধুমাত্র আমার প্রিয়দের জন্য।

—আমি কি তোমার প্রিয়ের তালিকায় নেই তাহলে?

—আপনাকে প্রিয়ের তালিকায় রাখা মানুষের সংখ্যা অহরহ। সেক্ষেত্রে আমি রাখলেও যা আর না রাখলেও একই কথা।

তখনই ইলিয়ানার ফোনটা বেজে ওঠে।ভিডিও কল ইলিয়াস চৌধুরীর।ইলিয়ানা ইচ্ছে করেই ওখান থেকে সরে যায় না। বরং ওখানেই কল রিসিভ করে। ইলিয়াস চৌধুরী বলে ওঠে,

—আসসালামু আলাইকুম কলিজা,কেমন আছো?

ইলিয়ানা চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।ভাইয়ের যে মতলব ভালো না ভালোই বোঝে।তবে কি মতলব এটেছে সে তা ইলিয়ানার জানা!কলিজা শব্দটা শুনেই আহান স্যারের বুকের ধুকপুক বেড়ে গেছে।মনে তার ভয় জেঁকেছে।তিনি ভাবছেন,সময় কি তবে পেরিয়ে গেল নাকি আমি তাকে নিজ থেকেই হারালাম!

—আলহামদুলিল্লাহ। তবে আমি তোমার বিয়ে সমন্ধে কোনো কথাই শুনছি না।রাখছি

—ইলি

ইলিয়াস চৌধুরী সম্পূর্ণ কথা আর সম্পন্ন করতে পারেন না।তার আগেই ইলিয়ানা কল কেটে দেয়।আহান স্যারের চোখে লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে।বিয়ে?করাছে সে ইলিয়ানাকে বিয়ে।ইলিয়ানার হাত শক্ত করে ধরে স্কুল মাঠ পেরিয়ে সরকারি প্রাথমিক স্কুলের ওদিকটায় চলে আসে।

—আরে আপনি কি পাগল হয়েছেন? আমাকে এভাবে টানছেন কেন?

ইলিয়ানা কপট রাগ দেখিয়ে বলতেই খেপে ওঠে আহান স্যার।রাগী এবং গম্ভীর স্বরে বলে,

—ওই ছেলেটা কে ছিলো?

—আপনি জেনে কি করবেন?

—আমি জানতে চাই। তুমি বলো?

—আমি জানাতে আগ্রহী না

—ইলিয়ানা

—চিৎকার করবেন না স্যার।আমার এখনো মনে আছে আপনি আমাকে কিভাবে ট্রিট করতেন।হ্যা আমি জানি আমি ছ্যাছড়ামি কম করেনি।তবে আপনার অবহেলাও কম ছিলো না।আজও আমি আপনার রেস্ট্রেক্টড আইডিতে আটক।ভালোবেসে ঠেকেছি নাকি!

ইলিয়ানা হাইপার হয়ে পড়ছে। রাস্তার মানুষেরাও এদিকটায় তাকিয়ে দেখছে।তাইতো ইলিয়ানাকে তিনি বললেন,

—বিয়ে করবে আমায়?

—কতবার তো আগেও বলেছেন।তবে ঠিক তার ঘন্টাখানেক পরেই বলেছিলেন যে আপনি রিপ্লাই একজন মেয়েকে ভালোবাসেন,,,ইত্যাদি।আবার আপনার পছন্দের রমনীর খোঁজ পেয়ে যাওয়ায় আপনি কে বলেছে তা জানতে চেয়েছিলেন।বলেনি তাই তো রেস্ট্রেক্টড করে রেখেছেন।

—ইলিয়ানা বিয়ে করবে?

—আমি কখনোই বিয়ে করবে না। পুরুষ মানুষ সন্তান,ভাই আর বাবা হিসেবেই শ্রেষ্ঠ।স্বামী হিসেবে কাউকে চাই না।

—ইলিয়ানা আমি বললাম আবারো জিজ্ঞেস করছি বিয়ে করবে?

ইলিয়ানা চুপচাপ অশ্রুশিক্ত নয়নে ওনার দিকে তাকিয়ে থাকে।নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত করে।ইলিয়ানা অবাক হয়।সে তো কান্না করার মতো মেয়ে না।তবে কি করে সে আহান স্যারের সামনে কাদলো!

—হুম(ইলিয়ানা)

—কাকে?(আহান স্যার)

ইলিয়ানা ক্ষোভে ফেটে পড়ে।এবার আর কাঁদে না।ওই জায়গাটা থেকে সরে আসে।আর একটা কথাও বলেনা।সে ছুটে এসে দূরত্ব রেখে পাশাপাশি হাঁটছে।তবে ইলিয়ানা পাত্তা দেয় না তাতে।

রাতে ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলার বিশাল আসর বসেছে। ইলিয়ানা দের ব্যাচের সবাই আসেনি।তো আবার কমও আসেনি।প্রায় পঞ্চানজন উপস্থিত সাইন্স, কমার্স মিলে।বিশাল আসরে সব শিক্ষার্থীরা আবার বসেনি।তবে শিক্ষার্থীদের জোরাজুরিতে স্যাররা বসেছে।সবাই ভেবেছিল আহান স্যার বসবেন না।তবে ইলিয়ানার পাশে তিনি বসে পড়েন।তার বা’পাশে ইলিয়ানা আর ডানপাশে লাবিব স্যার।

খেলার শুরু হয়।বোতল ঘুরে সামীমের দিকে পড়ে।সবাই চিৎকার করে ওঠে।বেচারা ওদের ভয়ে ট্রুথ নেয়।একে একে যতজনের দিকে বোতল পড়েছে সবাই ট্রুথ।তাইতো তাসনিম বিরক্ত হয়ে বলে,

—সবাই যদি ট্রুথই নেয় তাহলে এই গেমের চেয়ে বিরক্তকর গেম আর দ্বিতীয়টি নেই।

—আচ্ছা মন খারাপ করিস না।আমার দিকে আসলে আমি ডেয়ার নিবো।(ইলিয়ানা)

আবারো খেলা শুরু হয়। তবে প্রথমেই ইলিয়ানার দিকে পড়ায় তাসনিম খুশিতে চেঁচিয়ে ওঠে। আমাদের প্রিন্সিপাল স্যার হেসে বলেন,

—এই মেয়ের চিল্লাচিল্লি এখনো যায়নি দেখছি!

সবাই হেসে দেয়। তাসনিম স্যারের কথা বেশি পাত্তা না দিয়ে ডেয়ার চিন্তা করে ফেলে। অতঃপর অতি দ্রুত তা মেহের,অনন্যাসহ সবার সাথে শেয়ার করে।অন্তরা যে রাজি না তা তার ডানে-বামে মাথা ঘুরানো দেখেই বোঝা যাচ্ছে।তবে বাকিরা রাজি।তাইতো তাসনিম বলে উঠলো,

—ইলিয়ানা বেবি প্রপোজ কর আহান স্যারকে।

—হোয়াট,ডেয়ার চেঞ্জ কর ইয়ার(ইলিয়ানা)

—কোনো চেঞ্জ হবে না।দ্রুত কর।(মেহের)

ইলিয়ানা জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।সবাই ভেবেছিলো সে চলে যাবে।তবে সবার ভাবনা ভুল করে আহান স্যারের হাত প্রথমবারের মতো স্পর্শ করে তাকে গোলকের মাঝে এনে দাঁড় করায়।ইলিয়ানা স্কুল গার্ডেন থেকে ফুল এনে বসে পড়ে স্যারের সামনে।

—ভালোবাসা কি জানি না। আসক্তি আপনি।বয়সটা হয়তো অনেক পার্থক্যের।তবুও চাই আপনাকে।বলতে পারেন আসক্তি কেটে যাবে।যদি তাই হতো তবে আরো আগেই কেটে যেতো!ভালোবাসি।আপনি কি একান্তই আমার হবেন?

কথাগুলো বলেই ইলিয়ানা উঠে দাঁড়ায়।বলে,

—ডেয়ার ইজ কমপ্লিট।এখন আমি আসছি।আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট কল আসছে।

সবাই এক অবাকতা থেকে যেখানে বের হতে পারেনি।সেখানে আরেক অবাকতা।কিঞ্চিত দূরে গিয়ে ফোন রিসিভ করে ইলিয়ানা। একজন জানায়,

—ম্যাম বাংলাদেশে সিরিয়াস একটা অপারেশন আছে। আপনি বাংলাদেশে জেনে তারা চাচ্ছে আপনি এই অপারেশনটা করুন।মেবি গাজীপুরের কোনো হসপিটালে এখন আছে।আপনি বললে ঢাকাতে সিফট করতে বললো।

—ঢাকা থেকে সব মেডিকেল সরঞ্জাম,প্রয়োজনীয় মেডিসিন প্রভৃতির ব্যবস্থা রাখতে বলো।আর আমাকে হসপিটালের লোকেশন পাঠাও।(ইলিয়ানা)

—ওকে।ম্যাম আপনাকে লোকেশন পাঠিয়েছি।আপনি কি আজই যাবেন?

—হ্যা। তাদের জানিয়ে দেও।কর্মরত চিকিৎসককে উপস্থিত থাকতে বলো।রোগীর রিপোর্টগুলো রেডি রাখতে বলো।(ইলিয়ানা)

—ওকে ম্যাম।

ইলিয়ানা কথা শেষে এগিয়ে এসে সকলের উদ্দেশ্যে বলে,

—আপনারা সবাই ইঞ্জয় করুন।আমাকে একটু মৌচাকের দিকে যেতে হবে।

—রাত এগারোটায় একাকী যাবে?কোনো ফ্রেন্ডকে নিয়ে যাও।

প্রিন্সিপাল স্যারের বলা কথাটা খারাপ না।তবে ইলিয়ানা কাউকে সঙ্গে নিতে চায় না। কেননা সে আরেকজন গার্ডের থেকে অলরেডি জেনে গিয়েছে জ্যাক বাংলাদেশে।আর জ্যাকের লোকেশনও ইলিয়ানা থেকে খুব বেশি দূরে দেখাচ্ছে না।যাওয়ার পূর্বে ইলিয়ানা এদিক-ওদিক তাকায়‌।আহান স্যার নেই।

ইলিয়ানা রিক্সায় উঠার সাথে সাথেই আহান স্যার লাফিয়ে ওঠে রিক্সায়। ইলিয়ানা ভয় পেয়ে দূরে সরে যায়।তবে আহান স্যারকে দেখে ধাতস্থ হয়।তবুও দূরত্ব রেখেই বসে।আর‌ আহান স্যারও অনেকটা দূরত্ব রেখে বসে এবং বলে,

—বন্ধুদের চক্করে আর কত মানুষকে প্রপোজ করেছে নিজের সাহসীকতা প্রদর্শনে?

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে