অতঃপর_তুমি পর্ব-১০

0
5325

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-১০
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

১৬.
পুরো বাড়িতে অভ্র আর আমি ছাড়া কেউ নেই।অভ্রর বাবা মা গেছেন অভ্র’র অসুস্থ এক নিকট আত্মীয়কে দেখতে।চম্পা গেছে মগ বাজারে তার কোন খালার বাড়িতে,সকালে ফিরবে।আমি বাড়িতে একা বলে অভ্র আজ অফিস থেকে আগেই এসে পড়েছে।
রাত আটটা বাজে।অভ্র হলরুমের সোফায় বসে বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের ম্যাচ দেখছে।আমার কিছু করার নেই তাই কফি বানিয়ে খাচ্ছিলাম।বানানোর আগে অভ্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তিনি খাবেন কিনা।কিন্তু মহাশয় খেলা দেখায় এতটাই ব্যস্ত যে কফিতে এক সেকেন্ডের জন্য চুমুক দেবারও তার সময় নেই।একা একা কোনো কিছুই ভালো লাগে না।খুব বোরিং লাগছে।এমনিতে তো বাড়িতে কেউ নেই আর যিনি আছেন তিনি না থাকার মতই।তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি এই বাড়িতে নন ঐ খেলার ময়দানে বসেই খেলা দেখছেন।অভ্র টানটান উত্তেজনা নিয়ে বসে আছে টিভির সামনে বরাবর সোফায় আর আমি বসে আছি ডান দিকের সোফাটায়।কফি খেতেও বেশি একটা ভালো লাগলো না।তাই মগের অর্ধেক কফি নিয়ে ফেলে দেওয়ার জন্য উঠে টিভির সামনে দিয়ে যাবার সময় কিভাবে যেনো হাতের মগ থেকে কফি ছিটকে খানিকটা মেঝেতে পড়ে গেলো।

ধবধবে সাদা টাইলস করা মেঝে,কফির দাগটা আবার লেগে না যায় এই ভয়ে তৎক্ষনাৎ একটা ঘর মোছার বালতি নিয়ে টিভির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে মেঝে ঘষে ঘষে পরিস্কার করতে লাগলাম।অভ্র বারবার মাথা ঘুরিয়ে একবার এদিক থেকে আরেকবার ওদিক থেকে টিভি দেখার চেষ্টা করছে।আমি সেদিকে ওতো ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছি।
‘আহ!অরু কি করছো তুমি?’
‘কাজ করছি।’
অভ্র বিরক্তমুখে বলল,
‘তোমাকে কে বলেছে এখন এই মোছামোছি করতে?’
‘আরে এখানে কফি পড়েছে মুছবো না।দাগ হয়ে যাবে তো।’
‘হলে হোক।তোমাকে এখন এসব করতে হবে না।তোমার জন্য একটু শান্তিতে টিভি দেখতেও পারছি না।’

আমিও একটা বিরক্তিকর মুখভঙ্গি করে পেছনে ঘুরে আবার মেঝে মোছায় মন দিলাম।উফ! খেলা খেলা করে একেবারে মাথা ঘুরিয়ে ফেলছে।এই খেলার জন্য এখন ফ্লোরে কফি না মুছেই রেখে দিবো।
‘অরু প্লিজ যাও।বিরক্ত করো না।’
‘আমি কি বিরক্ত করলাম?একটু দুইমিনিট ধরে কাজ করছি এতেই বিরক্ত করা হয়ে গেলো?’

‘ও মাই গড!শুধু দুই মিনিট?সেই তখন থেকে ‘বাসার সবাই সকালে কখন আসবে?একটু ফোন দিয়ে জেনে নিন তো’,’কফি খাবেন?’,’চা খাবেন?’,’অন্য কিছু খাবেন?, তারপর একটু পরপর টিভির সামনে দিয়ে একবার এই মাথা থেকে ঐ মাথায় পায়চারী তো আছেই।’

আমি মুখ ফুলিয়ে ফেললাম।পুরো ফিরিস্তি বানিয়ে রেখেছে আমার কথার।মুখ ভার করে বললাম,
‘দেখুন আপনি খেলা।আমি আর ডিস্টার্ব করবো না।আমি চললাম।’

আমি চলে আসতে লাগলাম।আমি ভেবেছিলাম উনি হয়তো আমাকে পেছন থেকে ডাকবেন তাই আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে একটু তার গতিবিধি দেখার চেষ্টা করছিলাম।কিন্তু উল্টো দেখলাম তার কোনো ভাবান্তরই নেই।মাথাটাই গরম হয়ে গেলো।
কত বড় ভাব!ঠোঁট ফুলিয়ে জোড়ে জোড়ে শুনিয়ে বললাম,
‘এরপর কিন্তু কেউ ডাকলেও আমি আর আসবো না।’

উনি এখনও কিছু না বলে একধ্যানে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে।আমি জেদে চোখ মুখ কুঁচকে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চলে যেতে লাগলাম।যা আর এই রুমে আসবোই না।আমি কি একা থাকতে পারি না।কি মনে করে!এখন একা একাই রুমে গিয়ে বসে থাকবো।সিদ্ধান্ত তো নিয়ে নিলাম কিন্তু দরজা ক্রস করতে না করতেই হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেলো।অভ্র ‘ও শিট!’বলে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো।এক সেকেন্ডে জন্য একটু খুশি হলাম।একদম ঠিক হয়েছে কারেন্ট চলে গেছে।এখন দেখুক খেলা আরো।কিন্তু পরক্ষনেই সামনের ঘুটঘুটে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ঘাম ছুটে গেলো।এর ভেতর রুমে গিয়ে বসে থাকবো একা একা।অসম্ভব!
তাই একটু আগের ইগোটাকে ভুলে আমাকেই গুটিশুটি হয়ে অভ্র’র পেছনে গিয়ে দাঁড়াতে হলো।অভ্র ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে হঠাৎ পেছনে ঘুরতে গিয়ে অন্ধকারে আমার সাথে মৃদু ধাক্কা খেয়ে চমকে উঠলো আর বলল,
‘তুমি?এভাবে কেউ হঠাৎ করে পেছনে এসে দাঁড়ায়!’
আমি কিছুই বললাম না।বারবার ঢোক গিলে অন্ধকারের দিকে তাকাতে লাগলাম।অভ্র আমার অবস্থা দেখে একটু মজার ছলে বললো,
‘একটু আগে কে যেনো বললো? কেউ আর ডাকলেও সে আসবেনা।’

আমি চোখ ছোটো ছোটো করে তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে কোনো গালি দেওয়ার প্রস্তুতি নিলাম।এখন আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে মজা করা হচ্ছে!নয়তো আগামী দুই দিনের জন্য আমার মুখ দিয়ে কথা বের করতে পারতো কে!

অভ্র ধীরে ধীরে হলরুম হাঁতড়ে হাঁতড়ে এগিয়ে যেতে লাগলো।আমি একবার আশেপাশের অন্ধকারের দিকে চোখ বুলাচ্ছি আবার অভ্র’র পেছন পেছন ঘেঁষে ঘেঁষে হাঁটছি।অভ্র হঠাৎ পেছনে ঘুরে দাঁড়ানোতে আমি ও’র পায়ে পারা দিয়ে ফেললাম।ও ব্যাথায় আহ! করে উঠলো।

‘ও স্যরি..স্যরি।আপনার লাগেনি তো?’
‘লাগিয়ে বলছো লেগেছে কিনা।তুমি এভাবে ঘেঁষে ঘেঁষে হাঁটছো কেনো?’
‘ঐ অন্ধকারে…।
‘কি?’
‘না কিছু না।’
অভ্র হঠাৎ কিছু বুঝতে পারার মতো করে বলে উঠলো,
‘ও বুঝলাম ম্যাডাম ভিক্টোরিয়ার মতো যে কটকট করে কথা বলে সে কিনা অন্ধকারকে ভয় পায়।’
‘আমি মোটেও অন্ধকারকে ভয় পাই না।আমি কোনো কিছুকেই ভয় পাই না।’

কথাটা শেষ করতে না করতেই আমার মাথা ঘেঁষে একটা টিকটিকি পড়লো আমি চিৎকার দিয়ে অভ্র’র দিকে আরো ঘেঁষে দাঁড়ালাম আর অভ্র অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।

‘কোনো কিছুতেই ভয় পাই না!আর এখন টিকটিকি দেখে ভয়ে লাফিয়ে উঠে।ভীতু!’

‘আমি ভীতু না।ওতো শুধু হঠাৎ মাথার উপর অন্ধকারে পড়লো তাই।আর টিকটিকি দেখে ভয় পেয়ে এমন করিনি সেতো শুধু টিকটিকি দেখলে গা কেমন যেন রি রি করে তাই এমন করলাম।’

‘আচ্ছা!তাহলে তো তুমি কোনো কিছুকেই ভয় পাও না।তাহলে একটা কাজ করো তুমি আগে আগে যাও আর আমি তোমার পেছন পেছন আসছি।’

তার কথায় আমি আতংকিত হয়ে জোড়ে বলে উঠলাম,’না!’

আমার ‘না’ করার ভঙ্গিমা দেখে তার হাসি আরো দ্বিগুণ হয়ে গেলো।আমি মুখ ভার করে বললাম,
‘শুনুন আমি এমনিতে অন্ধকার ভয় পাই না।তবে আজ একটু পাচ্ছি।কারণ আমি দুপুরে খালি বাসায় একা একা বসে হরর মুভি দেখেছি।’
‘ভয় লাগে তাহলে দেখলে কেনো?যখন দেখেছো তখন ভয় পাও নি আর এখন পাচ্ছো।’
‘দেখার সময় কি ভয় লাগে নাকি।যখন দেখি তখন তো মজাই লাগে।ভয় তো লাগে রাতে।জানেন ঐ মুভিতেও না এভাবেই হঠাৎ কারেন্ট চলে যায়।তারপর মেয়েটা লাইট খুঁজতে বের হয়….
অভ্র আমার কথার মাঝে ফিসফিসিয়ে বলতে শুরু করলো,
‘আর তারপরই মেয়েটার মনে হয় ও’র আশেপাশে কেউ আছে আর মেয়েটি পেছনে ফিরে তাকায় আর ভো….!’
অভ্র হঠাৎ আমার কানের কাছে জোড়ে ‘ভো’ করে চিৎকার দেওয়ায় আমি ভয়ে অভ্র’র একহাতের শার্ট খামচে ধরে জড়িয়ে ধরি।আর অভ্র জোড়ে জোড়ে হাসা শুরু করে।
‘সিরিয়াসলি অরু!আমি হাসি থামাতে পারছি না।তুমি কি ভেবেছিলে ভূত এসে পড়েছে?তোমার মতো এতো বড় মেয়ে নাকি ভূতে ভয় পায়!হা হা হা!’
তার হাসিতে খুন হয়ে যাওয়া দৃশ্য দেখে আমার রাগে গা জ্বলে উঠলো।

এর মাঝে আবার অভ্র’র ফোনের টর্চ বন্ধ হয়ে গেলো।আমি ভীত গলায় বললাম,’কি হলো?’

‘ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে।তোমার ফোনটা দাও তো।’
‘ফোন আমার কাছে তো নেই।’
‘কোথায় রেখেছো?’
‘রুমে।’
অভ্র ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বললো,
‘ফোনটা তো এট লিস্ট হাতের কাছে রাখবে।কখন দরকার পরে যায়।এখন এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে কি করবো?কিছু জ্বালাতে হলেও তো সেটাকে আগে খুঁজে বের করতে হবে।’
‘এখন এখানে আমার কি দোষ?মনে নেই অফিস থেকে এসে আপনিই আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে ড্রয়ারে লক করে রাখলেন।’
‘ও হ্যাঁ।মনে পড়েছে আমি অফিস থেকে এসে দেখলাম তুমি বই খুলে রেখে আরামে ফোন টিপছিলে।কিছুদিন পর তোমার এক্সাম তাই আমি তোমার ফাঁকি বাজি বন্ধ করতে ফোন নিয়েছিলাম আর বলেছিলাম যতক্ষণ পড়া শেষ না করবে ফোন পাবে না।’
‘হুম সেটাই।এখন বলুন দোষটা কার?’
‘দোষটা তো তোমারই।না তুমি পড়া ফাঁকি দিয়ে ফোন টিপতে আর না আমি ফোন লক করে রাখতাম।আর তোমার ফোনও এখন তোমার সাথেই থাকতো আর আমাদের এমন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না।’
‘আচ্ছা তাহলে আমিও তো বলতে পারি আপনি কেনো আপনার ফোনটা চার্জ দিয়ে রাখেননি।বসে বসে শুধু খেলা দেখছিলেন।!’
‘এখন এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি শুধু আর্গুমেন্টস-ই করবে নাকি আলো জ্বালানোর মতো কিছু খুঁজবে।’

অভ্র একটু এগিয়ে গিয়ে খানিক থেমে হঠাৎ ম্যাচবক্সের কাঠি জ্বালিয়ে ধরলেন।আমি বললাম,
‘আপনি সিগারেট খান?’
‘হোয়াট!আমি সিগারেট কেনো খাবো?’
‘তাহলে আপনার কাছে এই ম্যাচবক্স কিভাবে এলো?’
‘ম্যাচবক্সটা দেখেই তোমার সিগারেট খাওয়ার কথা কেনো মাথায় এলো?’
‘হুম।কারণ যেসব ছেলেরা সিগারেট খায় তাদের পকেটেই তো ম্যাচবক্স থাকে।’
‘আমি কি ম্যাচবক্সটা পকেট থেকে বের করেছি?আমি তো পেলাম এই ডেস্কের উপর।’
‘ওহ!আপনি অন্ধকারে হাত রাখলেন আর ওমনি ম্যাচবক্সটা পেয়ে গেলেন!
অভ্র আমার কথায় ক্লান্ত হয়ে হাফ ছেড়ে বললো,
‘ম্যাম,ইট’স এ কো-ইনসিডেন্স।কাইন্ডলি প্লিজ আপনি কি আপনার মুখটা একটু কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখবেন।’
তার কথায় আমি মুখ ভেংচি দিয়ে চুপ করে রইলাম।
অভ্র একা একাই নিজে নিজে বলতে লাগলো,
‘ম্যাচবক্সটা যেহেতু এখানে পাওয়া গেছে মোমবাতিও এখানে থাকারই কথা।’

প্রথম ড্রয়ারের পর দ্বিতীয় ড্রয়ারটা খুলতেই অভ্র মোমবাতি পেয়ে গেলো।আমি তার হাত থেকে ম্যাচবক্সটা নিয়ে মোমবাতি ধরিয়ে দিলাম।কাঠি দিয়ে আগুন ধরানোর পর আমার চোখ পড়লো অভ্র’র দিকে।মোমবাতির হালকা আভায় তাকে দেখতে কি সুন্দর লাগছে।আমি অপলক ভাবে তাকিয়ে রইলাম।আর এদিকে কাঠির মাথা পুড়ে আগুন আমার আঙ্গুলের কাছে এসে পড়ায় ছ্যাকা লেগে গেলো।আমি একটু উহ! করে উঠলাম।
অভ্র ব্যস্ত হয়ে মোমবাতিটা টেবিলের উপর রেখে চেয়ার টেনে আমাকে বসিয়ে অপরদিকে নিজে বসে বললো,
‘কি যে করো না!দেখি কোথায় লেগেছে।’
উনি আমার আঙ্গুল উনার মুখের সামনে ধরে ফু দিতে লাগলো।আর আমি তাকে দেখতে লাগলাম।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে