Monday, October 6, 2025







সুতোয় বাঁধা জীবন পর্ব-০৭

#সুতোয়_বাঁধা_জীবন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – সাত

ঘুমকাতুরে রুহান তখনও বিছানায় লেপটে আছে। তার পায়ের তলায় ছোটো ছোটো আঙুলের সাহায্যে সুড়সুড়ি দিচ্ছে উমামা। সে এদিক দিয়ে কাৎ হয়ে আবার অন্যদিক ফিরে ঘুমিয়ে পড়ছে। কিন্তু চোখ টেনে খুলতে পারছে না। উমামা অনেক ডাকাডাকি করার পরও রুহানের ঘুম ভাঙল না। পরিশেষে বাচ্চা মেয়েটা উপায়ন্তর না পেয়ে রুহানের একটা পা টেনে ধরে তাকে বিছানা থেকে ধপাস করে নিচে ফেলতে গেলেই চিৎকার দিয়ে উঠল রুহান। বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে বালিশে মুখ গুঁজে রইল। সচরাচর এত রাত অবধি জেগে থাকে না রুহান। গতকালই দেরী করে ঘুমিয়েছে। তাই আজ ঘুম ভাঙতেও দেরী হচ্ছে তার। সে ঘুমঘুম গলায় বলল,

-‘আজ স্কুলে যাব না, সোনামা।’

উমামা প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। রুহানের গালের কাছে চিমটি দিয়ে বলল,
-‘এখুনি যদি না ওঠো, আমি একা একাই বাবাইয়ের সব আদর নিয়ে নিব। তোমার ভাগে কিচ্ছু রাখব না।’

এবার উমামার গলার স্বরটা রুহানের কানে গেল। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বলল,
-‘তুমি কখন এসেছ?’

-‘বাবাইও এসেছে। ওঠো না ভাইয়া। একসাথে স্কুলে যাই।’

কী নিদারুণ আবদার! উমামার এই আদুরে গলার আবদার ফেলার দুঃসাহস হলো না রুহানের। ঝটপট বিছানা ছাড়ল। অবাক চোখে বলল,

-‘আমি কি তোমার ভাইয়া হই?’

-‘হ্যাঁ। কাল রাতে সোনামা তো বলল, আমরা ভাই-বোন। বাবাইও বলেছে, তোমাকে ভাইয়া ডাকতে। নাম ধরে ডাকলে বেয়াদবী হবে।’

রুহামা পাশে দাঁড়িয়ে পাকাবুড়ির পাকামো কথাবার্তা শুনল। গতকাল রাতে বাড়ি গিয়ে উমামা জেদ ধরেছিল, রুহানকে সে কী বলে ডাকবে এই নিয়ে! তখনই উষাদ বলেছিল, ভাইয়া ডাকতে। নাম ধরে যেন না ডাকে। কিন্তু উমামা মানতে নারাজ ছিল। স্কুলের খাতায় রুহানের জন্মতারিখ উল্লেখ করা থাকলেও সেটা মনে ছিল না উষাদের। মেয়েকে মানাতে বাধ্য হয়ে মাঝরাতে রুদিতাকে ফোন করে বিরক্ত করেছিল দু’জনে। জেনে নিয়েছিল, রুহানের জন্ম তারিখ। এরপরই উমামা মেনে নিয়েছে, সে ছোটো এবং রুহান বড়ো। তাই তাকে ভাইয়া ডাকা-ই উচিত। তার সাথে আদব দিয়ে কথা বলা উচিত।

-‘তাহলে আমি তোমাকে কী বলে ডাকব?’

আসলেই তো! ভাববার বিষয়। দু’জনই গভীর ভাবনায় ডুবে গেল। একজন তো ভাইয়া ডাকবে, অন্যজন কি নাম ধরে ডাকবে? যেহেতু উমামা ছোটো তাকে নাম ধরে ডাকা যায়। কিন্তু রুহান কিছুক্ষণ গালে হাত রেখে ভেবেচিন্তে বলল,

-‘আপু ডাকি?’

-‘আমি তো তোমার ছোটো। ছোটোদের আপু ডাকা যায়?’

রুহান তার সোনামার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ছোটোদের আপু ডাকা যাবে না সোনামা? আমি কি ও’কে নাম ধরে ডাকব?’

রুহামা দু’জনকে পাশে বসিয়ে বলল,
-‘ছোটো-বড়ো ব্যাপার নয়। সম্পর্কটা হচ্ছে সম্মানের। তোমরা যদি একে-অন্যকে সম্মান করো, শ্রদ্ধা করো, ভালোবাসো, তাহলে নাম ধরার বদলে ভাইয়া-আপু বলে ডাকতে পারো। কোনো অসুবিধা নেই।’

-‘আচ্ছা।’

রুহানের আলসেমি দেখে উমামা বলল,
-‘স্কুলে দেরী হচ্ছে তো।’

-‘ভালো লাগছে না, আমার।’

আলসেমি করে আবারও ঘুমোতে চাইছিল রুহান। তখনই দরজার সামনে থেকে উষাদ বলল,
-‘যদি বিকেলের সময়টা ঘোরাঘুরি করে কাটাতে চাও, তাহলে আধঘণ্টার মধ্যে তৈরী হয়ে নাও। নয়তো আজকের আনন্দ তুমি পুরোপুরি মিস্ করবে। তাই না, উমা?’

উষাদের কথায় সম্মতি দিল উমামাও। বলল,
-‘বাবাই বলেছে, ক্লাস শেষে আজ আমাদের নিয়ে শিশুপার্কে ঘুরতে যাবে। তুমি যেতে চাও না, ভাইয়া?’

ঘুরতে যাওয়ার খবর শোনে সব অলসতাকে ঝেড়ে ফেলল রুহান। বলল,
-‘আমিও যাব।’

বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে দৌড় দিল রুহান। হাতে ব্রাশ ও টুথপেষ্ট নিয়ে পিছন পিছন ছুটল রুহামাও। ঘুরতে যাওয়ার নাম শোনেছে, আর তাকে পায় কে!

***

স্কুলের ইউনিফর্ম পরিয়ে রুহানকে পুরোপুরি তৈরী করে নিল রুহামা। রুদিতা নিজেও অফিসের জন্য তৈরী হচ্ছিল। বিদায় নেয়ার সময় রুহানের গালে চুমু খেল রুদিতা। সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিল রুহান। রুদিতা ছেলেকে যত কাছে টানতে চায়, রুহান ততই দূরে সরে যায়। ভয় থেকে নিজেকে মায়ের কাছেপাছে থেকে গুটিয়ে নিয়েছে বাচ্চাটা। এখনও মায়ের সাথে সহজ হতে পারে না। জন্মের পর থেকে মায়ের আদরের অভাব ছিল তার জীবনে। মা থাকার পরও আদর পায়নি। এই কারণে মায়ের প্রতি টানও তার কম। দেখলেই ভয় পায়। লুকিয়ে পড়ে। এখনও উশখুশ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল রুহান। রুদিতা আরও দুটো চুমু খেয়ে বলল,

-‘শান্ত হয়ে থেকো। দুষ্টুমি করবে না, কারও সাথে ঝগড়াঝাটি করবে না। কিছু প্রয়োজন হলে বাবাইকে জানাবে। ঠিক আছে?’

রুহান উপরনিচ মাথা নাড়ল শুধু। রুদিতা বলল,
-‘আমার ওপর এত রেগে থাকো কেন?’

ফ্যালফ্যালিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল রুহান। এরপর না বলল। রুদিতা সুধাল,

-‘রাগোনি?’

-‘না।’

-‘তাহলে কাছে আসো না, কেন?’

রুহান কিছু বলল না। রুদিতা বলল,
-‘আমি কি কখনও তোমাকে বকেছি? মেরেছি?’

এবারও না বলল রুহান। রুদিতা আবারও বলল,
-‘মিছেমিছি ভয় কেন পাও? কেন দূরে সরে যাও? আমারও তো ইচ্ছে করে তোমাকে কোলে নিয়ে আদর করতে। তুমি কেন আমার কাছে আসো না? তুমি কি জানো, তোমার এই কাজ আমাকে রোজ কত কষ্ট দেয়?’

এত কথা রুহান বুঝে না। সে শুধু জানে, মাকে ভয় পায়। ভীষণ ভয় পায়। মা তাকে আদর করলেও সে ভয় থেকে এখনও বের হতে পারছে না। ছেলের এই উদ্ভট আচরণটা ভীষণ ভোগাচ্ছে রুদিতাকে। এই ছেলেটাকে নিজের কোলে ফিরিয়ে আনতে অনেক কাঠগড় পোহাতে হয়েছিল তাকে। কত ঝড়-তুফান, কত মারামারি, কত দৌড়ঝাঁপের পর নাড়িছেঁড়া ধনকে কোলে পেয়েছে সে। পুরনো সব কথা মনে হলেই নিজেকে তার বড্ড অসহায় মনে হয়। আর দেরী করা চলে না। রুহানের ক্ষতি হচ্ছে। শীঘ্রই তাকে ভালো একজন ডাক্তার দেখাতে হবে, এই চিন্তা মাথায় রেখে ছেলেকে নিয়ে বসার ঘরে আসলো রুদিতা। উষাদকে দেখামাত্রই ছুটে গেল রুহান। কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বলল,

-‘আমরা আজ ঘুরতে যাব?’

-‘হ্যাঁ, যাব। খেয়ে নাও আগে। স্কুল ছুটি হলেই আমরা ঘুরতে যাব। দেরী হচ্ছে তো।’

সামান্য নাশতা খেয়ে দু’জনকে নিয়ে রাস্তায় চলে এলো উষাদ। বাড়ির মূল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল রুদিতাও। উমামা ছুটে এসে তাকে চুমু খেল। আদর নিল। তারপর গাড়িতে গিয়ে বসল। কিন্তু রুহান আসলো না। সে দাঁড়িয়েই রইল। উষাদ বলল,

-‘মাম্মামের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসো।’

রুহান কাছে গেল না। দূর থেকেই ‘আল্লাহ্ হাফেজ’ বলল। রুদিতা হাত নাড়াল। উষাদ গভীরচোখে দু’জনকেই লক্ষ্য করল। রুহানকে বলল,

-‘তুমি কি মাম্মামের ওপর রেগে আছো?’

-‘না তো।’

-‘তবে কাছে গিয়ে বিদায় নাওনি কেন? উমা যেভাবে আদর করল, তুমিও আদর করে এসো।’

-‘পারব না।’

রুহান নিজের জায়গায় স্থির রইল। গালমুখ ফুলিয়ে একসময় গাড়িতে গিয়ে বসল। উষাদ মারাত্মকভাবে চমকে গেল। হতাশ হলো রুহানের এই অহেতুক আচরণে। রুদিতার মুখটাও থমথমে হয়ে আছে। উষাদ কাছে এসে বলল,

-‘কিছু কি হয়েছে?’

-‘কোথায়, কী হবে? সব ঠিক আছে।’

ঝটপট জবাব দিল রুদিতা। উষাদ আহতস্বরে বলল,
-‘রুহান এরকম আচরণ কেন করছে? আপনার কাছে আসছে না, আপনিও ও’কে কাছে টানছেন না।’

-‘ও এমনই। কখনওই আমার কাছে আসে না। জোর করলে হিতে বিপরীত হয়।’

-‘কেন? আপনি তো ওর মা। মায়ের কাছে আসতে এত দ্বিধা কেন?’

-‘আমি শুধুই মা। জন্ম দিয়েছি। অন্যসব দায়িত্ব পালন কর‍তে পারিনি।’

-‘মানে?’

-‘রুহান গত ছ’মাস ধরে আমার কাছে থাকছে।’

যারপরনাই চমকাল উষাদ। বলল,
-‘এত বছর কার কাছে ছিল?’

-‘ইফতির কাছে।’

রুদিতার মুখে এমন একটা অচেনা ও পুরুষের নাম শোনে কিছু সময় নীরব রইল উষাদ। পরমুহূর্তে জানতে চাইল,

-‘ইফতি কে?’

-‘রুহানের জন্মদাতা আর…। আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ ও জঘন্য অধ্যায়ের নাম।’

ইফতি যে রুদিতার প্রথম স্বামী, এটা নিশ্চিত বুঝতে পারল উষাদ। তার মুখের কথারা হারিয়ে গেল। বলার মতো উপযুক্ত শব্দ, বাক্য খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইল। রুদিতা বলল,

-‘একটা হেল্প করতে পারবেন?’

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল উষাদ। রুদিতা বলল,
-‘ওকে নিয়ে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতাম। আমি অফিসের কাজে সারাদিন এত ব্যস্ত থাকি, সময়ও পাই না।’

এবারে উষাদ বুঝল, রুহান কোনোভাবে মানসিক আঘাত পেয়েছে। তার মনে মা’কে ঘিরে কোনোপ্রকার ভয় কাজ করছে। এইজন্যই মায়ের কাছেপাশে ঘেঁষতে চাইছে না সে। দূরে দূরে থাকছে। ডাক্তার দেখালেই হয়তো এই সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। এইটুকু বুঝে উষাদ বলল,

-‘কবে যেতে চান?’

-‘আপনি যেদিন ফ্রি হবেন।’

-‘দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের জন্য আমি সবসময়ই ফ্রি। শুধু সময় করে আমাকে জানিয়ে রাখবেন। কবে, কখন, কোন ডাক্তারের কাছে যেতে চান।’

-‘থ্যাংক য়্যু।’

স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে। এক্ষুণি রওনা দিতে হবে। গাড়িতে ওঠার আগে উষাদ বলল,
-‘অফিস কোনদিকে? আমি পৌঁছে দিই?’

-‘না, না। ওদের দেরী হয়ে যাবে। আপনি যান। দশমিনিট পর আমার অফিসের গাড়ি আসবে।’

-‘তাহলে আর কী? সাবধানে যাবেন। আসছি। ফিরতে দেরী হলে দুঃশ্চিন্তা করবেন না কেউ। সন্ধ্যের আগেই আমি ও’কে পৌঁছে দেব।’

***

দু’জনকে নিয়ে একসাথে স্কুলে পৌঁছাতেই এই দৃশ্যটা সবার প্রথমে চোখে পড়ল প্রিন্সিপাল ম্যাডামের। তিনি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কফি পান করছিলেন। উষাদের সঙ্গে দু’জনকে দেখে খানিকটা অবাকই হলেন। অফিস-রুম ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। উষাদ ক্লাসরুমে প্রবেশ করল। দু’জনকে পাশাপাশি বসিয়ে বলল,

-‘একদম দুষ্টুমি করা চলবে না। কিছু প্রয়োজন পড়লে বাবাইকে জানাবে। আর কিছুক্ষণ পরই ক্লাস্ শুরু হবে।’

রুহান ঘাড় কাত করে সায় দিল। বাকি ছাত্রছাত্রীদের সাথে খেলাধুলা করার অনুমতি দিয়ে অফিসরুমে পা ফেলল উষাদ। নওশীন আরা খানমকে দেখে সালাম দিল। তিনি সালামের জবাব নিয়ে বললেন,

-‘কী অবস্থা? কেমন আছেন?’

-‘আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি?’

-‘ভালো আছি। রুহান আজ আপনার সাথে যে!’

উষাদ লজ্জামাখা এক হাসি দিল। চেয়ারে বসে কপাল চুলকে বলল,
-‘একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে ম্যাম।’

-‘তাই না-কি? কী সেই মারাত্মক ঘটনা শুনি!’

-‘আগে একজনের দায়িত্ব ছিল, এখন তিনজনের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়েছে।’

-‘মানে?’

-‘আর বলবেন না, মা একজনকে পছন্দ করে রেখেছিলেন। আমাকে কিছু জানাননি। গত পরশু সবে জানালেন, উমাও জেদ ধরল। ব্যস, এরমধ্যেই কালরাতে আকদের কাজ সম্পন্ন হয়ে গেল। নিমিষেই আমি ছন্নছাড়া, বাঁধনহারা পাখি থেকে পোষমানা পাখি হয়ে গেলাম।’

নওশীন আরা খানম হাসিমুখে বললেন,
-‘ওয়াও! কংরাচুলেশনস্। খুশির খবরে নিজেকে পোষমানা পাখি দাবী করছেন, কেন? আপনি তো একটা চমৎকার কাজ করেছেন। দায়িত্ব কাঁধে নেয়া কত কঠিন জানেন? আর সেটা যদি হয় কোনো ইয়াতিম বাচ্চা, তাহলে তো কথাই নেই। আজকালকার সব পুরুষেরা দায়িত্ব কাঁধে নিতে জানে না স্যার। ইয়াতিমদের মানুষ বোঝাই মনে করে। অথচ আপনি কত সহজেই তা করে ফেললেন।’

-‘সব আল্লাহর ইচ্ছা, ম্যাম। দোয়া রাখবেন। আমি যেন সব দায়িত্ব-কর্তব্য ঠিকঠাকভাবে পালন করতে পারি।’

-‘ইনশা’আল্লাহ্। আল্লাহ্ সব সহজ করে দিবেন।’

একে একে আরও সব স্যার-ম্যাডামদের আগমন ঘটল। সবাই এসে উষাদকে শুভেচ্ছাবার্তা জানাচ্ছে। উষাদও সব দোয়া ও শুভেচ্ছা বিনাবাক্যে গ্রহণ করছে। এত বছর ধরে এখানকার প্রত্যেকের সাথে কাজ করতে গিয়ে সবার সাথেই মজবুত ও বিশ্বস্ত এক সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। যার কারণে, প্রত্যেকের বিষয়ে প্রত্যেকে অল্পস্বল্প ঘটনা ও জীবনের উত্থান-পতনের নানাবিধ ছোটো ছোটো গল্পগুলো জানে। তবে কেউ-ই খুব বেশি কিংবা বাড়াবাড়ি রকমের কথা জানতে চায় না। একটা মানুষ সম্পর্কে ততটুকুই জানা উচিত, যতটা ব্যক্তি নিজে থেকে জানাতে আগ্রহী। বেশিকিছু জানতে চেয়ে কাউকে কোনোপ্রকার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার মতো ছোটো মন-মানসিকতা নেই কারও। এজন্য কেউ-ই জানতে চায়নি, মেয়েটা কে! কী কাজ করে! বাড়ি কোথায়! কার কী! শুধু রুহানের বাবার আসনে নিজেকে বসিয়েছে, এইটুকুই জেনেছেন সবাই। বুঝেও গেছেন, সেই মেয়েটা যে মিসেস রুদিতা। এই কারণে আর কোনো বাড়তি প্রশ্নের চাপে পড়েনি উষাদ। শুধু দোয়া ও শুভেচ্ছাটাই হাসিমুখে গ্রহণ করেছে।

***

রুহানের আজকের দিনটা স্বপ্নের মতো সুন্দর। রূপকথার গল্পের মতো সাজানো-গোছানো আর ঝামেলাবিহীন। উমামার পাশে বসে ক্লাস করা। একসাথে ক্লাসওয়ার্ক করা। টিফিন টাইমে একই খাবার ভাগ করা। আবার খেলাধুলার সময় হাতে হাত ধরে ক্লাস থেকে বেরিয়ে মাঠে ছোটাছুটি করা। সবকিছুই তাকে সুখ দিচ্ছে। হাসি দিচ্ছে। পবিত্র চেহারার ওই চমৎকার হাসিটাকে দূর থেকে লক্ষ্য করছে উষাদ। ভাবছে, পিছনের জটিল অধ্যায়টা ঠিক কী! রুদিতা কেনই-বা বলল, ইফতি তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ ও জঘন্য অধ্যায়ের নাম! তবে কি দুটো মানুষের জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত দুটো ট্রাজেডি আছে? থাকতেও পারে। নয়তো জীবন কেন এত কঠিন হলো দু’জনার? আরেকটু সহজ ও সুন্দর হলে কী এমন ক্ষতি হতো?

সমবয়সী কয়েকটা বাচ্চাকাচ্চা একসাথে খেলছে। উমামা ও রুহান যোগ দিয়েছে খেলায়। এই কিন্ডারগার্টেনে পড়াশোনার পাশাপাশি বাচ্চাদেরকে খেলাধুলা, বিনোদনসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। শিশুরা এখানে মনমতো সময় কাটাতে পারে। খেলতে পারে। দৌড়াতে পারে। এখানকার সব বাচ্চা বুদ্ধিমান-বুদ্ধিমতী। প্রত্যেকেই ভীষণ চটপটে ও আদুরে। খেলতে খেলতে ক্লান্ত উমামা একটা সময় দৌড় থামিয়ে ‘ওয়াটার পট’ থেকে পানি পান করল। রুহান বলল,

-‘আমরা কখন ঘুরতে যাব, আপু?’

ঘোরাঘুরির কথা ভুলেই গিয়েছিল উমামা। রুহানের কথায় মনে পড়ল। মুখভার করে আদুরে আওয়াজে বলল,

-‘কিন্তু বাবাই তো এখনও ফ্রি হয়নি। চলো, আমরা গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসি।’

দু’জনেই ছুটল উষাদের কাছে। ছুটির আরও বেশ কিছুক্ষণ বাকী। ক্লাস শেষ করে ফ্রি সময়টায় চা পানের বিরতি নিয়েছিল উষাদ। বসে বসে চা পান করছিল। ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চেয়ে উমামা বলল,

-‘বাবাই, ঘুরতে কখন যাব আমরা?’

উষাদ চোখ তুলে দু’জনকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
-‘আজ ঘুরতে যাওয়ার এত তাড়া কেন? ক্লাস্ শেষ হোক। যাব তো। না-কি ক্লাস্ ফাঁকি দিতে চাও দু’জনে?’

উমামা দু’হাতে উষাদের গলা প্যাঁচিয়ে ধরে আহ্লাদী স্বরে বলল,
-‘একদিন ফাঁকি দেই না, বাবাই। কিচ্ছু হবে না।’

-‘ক্লাস্ ফাঁকি দিলে হোমওয়ার্কের কী হবে? আগামীকালের পড়া কমপ্লিট করবে কীভাবে?’

উমামা ফিসফিসিয়ে বলল,
-‘তুমি হেল্প করবে।’

-‘যদি না করি?’

-‘জানি তো, করবে। চলো না, যাই। একদিন-ই মিস দিব।’

রুহানের দিকে দৃষ্টি দিল উষাদ। দু’জনই আগ্রহী মেজাজে দাঁড়িয়ে আছে। যেন এক লাফে খাড়া। এক্ষুণি যাই বললেই ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়বে। সে দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘ঠিক আছে, যাও। আধঘণ্টা পর ঘুরতে যাব। প্রতিদিন কিন্তু ক্লাস্ ফাঁকি দেয়া মেনে নিব না।’

-‘আমরা কি ঘুরতেও যাব না?’

গাল ফুলিয়ে বলল উমামা। উষাদ বলল,
-‘কেন যাবে না? অবশ্যই যাবে। তবে ছুটিরদিন, অথবা ছুটির পর। ক্লাস্ ফাঁকি দিয়ে নো ঘোরাঘুরি। মনে থাকবে?’

উমামা ‘হ্যাঁ’ বললে, রুহানও মাথা নাড়ল। এখনও সে উষাদের সাথে পুরোপুরি ফ্রি হতে পারছে না। তবে আদরটুকু ঠিকই গ্রহণ করে নিতে শিখে গেছে। উষাদ বলল

-‘এখন ক্লাসে যাও।’

দু’জনকে ক্লাসে পাঠিয়ে আধঘণ্টা বললেও প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট পর অন্য একটা ক্লাস শেষ করে, প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে নিল উষাদ। দু’জনকে সাথে নিয়ে রওনা দিল, পার্কে। আনন্দে আত্মহারা বাচ্চাদুটো নিজেদের খুশিকে মেলে ধরতে লাগল। মুগ্ধচোখে দুটো অবুঝ বাচ্চার খিলখিল হাসি ও খুশিটাকে দেখল সে। পার্কে প্রবেশ করে দু’জনকে হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত করে দিল। বলল,

-‘যাও, উড়ো, ডানা মেলে, নির্ভয়ে। সময়টাকে মুঠোবন্দী করে, নিজেদেরকে প্রকাশ করো। শাসন, বারণ, নিষেধাজ্ঞা কিচ্ছু থাকবে না আজ।’

***

চলবে…

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ