সুতোয় বাঁধা জীবন পর্ব-০৬

0
552

#সুতোয়_বাঁধা_জীবন
লেখনীয় : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ছয়

-‘আপনার চা।’

দু’জনার প্রথম আলাপের শুরু হলো সবে। সংকোচ ও দ্বিধা নিয়েই চায়ের কাপ রেখে খানিকটা দূরে এসে বিছানার এককোণে বসল রুদিতা। অফিসের কাজের সুবিধার জন্য বেতের দুটো সোফা ও ছোট্ট একটা টি-টেবিল নিজের রুমে রেখেছে সে। সেখানেই একসিটের সোফাতে বসে পকেট থেকে চেকবুক বের করে দ্রুত হাতে দেনমোহরের নির্দিষ্ট অ্যামাউন্ট বসিয়ে দিল উষাদ। লেখা শেষে চোখ তুলে রুদিতাকে একনজর দেখে কণ্ঠস্বর নিচু রেখেই বলল,

-‘এটা রেখে দিন। কাজে লাগবে।’

একদৃষ্টিতে সদ্যলেখা চেক-এর দিকে তাকিয়ে রইল রুদিতা। দীর্ঘশ্বাসের সাথে নিজের সবটুকু যন্ত্রণা আড়াল করে বলল,

-‘চা শেষ করুন, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’

উষাদ কিছু বলল না। কলম পকেটে ঢুকিয়ে বাড়তি কাপটা নিজেই বাড়িয়ে দিল রুদিতার দিকে। রুদিতা অবাক চোখে চেয়ে থেকে বলল,

-‘আপনি কষ্ট করছেন কেন? আমি নিজেই নিতাম।’

মনে অনেক প্রশ্ন উদয় হলো উষাদের। রুদিতার এই ঠাণ্ডামাথার কথা ও শান্তশিষ্ট মেজাজটা তার মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে ইতিমধ্যে। সব কথা বলার, জানার কিংবা বোঝার উপযুক্ত সময় এটা নয়, তাই কোনোকিছু নিয়ে বাড়তি আলাপ-আলোচনায় যেতে চাইল না সে। এখনও কেউ কাউকে এত গভীরভাবে চিনতে পারেনি। আগে নিজেরা নিজেদের চিনুক, জানুক, বুঝুক, তারপর বাকিসব কথার আদান-প্রদান হবে। উষাদ খুব সহজ ও দৃঢ়কণ্ঠে বলল,

-‘দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছি, সবদিক খেয়াল রাখা উচিত।’

রুদিতার ম্লানমুখে একটুকরো হাসি দেখা গেল। সে জানে, বিয়ের পর প্রথম প্রথম সব ছেলেরাই এইভাবে আদুরে কথার জালে ফেলে তাদের বউদের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ব-কর্তব্য জাহির করে। এরপর ভালোবাসতে বাধ্য করে। সম্পর্কের প্রতি টান ও ভালোবাসা জাগিয়ে, সুযোগ বুঝে টুপ করে দুর্বল জায়গায় আঘাত দিয়ে প্রতিনিয়ত নরকযন্ত্রণা উপহার দেয়। সে-ও পালটা জবাবে বলল,

-‘খুব বেশি দায়িত্বশীল হতে চান?’

উষাদ হাসিমুখে জবাব দিল,
-‘সম্পর্ক, বন্ধন, পরিবার, আপন মানুষ কিংবা কাছের মানুষ প্রত্যেকটা মানুষকে ভালোবেসে, সবার প্রতি সম্মান বজায় রেখে, প্রত্যেকের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া – মানুষ হিসেবে একজন মানুষের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হওয়া উচিত বলে মনে করি। আমি আমার জায়গায় থেকে প্রত্যেকটা সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি সবসময়। নিজের বিবেক ও মনের কাছে শুদ্ধ থাকতে, সৎ থাকতে সব দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করার চেষ্টা করি। এটা যদি খুব বেশি দায়িত্বশীলতার পর্যায়ে পড়ে, তাহলে আমি তা-ই।’

মনের সব ভয় মুহূর্তেই বিস্ময়ে রূপান্তরিত হলো রুদিতার। ক্ষণে ক্ষণে বিস্ময় বাড়তেই থাকল। বাড়িয়ে রাখা চায়ের কাপটা আলগোছে নিজের হাতে আনল। বলল,

-‘আমি কি আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ি?’

-‘অবশ্যই। ‘কবুল’ বলে গ্রহণ করেছি আপনাকে। অস্বীকার করার মতো এত নীচু মন নেই আমার। আমি জানি, আমাদের এই সম্পর্ক তৈরী হয়েছে শুধুমাত্র দুটো বাচ্চার সুখ ও সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে। মূলত, ওদেরকে পরিবার ও বাবা-মায়ের আদর-স্নেহ পুরোটা দেয়ার জন্যই আমাদের এই বন্ধনে জড়ানো। তবে সবচে বড়ো সত্য এই যে, সম্পর্ক গড়ে ওঠার পিছনে, ওরা সামান্য উছিলা হলেও আপনি আমার স্ত্রী ও আমার দায়িত্বের অন্যতম প্রধান অংশ, যা আমি শত চাইলেও অস্বীকার করতে পারব না। আজ থেকে যেহেতু আপনি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্যের একটা অংশ হয়ে গিয়েছেন, তাই এখন থেকে এইমুহূর্ত থেকে আপনার ও রুহানের জীবনের ভালো-মন্দের যাবতীয় দায়ভার আমার। আমি চেষ্টা করব, একজন ভালো বাবা হয়ে ওঠার পাশাপাশি কারও বিশ্বস্ত আশ্রয় হতে। আর এ-ও চাইব, আপনিও যেন ভালো মা হয়ে উঠতে পারেন।’

রুদিতা অপলকে শোনে গেল। আফসোস হলো, ইফতি যদি এইভাবে ভাবত। তবে হয়তো, রুহান ও তার জীবনটা আজ এমন হতো না। রুদিতার সব ভাবনায় জল ঢেলে দিয়ে উষাদ পূণরায় বলল,

-‘দুটো বাচ্চার ভবিষ্যতকে সুন্দর করে সাজানো-গোছানোর এই অঙ্গীকারে আমার পাশে আপনাকে ভীষণ প্রয়োজন। আপনি থাকবেন তো?’

রুদিতা চায়ে চুমুক দিল। এমন কথা উপেক্ষা করার সাহস যেমন তার নেই, এত সহজে গ্রহণ করার মতো মেজাজটাও নেই। মন এখনও অনেক দুর্বল, অনেক ভীতু। এযে পুরুষ মানুষের তৈরী করা কঠিন এক ফাঁদ। এই ফাঁদ তাকে আবার ভোগাবে। খুব ভোগাবে। সে নিশ্চিত। অযাচিত ভাবনা ও ভয়কে মনে পুষে রেখে নির্বিঘ্নে বলল,

-‘নিয়তি একই সুতোয় বেঁধে দিয়েছে আমাদের জীবন। না থাকার প্রশ্নই আসে না। তবে, সবকিছুকে সহজভাবে গ্রহণ করতে আমার একটু সময় লাগবে।’

***

দু’জনার আলাপচারিতায় বাধা পড়ল। দরজায় ঠকঠক করে আওয়াজ করল কেউ। কথোপকথন থামিয়ে দু’জনের দৃষ্টি-ই দরজার দিকে আটকাল। ওপাশ থেকে রওনক চাপা অনুরোধ ও আদেশের স্বরে বলল,

-‘রাহা একটু বাইরে আয় তো।’

দেরী করল না রুদিতা। থমথমে গলার স্বর শোনে ঝটপট দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে ভাইয়ের পিছনে দাঁড়িয়ে বলল,

-‘ডাকলে?’

রওনক চমৎকার এক হাসি দিল। বোনের মাথায় হাত রেখে বলল,
-‘দোয়া করি, সুখী হ।’

আশ্চর্যের সপ্তম আকাশে পৌঁছে গেল রুদিতা। মনের ভেতর মিছেমিছি ভয় দানা বাঁধতে শুরু করল। রওনক তাকে দোয়া করছে, এ-ও হওয়ার ছিল? কেন যেন এই দোয়ার মাঝেও রহস্য রহস্য গন্ধ পেল সে। মুখফুটে কিছু না বললেও ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,

-‘তোমার দোয়া কবুল হোক।’

রওনক চাপা স্বরে এবার বলল,
-‘ইয়ে মানে, একটা দরকারী কথা বলতাম।’

ভয় সত্যি হতে যাচ্ছে দেখে মনকে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে নিল রুদিতা। ঠিকই আন্দাজ করেছিল, রওনকের এখানে আসা ও দোয়ার পিছনে কিছু একটা রহস্য আছেই। দরকারী কথা ও দোয়া দিয়ে বোনকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে তার আদরের ভাই। নিজের মনের ভাবনাকে লুকায়িত রেখে বলল,

-‘বলো।’

আমতা-আমতা স্বরে বোনের কানের কাছে ফিসফিস করে কিছু বলল রওনক। ‘ইন্না-লিল্লাহ’ বলে দু’হাতে মুখ ঢেকে রেখে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে রুদিতা বলল,

-‘এসব কী বলছ ভাইয়া? এটা কী করে সম্ভব? আমি এখনও ওই চেকটা হাতে নিইনি।’

-‘আস্তে কথা বল, শোনে ফেলবে তো।’

নিচু স্বরে ধমকে উঠল রওনক। রুদিতা ভয় পেল না। রাগান্বিত মেজাজে বলল,
-‘শোনলে শুনুক, আমার কিছু যায় আসে না। তুমি এমন একটা আবদার কী করে করতে পারো, বুঝি না আমি। ছিঃ ছিঃ।’

-‘আরেহ্, এত ছিঃ ছিঃ করার কী আছে? এটা তো তোরই টাকা। দেখ্, আজ অনেক টাকা খরচ হয়েছে। কিছু টাকা ঋণ করেছি আমি। দেনা তো দিতেই হবে, তাই না? লক্ষ্মী বোন আমার, চেকটা নিয়ে আয়।’

-‘আমি পারব না ভাইয়া।’

-‘খুব খারাপ হবে কিন্তু। তিন তিনটে বোঝা টানতে টানতে কতদিকে হাত পাততে হয়েছে আমাকে। তোরা আমার কষ্ট বুঝবি কী? ঘরের কোন খবরটা রাখিস্ তোরা? সারাদিন বাইরে বাইরে থাকিস্। ঝড়তুফান তো সব আমার উপর দিয়েই যায়।’

লজ্জায়, অপমানে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো রুদিতার। এই ছোটোখাটো আয়োজনে যা খরচ হয়েছে, সবটাই তার নিজের টাকার অংশ থেকে হয়েছে। বরের বাড়ির লোকজনের আপ্যায়ন ছাড়াও পরিবারের সবাইকে উপহারসামগ্রীর পিছনে যত খরচ হয়েছে, সেটুকুও রুদিতা সামলেছে। ভাইয়ের পকেট থেকে এক টাকাও খরচ হয়নি। তবুও এই ভাই বলছে, তার ঋণ জমা হয়েছে। যদি দুইবোন ও মায়ের পিছনে সে খরচ না-ই দেয়, এত টাকা ঋণ হয় কীভাবে? আর হবেই কেন? তার নিজের ব্যবসা আছে। এত বড়ো একটা ফাস্টফুডের দোকান সামলায় যে, তার আবার ঋণ আসে কোথা থেকে? রুদিতার নীরবতা দেখে রওনক আবারও বলল,

-‘দাঁড়িয়ে আছিস্ কেন? যা, নিয়ে আয়।’

-‘পারব না। আমি জানি তোমার কোনো ঋণ হয়নি। তুমি আমাকে মিথ্যে বলছ। আসলে ওই টাকাটা তোমার চাই, তাই এই নাটক।’

দাঁতে দাঁত চাপল রওনক। বলল,
-‘বুঝতেই যখন পারছিস্, যাচ্ছিস্ না কেন?’

-‘একবার বলেছি, আমি ওই টাকায় হাত দেব না।’

-‘তাহলে কালই তোদেরকে রাস্তায় নামিয়ে দেব।’

-‘এত সহজে আমরা আমাদের অধিকার ছাড়ব কেন?’

-‘ঘাড়ধাক্কা বুঝিস্? অপমান বুঝিস্? তোকে কিছু করব না। শুধু তোর ওই মা ও বোনকে আশ্রমের দ্বারে পৌঁছে দিয়ে আসব।’

আঁৎকে উঠল রুদিতা। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
-‘ছিঃ ভাইয়া। তুমি এত নিচে নামলে কী করে?’

-‘যদি চাস্, মা আর রুহামা এখানেই থাকুক তাহলে চেকটা নিয়ে আয়।’

-‘হায়রে মানুষ! আরও কত রূপ দেখাবে। তুমি যে আমার ভাই, সেটা ভাবতেই ঘৃণা হয় আমার। নির্লজ্জ, কাপুরুষ কোথাকার।’

ঘৃণিত দৃষ্টি দিয়ে রওনককে একবার ভালোমতো দেখে রুমের ভেতরে প্রবেশ করল রুদিতা। টি-টেবিলে রাখা চেকটার দিকে ফিরেও তাকাল না। চাবি দিয়ে আলমারি খুলল। ভেতরের ছোট্ট ড্রয়ার থেকে গুনে গুনে এক হাজার টাকার পঞ্চাশটা নোট বের করে ঝড়েরবেগে বারান্দায় এসে টাকার বান্ডেল ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলল,

-‘আর অমানুষ থেকো না। এবার মানুষ হও।’

***

জীবনে এত অশান্তি, অপমান আর ভালো লাগে না। অসহ্য লাগে চারপাশ। অসহ্য লাগে চারপাশের মানুষ ও সম্পর্ককে। কেন সবকিছু এত জটিল ও কঠিন বুঝে না রুদিতা। শুধু জানে, এই সমাজ পাল্টাবে না। এই সমাজের মানুষ পাল্টাবে না। লোভ, হিংসা এসব মানুষকে অন্ধ বানিয়ে রেখে দিয়েছে। মানুষ আর মানুষ নেই। বিবেক হারিয়ে অমানুষ হয়ে বসে আছে। তার ভাই রওনকই তার জলজ্যান্ত এক দৃষ্টান্ত। ভাইয়ের এই রূপ ও মা-বোনের চিন্তায় এলোমেলো ভাবনা নিয়েই রুমে পা রাখল রুদিতা। উষাদ বলল,

-‘সব ঠিক আছে?’

রুদিতা চমকে তাকাল। তড়িৎ মাথা নাড়ল। ঘরে যে বাড়তি একটা মানুষ ও সদ্য বিবাহিত পুরুষ আছে, সে ভুলেই গিয়েছিল। মেকি হাসি ফুটিয়ে বলল,

-‘একদম।’

উষাদ উঠে দাঁড়াল। ভাই-বোনের আলাপচারিতার ফাঁকেই তার চা পানের সমাপ্তি ঘটেছে। প্রয়োজনীয় কাজটাও শেষ। রাত অর্ধেকের বেশি। আর দেরী করা চলে না। সে বিদায়ের প্রস্তুতি নিয়ে বলল,

-‘আপনার ফোনটা একটু দেয়া যাবে?’

ফোন কেন প্রয়োজন, এমন ভাবনা নিয়ে উষাদের দিকে তাকিয়ে রইল রুদিতা। উষাদ বলল,
-‘আপনার ফোনে আমার নম্বর আছে। সেইভ করে দিই?’

রুদিতা সত্যি সত্যিই এবার মারাত্মক চমকাল। বলল,
-‘আমার ফোনে আপনার নম্বর আসবে কোথা থেকে?’

-‘বারে! গতদিন কতবার করে কল দিলাম, রুহানের ব্যাপারে কথা বলার জন্য, কেউ ফোন রিসিভই করল না। কললিস্ট দেখুন, গতদিন দুপুরে পাঁচবার কল করেছি।’

নিজের ফোন হাতে নিয়ে বিস্ময়ে ‘থ’ বনে দাঁড়িয়ে রইল রুদিতা। উষাদ হাত বাড়াতেই আলগোছে ফোন দিয়ে দিল। গতদিন সে ওই সময়ে কনফারেন্স রুমে মিটিং-এ ব্যস্ত ছিল, তাই কোনোপ্রকার ফোনকল রিসিভ করতে পারেনি। নিজের অপারগতা জানিয়ে বলল,

-‘আমি তখন অফিসের জরুরী একটা মিটিংয়ে ছিলাম।’

-‘বুঝতে পেরেছি।’

নম্বর সেইভ করে পূণরায় ফোনটা রুদিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে উষাদ বলল,
-‘প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কল করে জ্বালাতে পারেন। বকাঝকা করব না। আমি আবার খুব ভদ্র মানুষ। অকারণে কারও ওপর চোটপাট করি না।’

রুদিতা কিছু বলল না। নিশ্চুপে ফোনটা নিজের হাতে টেনে নিল। সে বুঝতে পারল, ইনিয়েবিনিয়ে ছেলেটা তাকে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে গতদিনের ঘটনার কথা মনে করে বলল,

-‘আমিও অকারণ কারও ওপর চোটপাট করি না। গতদিন রিজন ছিল, তাই ওভাবে রি’অ্যাক্ট করেছি।’

উষাদ বলল,
-‘আমি তো সেটা নিয়ে কিছু বলিনি।’

-‘সরাসরি বলেননি, কিন্তু ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে ঠিকই বলেছেন।’

-‘মোটেও সেটা নয়। আমি কথাটা অন্যভাবে বলেছি। আপনি এক্ষুণি সেটা বুঝবেন না।’

-‘আমাকে এত বোকা ভাববেন না।’

-‘আচ্ছা, ভুল হয়েছে আমার। কথা না বাড়াই আর। বিদায় নিচ্ছি। ভালো থাকবেন। রুহানের প্রতি একটু মনোযোগী হবেন।’

রুদিতার মনে হলো, ছেলেটা তাকে জ্ঞান দিচ্ছে। একদিনেই এত অধিকার জন্মে গেছে? সে রেগে গিয়ে বলল,
-‘আপনি কী বলতে চান, আমি রুহানের প্রতি অমনোযোগী?’

উষাদ সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই রুদিতা ভয়ানক রেগে গেল। বলল,
-‘কাউকে পুরোপুরি না জেনে, তার সম্পর্কে বাড়াবাড়ি কিছু ভাববেন না প্লিজ।’

-‘যতটা দেখেছি, বুঝেছি, তার থেকেই বলেছি। আপনি রুহানের প্রতি ভীষণ অমনোযোগী। সামান্য একটা আইসক্রিমের জন্য যেভাবে রি’অ্যাক্ট করলেন! এতদিন হলো রুহান ওই স্কুলে অ্যাডমিশন নিয়েছে, কোনো পেরেন্টস্ মিটিংয়ে আপনাকে দেখা যায়নি। কেন? কোনো মনোযোগী গার্ডিয়ান তার সন্তানকে এভাবে অযত্নে ছেড়ে দেয় না।’

সে-ই একই কথা। একই প্যাঁচাল। এক্ষুণি এত কথা কীসের? এত অধিকার কীসের? রুদিতা বিরক্ত হলো। বলল,
-‘আপনি কি যাবেন? মেজাজটা একদম চটে আছে আমার। উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলতে পারি। বিয়ের দিনই আজেবাজে কথা বলে, বিতিকিচ্ছিরি কাহিনী ঘটাতে চাইছি না।’

উষাদ তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই মেয়েটাকে চেনা ভীষণ কঠিন। আর বুঝা, সেতো আরও বেশি কঠিন। সামান্য একটা কথার জের ধরে চমৎকার এই একটা মুহূর্তকে তিতকুটে করে দিয়েছে মেয়েটা। সে ভুল কী বলল? যা দেখে এলো, তাইতো বলল। এখানে এত রাগের কী হলো? হোক রুহান অসুস্থ, হোক ফুড পয়জনিং, হোক সে অচেনা ব্যক্তি, তাই বলে এইভাবে রি’অ্যাক্ট? তবে এটা নিশ্চিত, সত্য যতই তিক্ত হয়, মানুষ তা সহজেই ইগনোর করে চলার চেষ্টা করে। তড়িঘড়ি এই ঝগড়ুটে পরিস্থিতি সামলে নিতে বলল,

-‘আমি যেন শখ করে এখানে থাকতে এসেছি। ঢের হয়েছে জামাই আদর। আর না। যাচ্ছি।’

পা চালিয়ে বিদায় নিল উষাদ। রুদিতা বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রইল। ‘ঢের হয়েছে জামাই আদর’ মানে কী? কেউ কি তাকে অপমান করল? খাবারে কম দিল? না-কি নতুন জামাই বলে, অতিরিক্ত খাইয়ে-দাইয়ে বদহজম বাড়িয়ে দিল? আশ্চর্য! এমন কোন মানুষের পাল্লায় পড়ল সে? কিছু না বুঝেই ছাগলের তিন নম্বর ছানার মতো লাফঝাঁপ দেয়!

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিদ্যুতের গতিতে আবারও রুমে প্রবেশ করল উষাদ। রুদিতার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত কটমট করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-‘সাবধানে থাকবেন, সুস্থ থাকবেন, নিরাপদে থাকবেন। রুহানের খেয়াল রাখবেন। সর্বোপরি আমার আমানতকে হেফাজতে রাখবেন। যত্নে রাখবেন। সুরক্ষিত রাখবেন। নতুবা…।’

রুদিতা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। ঠোঁটমুখ বাঁকিয়ে বলল,
-‘আপনার আমানত মানে? সেটা আবার কী? কোনোকিছু কি ফেলে যাচ্ছেন এখানে?’

-‘কেন আপনি! আপনি পুরোটাই তো আমার আমানত। আপনাকে আমি আপনার কাছেই গচ্ছিত রেখে যাচ্ছি। মাত্র সাতদিন, নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারবেন না? না-কি এইটুকুর জন্য রোজ আমাকে ছুটে আসতে হবে? স্যরি টু সে, আমি নতুন জামাই। কারও খেয়াল রাখতে রোজ রোজ এভাবে শ্বশুরবাড়িতে আসতে পারব না। শেষে ঘরে-বাইরে লোকজন আমাকে বউপাগল খেতাব দিয়ে গোল খাওয়াবে।’

রুদিতা তাজ্জব বনে গেল। বিস্ময়ে হা হয়ে গেল তার মুখ। চোখের পলক রইল স্থির। উষাদ তার এই ফেইস দেখে ভীষণভাবে মজা নিল। চোখ নাচিয়ে বলল,

-‘কী হলো? চুপ করে আছেন কেন? এই সাধারণ কাজটা করতে পারবেন না? এজন্যই তো ভাবী, রুহানের প্রতি কেন এত উদাসীনতা! যে নিজের খেয়াল রাখতে জানে না, সে একটা বাচ্চার খেয়াল কী করে রাখবে!’

দু’হাতে নিজের চুল খামছে ধরল রুদিতা। জল টলমল চোখে তাকাল। তবে চোখের পানিকে নির্দিষ্ট জায়গাতেই আটকে রাখল। গড়িয়ে পড়তে দিল না। সে যথেষ্ট ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। অকারণ রাগ-ক্ষোভকে মনে জায়গা দেয় না। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজের রাগকে সামলে রাখতে পারে না। যেকোনোভাবে প্রকাশ করে ফেলে। আর কিছুক্ষণ পরই নিজের ওপর থেকে সবটুকু নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাবে তার। নিজেকে সে ভালো বুঝে। এজন্য শক্ত কণ্ঠে বলল,

-‘আর এক সেকেন্ড যদি আপনাকে আমার আশেপাশে দেখেছি, ভালো হবে না। একদম ভালো হবে না। আপনি জানেন না, ঠিক কোথায় আঘাত করেছেন। যান এখান থেকে। এক্ষুণি যান। নয়তো…।’

ক্রমাগত জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল রুদিতা। সদ্য জন্ম নেয়া সম্পর্কের অধিকার দিয়ে, এই মানুষটার ওপর রাগ-ক্ষোভ প্রয়োগ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। নিজেকে আড়াল করতে একছুটে চলে গেল বারান্দায়। উষাদ স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ। ঠিক কী হলো এটা, বুঝতেই পারল না সে। সব তার মাথার ওপর দিয়ে গেল!

***

রাত সাড়ে বারোটা। বিদায়ের প্রস্তুতি চলছে। মেয়েকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিজের কোলে আনল উষাদ। তার কান্নাকাটি থেমেছে। মাম্মামের কাছে থাকার বায়না নেই, তবে শীঘ্রই মাম্মামকে বাড়ি নেয়ার বায়না আছে। সব আলোচনার ও আয়োজনের ইতি টেনে সবাই যখন ঘর ছেড়ে চলে যাবেন, তখন উষাদ চারপাশে তাকিয়ে খেয়াল করল, মন খারাপের মেজাজে আতিকা জাহানের পিছনে লুকিয়ে আছে রুহান। সে উমামাকে তার মায়ের কাছে দিয়ে দু’পা এগিয়ে এসে দু’হাতে রুহানকে কোলে তুলে নিল। গালে হাত রেখে বলল,

-‘কী হলো? মন খারাপ?’

রুহান অভিমানী কণ্ঠে বলল,
-‘আপনি চলে যাচ্ছেন কেন? আবার কবে আসবেন?’

-‘রোজ আসব। তোমার জন্য। একসাথে স্কুলে যাব। হবে না?’

-‘সত্যিই আসবেন?’

আনন্দে আত্মহারা হয়ে প্রশ্ন করল রুহান। উষাদ সম্মতি জানিয়ে বলল,
-‘হ্যাঁ আসব। একসাথে স্কুলে যাব। টিফিন টাইম শেয়ার করব। ঘুরাঘুরি করব। দ্যান, তোমাকে বাড়িতে পৌঁছেও দেব।’

রুহান যেন কথাটা বিশ্বাসই করতে পারল না। পালটা প্রশ্ন করল,
-‘আমি প্রতিদিন আপনার সাথে থাকতে পারব?’

-‘হ্যাঁ, পারবে। আপাতত ক’দিন মাম্মামের কাছে থাকো। ঠিক এক সপ্তাহ পর থেকে বাবাইয়ের কাছে থাকবে।’

-‘বাবাই?’

প্রশ্নবোধক শব্দ ছুঁড়ে আনমনা হয়ে গেল রুহান। উষাদ ভালোমতো বাচ্চাটাকে খেয়াল করল। চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে রুদিতাকে খোঁজার বৃথাচেষ্টা চালিয়ে গেল, কিন্তু পেল না। রুহানের ব্যাপারে কতকিছু যে জানার আছে তার। ভাবনার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে বাচ্চাটার আদুরে গালে অসংখ্য চুমু খেয়ে বলল,

-‘হ্যাঁ, বাবাই। ডাকবে না?’

নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করার জন্য যুতসই শব্দ, বাক্যের বড্ড অভাব পড়ল রুহানের। সে কিছুই বলতে পারল না। শুধু দু’হাতে উষাদের গলা আঁকড়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখল। খানিকক্ষণ পর আধোমুখের ভাষা দিয়ে ভাঙাগলায় উচ্চারণ করল,

-‘আমার তো বাবা নেই।’

বাচ্চাটার কষ্টে বুক ভার হয়ে এলো উষাদের। নরম স্বরে বলল,
-‘কে বলেছে নেই? আমি-ই তো তোমার বাবাই। তুমি আমার সন্তান। আমাকে বাবাই বলে ডাকো।’

রুহান ভয় পেল। বাবা ডাকার সাহস হলো না। নেমে পড়ল কোল থেকে। ছুটে চলে গেল কোথাও। হতভম্ব উষাদ বুঝতে পারল না কিছু। অবাক চোখে চেয়ে থেকে বলল

-‘রুহান এভাবে চলে গেল কেন?’

উষাদের প্রশ্নে চকিতে দৃষ্টি ফেরাল রুহামা। বলল,
-‘ওর কথা বাদ দিন। হয়তো লজ্জা পেয়েছে।’

এখুনি রুহানের ব্যাপারটা খোলাসা করার মতো ধৈর্য ও মনের জোর নেই রুহামার। সবকিছু আগে ঠিকঠাক হোক, বোন তার স্বামী-সংসারে পা রাখুক, এরপর সময় বুঝে উষাদকে সে নিজেই সব কথা জানাবে। এখন আপাতত কিছু বিষয় সবার অলক্ষ্যেই থাকুক। তাই এড়িয়ে গিয়েই হোসনা বেগমকে বলল,

-‘আন্টি, আজ এখানে থেকে গেলেই পারতেন।’

হোসনা বেগম বললেন,
-‘এখন কী কোথাও থাকার বয়স আছে, মা? আজ যাই। আত্মীয়তা তো সবে শুরু হলো। আল্লাহ্ চাইলে অন্য একদিন থাকব।’

-‘আবার আসবেন কিন্তু।’

সবাইকে বের হতে বলে হোসনা বেগম কয়েক মিনিটের জন্য রুদিতার কাছে গেলেন। বিছানার এককোণে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসেছিল রুদিতা। রুমে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তুলে তাকিয়েই স্থির হয়ে গেল। লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে কদমবুসি করে বলল,

-‘কেমন আছেন আপনি?’

-‘এখন মায়ের খোঁজ নেয়ার কথা মনে পড়েছে? এতক্ষণ মনে ছিল না বাড়িতে একটা বয়স্ক মা এসেছে, তার খেয়াল রাখা উচিত?’

লাজুক হেসে কানে হাত দিল রুদিতা। বলল,
-‘আমি খুবই দুঃখিত, মা। এরপর আর এই ভুল হবে না। আসলে আমি…।’

হোসনা বেগম তার না বলা কথা ও মনের অবস্থা বুঝে ফেললেন নিমিষেই। নির্ভার হেসে বললেন,
-‘দুঃখিত হওয়ার কিচ্ছু নেই। আজ আসছি। ভালো থেকো। নিজের ও বাচ্চার খেয়াল রেখো।’

রুদিতার কপালে চুমু খেলেন একবার। আলতো করে জড়িয়ে ধরে হাতের মুঠোয় ধরিয়ে দিলেন কিছু টাকা। বললেন,
-‘এটা রাখো। প্রয়োজন হলে খরচ করো।’

***

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে