Sunday, October 5, 2025







নিষ্প্রভ প্রণয় পর্ব-১২

#নিষ্প্রভ_প্রণয়
#পর্ব_১২
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

বিছানায় একে একে কিশোরী বয়সের সবগুলো ছবি সাঁজিয়ে রাখল সেতু।পাশ দিয়ে রাখল ছোট্ট ছোট্ট চিরকুটগুলো।নিষাদ অবাক হয়ে চাইল।তবে কি এই অবেলায় অফিস থেকে ডেকে আনার কারণ এসব?বেশ কিছুক্ষন ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকেই সেতুর দিকে চাইল সে।সেতুর চাহনী স্পষ্ট,সরু।নিষাদ ভ্রু কুঁচকাল।সেতু একখানা চিরকুট এগিয়ে দিয়েই বলল,

” পড়ে শোনান কাগজটা।”

নিষাদ হাতে নিয়েই থেমে রইল।দুইজনেই দুইজনের দিকে তাকিয়েই সুদূর অতীতে ভেসে গেল মুহুর্তে।যে অতীত তাদের অনুভূতির জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছিল।যে অতীত তাদের শতসহস্র অস্থিরতার সাক্ষী ছিল।

………….

চুলে দুই বেনুনি,ফর্সা চেহারা, মিহি ঠোঁটজোড়া আর ডাগর চোখের তরুণী মেয়ে।অন্যসব তরুণী মেয়েদের মতো তার মুখে উচ্ছ্বাস খেলত না, চঞ্চলতায় হৈচৈ করত না।তরুণী মেয়েটি হলো সেতু। প্রতিবছরের মতো সেবারও পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। মেয়াদকাল সাতদিন! কোনদিন গান, কোনদিন নাচ, তো কোনদিন আবৃত্তি।পাড়ার অনুষ্ঠানে সেবার যোগদান করল বাইরের পাড়ার কিছু ছেলেপেলে।পাড়ার বড়ভাইদের চেনাজানা ছিল ছেলেগুলোর সাথে।কাজেই এই পাড়ার না হয়েও খুব গুরুত্ব পেয়ে গেল সবার কাছে।সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করা ছাড়াও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার দায়িত্বে এই পাড়ার ছেলেদের সাথে সাথে বাইরের ছেলেগুলোও যোগ হলো।পাড়ার ছেলেদের সাথে বন্ধুত্বও হয়ে উঠল খুব দ্রুত ছেলেগুলোর।যেন অনেকদিনের চেনাজানা।সেতু তখন কিশোরী।স্কুল আসা যাওয়া হলেও নির্দিষ্ট কোন বন্ধু ছিল না তার।তবে সবার সাথেই মেলামেশা হতো।সেই হিসেবেই ক্লাসের বাদবাকিদের সাথে তাল মিলিয়ে স্কুল ছুটির পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করতেও যাওয়া হতো।বান্ধবীরাই জোরাজুরি করে নাম দিয়ে বসল দলীয় নাটকে।সেতু প্রথমে না রাজি হলেও পরবর্তীতে বাধ্য হয়েই রাজি হলো।নাটকের আগামাথা না বুঝা সেতু তখন ভয়ে আড়ষ্ট।নাটকের রিহার্সাল করার জন্যই বেশ অনেকক্ষন কাঁটাতে হতো সেখানে।বান্ধবীদের তখন হৈ হৈ কান্ড!প্রেমের বয়সে ছেলেপেলেদের সঙ্গ পেয়েই কেউ কেউ পিঁছলে পড়ল প্রেমরোগে।কেউ বা ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা জুড়ত। কেউ কেউ আবার তথাকথিত “ক্রাশ” শব্দে আটকে পড়ে দিনরাত অস্থির হয়ে ক্রাশঘটিত কান্ডকারখানা সম্পর্কে বলে যেত।সেতু সেসব শুনত। চুপচাপ চেয়ার পেতে এককোণে বসে অপেক্ষা করত কবে বাড়ি যাবে।বাকিসব মেয়েদের মতো ছেলে দেখলে তার মধ্যে উচ্ছ্বাস কাজ করত না।ছেলেদের সাথে কথা বলার জন্য মরিয়াও হয়ে উঠত না।উল্টো ছেলেদের উপস্থিতি টের পেলেই অস্বস্তিতে আড়ষ্ট হয়ে যেত। ছেলেরা এককোনে থাকলে সে থাকত অন্যকোণে।কখনো সখনো সব বান্ধবীদের ছেলেদের সাথে আড্ডায় মশগুল দেখলে চেয়ার টেনে একা একাই এককোণে বসে থাকত হাতে স্ক্রিপ্ট নিয়ে।সেদিনও একা একাই বসে রইল।বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে দেখে তাকিয়ে রইল সেদিক পানে।হঠাৎই পাড়ার এক বড়ভাই এসে ডেকে বলল,

” সেতু শোনতো,রিহার্সাল শেষ হয়েছে না?”

সেতু মাথা নাড়াল। জবাব দিয়ে বলল,

” শেষ দাদা।”

” তাহলে নিষাদ, রঙ্গন আর দিয়াকে একটু ডেকে দে তো বোন।জলদি!”

সেতু ভ্রু কুঁচকাল।দিয়া নামটা শুনেছে সে।অপরিচিত ছেলেগুলোর সঙ্গে একটা মেয়ে ও আছে।বেশ সুন্দরী মেয়েটা।ইতোমধ্যেই পাড়ার ছেলেরা সেই মেয়ের জন্য মরিয়া হয়ে গিয়েছে।সেতু মেয়েটাকে চেনে।নাটকের সময় দিয়া নামক মেয়েটা বেশ কিছু সময় তাকে সাহায্য করেছে।বয়সে তার থেকে বড়ই হবে।কিন্তু নিষাদ আর রঙ্গন কে?সেতু প্রশ্নবোধক চাহনী রেখেই শুধাল,

” দিয়া দিকে চিনি আমি।নিষাদ আর রঙ্গন কে তাতো জানি না। ”

” আজ তিন চারটে দিন এত আড্ডা হলো, হৈচৈ হলো।অথচ এখনও বলছিস চিনিস না?তুই না সত্যিই বড্ড সেকেলে সেতু।তোর চিনতে হবে না ওদের।ওখানে গিয়ে নামগুলো বললেই হবে।বলবি তাড়াতাড়ি আসতে।”

সেতু মাথা নাড়িয়ে পা বাড়াল।যেতে যেতে ভাবল, সেকেলে?সেকেলে বলল কেন তাকে?ছেলেদের সাথে মিশে না বলেই এই বিশেষণ দেওয়া হলো?আশ্চর্য!ছেলেদের সাথে মেলামেশাই কি আধুনিকতার লক্ষন নাকি?সেতু উত্তর খুঁজে পেল না।আড্ডাবাজদের আড্ডায় পৌঁছে গিয়েই দিয়া নামক মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বলল,

” দিয়া দি?তোমায় ডাকছে বাইরে।আর তোমার সাথে নিষাদ আর রঙ্গনকেও ডাকছে।তোমাদের যেতে বলেছে।”

দিয়ার সাথে সাথে নিষাদ আর রঙ্গনও দ্রুত তাকাল মেয়েটার দিকে।সাদামাটা উদাস চেহারা।লম্বা কালো চুলে দুই বেনুনি।দিয়াকে “দি” বলে সম্বোধন করলেও আশ্চর্যের বিষয় নিষাদ আর রঙ্গনকে নাম ধরেই বলেছে।এইটুকু মেয়ে তাদের নাম ধরে ডাকবে কেন?নিষাদ কপাল কুঁচকে মেয়েটাকে কয়ক সেকেন্ড খেয়াল করল।এর আগেও দেখেছে।তবে বিশেষ পাত্তা দেয়নি।মেয়েটা কেমন জানি!কারো সাথে মিশে না। কথাও বলে না।নিষাদ চুপচাপ উঠে দাঁড়াল।রঙ্গন প্রশ্ন ছুড়ল,

” এই মেয়ে?তোমার নাম কি?”

সেতু ঠোঁট ভিজাল জিহ্বা দিয়ে।উত্তরে বলল,

” সেতু, সেতু ভৈামিক।”

দিয়া কটমটে চাহনীতে রঙ্গনের দিকে তাকাল।রঙ্গন আর দিয়ার তখন মাখোমাখো প্রেম।একে অপরকে ছাড়া বেঁচে থাকা দায় এমন ভাব।সে মাখোমাখো প্রেমের মাঝে তার প্রেমিক পুরুষ অন্য মেয়ের নাম জিজ্ঞেস করছে বিষয়টা মানা গেল না।চুপচাপ উঠে চলে যেতে যেতেই বলে উঠল,

” আসলে আয় তোরা।নয়তো থাক।”

রঙ্গন চুপসানো চাহনীতে পেঁছন পেঁছন গেল।নিষাদও পা বাড়াল। পা বাড়াতে বাড়াতেই মনে মনে আওড়াল,” মেয়েটা অন্যরকম।বাকি সবার থেকে অন্যরকম।”

.

সেদিন বাড়ি ফিরে আর ঘুম হলো না নিষাদের।বার বার মেয়েটার মুখের নিষাদ নামটাই কানে বাঁজল।মেয়টাকে এই দুচারদিনে আরো কয়েকবার দেখেছে সে। অথচ আজই মেয়েটাতে ফেঁসে গেল মনে হচ্ছে।মেয়েটার কারো সাথে না মেশা, কারো সাথে বেশি কথা না বলা,উদাস চাহনী বারংবার মনের ভেতর প্রশ্ন ছুড়ল।কি আশ্চর্য!ঐটুকু মেয়ে তার ঘুম কেড়ে নিচ্ছে?তবে কি রঙ্গনের মতো দশা হয়েছে তার?রঙ্গনের যেমন দিয়ার সাথে কথা না বললে ঘুম হয় না। তার ও কি সেতু নামক মেয়েটার কথা ভেবে ঘুম হচ্ছে না?প্রেমে ট্রেমে পড়ে গেল নাকি সে?নিষাদ শোঁয়া ছেড়ে উঠে বসল ধড়ফড়িয়ে। কি অদ্ভুত চিন্তাভাবনা।এতগুলো দিন হাসিখুশি থেকে বিন্দাস জীবন কাঁটিয়ে দিয়ে এখন কিনা প্রেম নামক ভয়ঙ্কর অনুভূতি নড়বড়ে করে দিচ্ছে ভেতরটা?নিষাদ মনকে শক্ত করল।মনে মনে বলল,

“খবদ্দার নিষাদ!প্রেমে ট্রেমে পড়া যাবে না।একেবারেই না।প্রেম হলো ভয়ঙ্কর।একবার এই ভয়ঙ্কর খেলায় জড়ালেই জীবন ত্যানাত্যানা হয়ে যাবে।তুই কিন্তু একেবারেই পা বাড়াবি না সেই প্রেমের দিকে।পা বাড়াবি তো ম’রবি।”

নিষাদ নিজেকে মনে মনে সতর্ক করল ঠিকই কিন্তু সে সতর্কবাণী একটুও ফলপ্রূস হলো না।পরেরদিনই সে পাড়ার অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রথমে খোঁজ চালাল সেই মেয়েটির।কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেদিন সেতু আসল না।কি অদ্ভুত!এতগুলো দিনতো নিয়মিতই আসতো।আজই মেয়েটাকে না আসতে হলো?নিষাদ অস্থির হলো।বুকজুড়ে অস্থিরতা নিয়ে পুরোদিন চোখজোড়া সেই মেয়েটিকে খুঁজল।কিন্তু লাভ হলো না।সেতু সেদিনের পরদিনও আসল না।দলীয় নাটকে নাম দিলেও নাটকে অংশগ্রহণ করল না।সে আসল একেবারে শেষের দিন।যেদিন অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবে সেদিন। এসেই চেয়ার টেনে একপাশে বসে উদাস মুখে তাকিয়ে রইল।নিষাদ দূর থেকে লক্ষ্য করল।বেশ কিছুটা সময় পর এগিয়ে গিয়েই গলা ঝেড়ে কন্ঠে চাপা রাগ নিয়ে বলে উঠল,

” আসোনি কেন এই দুইদিন?”

হঠাৎ পুরুষালি কন্ঠে সেতু চমকাল।মাথা তুলে উপর দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল লম্বাচওড়া এক যুবককে।ঠিকঠাক নাম জানে না।তবে এই লোকটা নিষাদ অথবা রঙ্গনের মধ্যে কেউ একজন।সেতু শুকনো ঢোক গিলল।শান্ত গলায় বাধ্য মেয়ের মতো উত্তর দিল,

” বাড়িতে কাজ ছিল।ব্যস্ত ছিলাম তাই।”

নিষাদ পাশের চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসল।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে পুনরায় সুধাল,

” দলীয় নাটকে নাম দিয়ে অংশগ্রহণ না করার মানে হয়?অংশগ্রহণ করবে নাই যখন নাম দেওয়ার তো কোন কারণ দেখছি না।কতৃপক্ষকে হয়রানি করলে না এটা করে?”

সেতু পাশ ফিরে চাইল।অপরাধী গলায় বলল,

” নামটা আমি দিইনি।বান্ধবীরাই জোর করে দিয়ে দিয়েছিল।আমি পরে বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছিলাম।কিন্তু শেষমুহুর্তেই এসে বাড়ি থেকে বেরোনোরই সময় হয়ে উঠেনি,নাটকে অংশগ্রহণ তো দূর।আমি দুঃখিত এই জন্য।”

নিষাদ আড়ালে হাসল। চাপা কন্ঠে আবারও বলল,

” তো আগে জানতে না বাড়িতে কাজ থাকবে?”

সেতু মলিন হাসল।বলল,

” না। আসলে হঠাৎ করেই বউদির বাপের বাড়ির লোকেরা এসেছিল। বউদির পক্ষে তো একা হাতে এত কাজ করা সম্ভব ছিল না। তাই হাতে হাতে সাহায্য করেছিলাম শুধু।”

নিষাদ মাথা দুলাল।সেতুর সাথে কথা বলতে বলতে ভালো লাগারা ছুঁয়ে গেল তার হৃদয়।অন্যদিকে সেতু অপরাধীর মতো সমস্ত কিছু ব্যাখ্য করল। মনের ভেতর অনুশোচনা আর সংশয়!হয়তো নাটকের একটা চরিত্র হিসেবে সে না থাকায় অনেক সমস্যা হয়েছে এই ভেবেই আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল।

.

সেইবার পাড়ার অনুষ্ঠান শেষ হলো।নিষাদ অনেক কষ্টে রঙ্গনকে দিয়ে সেতুর মোবাইল নাম্বার,স্কুল, বাড়ির ঠিকানা সবটা জোগাড় করল। বারকয়েক নাম্বারে কলও দিল। কিন্তু কি আশ্চর্যের বিষয়!কল দিলেই ওপাশ থেকে পুরুষালি কন্ঠ ভেসে আসে।মাঝেমাঝে মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসলেও তা সেতুর কন্ঠ নয়।নিষাদের অবস্থা তখন অসহায়!রঙ্গনকে বিষয়টা জানাতেই রঙ্গন জানাল, এটা সেতুর বাড়ির নাম্বার।সেতুর নিজস্ব মোবাইল নেই।নিষাদ হতাশ হলো।উপায় না পেয়ে যাতায়াত বাড়াল সেতুর স্কুলের রাস্তায়। যদি দেখা হয়ে যায়?যদি কথা হয়ে যায়?অবশেষে হলোও দেখা।গেইট পেরিয়ে সেতুকে স্কুল থেকে বের হতে দেখেই দ্রুততার সঙ্গে সেতু আড়ালে ছবি তুলল। পরমুহুর্তেই মোবাইলটা পকেটে ফুরে পা এগিয়ে সেতুর সামনে দাঁড়াল।ভরাট গলায় বলল,

” এই মেয়ে ? তোমার নামটা জানি কি ছিল?”

নিষাদ জানত সেতুর নাম।খুব ভালোভাবেই জানত।তবুও না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করল।সেতু অবাক হয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

” আপনি?”

নিষাদ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

” হ্যাঁ আমি।নিষাদ।পাড়ার অনুষ্ঠানে কথা হলো না?ভুলে গেলে?”

সেতু চুপ থাকল। মাথা নাড়িয়ে বলল,

” না, মনেই আছে।”

নিষাদ মুদু হাসল। জবাবে বলল,

” তুমি এই স্কুলেই পড়ো?”

সেতু মাথা উপরনিচ করে বলল,

” হ্যাঁ।”

” তোমার নাম জিজ্ঞেস করলাম না? শুনোনি?”

” শুনেছি।আমার নাম সেতু।”

এইটুকু বলেই সেতু আর কথা বাড়াল না।দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে লাগল।নিষাদ পেঁছন থেকেই চেয়ে রইল।মেয়েটার মধ্যে কিছু একটা তো আছেই।কি সুন্দর এড়িয়ে পাশ কাঁটিয়ে চলে গেল।এটাকে ঠিক অহংকার বলা যায় না।পুরোপুরি এড়িয়ে তো যায়নি।শুধু প্রয়োজনের বাইরে কথা বলে নি।

.

এর পরে আরো হাজারবার দেখা হলো সেতুর সাথে নিষাদের।কখনো স্কুল গেইট, কখনো স্কুলের রাস্তায়।প্রতিবার নিষাদই আগ বাড়িয়ে কথা বলত।সেতু চুপচাপ জবাব দিত।সৌজন্যতা মূলক দুয়েকটা কথা বলেই আবার পা চালাত।নিষাদের বুকের অস্থিরতা দিনে দিনে ক্রমশ বাড়ল।এতগুলো দিনে মেয়েটা নিশ্চয় বুঝে গেছে নিষাদ যে তাকে ভালোবাসে।
বুঝারই তো কথা।নিষাদ আর পিঁছ পা হলো না।রঙ্গনের থেকে খুব ভালোভাবে পরামর্শ নিয়ে খুব কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল।ফুলের দোকান থেকে গোলাপ কিনে নিল মুহুর্তে।সতেজ, স্বচ্ছ লাল টকটকে গোলাপ।বুকে সাহস নিয়ে সেদিন পুরোটা দিন স্কুল গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল।মেয়েটা আজ স্কুলে আসল না।নিষাদ হতাশ হয়ে চোখ ছোট ছোট করে সূর্য ডোবা পর্যন্ত অপেক্ষা করল।মেয়েটাকে আজই না আসতে হলো?

যথারীতি আবারও পরদিন গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল নিষাদ।এবার আর ব্যর্থ হতে হলো না তাকে।গেইট পেরিয়ে সেতুকে আসতে দেখেই সাহসে বুক ফুলাল।জোরে জোরে শ্বাস ফেলে টানটান বুক নিয়ে এগিয়ে গেল সেতুর সামনে।গোলাপ এগিয়ে দিয়েই কোনরকম ভনিতা না করে স্পষ্ট কন্ঠে বলল,

” রাত হলে ঘুমোতে পারছি না আমি।দিন হলে নিজের প্রতি মনোযোগ না রেখেই সাত সকালে উঠে আসতে হচ্ছে তোমার স্কুল গেইটে।পড়া জমছে, এসাইনমেন্ট জমা দিতে পারছি না,ফেইলও আসছে!কি করণীয় আমার?তুমি আমার হয়ে যাও।সবটা ঠিক হয়ে যাক আবার।জীবনে এত বেঠিক আর ভালো লাগছে না সেতু।”

সেতু চোখ বড়বড় করে চেয়ে থাকল।মনে মনে এমন কিছু ধারণা করে রাখলেও নিষাদ যে এভাবে স্কুলের সামনেই গোলাপ দিয় বসবে ভাবে নি সে।সে গোলাপটা নিল না।ভ্রু জোড়া কুঁচকে রেখে প্রশ্ন ছুড়ল,

“কিসব বলছেন?গোলাপ কেন?চারপাশে আমার বন্ধুবান্ধবরা আছে।কেউদেখে ফেললে মুশকিল।”

“থাকলে থাকুক।ক্ষতি কি?”

সেতু শক্ত কন্ঠে বলল,

” ক্ষতি আছে।”

” গোলাপটা নিবে না?”

সেতু অন্যদিকে ফিরে তাকাল।কন্ঠ কঠিন করে শুধাল,

” না।”

” কেন নিবে না?”

সেতু সোজা হয়ে চাইল নিষাদের দিকে।চোখে ধারালো দৃষ্টি প্রখর করেই দাঁতে দাঁত চাপল। বলল,

” আপনার সাথে আমার কি গোলাপ নেওয়া-দেওয়ার সম্পর্ক আছে নিষাদ?”

নিষাদ সেই প্রখর দৃষ্টিকে পাত্তা দিল না।পিঁছেল গলায় শুধাল,

‘ নেই তো কি হয়েছে?করে নিতে কতক্ষন? তুমি চাইলে এই মুহুর্ত থেকেই সেই সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাবে।”

” কিসব প্রলাপ বকছেন?”

নিষাদ অবাক হওয়ার ভান করে বলল,

” প্রলাপ?কিসের প্রলাপ?আমার অবস্থা বুঝতে পারছো?ঘুমোতে পারছি না।ছটফট করছি।ঘুম ধরলেও কোনভাবে তুমি এসে উপস্থিত হচ্ছো স্বপ্ন।কি জ্বালা বুঝতে পারছো?”

” না, পারছি না।আপনি কিসব আজেবাজে বকছেন কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“তুমি বাকিদের থেকে আলাদা কেন?বাকিদের মতো সবার সাথে মিশো না কেন?ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দাও না কেন?চুপচাপ হয়ে একা একা থাকো কেন?বলো।কেন?এসবের জন্যই তো ভাবতে ভাবতে ফেঁসে গেলাম নিষ্পাপ আমি।তোমারও উচিত ছিল বাকি সবার মতো হওয়া।”

সেতু মিনমিনে চোখে চাইল।বলল,

” আমি বরাবরই এমন।”

” কে বলেছে এমন হতে? ”

সেতু অবাক হলো।কপাল কুঁচকে বলল,

” কে বলবে?আপনার মাথায় কি সমস্যা দেখা দিয়েছে নিষাদ?কি অদ্ভুত কথাবার্তা বলছেন।আপনার কি কিছু হয়েছে নাকি? ”

নিষাদ মুখ খানা মলিন করল। ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বুকে হাত রাখল।নরম গলায় বলল,

” তুমি বুঝবে না সেতু।বুঝবে না।আমার খুব ভয়ঙ্কর এক অসুখ হয়েছে।বুকের ভেতর অসুখটা জ্যান্ত দানবের মতো রাজত্ব করছে আর আমায় ক্রমশ মেরে ফেলছে।কি করবো আমি?”

সেতু চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বলল,

” কি আজেবাজে কথা বলছেন আবারো? অসুখ কখনো জ্যান্ত দানবের মতো হয় নাকি?”

নিষাদ অসহায় গলায় বলল,

” হয় তো।আমার বুকের উপর হাত রাখো। বুঝতে পারবে, কি ভীষণ অত্যাচার হচ্ছে এখানটায়। কি ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কি ভীষণ অস্থিরতা ঝেঁকে ধরেছে আমায়।আমার কি করণীয়?”

সেতু প্রশ্নের জবাব দিল না।কি বলছে এসব এই ছেলে?গোলাপ দেওয়া পর্যন্ত ঠিক ছিল।কিন্তু এসব কি প্রলাপ বকে চলেছে?মাথা টাথা ঠিক আছে তো এই ছেলের?নাকি এই ছেলেটা পাগল টাগল হয়ে গিয়েছে?কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই পা এগিয়ে হাঁটা ধরল সে।দ্রুত হাঁটল।এই ছেলের এসব প্রলাপ শুনলে সেও পাগল হয়ে যাবে। বয়স কত তার?এই বয়সে পাগল হতে চায় না সে।

.

” সেতু? একটু ভালো করে তাকাও তো আমার দিকে। দেখো তো আমার চোখের নিচে কালি বসেছে কিনা।মা বলেছে চোখের নিচে নাকি গাঢ় কালো দাগ বসেছে।সত্যিই?”

সেতু স্কুল গেইট পেরিয়ে স্কুল প্রাঙ্গনে ডুকবে ঠিক সেই সময়েই কথাটা কানে আসল।কন্ঠটা সে চেনে।পিঁছু ঘুরে তাঁকিয়েই নিষাদকে দেখে স্থির চাহনীতে তাকাল।দু পা বাড়িয়ে অন্যদিকটায় দাঁড়িয়ে বলল,

” আপনি আবার ও এসেছেন?”

নিষাদ হাসল।ঠোঁট চওড়া করে বলল,

” তুমিই তো টেনে আনো।না এসে কি করে থাকি তাহলে?”

” আমি?আমি কখন টেনে এনেছি আপনাকে?

“স্বপ্নে।”

সেতু পাত্তা না দিয়ে পাশ ফিরে হাঁটতে লাগল।নিষাদ আবারও বলে উঠল,

” দাঁড়াও সেতু।”

সেতু দাঁড়াল।কিন্তু ঘুরে চাইল না।নিষাদই পা বাড়িয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।শান্ত কন্ঠে ধমকস্বরূপ বলে উঠল,

” তুমি তো দেখি খুব বেয়াদব মেয়ে।তোমার থেকে বড় হই আমি বয়সে।ভুলে গেছো হুহ?”

সেতু হতাশ চোখে তাকাল।বলল,

” না,ভুলিনি।আমার ক্লাসের লেইট হয়ে যাবে।আসি।”

নিষাদ এবার প্রকাশ্যেই ধমক দিয়ে বলে উঠল,

” এই মেয়ে?দাঁড়াতে বলেছি না?কানে শুনো না?”

সেতু চোখের দৃষ্টি ক্ষীন করে তাকাল।নিষাদ গলা ঝেড়ে বলল,

” আমার প্রশ্নের উত্তর দাও তাড়াতাড়ি।”

” কোন প্রশ্ন?কিসের উত্তর?”

” আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখো।কি অবস্থা হয়েছে!সব তোমার জন্য।”

” আমি তো কিছু করিনি।আপনি না ঘুমোলে কিংবা ঘুম না হলে আমার দোষ?”

নিষাদ অসহায় গলায় বলল,

” কারণটা তো তুমিই।”

সেতু ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল।এড়িয়ে গিয়ে বলল,

” দেরি হচ্ছে আমার।”

নিষাদ ছোট করে বলল,

” ঠিকাছে, যাও।”

কথাটা বলেই আবারও বলল,

“মেয়ে শোন?ভালোবাসি।”

কথাটা শোনামাত্রই সেতু পিঁছু ঘুরল।এভাবে সরাসরি কেউ ভালোবাসি বলে?আশ্চর্য!সেতু জোরে জোরে শ্বাস ফেলল। অস্বস্তিতে হাত পায়ের তালু ঘেমে উঠল।সেদিন আর ক্লাসে মনোযোগ দেওয়া হয়ে উঠল না তার।কি ভীষণ অস্থিরতা বুকের ভেতর!কানের সামনে কেবল আওয়াজ তুলল,” মেয়ে শোন?ভালোবাসি।”

#চলবে….

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ