নিষ্প্রভ প্রণয় পর্ব-১১

0
612

#নিষ্প্রভ_প্রণয়
#পর্ব_১১
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

নিষাদ আরো ঘন্টাখানেক পর বেলকনি ছেড়ে ঘরে আসল। ঢ্রিম লাইটের ম্লান আলোয় ঝাপসাভাবে সেতুকে স্থির হয়ে শুঁয়ে থাকতে দেখে ভাবল ঘুমিয়ে গিয়েছে।পা বাড়িয়ে নীরের অন্যপাশটায় সেও শুঁয়ে পড়ল।গহীন চাহনীতে সেতুর মুখে তাকাতেই চোখের পাতা নড়চড়ে হতে দেখল।বুঝতে পারল, সেতু ঘুমায়নি।নিষাদ মৃদু হেসেই বলল,

” ঘুমাও নি কেন?রাত হয়েছে না?”

সেতু মুহুর্তেই চোখজোড়া দ্বিগুণ গতিতে খিচে ধরল।ঘুমিয়ে যাওয়ার মিথ্যে নাটক করেই জোরে জোরে শ্বাস ফেলল।নিষাদ দৃষ্টি না সরিয়ে সবটাই খেয়াল করল।ঠোঁট চেপে আবারও বলল,

” নাটকফাটক করবে না সেতু।তুমি যে ঘুমাওনি জানি আমি।

সেতু হুট করেই চোখ মেলে চাইল।অস্বস্তিতে নিষাদের সামনে শুঁয়ে থাকতে পারল না।তৎক্ষনাৎ উঠে বসতেই খোপা করা চুল খুলে পিঠভর ছড়িয়ে পড়ল।সেতু কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো।দুইহাতে পুনরায় চুলের খোপা করতে নিতেই নিষাদ বলল,

” বাঁধছ কেন?থাক না ওভাবে।”

সেতু পাশ ফিরে নিষাদের দিকে তাকাল।পরক্ষনেই নিষাদের চোখজোড়ার গভীর চাহনী দেখেই ভড়কে গেল।সে তাকানো সত্ত্বেও নিষাদ দৃষ্টি ফেরাল না।একই ভাবেই স্থির চাহনীতে তাকিয়ে রইল।সেতু শুকনো ঢোক গিলল।দ্রুত খাট ছেড়ে উঠেই বলল,

” চুল খোলা থাকলে অস্বস্তি লাগে।”

” তো?”

” অসুবিধে হয় আমার।খোপা করা থাকলে স্বস্তি লাগে।”

” আমার তো অসুবিধা হচ্ছে না।এভাবেই ভালো লাগছে।”

সেতু দৃষ্টি ক্ষীণ করল।চুলগুলো বাঁধতে গিয়েও বাঁধল না।পিঠভর ছড়িয়ে রেখে বলল,

” খুলেই রাখলাম।শান্তি?”

নিষাদ হাসল। বুকে হাত রেখেই শুধাল,

” খুব শান্তি!”

নিষাদের শান্ত স্বরে ছোট্ট দুটো শব্দটা শুনেই অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে পড়ল সেতু। দ্রুত নিষাদের চোখের সামনে থেকে সরে যাওয়ার জন্যই বলল,

” আচ্ছা,আসছি।”

কথাটা বলেই ধীর পায়ে পা চালাতেই নিষাদ চোখ বন্ধ করল।মাথার নিচে হাত রেখেই বলল,

” কোথায় যাচ্ছো?”

সেতু মৃদু আওয়াজ তুলে উত্তর দিল,

” বেলকনিতে যাচ্ছি।আজ ঘুম আসছে না আমার।”

” আমার রোগটা তোমায় ধরল নাকি?”

সেতু এবার না চাইতেও হেসে দিল।তবে আড়ালে!যাতে নিষাদ দেখতে না পায়।কন্ঠ স্থির রেখে বলল,

” আপনার রোগ সম্পর্কে জানতে পেরেই ঘুম আসছে না নিষাদ। কি বিচ্ছিরি রোগ আপনার।”

নিষাদ চোখ মেলল।ভ্রু কুঁচকে বলল,

” বিচ্ছিরির কি আছে?”

” বিচ্ছিরি নয়?”

” একদমই নয়।”

সেতু আবারও মুখ চেপে হাসল।নিষাদের অনুভূতির স্বচ্ছতা প্রমাণ পেয়েই বারংবার অবাক হয়। এতগুলো দিনে কি নিষাদের মনের অনুভূতিরা এইটুকুও কমেনি?উহ!এত অনুভূতি কেন তার জন্যই থাকতে হবে? সেতু চোখ বুঝে বার কয়েক শ্বাস টানল।কানে আসল নিষাদের গমগমে কন্ঠ,

“সেতু?ঘুমিয়ে যাও।তোমার থেকে দৃষ্টি সরিয়েছি আপাদত।দেখো, চোখ বন্ধ করেছি।”

সেতু চোখ মেলে তাকাল।নিষাদকে চোখ বুঝে থাকতে দেখে অবাক হলো।এই লোকটা এত ভালো কেন বাসে তাকে?দূর থেকে যতোটা না মুগ্ধ হয়েছিল এই মানুষটাতে। কাছাকাছি এসে তার থেকেও দশগুণ আকৃষ্ট করছে মানুষটার ব্যবহার,আচার, আচরণ আর ব্যাক্তিত্ব!নিষাদ চাইলেই তাকে ছুঁতে পারত, অধিকার ফলাতে পারত।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই মানুষটা তার সাথে তেমন কিছুই করেনি।সেতু অতোটাও অবুঝ নয়। নিষাদের অনুভূতি সম্পর্কে সবটাই বুঝে সে, সবটাই উপলব্ধি করে।তবুও কোথাও গিয়ে বাঁধার প্রাচীর!কোন এক অজানা কারণে নিজ থেকে পা বাড়াতে গিয়েও পা চলতে চায় না।

.

এত রাতেও নীরুর ঘরময় আলো জ্বলছে।রাত দশটায় পড়া শুরু করেছিল।এখন আড়াইটা।এই সাড়ে চারঘন্টা সে পড়েছে ঠিকই, কিন্তু কি পড়েছে সেটাই বুঝতে পারল না নীরু।মাথাভর্তি কেবল রঙ্গন,রঙ্গন আর রঙ্গন!নীরু বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগল অলস ভঙ্গিতে।পড়ার আগামাথা কিছু না বুঝেই কান্না পেল তার।দুদিন পর পরীক্ষা!কি লিখে আসবে সে?রঙ্গন যে এভাবে মাথার মধ্যে ঘন্টা বাঁজিয়ে চলেছে তার ফলাফলস্বরূপ তো পরীক্ষার খাতায় দুটো ডিমস্বরূপ শূণ্য আসবে।নীরুর রাগ লাগল।বই বন্ধ করে দ্রুত মোবাইল নিল হাতে।রঙ্গনের নাম্বারে লাগাতার কল দিতে দিতেই বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল।ওপাশ থেকে কল রিসিভড হলো অনেক পরে।রঙ্গন রাগ ঝেড়েই বলে উঠল,

” সারা দিন যায়, তোর কল করার কথা তখন মনে পড়ে না?মাঝরাতে এসেই কল করার কথা মাথা চড়া দিয়ে উঠে তোর। তাই না?”

রঙ্গনের রাগকে পাত্তা দিল না নীরু।দাঁতে দাঁত চেপে দ্বিগুণ রেগে বলল,

” কি শুরু করেছো এসব?আমার মতো সহজ সরল মেয়ে পেয়েই সব অন্যায় সেরে ফেলছো?তুমি কি ভেবেছো এসবের শাস্তি পাবে না তুমি?”

রঙ্গনের কন্ঠ মৃদু হলো।হতাশার সুরেই বলল,

” যাক বাবা!কি করেছি আমি তোর সাথে?”

নীরুর রাগ দমল না।তেজ নিয়ে বলে উঠল,

” মাথার মধ্যে থৈ থৈ করে নৃত্য করছো। গাঁধা কোথাকার!নিজে তো এক গাঁধা, আমাকেও গাঁধা বানানোর মতলব করছো?বুঝি না কিছু?আমার সামনে পরীক্ষা। অথচ আমি পড়তে পারছি না।মনোযোগ রাখতে পারছি না।যা পড়ছি সবই মাথা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।আমার মতো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টের এই অবস্থা করে পার পেয়ে যাবে তুমি?বিধাতা সাক্ষী!এর শাস্তি তুমি একদিন না একদিন পাবেই।”

রঙ্গন দম ফেলে কথাগুলো শুনল।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” পরীক্ষা তোর, পড়া তোর, পড়া মাথা থেকে বের হওয়ার দোষ ও তোর।এতে আমি কি করলাম সেটাই তো বুঝলাম না।তোর যে মাথায় সমস্যা আছে এমনি এমনিই বলি আমি?কালই নিষাদকে বলতে হবে তোকে ভালো ডক্টর দেখাতে।”

” চুপ!একদম চুপ!সব দোষ তোমার।আমাকে ডক্টর দেখানোর কথা ভাবতে হবে না তোমায়।আমি আমরাটা বুঝি।”

রঙ্গন বিরক্তির সুরে বলে উঠল,

“বুঝলে কল দিয়েছিস কেন?আমি বলেছি কল দিতে?রোজ রোজ রাত দুটো, তিনটে, চারটে! কি এসব?ঘুমাস কখন তুই?”

” আমি তো ঘুমের মধ্যেও তোমার সাথে কথা বলি।এর জন্যই বেশি বেশি ঘুমাই।দিনে ঘুমাই, রাতে ঘুমাই।ঘুম ভেঙ্গে গেলে তোমায় কল দিই।”

“হু, নিজে তো ঠিকই ঘুমাস।আমার ঘুমেরই বারোটা বাঁজিয়ে দিস।এরপর আর কল দিবি না বলে দিলাম।”

নীরু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল।ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

” হু কল দিলে তো তোমার সমস্যা হবে।আমার বেলায় তো তোমার যত সমস্যা।আমি ভালোবাসি বললে তোমার দিয়াপাখির কথা মনে পড়ে যায়।অথচ এইদিকে বিয়ে করার জন্য ঠিকই মেয়ে খুঁজছো।সেবেলায় দিয়াপাখির প্রতি ভালোবাসা কোথায় যায়? ”

” তোকে উত্তর দিব কেন?কে তুই?”

” তোমার সাতজম্মের বউ!আমার রাগ লাগছে কিন্তু।খুবব রাগ লাগছে।দেখা করতে পারবে তুমি?আমি রাগ ঝাড়তে চাইছি।নাহলে শান্তি লাগবে না আমার।”

রঙ্গন হেসে উঠল।বলল,

” রাগে ফুলেফেঁপে ফেঁটে যা।আমার কি?তোর শান্তি না লাগলে আমার তো কোন ক্ষতি হবে না।বরং আনন্দ হবে।”

নীরু ঠোঁট উল্টাল।এই মুহুর্তে রাগে কান্না চলে আসছে তার।ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করেই বলে উঠল,

” তুমি কোথায় তাই বলো। আমিই গিয়ে দেখা করব।”

” আমি শহরের বাইরে আছি বিজন্যাসের কাজে।আসতে পারবি?”

নীরুর কান্নারা এবার বাঁধ মানল না।হুট করেই গলার আওয়াজ আড়ষ্ট হয়ে আসল।নাক টেনে বলল,

” শুনো গাঁধা, তুমি তোমার নাম্বারটা বদলে ফেলো।প্লিজ!আর? আর নয়তো আমি কল দিলেও কল রিসিভড করতে পারবে না।ঠিকাছে?আমার আর তোমার অনেকদিন কথা না হোক। অনেক অনেক দিন।আমার ভাল্লাগছে না আর তোমাকে।আমি ভালো থাকতে পারছি না।”

রঙ্গন অবাক হলো না।বছরজুড়ে হাসিখুশি থাকা নীরু মাঝেমধ্যেই তার সাথে কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে।কেঁদে দিয়েই এসব প্রলাপ বকে।কিন্তু কিছুক্ষন যেতেই আবার সব ভুলে বসে। সেই আবার খিলখিলিয়ে হেসে কথার আসর জমায়।রঙ্গন কাঁশল।গলা ঝেড়ে বলল,

” কাঁদছিস কেন?”

” তোমার সাথে কেন আমার পরিচয় হলো?”

” বিধাতা চেয়েছেন তাই।”

সেতু ফুঁপিয়ে উঠল।ঠোঁট টেনে বলল,

” তুমি এবার বিয়েটা করে নাও। যাকে ইচ্ছে তাকে।নয়তো দিয়া দির সাথে আবারও প্রেমটা শুরু করো।আমার আর এসব ভালো লাগছে না।”

রঙ্গন শান্ত সুরেই বলল,

” কোনসব ভালো লাগছে না?”

” এই যে রোজ রোজ আশা নিয়ে বসে আছি।তোমার কথা ভাবছি, তোমার সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করছি।তুমি বিয়ে বা প্রেম করলে আমি এসব কিছুই করব না।তুমি কাউকে নিয়ে পরিপূর্ণ জানার পর দ্বিতীয়বার আমি আর পা বাড়াব না।দেখো?”

” ভেবে বলছিস তো?পরে যদি পস্তাতে হয় তোকে।”

নীরু বেশ কিছুক্ষন চুপ থাকল। কান্না থামিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করল।তারপরই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বলল,

” আহা!এত সহজে বিয়ে করে নিতে দিব তোমায়?তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে গেলে কিডন্যাপ করে তুলে আনব বুঝলে?”

” বুঝলাম।”

নীরু আবারও হাসল।বলল,

” আরে চিল।তেমন কিছু করব না।আমার বরের বিয়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব আমিই নিব হুহ?এতক্ষন মজা করেছি। তুমি আবার সিরিয়াসলি নিয়ে নিও না হুহ?আর হ্যাঁ, কান্নাটা কিন্তু জাস্ট নাটক।তুমি কি তা ধরতে পেরেছো? নাকি সত্যি সত্যি ভেবে নিয়েছো?”

রঙ্গন ঠান্ডা কন্ঠে বলল,

” আমি তোর সবকিছুই ধরতে পারি নীরু।যা ঘুমা।”

” ওকে, গুডনাইট বর।”

কথাটা বলেই কল রাখল নীরু।কেন জানি প্রচুর কান্না পাচ্ছে। প্রচুর রাগ হচ্ছে।কিন্তু কেন সেটাই বুঝতে পারল না।সব রাগ গিয়ে জমল মোবাইলের উপর।মোবাইলটা না থাকলে এতবার কল দেওয়া হতো না।রোজ রোজ কথা বলা হতো না।দুর্বলতাটাও এতটা প্রখর হতো না।নিজের পড়ালেখারও বারোটা বাঁজত না।নীরু হাতের মোবাইলটা আঁছাড় মারল।বেলকনির ফ্লোরেই মোবাইলটা সেভাবে ফেলে রেখে হনহন করে রুমে ডুকল। আলো নিভিয়ে সটান শুঁয়ে পড়ল।

.

দুপুরে আলমারির কাপড়গুলো গুঁছাতে গিয়েই সেতুর চোখ পড়ল আলমারির নিচের ড্রয়ারটায়।ড্রয়ারটা ঠিকভাবে মারা হয়নি। ভেতর থেকে একটা কাগজ বেরিয়ে আছে।সেতু কপাল কুঁচকাল।ঝুঁকে গিয়ে ড্রয়ারটা টেনে খুলেই কাগজটা হাতে নিল।উল্টে আবারও ড্রয়ারে রাখতে গিয়েই চমকাল।এটা কাগজ না। একটা ছবি।সেতু স্থির চাহনীতে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল।ছবিটা তারই।তখন বয়স ছিল ষোল। পরনে লাল শাড়ি।পাড়ার পূজা উপলক্ষ্যেই পরেছিল শাড়িটা।নিষাদ কখন এই ছবিটা তুলেছে তার খেয়াল নেই।তবে এতগুলো দিন পার হওয়ার পরও নিষাদের কাছে সেইসময়ের কোন ছবি থাকতে পারে আশা করেনি সে।সেতু ভ্রু জোড়া কুঁচকে ড্রয়ারের ভেতর তাকাল।আরো অনেকগুলো ছবি আছে।সেতু হাত এগিয়ে ছবিগুলো একে একে চাইল। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থার ছবি সহ,কিশোরী বয়সের ছবি, বিয়ের ছবি,বিয়ের পর ঘরোয়া শাড়ির সাঁজে অনেকগুলো ছবি।এর মধ্যে বেশির ভাগই তার কিশোরী বয়সের ছবি।সেতু শুকনো ঢোক গিলল।পাশে কতগুলো শুকনো গোলাপ দেখেই বুঝল এগুলো তার প্রত্যাখিত প্রত্যেকটা গোলাপ।কিশোরী বয়সে নিষাদ যতবারই তাকে ভালোবাসি বলেছিল, সঙ্গে একটা করে গোলাপ দিয়েই বলেছিল।আর সেতু সদা সর্বদা সেই গোলাপ ফেরত দিয়ে চুপচাপ বাড়ির উদ্দেশ্যে পা চালাত।সেতু আনমনে হাসল।গোলাপগুলোর পাশে আরো কিছু চোখে পড়ল।কয়েকটা কাগজ।মূলত কাগজ নয়।চিরকুট!সেতু দ্রুত লুফে নিল চিরকুট গুলো।প্রথমটা মেলে ধরতেই চোখে পড়ল,

“এই মেয়ে?কি অসুখে বেঁধে দিলে আমায়?আমি না পারছি সুস্থ হতে না পারছি নিজের অসুখের কথা বুঝাতে।কি এক আশ্চর্য অসুখ।তুমিময় অসুখ।দয়া করে মুক্তি দাও এই অসুখ থেকে।”

সেতু চোখ বড়বড় করে চেয়ে থাকল।নিষাদের লেখা বরাবরই সুন্দর।সুন্দর লেখায় সুন্দর মনের কথা!সেতু জমে হেল।পরের চিরকুটগুলো মেলতে আবারও দেখল,

” সেতু?কি দরকার ছিল লাল শাড়ি পরার?সবাই পূজায় মনোযোগ দিল।অথচ আমি মনোযোগ দিতে পারলাম না।আমার মনোযোগ কেবল তোমাতেই আটকাল।তুমি নিজেও জানো না, লাল শাড়িতে কি ভীষণ ক্ষতি করে দিলে আমার।”

” ভালোবাসি।এই কথাটার বিনিময়ে ভালোবাসি বলতে হয়।জানো না মেয়ে?তুমি কেন কিছু না বলে চলে যাবে?আমার বুকের অস্থিরতা যদি বুঝতে তবে তুমি চলে যেতে পারতে?পারতে না মেয়ে।”

” কি আশ্চর্য!আমি তোমার কথা ভেবে দিনরাত পার করছি।না ঘুমিয়ে তোমার বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করছি।স্নান না সেরে,ব্রাশ না করে তোমার স্কুলের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকছি।ওহে মেয়ে?তুমি কি সত্যিই কোনদিন বুঝবে না এই যুবকের যন্ত্রনা?”

” মৃ’ত্যুসম যন্ত্রনা!এভাবে আর কত অবেহেলা সেতু?এত অবহেলা কুড়োতে ভালো লাগছে না আমার।খুব জ্বালিয়ে মারছো কিন্তু।ইচ্ছে করছে তোমায় টুপ করে চুমু দিয়ে ফেলি।সব জ্বালার অবসান ঘটুক।”

সেতু জোরে জোরে শ্বাস ফেলে একে একে সব চিরকুট পড়ল।বুঝতে পারল চিরকুট গুলো সব আগের লেখা।যখন নিষাদের সাথে তার দেখা হয়েছিল কিশোরী বয়সে তখনকারই। চোখ বুঝে নিল সে।এত এত ভালোবাসাকেও অবহেলায় মুড়িয়েছিল সে।শুধুমাত্র পরিবারের জন্য।উহ!নিষাদ কি তখন খুব বেশি কষ্ট পুষত?দিনরাত অবহেলার যন্ত্রনায় ছটফট করত?সেতু ঠোঁটে ঠোঁট ছাপল।বুকের ভেতর ভয়ঙ্কর অস্থিরতা সতেজ হয়ে উঠল মুহুর্তে।রক্ত চলাচল দ্রুত ঘটল।অনুভূতিতে চোখ টলমল করল।
সেতু কাঁপা কাঁপা হাতে সব আগের মতো গুঁছিয়ে ড্রয়ারটা আবারও আগের মতো করে রাখল।মোবাইল হাতে নিয়ে নিষাদের নাম্বারের দিকে তাকিয়ে থাকল বেশ কিছুটা সময়।বুঝে উঠল না কল দেওয়া উচিত নাকি উচিত না।অবশেষে নিজের অস্থিরতাকে দমানো গেল না।চেনা নাম্বারটায় দ্রুত কল দিয়ে কানে নিতেই ওপাশ থেকে রিসিভড হলো।সেতু কিছু বলতে পারল না।গলা দিয়ে শব্দ বের হতে চাইল না।যেন জমে রইল সে।ওপাশ থেকে নিষাদই বলল,

” হঠাৎ কল দিলে?”

সেতু চুপ থাকল বেশ কিছুটা সময়।ওপাশেও নিরবতা।নিরবতা ভেঙ্গে নিষাদ আবারও বলল,

” কি হলো?কথা বলছো না কেন সেতু?”

সেতু চোখ বুঝল।নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে গলা ঝেড়ে বলে উঠল,

“বাসায় আসুন তাড়াতাড়ি।কথা আছে আপনার সাথে।”

নিষাদ এবার চুপ রইল।সচারচর সেতু তাকে কল করে না।আজ কল করে সোজা বাসায় যেতে বলছে?বিষয়টা অদ্ভুত ঠেকল।ভ্রু জোড়া কুঁচকে বেশ কিছুক্ষন পর প্রশ্ন করল,

” এখনই?কোন দরকার?সবাই ঠিক আছে বাসার?”

সেতু মৃদু হাসল।খাটের উপর আয়েশ করে বসে নরম গলায় বলল,

” ঠিক রেখেছেন?”

নিষাদ এবারও বুঝল না কিছু।গলা ঝেড়ে বলল,

” কি ঠিক রাখিনি?কিছু হয়েছে সেতু?নীর কোথায়?”

সেতু উত্তর দিল,

“নীরুর কাছে।”

নিষাদ আবারও প্রশ্ন ছুড়ল,

” আসার জন্য বলছো কেন?কারো কিছু হয়েছে?”

সেতু ছোট্ট শ্বাস ফেলল।বলল,

” হয়েছে।”

নিষাদের ফের প্রশ্ন,

” কার?কি হয়েছে?’

সেতু গলা ঝাড়ল।স্পষ্ট কন্ঠে বলল,

” আপনি আধঘন্টার মধ্যে বাসায় আসুন। তবেই বলছি।আসতে পারবেন?”

” ফোনে বলা যায় না সেতু?কি এমন ঘটেছে?নীরু, নীর, মা সবাই ঠিক আছে?”

সেতু বলল,

” ঠিক আছে সবাই।”

” তাহলে?তুমি ঠিক আছো সেতু?”

সেতুর এবার হাসি আসল ভীষণ।ঠোঁটে ঠোঁট চাপল।কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,

” বাসায় আসতে পারবেন?পারলে আসুন।নয়তো রাখলাম।হুহ?”

নিষাদ দ্রুত কন্ঠে বলল,

” আসছি আমি।একটু অপেক্ষা করো।”

সেতু অপেক্ষা করল।এক মিনিট, দুই মিনিট, পুরোপুরি চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করল।অবশেষে দরজায় আওয়াজ হলো।সেতু বসা ছেড়ে উঠল।দ্রুত পায়ে গিয়ে দরজা খুলতেই চোখে পড়ল ঘামে ভিজে নিয়ে একাকার হওয়া নিষাদকে।সেতু ছোট ছোট চোখে তাকাল।দরজা মেলে দিয়ে বলল,

” খেয়েছেন?”

নিষাদ অবাক হয়ে তাকাল সেতুর দিকে।ভ্রু জোড়া উঁচু করে বেশকিছুক্ষন চেয়ে থেকেই ঘরে পা বড়াল।ট্রাইটা ঢিলে করে শার্টের উপরের বোতাম খুলে দিয়েই সোফায় দুম করে বসল।পায়ের মোজা খোলায় মনোযোগ রেখে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ডাকলে কেন এভাবে? খেয়েছি কিনা তা জিজ্ঞেস করতে?”

” না,আপনার কাজকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য।”

নিষাদ মাথা তুলে চাইল।ভ্রু জোড়া কুঁচকে রেখে বলল,

” মানে?”

সেতু চুপ থাকল।বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকেই পা বাড়িয়ে রুমে যেতে লাগল।মিনমিনে গলায় বলল,

” আমি বলার সাথে সাথে আপনাকে চলে আসতে হবে কেন?আমি কি আপনার প্রেমিকা?যে আমার কথায় উঠবস করবেন?এত গুরুত্ব দেওয়া দেখাচ্ছেন কেন আমায়?”

নিষাদ বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রইল।কাল রাতের কথাগুলোই সেতু উল্টো করে বলে গেল তাকে।বিশ্বাস হলো না নিষাদের।সেতুকে তো আগে এমনটা করতে কখনো দেখেনি।কি হলো হঠাৎ এই মেয়ের?জ্বরটর বাঁধাল নাকি শরীরে?

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে