হৃদ মাঝারে পর্ব-২৭

0
320

#হৃদ_মাঝারে (পর্ব ২৭)

শিবাজীর শরীরটা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে | শনি, রবি দুটো দিনই ঘুরে ঘুরে জ্বর এসেছে | তবে রবিবার সকালের পর থেকে আর গা গরম হয়নি বলে রাজন্যার অনেক বকাঝকা সত্বেও সোমবার তাকে অফিস যাওয়া থেকে বিরত করা যায়নি | ওরা অফিস পৌঁছুতেই কার্ল অভিযোগের ঝুলি খুলে বসলো

– রাজন্যা আমার সাথে জু দেখতে যাবে বলেও লাস্ট মোমেন্টে ক্যানসেল করেছে!

রাজন্যা গোবেচারা মুখ করে বলল,

– কি করি? আমার লোকাল গার্জিয়ানকে দেখলাম জ্বরে উল্টে পড়েছে | তাকে ফেলে রেখে এনজয় করতে যাই কি করে বলো?

রত্নেশ এবং আরো অনেকে শিবাজীকে আজকের দিনটা অফিসে আসার জন্য মৃদু ভর্ৎসনা করলো | শিবাজী পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গি করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,

– আমার শরীরও সেয়ানা। দেখছো না? ঠিক উইক এন্ড টুকুতেই খারাপ হয়েছে। যাতে অফিসের কাজ বাদ না যায়…

কার্ল মুখ গোমড়া করে বলল,

– সেই! শুধু আমার লোভনীয় ডেটটাকে বরবাদ করে দিল।

সকলে হো হো করে হেসে উঠলো। কেবল রাজন্যা ডেট কথাটা শুনে লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করলো।

আজ ক্লায়েন্টের একজন সিনিয়র ম্যানেজারের সাথে মিটিং ছিল | শিবাজীর গলায় ব্যথা বলে কথাবার্তা রাজন্যাই বলল | প্রথমদিকে একটু ভয় ভয় থাকলেও খানিক বাদেই কনফিডেন্টলি সমস্তটা বুঝিয়ে বলতে পারল। শিবাজীর চোখে প্রশংসা দেখেই বুঝলো কোন রকম গন্ডগোল হয়নি। সিনিয়র ব্যক্তিটিও করমর্দন করে বললেন,

– হ্যাপি টু বি ওয়ার্কিং উইথ ইউ মিস রাজ |

রাজন্যার চোখ মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠলো | অফিসে অনেকেই ওদের ফিরে যাওয়ার দিন এগিয়ে আসা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করল, দু-একজন রাজন্যাকে বলেই ফেলল পরেরবার চেষ্টা করে অন্তত তিন মাসের জন্য আসতে | বাড়ি ফেরার পথে একটা অন্য বাসে উঠতে দেখে রাজন্যা প্রশ্ন করল,

-এটা তো আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ফেরার বাস নয়?

শিবাজী ভ্রু তুলল,

– বাবা! এসব লক্ষ্য করেছো দেখছি? ভেরি গুড!
– বা রে! দু সপ্তাহ যাতায়াত করছি, লক্ষ্য করব না?
– কি জানি! আমি তো ভাবছিলাম আমাকে বোধহয় অন্ধের মত বিশ্বাস করো!
– তা তো করিই! তা না হলে অন্য বাস দেখেও উঠে পড়লাম?

শিবাজী হাসলো,

– তাও ঠিক! আজ তোমাকে লাইব্রেরীতে ঘুরিয়ে আনবো চলো

লাইব্রেরীর আয়তন দেখে রাজন্যার মুখ হাঁ হয়ে গেল | বিশাল বড় জায়গা জুড়ে লাইব্রেরী | বাইরে বিরাট পার্কিং লট, বসার জায়গা, একটা ছোট লেক | ভিতরে সারি সারি কাঠের খোলা সেল্ফ জুড়ে অজস্র বই | একটা দিকে শুধুমাত্র বাচ্চাদের বই এবং প্রচুর খেলনা | বিভিন্ন বয়সের বাচ্চারা বই নিয়ে, খেলনা নিয়ে সেখানে বসে নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছে। দোতলায় যাওয়ার একটা সিঁড়ি দেখতে পেল |

– ওপরে আরো বই?

শিবাজী সিঁড়ির কাছে একটা নোটিশ দেখে বলল,

– না, উপরটা মনে হচ্ছে ভিডিও ক্যাসেটের জায়গা | এখানে বসেও দেখার ব্যবস্থা আছে।

রাজন্য অবাক হয়ে দেখল, লোকজন দশ বারোটা করে বই নিয়ে কাউন্টারের দিকে যাচ্ছে |
– এতগুলো করে বই বাড়িতে নিতে দেয়?
– হ্যাঁ, কোন লিমিট নেই | এখানে এরা বই পড়াটাকে খুব এনকারেজ করে
– আমরাও নিতে পারব?
– মেম্বারশিপ করলেই পারব | করতে চাও?
– না থাক, আর তো মাত্র কয়েক দিনের ব্যাপার | পরে কখনো আরো বেশি দিনের জন্য এলে প্রথমেই লাইব্রেরীর মেম্বারশিপ করবো |

দু’চারটে বই নাড়াচাড়া করে শিবাজী রাজন্যাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো লাইব্রেরীর বাইরে | খোলা জায়গাটায় খানিক দূর হেঁটে এসে একটা বেঞ্চে বসলো দুজনে | সামনের লম্বা রাস্তাটা হাঁসুলী বাঁকের মতন গোল হয়ে বেঁকে গেছে একটা মাঠের পাশ দিয়ে | রাস্তার পাশে পাশে উঁচু উঁচু কতগুলো গাছ আর খানিক দুরে দেখা যায় ছোট ছোট কয়েকটা বাড়ি। একদিকে একটা ছোট্ট কাঠের ব্রিজ আর একটা জলাশয়। নিশ্চিন্তে কতগুলো হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে সেখানে। এখানে সন্ধ্যা হয় একটু দেরিতে। তাই এখনো আকাশে লালচে হলুদ আভা |

– জায়গাটা কি সুন্দর!

রাজন্যা মুগ্ধ ভাবে বলল

– মনে হচ্ছে না কেউ যেন রং তুলি নিয়ে ছবি এঁকে দিয়েছে?
– ঠিক তাই! ছোটবেলায় এরকম করেই তো ছবি আঁকতাম | দুটো তিনটে বাড়ি, একটা আঁকাবাঁকা রাস্তা, দূরে দু’চারটে গাছ

শিবাজী যোগ করল,
– আর ত্রিভুজের মতন পাহাড় আর দুটো পাহাড়ের মাঝখানে কমলা রঙের সূর্য
– ঠিক ঠিক!

রাজন্যা হেসে উঠলো

– আমি আবার ভি শেপের কাকও এ্যাড করতাম আকাশে…
– একদম! ওই ছবিতে কঠিন কোন কিছু থাকতো না।

দুজনেই হেসে উঠল একসাথে |

রাজন্যার পিঠের পেছন দিয়ে শিবাজীর ডান হাতখানা রাখা | রাজন্যা বেঞ্চের হেলান দিতে গিয়ে হাতের স্পর্শ পেয়ে সরে আসতে গেল। পরমুহূর্তেই কাঁধের কাছে একটা হাতের ছোঁয়া |

– কি হলো? হেলান দিলে না যে!
– না ঠিক আছে
– কি ঠিক আছে?

কেন যেন লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো রাজন্যা | নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই টের পেল, একজোড়া চোখ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে | কয়েক মুহূর্ত পরে কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে উপর দিকে তাকাতে গিয়েই সেই এক জোড়া চোখে ধাক্কা খেয়ে ফের চোখ নামিয়ে নিতে যেতেই শিবাজী বলে উঠলো,

– কেন? চোখ নামাচ্ছো কেন?

রাজন্যা হেসে ফেলল,

– আপনি ওরকম ভাবে তাকিয়ে আছেন যে!
– তাকিয়ে দেখার জিনিস হলে তাকাবো না?
– ধুত চলুন, উঠি | বাইরে এভাবে বসে থাকলে আবার আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে | টেম্পারেচার কিন্তু সন্ধ্যার দিকে একটু কম |

রাজন্যা উঠে পড়তে যেতেই পরমুহূর্তেই বাঁ হাতে একটা টান খেয়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে শিবাজীর গায়ের উপরে পড়ল। সারা শরীর শির শির করে উঠলো | সজ্ঞানে মানুষটার এত কাছে এই প্রথম | শনিবার দিনও শিবাজীদাকে জড়িয়ে ধরে বিছানা থেকে তুলেছে, ওষুধ খাইয়েছে, জল খাইয়েছে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে | কিন্তু সে ছিল অসুস্থ মানুষের পরিচর্যা | আজ তো তা নয় |

শিবাজী কিছুক্ষণ রাজন্যার রাঙা হয়ে ওঠা মুখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

– তুমি এত ছোট কেন রাজন্যা? আমার জীবনে আগে কেন এলেনা? আজ আমি একজন ভাঙাচোরা মানুষ, যার একবার বিয়ে হয়ে গেছে, যার একটা বাচ্চা আছে | চাইলেও সাহস করে তোমাকে আমার জীবনে আসতে বলার কথা বলতে পারব না | চলো উঠি…

রাজন্যা হতবাক হয়ে গেল | কি বলল শিবাজী দা? চাইলেও বলতে পারব না, তার মানে?

লাইব্রেরী থেকে ফিরে অভ্যাস মতন দু কাপ কফি বানিয়ে ফেললো শিবাজী | তারপরেই রুটিন মাফিক কাজের অ্যানালিসিস আর ডকুমেন্ট নিয়ে বসলো | খানিক্ষণ কাজ করার পরে ঘড়ি দেখে বলল,

– বাড়িতে একটা ফোন করি | পিপিয়ার হোয়াটসঅ্যাপে গন্ডগোল করছিল বলে, ভিডিও কল করা হয়নি কদিন।
– কিন্তু আজ তো সোমবার, তিতলির স্কুল আছে না?
– নাহ্, আজকে টিচার্স ডে, স্কুল ছুটি।

খানিক পরেই ভিডিও কলে সুমিত্রাকে দেখা গেল | ওদের দুজনকে এক জায়গায় দেখে সুমিত্রা হেসে ফেললেন | শিবাজী বা রাজন্যা কেউই আলাদা করে বলেনি যে ওরা দুজনে একই অফিসে চাকরি করে বা একই সাথে অনসাইট যাচ্ছে | কিন্তু সুমিত্রা ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন। একই দিনে একই সময়ের জন্য একই জায়গায় যাওয়াটা যে কাকতালীয় হতে পারে না সেটুকু তিনি বুঝে ফেলেছিলেন | খানিক কথাবার্তার পরে একটু গম্ভীর ভাবে সুমিত্রা বললেন,

– তোর সাথে একটু ব্যক্তিগত কথাও ছিল বাবাই, পরে যখন ফ্রি হবি আলাদা করে ফোন করিস |

শিবাজী যে ইতিমধ্যে রাজন্যাকে সমর্পিতা সম্বন্ধে সমস্ত কিছু বলেছে তা সুমিত্রা জানেন না | শিবাজী ও সে সম্পর্কে কিছু না বলে শুধু বলল,

– ঠিক আছে

রাজন্যা জিজ্ঞাসা করে উঠল,

– পিসিমা, তিতলি কোথায়? ঘুম থেকে ওঠেনি?
– উঠেছে উঠেছে। ডাকছি…

পরমুহূর্তেই সিঁড়ি দিয়ে লাফাতে লাফাতে তিতলিকে নামতে দেখা গেল। রাজন্যা ব্যস্ত হয়ে উঠলো,

– আরে অত লাফিও না, পড়ে যাবে তো!

ভিডিও কলে বাবাইয়া আর ফেয়ারি সিস্টারকে একসাথে দেখতে পেয়ে প্রবল উত্তেজিত তিতলি। কল কল করে অনেক গল্প করে ফেলল একসাথে। তারপরেই বলে উঠলো,

– জানো তো ফেয়ারি সিস্টার, আমার মাম্মা এসেছিল | কিন্তু মাম্মা একটুও ভালো না, আর আমাকে মারবে বলেছিল |

মুহূর্তে শিবাজীর মুখ থমথমে হয়ে উঠল।

– পিপিয়া! কি বলছে তিতলি?

সুমিত্রা গম্ভীর মুখে বললেন,

– এই কথাই বলছিলাম |

সুমিত্রার কাছ থেকে শনিবারের সমস্ত ঘটনার বর্ণনা শুনল রাজন্যা শিবাজী দুজনেই | মাধবীর এই বাড়িতে আসার কথা এবং সমর্পিতার বাবার বাড়ির ভাগ চাওয়ার কথাও সুমিত্রা বললেন |

ফোন রাখার পরে সমর্পিতার আইনি চিঠি খানার কথাও রাজনাকে বলল শিবাজী। রাজন্যা রাগে ফেটে পড়ল।

– ওই মহিলাকে আমি ছাড়বো না শিবাজীদা।

শিবাজী গম্ভীর ভাবে বলল,

– এভাবে রাগের মাথায় কিছু করতে পারবে না। সমর্পিতাকে এবারে এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে যাতে ও ভবিষ্যতে আর এরকম কোন বেচাল করার সাহস না পায় |
– ওর এত বড় সাহস যে ও তিতলিকে থাপ্পড় মারতে যায়? দশ মিনিট একটা বাচ্চাকে সামলানোর ক্ষমতা নেই, সে আবার মা?

রাজন্যা কিছুতেই ভুলতে পারছে না | শিবাজী রাজন্যার হাতের উপরে হাত রাখল।

– শান্ত হও | কৈলাসদা থাকতে কারোর সাহস নেই আমার মেয়ের গায়ে হাত দেয়।

রাজন্যা তবু পা দাপাতে থাকে, তারপরে বলে,

– কিছু তো একটা ব্যবস্থা আমি ওর করবোই, আমাকে শুধু একটু ভাবার সময় দিন।

পরবর্তী কয়েকদিন এদিকে অফিশিয়াল কাজকর্মে দুজনেই ব্যস্ত থাকলেও নিয়ম করে বাড়ির খবর নিতে ভুলল না। দুই এক দিন ভিডিও কলেই ফেয়ারি সিস্টারের থেকে গল্প শোনা হয়ে গেল তিতলির। সুমিত্রা মনে মনে এক অন্যরকম আশায় বুক বাঁধছেন |

আগের দিনের সমর্পিতার মারকুটে ব্যবহারের ভিডিও সত্যেনের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন | সত্যেন ফোন করে ক্ষমা চেয়েছেন সুমিত্রার কাছে। বলেছেন,

– আমার মেয়েকে আমি মানুষ করতে পারিনি দিদি | এ আমার অক্ষমতা, এ আমার লজ্জা | কিন্তু ও যাতে কোনভাবেই আর আপনাদের পরিবারে কোনরকম অশান্তি না আনতে পারে সেটুকু আমি আইনিভাবে নিশ্চিত করে দেবো।

ডে ময়েনের শেষ উইক-এন্ড টাও কেটে গেল | আগামী শুক্রবার শিবাজী আর রাজন্যার দেশে ফেরার ফ্লাইট | রাজন্যার মনটা একটু খারাপই হচ্ছে। এখানে যেভাবে শিবাজীদার সাথে এতটা সময় কাটাতে পেরেছে, দেশে ফিরে গেলে তো আর তা হবে না | দুজনে ওরা দুজনকে পছন্দ করে, কিন্তু মুখ ফুটে পরিষ্কার করে বলে ওঠা হয়নি কারোরই | শিবাজীর মনের ভিতর সংকোচ বয়স নিয়ে, নিজের বৈবাহিক স্ট্যাটাস নিয়ে | রাজন্যার সংকোচ নিজের অর্থনৈতিক অবস্থান নিয়ে। সমর্পিতা শিবাজীর ব্যবসার জন্য, প্রতিপত্তির জন্য ওকে বিয়ে করেছিল | আবারও যদি কেউ ভাবে রাজন্যার মত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে কেবলমাত্র পয়সার জন্য শিবাজীকে ফাঁসাতে চাইছে? না না! সে অপমান কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না রাজন্যা। তার চাইতে চুপটি করে দূর থেকেই ভালোবাসবে বরং | তবে তিতলির থেকে দূরে থাকতে পারবে না | এই এক মাসের দূরত্বে তিতলির উপরে টানটা যেন আরো বেড়ে গেছে | ওদিকে তিতলিও প্রায় প্রতিদিনই ফেয়ারি সিস্টার এর ফেরার দিনের কথা জিজ্ঞাসা করে করে সুমিত্রার মাথা খারাপ করে দেয়।

রাত্রে ডিনার সারতে সারতে শিবাজী বলল,

– আর তো ডে ময়েনের পাট ঢোকানোর সময় হয়ে এলো রাজন্যা।

রাজন্যা একবার শিবাজীর দিকে তাকিয়েও ফের চোখ নামিয়ে নিল।

– কি হলো, কিছু বলবে না?
– কি আর বলব? এক মাসের জন্য এসেছিলাম তা তো জানতামই।

শিবাজী খানিক আহত চোখে তাকিয়ে রইল রাজন্যার দিকে | রাজন্যা যদি নিজে থেকে না চায়, তাহলে কখনোই ওকে নিজের জীবনে আনার জন্য জোর করবে না | কতই বা বয়স মেয়েটার? শিবাজীর থেকে অন্তত দশ বছরের ছোট | ও ওর কাছাকাছি বয়সের একজন জীবনসঙ্গীকে ডিজার্ভ করে, যে প্রথম থেকেই একসাথে ওর সাথে পথ চলবে | শিবাজীর মতো ভুলভাল পথে চলে ফিরে আসা মানুষ রাজন্যার মত মেয়ের জন্য যোগ্য নয় হয়তো |

রাজন্যা ছোট ছোট গ্রাসে খাবার শেষ করতে করতে ভাবলো, শিবাজীদা কি কিছু বলতে চাইছিল? তাহলে বলল না কেন? ও বুঝি নির্লজ্জের মতন বলতে পারে!

খাওয়া শেষ | দুজনেই চুপ | কেউই অপরজনকে নিজের মনের কথাটা বলে উঠতে পারল না |

এরকমভাবেই সপ্তাহের বাকি দিন ক’টাও কেটে গেল | ফের ব্যাগ প্যাক করার পালা, ফের ওয়েব চেক ইন, ফের টিকিটের প্রিন্ট আউট নেওয়া, সমস্ত ডকুমেন্ট গুছিয়ে ব্যাগে নেওয়া, অফিসের সকলের থেকে বিদায় নেওয়া।

শেষ দিন কার্ল রাজন্যাকে একটা হাগ করে একটা পারফিউমের বোতল দিয়ে বলল,

– আ স্পেশাল গিফট ফর আ স্পেশাল লেডি!

রাজন্যা হাসিমুখে বোতলটা নিতে নিতে দেখল শিবাজী গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে | মনে মনে একটু হাসলেও মুখে কিছু প্রকাশ করল না রাজন্যা |

গভীর রাতের ফ্লাইট | রত্নেশ আসবে ওদের এয়ারপোর্টে ছেড়ে দিতে | সকালে অল্প সময় অফিস করে দুপুরের মধ্যেই অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এসেছে ওরা। ব্যাগগুলো আরেকবার করে চেক করতে করতেই শিবাজী বলে উঠলো,

– তোমার রোমিওর দেওয়া বটলটা ভালো করে তোয়ালে টোয়ালে মুড়িয়ে ব্যাগে ঢুকিও |

রাজন্যা ফিক করে হেসে ফেলল,

– আপনি জেলাস বুঝি?
– তা একটু জেলাস! আমার কপালে তো আর কোন সুন্দরী মহিলা জুটলো না এদেশে।
– হ্যাঁ, সেই! আপনাকে তো দেশি মহিলার পাশাপাশিই ঘুরতে হল পুরো সময়টা!

বলেই খানিক অপ্রস্তুত রাজন্যা। শিবাজী খানিক কাছে এগিয়ে এলো

– দেশি মহিলা খুব কাছাকাছি আসতে দিল কোথায়?

রাজন্যা একটু সরে গেল।
– আর কত কাছাকাছি আসতে দেবে?

শিবাজী আচমকা রাজন্যার হাত ধরে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। তারপর চোখে চোখ রেখে বলল,

– ঠিক এতখানি কাছাকাছি!

রাজন্যার মনে হল ওর হৃদপিণ্ডের লাব ডুব শব্দ বুঝি কানের পর্দা ফাটিয়ে দেবে। শিবাজীর দুই বাহুর মধ্যে মোমের মতন গলে যাচ্ছে যেন রাজন্যার শরীর | শিবাজী আলিঙ্গন আরেকটু শক্ত করল,

– মে বি আই ডু নট ডিজার্ভ ইউ রাজন্যা। তবু প্রশ্নটা না করে পারছি না, উইল ইউ বি মাইন?

রাজন্যা কি ঠিক শুনছে? নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। ফিসফিস করে বলল,

-আবার বলুন!

শিবাজীর মুখ নামিয়ে আনলো রাজন্যার মুখের খুব কাছে। তারপর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে বলল,

-আমার হবে রাজন্যা? বরাবরের মতো?

রাজন্যার সারা শরীর কেঁপে উঠলো | টুপ করে চোখের পাতা বুজিয়ে ফেলে ফিসফিসিয়ে বলল,

– হ্যাঁ!

পর মুহূর্তেই একজোড়া পুরু ঠোঁটের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল রাজন্যার দুই অধর | কতক্ষণ ওরা দুজনে এরকম আলিঙ্গনাবদ্ধ ছিল জানা নেই, আশেপাশের পৃথিবীর যেন থমকে দাঁড়িয়ে ছিল এই কিছুটা সময় |

হঠাৎ শিবাজীর ফোন শব্দ করে বেজে উঠতে সম্বিৎ ফিরল দুজনের | অপরিচিত নাম্বার | শিবাজী ফোন তুলতেই ওদিক থেকে মহিলা কন্ঠ।

– তিতলির ফেয়ারি সিস্টার যে সত্যিই আপনার সিস্টার তা জানেন তো মিস্টার শিবাজি সেন?
– আপনি কে বলছেন!
– আমি কে বলছি সেটা ইম্পোর্টেন্ট নয়, রাজন্যা সান্যালের মায়ের সম্বন্ধে কিছু জানেন কি? মহিলা তো আপনার কাছাকাছি আছেন, জিজ্ঞাসা করে নিন! রাজন্যা সান্যালকে লাঠি করে সমর্পিতা মল্লিক এর কাছ থেকে মুক্তি পাবেন ভাবছেন? আরো বড় খেলোয়াড়ের পাল্লায় পড়তে যাচ্ছেন কিন্তু…

শিবাজী কে ফোন রেখে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাজন্যা চিন্তিত গলায় জিজ্ঞাসা করল,

– কে ফোন করেছিল?
– জানিনা, কিন্তু খুব অদ্ভুত কথা বলল। রাজন্যা তোমার মায়ের নাম কি?
– আমার মায়ের নাম? হঠাৎ?
– বলোনা!
– আরাধনা। আরাধনা সান্যাল

এই নাম তো কখনো শুনেছে বলে মনে পড়ছে না শিবাজীর। কেউ কি মিছামিছি ওদের সম্পর্কটা বিষিয়ে দিতে চাইছে? এটা কি সমর্পিতার একটা চাল? কোনোভাবে টের পেয়েছে শিবাজীর সাথে রাজন্যার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছে, তাই ওর মনে তিক্ততা গেঁথে দেওয়ার দেওয়ার চেষ্টা করছে? কিন্তু রাজন্যার সম্বন্ধে সরাসরি কোন খারাপ কথা না বলে ওর মায়ের কথা বলল কেন? শিবাজী কে তখনো ভ্রু কুঁচকে থাকতে দেখে রাজন্যা ফোনে ওদের একটা পরিবারের ছবি বের করে এগিয়ে দিল।

– এই দেখো। আমার মা বাবা ভাই আর আমি…

রাজন্যার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে ছবিটা দেখতে দেখতে শিবাজীর দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল।

– ইনি তোমার মা?
– কেন?

শিবাজী রাজন্যার ফোনটা ছুঁড়ে সোফার উপর ফেলে দিয়ে তীব্র বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রাজন্যা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ | কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না | শিবাজীর অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দেখল দরজা ভিতর থেকে বন্ধ | বাইরে থেকে ধাক্কা দিল কয়েকবার।

-শিবাজী দা!

ভিতর থেকে গম্ভীর গলায় উত্তর এলো,

– প্লিজ লিভ মি অ্যালোন রাজন্যা। রত্নেশ এলে ওর সাথে এয়ারপোর্টে চলে যাবে। আমি আলাদা ক্যাব নিয়ে যাব।

রাজন্যা বুঝতে পারছে না কি হলো | এইতো কিছুক্ষণ আগে ওরা রঙিন স্বপ্নের জগতে ঘোরা ফেরা করছিল, এটুকু সময়ের মধ্যে কি এমন হয়ে গেল!

কাঁপা কাঁপা হাতে আরাধনার নম্বরটা ডায়াল করল, বেজে বেজে থেমে গেল | এ সময়টা রান্না ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকে মা | হয়ত ফোন বাজার শব্দ শুনতে পাচ্ছে না | আবার দরজায় ধাক্কা দিল।

– শিবাজী দা কি হয়েছে আমাকে বলুন একটু! প্লিজ!

দরজা খুলে গেল | এই কয়েক মিনিটের মধ্যেই শিবাজীর দুই চোখ লাল হয়ে গেছে | কেটে কেটে বলল,

– নিজের ঘরে যাও রাজন্যা। কখনো সখনো অন্যের কথা একটু শুনতে শেখো | লিভ নাও!

শেষের শব্দ দুটো এতটাই চিৎকার করে বলল যে রাজন্যা থরথর করে কেঁপে উঠল | তারপর এক দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো |

(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে