হৃদয়ে তুমি পর্ব-০৪

0
1052

#হৃদয়ে_তুমি
লেখনীতে:Waziha Zainab (নিহা)
চতুর্থ পর্ব

আমাদের রান্না নষ্ট করার প্ল্যানটা ছিলো নিশান ভাইয়ার।ফুফা ফুফিকে ডেকে আর উনি আমায় ঘরে পাঠিয়ে সুযোগ টা কাজে লাগিয়েছে।সেই সুযোগে রান্নার ঝাল লবন হলুদ সব বাড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এখন ফুফি কিছুতেই হার মানবে না সে আবার কম্পিটিশন করার জন্য বলেছে। এবার ফুফি নিজে রান্না পাহারার দায়িত্বে থাকবে।এই নিয়ে ফুফা ফুফি তুমুলঝগড়া করলেন। দুজন যেনো ১২ বছরের কিশোর কিশোরী।

রাত ১১ টা
আমি ঘরে গিয়ে দেখলাম উনি খুব মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছেন।আমি এগিয়ে একটা বালিশ আর একটা কাথাঁ নিয়ে সোফায় সুয়ে পড়লাম।আমার এমন কান্ড দেখে উনি হতভম্ব হয়ে বললেন
“কি ব্যাপার ওখানে কি করছো
আমি উত্তর দিলাম না
উনি আবার বললেন
“” কিছু জিজ্ঞাস করছি আমি
আমি আবারো উত্তর দিলাম না
এবার উনি উঠে এসে আমাকে সোফা থেকে কোলে তুলে ধপ করে বিছানায় ফেললেন

আমি আবারো উঠে সোফায় যেতে চাইলে উনি হাত টা হেচকা টান দেন।আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উনার বুকের উপর গিয়ে পড়ি উনি আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন।
তাও আমি নিজের ভাব ঠিক রাখার জন্য কথা না বলে উনার হাত সরানোর চেষ্টা করছি।
উনি এবার রাগী গলায় বললেন
“মাঝরাতে চড় না খেতে চাইলে
চুপচাপ ঘুমা….
আমিও ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে উনাকেও জাগিয়ে দিলাম তারপর রান্নাঘরের দিকে গেলাম।চুলায় চা বসালাম
ফ্রিজ খুলতে গিয়ে হঠাৎ কোনো প্যাকেটের দিকে আমার চোখ পড়লো।। প্যাকেট টা হাতে নিয়ে দেখলাম কোনো রেস্টুরেন্টের প্যাকেট।।
এবার বিষয়টা একটু সন্দেহ লাগলো
তারমাঝেই ভাবি রান্নাঘরে এলো।প্যাকেট টা দেখলো।বুঝতে পারলাম খুব ভালো করেই যে কাল রাতের খাবার গুলো ফুফা ভাইয়া আর উনি তৈরি করে নি রেস্টুরেন্টে থেকে আনিয়েছেন_এর মধ্যেই ফুফিও রান্নাঘরে এলো।

প্যাকেট গুলো দেখে ফুফি তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দেয়।
ফুফি সোজা কথা বলে দেয় আজ থেকে সে ফুফা ভাইয়া আর উনার জন্য রান্না করবে না
ফুফির কথায় ফুফা কাচুমাচু হয়ে বললো
” তোমার বড়ছেলের প্ল্যান সব
এবার নিশান ভাইয়া তেতে উঠে বললো
“ইশ বড় ছেলের প্ল্যান বললেই হলো
রেস্টুরেন্টে ফোন করে খাবার তো তুমিই অর্ডার দিয়েছিলে
এবার উনি এগিয়ে এসে বললেন
” আরে তোমরা ঝগড়া করছো কেনো
ভাইয়া আব্বু আমরা কি রান্না করতে জানি না নাকি?আমরাও জানি রান্না করতে সো ওদের খাবার আমরা খাবো না আর বাট সেটা কালকে থেকে, আজকে না হয় শেষবারের মতো মা জননীর হাতের খাবার খাই

পরদিন থেকেই শুরু হলো বাবা আর দুই ছেলের যুদ্ধ। নিশান ভাইয়া তেলের ভেতর মাছ দিতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে পেলেছে উনি মাছ কাটতে গিয়ে হাত কেটে অবস্থা খারাপ করে পেলেছে।আর ফুফা তো নাজেহাল অবস্থা।যা দেখে ফুফির হাসছে।সে যেনো হাসি থামাতেই পারছে না।পরে ভাইয়া আর উনি এসে ফুফিকে বললেন আর জীবনেও এমন কাজ করবে না।

এভাবেই কেটে যায় দিন।হাসি কান্না তামাশা খুনশুটি আর ভালোবাসায়।তারমাঝে খবর আসে আব্বুর গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়েছে খুবই শোচনীয়।
আমার পৃথিবী যেনো অন্ধকার হয়ে গেলো “যার বাবা আছে তার একটা পৃথিবী আছে” আমি নিজেকে শান্ত রাখতে পারলাম না।
‘হসপিটালে আইসিউর বাহিরে বসে আছি।আম্মুকে সামলানো আর সম্ভব হচ্ছে না।আম্মু বার বার আইসিউর ভেতরে ডুকতে চাইছেন।আমি আম্মুকে সামলাতে পারছি না।কান্নায় চোখ ভরে আসছে।দুদিন আগেও আব্বুর সাথে দেখা হয়েছিলো সব ঠিক ছিলো কিন্তু কোথায় থেকে কোন ঝড় এসে জীবনটাকে এলোমেলো করে দিলো
“হয়তো জীবনে দুঃখ আছে বলেই সুখ এতো মূল্যবান”

আইসিউর লাইট অফ হয়ে গেলো ভেতর থেকে ডক্টর বেরিয়ে আসতেই উনি আর ফুফা এগিয়ে গেলো।উনি হতাশ গলায় বললেন
“পেশেন্টের অবস্থা এখন কেমন
ডক্টর বললেন
” অবস্থা তেমন ভালো না উনার পায়ে চোট লেগেছে হয়তো উনি আর হাটতেও পারবে না

এবার আম্মুকে আর থামানো গেলো না হো হো করে কেঁদে দিলো বাচ্চাদের মতো।আমি ধীরে পায়ে এগিয়ে ডাক্তারের সামনে গিয়ে বললাম
” আমার আব্বু ঠিক হয়ে যাবে তো”
ডক্টর আমাকে শান্তনা দিয়ে বললো
“সবই আল্লাহর হাতে মা।ভরসা রাখো নিশ্চই ভালো কিছু হবে

৩ ঘন্টা পর আব্বুর জ্ঞান ফিরলো আম্মু দৌড়ে গিয়ে আব্বুর হাত দুটো ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে শুরু করে দিলো।আমি আর ফুফিও গেলাম।আব্বুকে এভাবে বেড এ শুয়ে থাকতে দেখে ভীষণ কষ্ট লাগছে,,,,বুকের ভেতর থেকে যেনো কলিজা টা ছিড়ে বের হয়ে আসছে।কি থেকে কি হয়ে গেলো।

১২ দিন পর আব্বুকে রিলিজ দেওয়া হলো।আব্বু এখন মোটামুটি ভালো।ডক্টর বলেছে অবস্থা ভালোর দিকে এগোচ্ছে
এই বারোটা দিন আমার কিভাবে কেটেছে নিজেও জানিনা বাসা হসপিটাল,,,হসপিটাল বাসা শুধু এভাবেই জার্নি ছিলো৷
আব্বুকে একটা হুইলচেয়ার দেওয়া হলো_
আব্বুর দিকে তাকাতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।যেই মানুষটা একটা মিনিট চুপ করে বসতে চাইতো না সেই মানুষটা এখন সারাদিন চুপ থাকে,,,,,
আম্মুর মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায় কতোটা কষ্টে আছেন৷ তবুও কাউকে বুঝতে দেয় না। মুখে একটা কষ্টের হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।

তিনমাস পর
আব্বু এখন অনেকটাই সুস্থ
হাটতেও পারে।বাচ্চাদের মতো কিছুদূর গিয়েই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যেতে নেয় কিন্তু আম্মু ধরে পেলে,,,,

সূর্যাস্ত শব্দটা অনেক প্রিয় মুহুর্ত আমার জন্য_মোমবাতি যেমন শেষ হয়ে যাওয়ার আগে নিজের সব শক্তি দিয়ে জ্বলে ওঠে,,,,সূর্যাস্তটাও তেমনই সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে নিজের সবটুকু দিয়ে আলো দেয়_
সূর্য টা পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে একটুপরই হারিয়ে যাবে অচেনা অজানা দেশে_
আমি ছাদে দাঁড়িয়ে আছি হাত ভাজ করে হঠাৎ কারো আগমনের আভাস পেলাম আমি_ বুঝতে আর বাকী রইলো না মানুষটা কে_আমি না তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম
“দূর আকাশে মেঘেদের মেলা
আকাশ জুড়ে ছুটে চলে সাদা বকের ভেলা”
উনি ধীরে পায়ে এসে পেছন থেকে আমার কোমরে হাত রেখে মুচকি হেসে বললেন
“আজ কাল যেনো আমার বউটার মাঝে কবি কবি ভাব চলে এসেছি
উনার কথায় আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে দুই হাত উনার কাঁধে রেখে বললাম
” বর যদি কবি হয় তবে বউ কবি হলে অসুবিধা কি”
আমার কথায় উনি হেসে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন আমায়__

ভোরের আলো ফোটিনি এখনও,,
আকাশে চাঁদ এখনও উকিঁ মারছে,,জানালা দিয়ে শীতল হাওয়া এসে পুরো শরীর কাপিয়ে দিচ্ছে,,,অস্পষ্ট পাখির কিচিরমিচিরও শোনা যাচ্ছে,,,
হঠাৎ ঘুম ভাঙায় উঠে অজু করে জানালা খুলে চেয়ে আছি ওই আকাশ পানে,,,,
“দুঃখ গুলো উড়িয়ে দাও
ওই আকাশের নীড়ে
অসীম সুখ বয়ে আসুক
সবার জীবন জুড়ে”
পাখিদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে,,,,পাখিরা সব খাবার খুজতে বেরিয়েছে,,,,জানালা দিয়ে আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি পৃথিবী এতো সুন্দর,,,,পৃথিবী কতো বৈচিত্রময়,,,,ভালো-মন্দ সুখ-দুঃখ মিলেই মানুষের জীবন_মানুষ সব সময় খারাপ থাকে না ভালো দিনও আসে,,,
কথায় আছে “সবুরে মেওয়া ফলে” ধৈর্য ধরলে আল্লাহ একদিন সব দেয়_
হাজার ভাবনার প্রহর কাটিয়ে আমি জায়নামাজ নিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যাই।
নামাজ শেষে উনাকেও জাগিয়ে দিই_উনার ও এখন তাড়াতাড়ি ওঠাটা অভ্যাস হয়ে গেছে_

চলবে___

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে