হৃদয়ে তুমি পর্ব-০১

0
1996

#হৃদয়ে_তুমি
লেখনীতে:waziha_zainab(নিহা)
সুচনা পর্ব

আমার দুই হাত দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে আমার সাথে লেপ্টে আছেন আয়ান ভাইয়া_
আমি সরানোর চেষ্টা করেও মানুষটাকে একটু নড়াতে ও পারছিনা_
আমার কাজিন নিশি আপুর বিয়েতে এসে এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়বো ভাবতেই পারিনি
৩ বছর পর আজ আয়ান ভাইয়ার মুখোমুখি হয়েছি __গলা টা বেশ ভারী হয়ে আসছে যেনো কিছু মুহুর্ত পরই কান্নায় ভেঙে পড়বো আমি
যে মানুষ টাকে নিজের থেকেও বেশী ভালোবেসেছি সে কিভাবে আমার সামনে এতো নিরব দাঁড়িয়ে আছে
তার কি একটুও কষ্ট হচ্ছে না?
সে কি সত্যিই আমায় ভালোবেসেছিলো নাকি সবটাই অভিনয় ছিলো তার??

(আমি ওয়াজিহা জাহান নিহা। inter 2nd year এ পড়ি।বাবা মায়ের আদরের ২ মেয়ের মাঝে আমি বড় মেয়ে।আর আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে আয়ান ইসলাম। আমার ফুফুর ছেলে। সে আমার থেকে ৫ বছরের বড়।সে আমার ফুফাতো ভাই আর আমি তার মামাতো বোন।ফুফুর দুই ছেলের মাঝে সে ছোটো।৩ বছর আগে আমার আর তার রিলেশন ছিলো।কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিলো যে সে আমাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়
সে ডিগ্রি 2nd ইয়ারে পড়ে
গায়ের রঙ ফর্সা_চুল গুলো স্পাইক করা)

৩ বছর এর মধ্যে আর ভাইয়ার সাথে কোনো যোগাযোগ হয় নি আমার।আজ নিশি আপুর বিয়েতে এসেছি। আব্বুর একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় আসতে পারেনি তাই আম্মুও আসে নি_
নিশি আপুর আম্মু বারবার বলেছিলো বিয়েতে যেনো আমরা সবাই এটেন্ড করি__
আত্মীয়তার খাতিরে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আম্মুর কথায় আসতে হলো_
এখন রাত প্রায় আড়াই টা বাজে_
সবাই বিয়ে বাড়ীতে গায়ে হলুদ নিয়ে ব্যাস্ত এখন
তাদের বাড়ীর উঠোনে স্টেজের ডেকোরেশন করা হয়েছে সেখানে সবাই নিশি আপুর হলুদ নিয়ে ব্যাস্ত।
এর মাঝে নিশি আপুর আম্মু আমাকে আর অনিতা কে পাঠালো ছাদ থেকে কয়েকটা চেয়ার আনতে___এতো রাতে অনিতা নাকি ছাদে যেতে ভয় পাচ্ছে ভুত থাকে যদি।

মাঝ সিড়িতে গিয়েই
অনিতা কাচুমাচু হয়ে বললো
“নিহা তুই যা আমি এখানেই আছি,,

আমি চোখ গরম করে তাকালাম কিন্তু কাজ হলো না,,,,

অনিতা আবার বললো
“” প্লিজ যা না

আমি আর কিছু না বলেই সামনের দিকে পা বাড়ালাম
শুধু শুধু এই মেয়ের সাথে এখানে কথা বললে সময় নষ্ট হবে

বর্তমান__
আমাকে এভাবে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভাইয়া বললো
“কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?
জীবনে দেখিসনি আমাকে

এবার আমার রাগ উঠলো ভীষণ__তিন বছর পর দেখা হলো আজও সে এরকম কথা বলছে

আমি রেগে বললাম
“এভাবে গায়ের সাথে চিপকে আছেন কেনো আপনি?
কি সমস্যা আপনার?

আমার কথা পাত্তা না দিয়ে ভাইয়া বললো
“আমি কই চিপকে আছি
তুই নিজেই তো আমার সাথে চিপকে আছিস তাকিয়ে দেখ

আমি তাকিয়ে দেখলাম যে তার হাত দুটো পকেটের মধ্যে ডুকিয়ে স্টাইল মেরে দাঁড়িয়ে আছে উনি__
“আপনি এতোক্ষন আমাকে ধরে দাড়িয়ে ছিলেন
আয়ান ভাইয়া বললো
“আমি না তুই ছিলি

আমি আর কথা বাড়াতে চাইলাম না তাই উল্টো দিকে হাটা ধরতেই উনি খপ করে আমার হাত টা আবারো চেপে ধরলেন
“আহ লাগছে
ছাড়ুন আন্টি আমাকে চেয়ার নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠিয়েছে এখানে।আমাকে যেতে হবে।আর অনিতা অপেক্ষা করছে আমার জন্য ছাড়ুন বলছি
.
আয়ান ভাইয়া শান্ত গলায় তার ফ্রেন্ড মিহির কে ডাক দিলেন
“মিহির,শোন একটু
মিহির ভাইয়া দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন
“এনি প্রব্লেম?
হেই নিহা কেমন আছো?
অনেক দিন পর দেখলাম তোমায়
আমি কিছু বলার আগেই আয়ান ভাইয়া বললো
“নিচে মামনি কে কয়টা চেয়ার দিয়ে আয় তো।
আর সিড়ির মাঝে অনিতা দাঁড়িয়ে আছে
ওকে বলিস যে নিহা একটু পরে আসছে
আমি ওদের কথার মাঝে রেগে বললাম
“একটু পরে নয় আমি এখনই যাবো
আয়ান ভাইয়া মিহির ভাইয়াকে চোখ দিয়ে ইশারা করে চলে যেতে বললেন__ উনিও তার ইশারা বুঝেই চলে গেলেন
আমি মনে মনে ভাবছি বেচারি আমি এখন আমার সম্পর্কে অনিতা কি ভাববে…ছিহ এতো রাতে আমি ছাদে একা কি করছি

আমার ভাবনার মাঝেই আয়ান ভাইয়া আমাকে ঝাকুনি দিয়ে বললেন_
“আমার নাম্বার ব্লকে রেখেছিস কেনো?
আমি বললাম
“ছাড়ুন আমার লাগছে
আয়ান ভাইয়া আমার হাত ছেড়ে এক টানে আমাকে তার সাথে মিশিয়ে নিয়ে শান্ত গলায় বললেন
“দেখো আমি এখন তোমাকে চড় মারতে চাইছি না সো বলো কেনো ব্লকে রেখেছো আমার নাম্বার?আর তোমার ফোন কি করেছো?তোমার নাম্বার বন্ধ কেনো?

আমি কোনো রেসপন্স না পেয়ে উনি আবার বললেন
আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি
এবার আমি শান্ত গলায় বললাম
“আপনার নাম্বার ব্লকেই মানায়
আয়ান ভাইয়া বললো মানে?
আমি এবার জোরে জোরে হাসতে শুরু করলাম
আয়ান ভাইয়া আবার প্রশ্ন ছুড়লেন আমার দিকে
~“আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি?
এবার আমি আর থেমে থাকতে পারলাম না
চোখ দিয়ে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো
আয়ান ভাইয়ার শার্টের কলার চেপে ধরে শক্ত গলায় বললাম
“কি চান কি আপনি?
আয়ান ভাইয়া বললো
“তুই এতো গুন্ডি হয়েছিস জানতাম না তো নেহু
এবার আমি কলারটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললাম
“কেনো আবার এসেছেন বলুন
আমার জীবন শেষ করে এখনো শান্তি হয় নি আপনার??
আর কি চান আমার কাছে বলুন?
আমি কি আপনার হাতের খেলার পুতুল যে ইচ্ছে হলে খেলবেন আবার পর মুহুর্তে ছুড়ে ফেলে দেবেন?
৩ বছর আগে কি আপনার একবার ও ভাবার দরকার ছিলো না যাকে মাঝ পথে ছেড়ে যাচ্ছেন তার আপনাকে কতোটা প্রয়োজন?
আয়ান ভাইয়া মাথা নিচু করে রইলেন
আমি কথা গুলো বলে আর এক মুহুর্ত ও ওখানে দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না
দৌড়ে নিচে চলে এলাম

ফ্ল্যাশব্যাক_

আয়ান ভাইয়া সম্পর্কে আমার ফুফাতো ভাই।
আমাদের বাসা থেকে তাদের বাসায় যেতে প্রায় ১৫ মিনিট লাগে।আমার আর আয়ান ভাইয়ার সম্পর্ক টা ছোটো থেকেই সাপে নেউলের মতো।আবার অন্য দিকে টম আন্ড জেরির মতো__একজন আরেকজনে না দেখলে যেনো থাকতেও পারি না
ফুফির বাসায় গেলে আমার প্রথম বাক্য হয় ভাইয়া কোথায়?
সবাই এই নিয়ে অনেক হাসাহাসিও করে।

আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন বর্ষাকালে একদিন রাতে ফেসবুক ঘাটাঘাটি করছিলাম তখন আয়ান ভাইয়ার আইডি থেকে মেসেঞ্জারে মেসেজ আসে
-ছাদে আয়
আমি আশ্চর্য হয়ে যাই অনেকটাই
আমি মেসেজের রিপ্লাই মেসেজ পাঠাই
-এখন ছাদে কেনো
আর ইউ ক্রেজি?
আয়ান ভাইয়া আবার মেসেজ দেয়
-১০ মিনিটের মাঝে ছাদে না এলে তোর কি অবস্থা করবো আমি নিজেও জানিনা
আমি আবার রিপ্লাই পাঠাই
-আম্মু রান্নাঘরে আছে আর আব্বু বসার ঘরে টিভিতে নিউজ দেখছেন সো এখন আসতে পারবোনা
আয়ান ভাইয়া দুটো agry রিয়েক্ট দিয়ে আবার মেসেজ পাঠালেন
-বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি আমি তাড়াতাড়ি আয়।জ্বর টর হয়ে মরে গেলে তখন ভুত হয়ে তোকে জ্বালাবো বলে দিলাম

(কাথাঁ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি তাই বুঝতেও পারি নি যে বাহিরে এমন ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে)

আমি উঠে জানালা টা মেলে দিতেই শীতল হাওয়া আমার পুরো শরীল শীতল হয়ে গেলো_
তারপর বসার ঘরের দিকে উকিঁ দিলাম।আম্মু আব্বু পাশাপাশি বসে বসে চ্যানেল একুশে টিভি তে নিউজ দেখছেন।তাদের টপকে ছাদে যাওয়ার সাহস আমার হচ্ছে না
আবারো ফোনের স্কিনে ভেসে উঠলো আয়ান ভাইয়ার আরেকটা মেসেজ
“আর সময় মাত্র ৩ মিনিট আছে তোর হাতে
তাড়াতাড়ি আয়
“মানুষটার জন্য চিন্তাও হচ্ছে আবার এদিকে আব্বু আম্মুর ভয় ও এবার কিছু না ভেবেই আমি আবার হাটা শুরু করলাম
দরজার দিকে যেতেই আম্মুর আওয়াজ কানে এলো
“এতো রাতে কোথায় যাচ্ছিস?
আমি কিছু না ভেবেই বললাম
“রিখিয়া কল করেছে কিছু নোট আনতে যেতে হবে
আম্মু আবারও প্রশ্ন ছুড়লেন
“সকালে নিয়ে আসিস
আমি করুণ গলায় বললাম
“সকালে নিয়ে এলে পড়বো কখন

আম্মু আর না করলো না যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিলো
আম্মু পড়াশোনার ব্যাপারে খুব নজরদারি করে
তাই আর আটকালো না
হালকা পায়ে সিড়ি দিয়ে ছাদের দরজার সামনে এসেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম আমি

দরজা খুলে দেখলাম কেউ তো নেই_ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে বৃষ্টির কিছুটা ফোটা এসে আমার শরীরেও পড়ছে যা আমাকে উত্তাল করে দিচ্ছে। তারপর চারদিক আরো একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম কেনো জানিনা মনের মধ্যে একটা বিশ্বাস ছিলো ভাইয়া আমাকে নিরাশ করবে না নিশ্চই সে এসেছে।আমার হাতে থাকা ছাতা টা মেলে ছাদের মাঝ বরাবর এলাম_আর একটু এগোতেই কারোর হেচকা টান অনুভব করলাম আমি__আচমকা টান দেওয়ায় আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে ভাইয়ার বুকের উপর গিয়ে পড়লাম আর ছাতা টাও হাত থাকে সাইডে পড়ে গেলো।ভাইয়ার দিকে তাকাতেই চোখ জুড়িয়ে গেলো__সাদা শার্ট পরেছে সে।বৃষ্টির পানিতে ভিজে শার্ট গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।খোচা খোচা দাড়ি গুলো যেনো তার সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি করে দিচ্ছে।
ভাইয়ার আওয়াজে আমার ধ্যান ভাঙলো
“এভাবে গায়ের উপর চিপকে আছিস কেনো?
কোনো কমন্সেন্স নেই
ভাইয়ার কথায় আমার প্রচন্ড রাগ হলো
উঠে যেতে নিলাম তখন ভাইয়া হালকা হেসে আমাকে আরো আষ্টেপৃষ্টে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন তারপর ভাইয়াকে ছাড়িয়ে আমি উঠে দাড়ালাম

তারপর ভাইয়া হাটু গেড়ে বসে হাত কয়েকটা কাঠ গোলাপ আমার সামনে ধরে বললেন

“প্রহর শেষে আলোয়
রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম
আমার সর্বনাশ”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভাইয়া আবার উদাসীন ভাবে কাঠগোলাপ গুলো এগিয়ে দিয়ে বললেন:
“এক গুচ্ছ কাঠগোলাপের প্রস্তাবে
তুমি কি আমার প্রেয়সী হবে?
“কথা দিচ্ছি ভালোবাসার অভাব কি কখনো বুঝতে দেবো না
“আমার অনুপস্থিতি অনুভব করতে দেবো না
ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখবো তোমায়
“তোমার জন্ম থেকেই শুরু আমাদের প্রেমালাপ
খুব যতনে তার নাম রেখেছি আমি কাঠ গোলাপ

আমাকে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভাইয়া বললো
” কি ব্যাপার পায়ে ব্যাথা হচ্চে তো আমার ফুল গুলো নিয়ে আমাকে একটু উউদ্ধার কর
আমি ফুল গুলো হাত থেকে নিয়ে নিলাম
এর পর ভাইয়া সোজা হয়ে দাড়ালেন
আমি স্থির গলায় বললাম
“এমনটা কখনই সম্ভব নয়
আপনি আমার ভাইয়া
আমার কথায় উনি ধমক দিয়ে বললেন
কিসের ভাইয়া হ্যা।আমি তোর ফুফাতো ভাই।ফু-ফা-তো ভাই
নিজের ভাই তো আর না
আর আমি তোকে কখনো বোনের চোখে দেখি নি আর দেখবোও না।
আমি এবার করুণ গলায় বললাম
“এমন টা হয় না ভাইয়া
লোকে কি ভাববে”
ভাইয়া এবার ধমক দিয়ে বললেন
“লোকের কথায় তো আর জীবন চলবে না
আমি তোকে ভালোবাসি তোরও আমাকে ভালোবাসতে হবে ব্যাসস
আমি আবারো বললাম
ফ্যামিলি জানলে কি হবে
ভাইয়া বললেন
” ওকে ফাইন
এখনো তুই ছোটো অনেকটাই ছোটো
তাই এখন রিলেশনে যাওয়া ঠিক হবে না
তুই পড়াশোনায় মন দে
আর তোর বিয়ের বয়স হলেই বাকীটা আমি দেখবো।

দিন যতো যেতে লাগলো ভাইয়ার প্রতি আমার দুর্বলতা টাও বাড়তে লাগলো হয়তো এটাই ভালোবাসা
যদিও আমি ভাইয়াকে ছোটো বেলা থেকেই পছন্দ করতাম কিন্তু বলা হয় নি
ভালোলাগা থেকেই ভালোবাসার শুরু আমিও তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি
আমার হৃদয়ে ঘর তৈরি করে নিয়েছে সে
যে হৃদয়ে শুধুই আছে সে
আর আমাদের গল্পের নাম হোক #হৃদয়ে_তুমি
আমার হৃদয়ে শুধুই সে

চলবে__

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে