হৃদয়ের ঠিকানা পর্ব-০৮

0
1019

#হৃদয়ের_ঠিকানা
৮ম পর্ব
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
,
সেদিনের পর থেকে আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়ে গেছিলো। মেয়েদের খুব মহৎ একটা গুন আছে। যেটা আমার মধ্যেও আছে, সব ভুলে যাওয়া। আমি তার অন্যায় ভুলে গেছিলাম। তাকে ভালোবেসে বাকি জীবন কাটাতে চেয়েছিলাম।

আমাদের সম্পর্কটা খুব মধুর ভাবে চলছিলো৷ চুপিচুপি একে অপরকে সময় দেওয়া যেন আমাদের নেশা হয়ে গেছিলো। আরেকটা কথা, আমাদের বিয়ের খবর মামীকে দেইনি আমরা। যদিও মামী রাগ করবেনা জানি। কারণ সে তো তার বউমা হিসেবে আমাকেই চায়। তবে আমাদের বিয়ের কথা তাকে না জানানোর কারণ ছিলো, আমরা একে অপরের কাছাকাছি আসতাম একদম লুকিয়ে। এর মধ্যে একটু থ্রিল কাজ করতো।

বিয়ের দুইমাস পর থেকে কাইফ নিজের কাজে মন দেয়। আমিও আমার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকি। কিন্তু নিয়তি কখনো আমার আপনার ইচ্ছায় চলেনা। লিখন যেটা আছে সেটাই হয়।

প্রায় বছর খানিক পর, আমাদের চুপিচুপি কাছে আসার একটা বড় উপহার পেয়েছিলাম আমি। আমার পেটে তখন কাইফের সন্তান। কেবল একমাস হয়েছে। মামীকে জানানো দরকার ছিলো কারণ এখন সব কিছু পালটে গেছে। আমাদের বিয়ের কথা সবাইকে জানানো না হলে আমাদেরই বদনাম হবে যে বিয়ের আগেই সন্তান। সবার সম্মান চলে গেলেও আমি আমার মামা-মামীর সম্মানকে তুচ্ছ করতে পারিনা।

একদিন আম অধৈর্য হয়ে যায়।
টেবিলে বসে পড়ছিলাম আর কাইফ আমার খাটে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। আমি বললাম,
– আমি এখনই মামীকে বলতে যাবো আমাদের সন্তানের কথা। তুমি যেন বাধা দিওনা।

– তুমি এতো উত্তেজিত কেন হচ্ছো সাওদা? জীবনে অনেক দূর এগোতে হবে হবে। মাকে বলবো একদিন। তুমি চিন্তা করো না।
আগে তাকে বাড়ি ফিরতে দাও।

মামী সেদিন বাড়ি ফেরে তার এক বান্ধবীর বাসা থেকে তবুও আর বলা হয়না। এদিকে দিনে দিনে আমার পেটটা বড় হতে থাকে। এবার আমি নিজেই ঠিক করি মামীকে বলবো আমাদের বিয়ের কথা। সবাই রাজি তাহলে প্রব্লেমটা কোথায় সেটাই আমি বুঝতে পারছিলাম না। এমন নয়তো কাইফ আমাকে ছেড়ে দিতে চায়! অন্য মেয়ের সাথে জড়ায়নি তো ও। মনে সন্দেহ বাড়তেই থাকে।

একদিন হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। কাপড় গোছানোর জন্য আমি দৌড়ে ছাদে চলে যায়। কিন্তু সেদিন আমার জীবনের সুখ শেষ হওয়ার দিন ছিলো আমি নিজেও জানতাম না। শুরুই দিকের বৃষ্টিতে পুরনো ছাদ একদমই পিচ্ছিল হয়ে গেছিলো। আমি ছাদে পা ফেলতেই একদম পড়ে যায়। পেটটা এমন ভাবে পড়ে যে আমার গর্বে থাকা তাকে আর বাচানো যায়নি।

হাসপাতালে মামী কাইফকে ঠাস করে একটা চড় মেরে বলে,
– এসব আমাকে কেন জানাসনি। আমি যদি কখনো বুঝতে পারতাম তাহলে অন্তত ওকে কোনো কাজ করতে দিতাম না। তোর জন্য আজ তোর সন্তান মরেছে।

কাইফ সেদিন মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলেছিলো কিন্তু আমি ফেলিনি। আমার চোখ থেকে পানি পড়েনি। মামী ঠিকই বলেছে মামী যদি জানতো আমার পেটে সন্তান আছে তাহলে সে আমাকে কখনোই ছাদে যেতে দিতো না। সব কিছুর মুলে ওই কাইফ। এই কথাটা মাথায় গেথে গেছিলো।

এরপর থেকে আমাদের একই ঘরে থাকার আদেশ ছিলো কিন্তু আমার মন কখনো এটা চাইতো না। আমি মেনে নিতে পারতাম না তাকে। কখনোই না। কোনোভাবেই না।। আমাকে ছুতেও দিতাম না। সব থেকেও যেন আমি শেষ হয়ে গেছিলাম।।

বছরও পার হয়ে যায়,

তার কাছে থেকেও দূরে থাকাটা হয়তো সে মেনে নিতে পারেনি তাই সে একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আমি তবুও চুপ ছিলাম। কিন্তু একদন ফোনে শুনতে পাই কাইফ বলছে, স্ত্রী বেচে থাকতে বিয়ে করা যাবেনা। কিছুদিন অপেক্ষা করো সব ঠিক হয়ে যাবে।

সেদিনের দেওয়া চাবিটা এভাবে কাজে লেগে যাবে আমি বুঝতে পারিনি। স্কলারশিপ লেটার টা বের করি আমি। কিন্তু আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে কে। আমি চাইনা কাইফের জীবনে বাধা হয়ে থাকতে।

আমি তার কথা একদম ভুলে গেলাম কি ভাবে! তাড়াতাড়ি ফোন বের করে তার নাম্বারে ফোন লাগিয়ে বললাম,

– মামা আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তুমি দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে কেন আমাকে কোনো অনাথাশ্রমে রেখে যাওনি! তাহলে এতো মায়া, এতো ভালোবাসা এতো অভিমান কিছুই আমার মধ্যে জন্মাতো না।

– তুই আমাকে সবটা বলবিতো মা!

– তোমার ছেলে আমাকে রেখে অন্য কাওকে বিয়ে করতে চাই। ও শুধু আমার মরার অপেক্ষায় আছে। তুমি যদি এখান থেকে আমাকে না নিয়ে যাও তাহলে আমি নিজেকে শেষ করে দেবো। আর কখনো আমাকে খুজে পাবেনা কেও।

– তোকে আনবো মা। নিশ্চয় আনবো। তবে কিছুদিন সময় লাগবে। আমার এক বন্ধু আছে তার সাথে তোর যোগাযোগ করা লাগবে। সে তোর পাসপোর্ট ভিসা সব ম্যানেজ করে দেবে।৷

এরপর থেকে চুপি চুপি আমার সব কাজ চলতে থাকে৷ আর কাইফ আমার সামনে বেশি বেশি অন্যের সাথে কথা বলতে থাকে। আমি চাই সে কথা বলতে বলতে তাকে বউ করেই আনুক। কি দরকার! সবতো শেষ।

কয়েকমাস পর মামা হঠাৎ ফোন দিয়ে বলে,
– সমস্ত কিছু রেডি তুই গুছিয়ে চলে আয়। তোর ভিসা আগামী পরসু।

আমার কথা শুনে বুকটা ধক করে ওঠে। কাইফকে ছেড়ে আমি চলে যাবো। এটা ভাবতেই কেমন লাগছিলো।

আজকে হঠাৎ কাইফের মাঝে পরিবর্তন দেখলাম। সারাদিন ফোনে কথা বলেনি। রাতে শুয়ে ছিলাম ফ্যানের দিকে তাকিয়ে। যদিও অন্ধকারে কিছুই দেখতে পারছিলাম না।

কাইফ হঠাৎ বললো,
-সাওদা, আমার মনে হচ্ছে আমি হারিয়ে যাবো কোথাও। তুমি আমাকে একবার আপন করে নেবে৷ মন ভরে তোমাকে ভালবাসতে চাই।

সেদিন ছিলো আমাদের শেষ কাছে আসা। একদিন পর খুব সকালে আমি বের হয়ে পড়ি এয়ার্পোরটের উদ্দেশ্য। কেও জানলো না আমি পাড়ি দিলাম ইংল্যান্ডে।
চোখের পানি দেখার কেও ছিলোনা সেদিন। খা খা বুক নিয়ে মেঘের উপর দিয়ে ভেসে চলেছিলাম।

,
এয়ার্পোরটের কাস্টমের কাজ থেকে থেকে বের হয়েই দেখলাম মামা দাড়িয়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
– মামা তুমি কেমন আছো কত বছর পর তোমার সাথে দেখা।

মামা হাসতে হাসতে বলে,
– তুই আমার একমাত্র ছেলের বউ। আমাকে বাবা বলে ডাকিস। আর মামা ডাক শুনতে ইচ্ছা করেনা।

-তোমাকে এমনিই বাবা বলবো তবে তোমার ছেলের শর্ত দিওনা প্লিজ।

– আচ্ছা ঠিক আছে ঠিক আছে। তুই এমনিই বাবা বলিস।

এরপর থেকেই গড়ে ওঠে আমার অন্য জীবন। আর আমার মধ্যে গড়ে উঠতে থাকে কাইফের একাংশ। এই নিয়েই আমার বিদেশের সাত বছর কেটেছে। যদিনা মিতু আপুর সাথে মাস দুয়েক আগে দেখা না হতো তাহলে জানতেই পারতাম না যে, কাইফ আমাকে কাছে পাওয়ার জন্য আমাকে জেলাস করানোর জন্য এমন অভিনয় করতো। সেদিন কাদবো নাকি হাসবো বুঝতে পারিনি। বারবার আমার দোষেই সব হয়েছে। আমার দোষে তার সাথে প্রায় দুই বছর একই বিছানায় শুয়েছি তবুও ভালোবাসা ছিলোনা। আমার ভুলের জন্য সাত বছর তার থেকে আলাদা ছিলাম।৷ উপরওয়ালার কি লীলা খেলা মিতু আপু তার হাজবেন্ড নিয়ে এখানে সেটেল হতে না আসলে কিছুই জানতাম না।

আমি মামাকে আমার করা ভুল বলতে গেলে মামা বলে,
– কাইফ আমাকে সব বলেছিলো রে মা। ও অভিনয় করতো আর ভাবতো তুই ওকে আবার ভালোবাসবি। কিন্তু না, তুই ওর থেকে দুরেই চলে এলি। তাই ও তোকে বাধা দেয়নি। ভাবিসনা ও কিছুই জানতো না। সব জানতো ও। তোর জন্যই ও তোকে আলাদা করে দিয়েছিলো। ও ভেবেছিলো তোর অভিমান দেখবে। কয়েকদিন পর ঠিক তুই ওর কাছে ফিরে যাবি। কিন্তু তুই গেলিনা। আজও আমার পাগল ছেলেটা তোর অপেক্ষায় দিন গোনে মা। এতো ভালোবাসা কোথায় পাবি।

সেদিনে কাদতে কাদতে মামাকে বলি, আমাকে যেন বাংলাদেশে আসাত ব্যাবস্থা করে দেয়। সব কাজ সম্পন হয় আমি আমার অভিমান ভেঙে এখানে ফিরে আসলাম আজকে। এই ছিলো আমার জীবনের অতীত।

গাড়ির হর্ন শুনে ভাবনা থেকে বের হলাম। মামী বলল,
– পৌঁছে গিয়েছি।

সামনের বাড়িটা আগের সেই বাড়ি নেই। দেখলেই মন ভরে যাচ্ছে। মেইন দরজায় লেখা আছে। সাওয়াম ভিলা।

আমার ছেলের নাম এরা জানলো কিভাবে!

,
,
চলবে
,
বানান ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে