হৃদয়হীনা পর্ব-০৫

0
1100

#হৃদয়হীনা
Part–5
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

সদ্য ঘুম থেকে উঠা শায়েরীর মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো। সে হুড়মুড়িয়ে টেবিলের সামনে গিয়ে দাড়ালো। কাগজটা হাতে নিতেই কেমন শুভ্র অনুভূতি জাগ্রত হলো মনের অন্দরমহলে । তার কাছে এই সামান্য কাগজের টুকরো টুকুকে খুব মূল্যবান জিনিস বলে মনে হচ্ছে। কাগজে লেখা খুলে দেখার আগেই সে দিব্যি টের পাচ্ছে এটা আহনাফ তার জন্য লিখেছে। সে লেখাটা পড়লো না। খুব সযত্নে আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখল। কেন রাখলো সে জানে না। কিন্তু খুললো না সে।অনেকক্ষণ চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থেকে এরপর গোসল নিতে বাথরুমে গেল। একটা সালোয়ার কামিজ পড়ে সে রুম থেকে খুব স্বাভাবিক ভাবে বের হলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো, তার একটা অসাধারণ গুণ হলো সে খুব দ্রুত মানুষকে ভড়কে দিতে পারে। দারুণ অভিনয় পারে সে।এই যেমন কাল সারাটা রাত সে ঘুমানোর অভিনয় করেছে।অথচ ফেমাস অভিনেতা তার সুক্ষ্ম অভিনয়টুকু ধরতে পারেনি৷সে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে নিয়ে সারাটা রাত বেচারা অস্বস্তি নিয়ে কাটিয়েছে। ভোরে যখন আহনাফ ঘুম থেকে উঠলো তখনো টের পেয়েছিল শায়েরী কিন্তু সারারাত জেগে থাকার জন্য ওইসময় সে কীভাবে যেন ঘুমিয়ে পড়ে।

ডাইনিং টেবিলে অনেকেই বসে নাশতা খাচ্ছে।মেহমানের মধ্যে অনেকেই আজকেও এই বাসায় আছেন। শায়েরী খাওয়ার টেবিলে এসে বসলো। দুই ধরনের নাশতা বানানো হয়েছে। পাতলা খিচুড়ি আর পিয়াজ-মরিচ দিয়ে ভাজা ডিম। এবং পরোটা সবজি। শায়েরী বিনা সংকোচে পরোটা পাতে তুলে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে নতুন বউ৷

শায়েরীর মা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে হতভম্ব হয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে, আহনাফ কোথায়? তুই একা নাস্তা খাচ্ছিস কেন? ওকে ডেকে আন। মানে তোর কারবার দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না।

শায়েরী প্লেটে একটা ডিমভাজী তুলে নিয়ে বললো, উনি চলে গেছে ,আম্মু।

— কখন গেল?

–সকালেই।

প্রশ্নের উত্তর দিতেই শায়েরী চমকে উঠে। মানুষটা তো তাকে কিছু বলে যায়নি। এমনও হতে পারে, সে আসলে যায়নি। এমনি বাইরে গেছে৷ সিগারেট টানার জন্যও যেতে পারে। কিন্তু শায়েরীর মন বলছে, উনি চলে গেছেন।কালকে রাতে তাকে ওইভাবে ইগনোর করার পর মানুষটার আত্মসম্মানে ঘা লেগেছে জন্য সে কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে। আর শায়েরীর মন যা বলে প্রায় সময় তাই হয়৷ সে খাওয়া বাদ দিয়ে চলে গেল রুমে। মাথাটা ভার ভার লাগছে।

রুমে কিছুক্ষণ পায়চারি করে আলমারি খুলে চিঠিটা বের করলো। কিন্তু পড়ার সাহস হচ্ছে না। সে চিঠিটা পুনরায় আলমারিতে রেখে দিল৷ এরপর বারান্দায় আসতেই হীম শীতল বাতাসে শীত লাগতে শুরু করে। সে মনে মনে ঠিক করে নেয়, যেদিন সে মানুষটাকে মন থেকে মেনে নিতে পারবে, সেদিনই এই চিঠিটা পড়বে। এর আগে না। তখনই রুমে শ্রুতি ঢুকে বলে,আপু, কই তুমি?

শায়েরী শান্ত গলায় বললো, কী?

— ভাইয়া এভাবে কাউকে না জানিয়ে হুট করে চলে গেছে শোনার পর বাবা অনেক রাগ করেছে৷

শায়েরী ভ্রু কুচকে বলে, রাগার মতো কিছু হয়নি তো।ওনার কাজ পরে গেছে তাই কাজে গেছে৷ আর না জানিয়ে যায়নি। আমাকে বলে গেছে৷

তার কথা শুনে শ্রুতি মিটমিট করে হেসে বলে, ইশস, একদিনেই এতো ভাব হয়ে গেল! কি ভালোবাসা!

শায়েরী বোনের কথা শুনে হালকা বিষ্মিত হলো।সে ফটাফট মিথ্যা কেন বলল? কেন লোকটাকে সবার সামনে বাঁচিয়ে দিল?আর আসলেই কী সব ঠিক আছে? তাদের বিয়েটা কী সত্যি খুব নরমাল? সে কী মেনে নিতে পেরেছে? কিছুই বুঝতে পারছে না সে। তবে তীব্র একটা রাগ তার মনের মধ্যে চেপে আছে। এই রাগের আগুণে আনন্দ, সুখ ভাটা পরছে যেন৷ রাগটা কার উপর এটাই আন্দাজা করতে পারছে না সে।

শ্রুতি মুখ গোমড়া করে বলে, ভাবলাম তোমাকে মেহেদী পড়িয়ে দিব। কিন্তু ভাইয়াই তো চলে গেল।

— উনি না থাকলে না থাকুক। আমরা মেহেদী পড়ি?নাকি মেহেদী পড়ার জন্য ওনার দরকার?

শেষ প্রশ্নটা করেই সে খেয়াল করলো, তার মন আসলে খুব খারাপ। একটা বেখেয়ালি, বেহিসেবী অভিমান বুক জুড়ে হাহাকার করছে। উনার প্রস্থানই কী এই অভিমানের কারণ? কিন্তু কেন? শায়েরী তো তাকে ভালোবাসে না। সেও তাকে ভালোবাসে না নিশ্চয়ই। একদিনে কি আর ভালোবাসা হয়? সে চুপচাপ রুমে এসে শুয়ে পড়লো। আজকে সারাদিন আর উঠবে না। তার যখনই মন ভীষণ খারাপ থাকে, সে শুয়ে থাকে।

_________________

আহনাফ শুটিং স্পটে বসে আছে।চারিদিকে ক্যামেরা, লাইট সাজানো হচ্ছে। একটু পরেই সব গুছানো হলে তার ডাক পরবে। এর আগে কেউ তাকে ডিস্টার্ব করবে না। আরএফএল এর নীল চেয়ারে বসা সে। মেকাপ করা শেষ তার। আজকে বেশ কিছু শট দিতে হবে। অলমোস্ট দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে। সে বেশ ভালোই বিরক্ত হয়ে আছে। কাল সারা রাত ঘুম হয়নি। ভোরে উঠেই একটা সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে সোজা ড্রাইভিং করে গাজীপুর এসে পৌঁছেছে৷তার শিডিউল ছিল আজ। কিন্তু কালকে অনুরোধ করে তা পিছিয়ে নিয়েছিল। যার জন্য ডিরেক্টরের সঙ্গে মনোমালিন্যও হচ্ছিল তবুও সাফ জানিয়ে দিয়েছিল আজ সে আসবে না। কিন্তু ডিরেক্টর কে অবাক করে দিয়ে সে শুটিং করার জন্য এসে পড়েছে। সকালে নাস্তাও সে খায়নি এক প্রকার জেদ করে। কিন্তু অবাকের বিষয় হলো, সে কী কারণে জেদ ধরে বসে আছে এটাই অজানা। এর মধ্যে ইউনিটের একটা ছেলে এসে ডাবের পানি দিয়ে গেল খাওয়ার জন্য। সে এক চুমুকেই পুরাটা খেয়ে আরেক গ্লাস আনার জন্য অনুরোধ করল।সে চোখ ঘুরিয়ে নায়িকার দিকে তাকালো। মেয়েটার নাম তিথি। ইন্ড্রাস্ট্রিতে নতুন। এটাই নাকি প্রথম ছবি তার। প্রথম ছবিতেই তার মতো সেলিব্রিটির সঙ্গে কাজ করতে পারায় মেয়েটা বড্ড খুশি। দু’বার তার সঙ্গে এসে কথা বলতে চাইলো কিন্তু লাভ হয়নি তেমন। অন্যদিন হলে আহনাফ নিজ থেকেই কথা বলত কিন্তু আজ তার মুড ভালো নেই।

ডিরেক্টর সাহেব এসে তাকে পুনরায় সব স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিল। কিছু রোমান্টিক সীনও আছে।আহনাফ পা বাড়ালো। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা শ্বাস নিল। এখন সে আহনাফ নয়। বরং ছবির চরিত্র রিয়াজ সে।রিয়াজ একজন পাগলা প্রেমিক। আহনাফের মনে হচ্ছে, সবাই প্রেমিক হতে পারে না।প্রেমিক হতেও ভাগ্য লাগে যা রিয়াজের থাকলেও তার ভাগ্যে নেই। হুহ!

প্রথম দৃশ্যটা চমৎকার ছিল। রিয়াজ কুয়াশামাখা সকালে ক্যামেরা নিয়ে বের হবে। প্রকৃতির ছবি তোলার জন্য আশপাশ ঘুরে ঘুরে দেখবে। হুট করে একটা খেজুর গাছের দিকে চোখ যাবে। এবং সে লক্ষ্য করবে খেঁজুর গাছের আগায় একটা হাঁড়ি বেঁধে রাখা। দারুণ বিষ্ময় নিয়ে সে গটগট করে ছবি তুলে যাবে তার ক্যামেরায় এবং সেই সময় খুব নিকট থেকে নুপুরের আওয়াজ পাবে সে। চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই থম বনে যাবে। নায়িকা বিনুনি ঝুলিয়ে হেলেদুলে হেঁটে আসছে তার দিকে। মেয়েটাকে দেখা মাত্র তার হাত থেকে ক্যামেরা পড়ে যাবে৷ নায়কের হাত থেকে ক্যামেরা পরে যেতে নায়িকা খিলখিল করে হাসবে। এই দৃশ্যটা ভালো হলো।

পরের দৃশ্যে চোখে চোখ রেখে,হাতে হাত রেখে কিছু আবেগের কথা বলতে হবে। এখান থেকে সমস্যা শুরু হলো। আহনাফ শুটটা ঠিকমতো করতে পারছে না৷ কিছুতেই সে মেয়েটার দিকে তাকায় না। কিন্তু সে মেগাস্টার জন্য তার সামান্য ভুল ডিরেক্টর সাহেব মাফ করে দিলেন। এরপরে আসলো আসল বিপত্তি। তাদের দুজনকে একটা ঘনিষ্ঠ দৃশ্যতে অভিনয় করতে হবে। চুম্বুন দৃশ্যটা করার কথা শুনতেই আহনাফ ঘাবড়ে গেল। কিছুতেই মনকে শান্ত করতে পারছে না সে। ঘামতে লাগলো। খালি বারবার মনে হতে লাগলো, সে কাউকে ঠকাচ্ছে।

ডিরেক্টর সাহেব রেডি ওয়ান টু থ্রি বলে দিল। ক্যামেরা তাক করা হলো তার দিকে। কিন্তু আহনাফ একচুলও নড়ে না। হাত-পা বরফ হয়ে আসলো তার। তিথি নামের মেয়েটা প্রথমে কিছুটা বিব্রতবোধ করলো। এরপর নিজ থেকে তার মুখের সামনে এসে দাড়াতেই সে পিলে চমকে উঠে। তার চোখের পর্দায় অন্য কোন রমনীর প্রতিচ্ছবি। চারপাশ ফাঁকা লাগতে শুরু করে।যেই না তিথি তার চোখের সামনে অতি কাছে এটা খেয়াল হলো, সে বিকট শব্দে পাশে থাকা চেয়ারে লাথি মেরে উঠে দাঁড়ালো। রাগে হনহনিয়ে হাঁটা ধরে।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে