হৃদি ভেসে যায়

0
596

ওস্তাদ ফ্রি আছেন?

– না ফ্রি নাই। কি বলতে চাস, ঝটপট বলে বিদায় হ।

স্ক্রিপ্টের বড় আকাল যাইতেসে। একটা মারমার কাটকাট টাইপ প্রেমের গল্প লিখা দেন।

– আমি কোনকালে গল্প লেখছি? যা ভাগ।

এতো এতো কবিতা লেখেন আপনি। গল্প লেখা তো ওয়ান টু র ব্যাপার হওয়ার কথা।

– এক কাজ কর কয়েকটা কবিতা মিলায়া তুই নিজে একটা স্ক্রিপ্ট দাঁড় করায়া ফেল।

কি যে কন বস! আমার মাথা এতো ভালো হইলে কি আর ডিরেক্টরের এসিস্টেন্ট থাকি এতোদিন। আপনে না একদিন বলছিলেন আপনের জীবনের কি এক গল্প আছে। ঐটা লিখা ফেলেন।

– আরে ধুর, ঐ টা ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী।

কলম আপনার, মাথা আপনার সফল প্রেমের কাহিনী বানায়ে ফেলেন ঐটারে।

রতন ছেলেটা ভীষণ রকম সাদাসিধে। তবে কথিত আছে সে গাবের আঠার সমতুল্য। একবার যখন তার মাথায় ঢুকেছে সে আমার থেকে লেখা নেবে সে সহজে আমার পিছু ছাড়বেনা। আচ্ছা লিখে ফেলবো নাকি নাতাশার গল্প? প্রায়ই শুনছি ওর বিয়ের তোড়জোড় চলছে। সাহস করে বলতে না পারা কথাগুলো কি পান্ডুলিপিতে লিখে দেবো? অবশ্য ও আদৌ বাংলা নাটক দেখেতো? তারচেয়েও বড় কথা ডিরেক্টরের আমার লেখা পছন্দ হবেতো? তবু কি মনে করে যে সে রাতে কিবোর্ডে হাত রাখি তা বুঝি শুধু যিনি সত্যিকারের জীবন নাটক লেখেন তিনিই জানেন।

নাতাশা আমার সেজো চাচার মেয়ে। ওর জন্ম আমেরিকাতে। আমার ভীষণ রকম দেশপ্রেমিক সেজো চাচা পড়ালেখার জন্য আমেরিকা চলে গেলে সবাই ধরেই নিয়েছিল উনি আর কখনো দেশে ফিরবেননা।সেগুনবাগিচায় দাদাভাইয়ের করে যাওয়া চারতলা বাড়ির একেকটা তলা দখলে চলে যায় বাবাদের আর তিন ভাইয়ের। যেহেতু চাচা দেশের বাইরে থাকেন, জীবন সম্পর্কে উদাসীন, আদৌ আর কখনো দেশে ফিরবেননা; এই ভেবে নীচতলাটা রাখা হয় ওনার জন্য। তবে সে বাসার ভাড়া সেজো চাচা নিতেন না বলে সেটা দিয়ে পুরো বাড়ির আর সব খরচ চালানো হতো।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে এক মধ্যরাতে সেজোচাচা, চাচী আর তাদের একমাত্র কন্যা নাতাশাকে নিয়ে দেশে চলে এলেন। সবাই প্রথমে ভেবেছিল চাচা বোধহয় মজা করছেন। আর তাই যত্নআত্তির চূড়ান্ত চলে প্রথম দু সপ্তাহ। বাড়িতে আর সব ভাইবোনদের মধ্যে আমি ছোট বলে সবার ভীষণ রকম অনুশাসন আর দাবড়ানিতে কাটতো আমার দিন। আমার থেকে ছোট নাতাশা কে পেয়ে আমি খুব আনন্দিত হয়ে উঠি। যাক ক্ষেপানোর একজন মানুষ পাওয়া গেলো।

দু সপ্তাহ পরে সবাই যখন বুঝতে পারলো চাচা সত্যি চলে এসেছেন বাকী তিনভাইয়ের মাথায় বাজ পড়ে যেন। এতো বোকা মানুষ হয় কি করে? বিদেশ ছেড়ে এই মরার দেশে কি? তখন সেভাবে না বুঝলেও এখন বুঝি সবার তখন ভয় ছিল নীচতলার বাসা দখল হয়ে যাওয়ার ভয়। সবার পকেট থেকে বাড়তি খরচের ঝামেলা। তার ওপর যদি সেজো চাচা প্রশ্ন করে বসেন কেন তাকে নীচতলা দেয়া হলো?

দেশের লোকে ভাবে মানুষ কয়েক বছর দেশের বাইরে থাকলে একটু বোকা কিসিমের হয়ে যায়। দেশের ভাবসাব বুঝতে পারেনা। কিন্তু সেজো চাচা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারেন যে তার পরিবারের কেউই যে তার ফিরে আসা মানতে পারছেনা। নিজের আত্মীয়দের এমন ব্যবহারেই কি না কে জানে দু মাস পেরোতে উনি চাকুরী পেয়ে গেলে অফিসের বাসায় সরে যান আমাদের বাসা থেকে অনেকটা দূরে। বাসার আর সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও দশম শ্রেনী পড়ুয়া এই আমি কেমন যেন কষ্টে ভুগতে থাকি। স্কুল থেকে ফিরে নাতাশাকে দেখার জন্য মন কেমন যে করে। একটু বোকাসোকা, দেশের পরিবেশে অনভ্যস্ত নাতাশাকে যখন তখন ক্ষেপানো আবার ওর সাথে হাহাহিহি করে আমার দিনগুলো যে ভালোই কাটছিলো। কিশোর বেলার সর্বনাশা আবেগগুলো কি যে হাহাকার রেখে যায় একজীবন তা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? কিন্তু নিজের মানুষদের থেকে পাওয়া কষ্টে নাকি অন্য কোন কারণে সেজো চাচা যোগাযোগ কমিয়ে দেন আমাদের বাড়ির সাথে। আর তাই নাতাশাকে দেখার জন্য বুকের ভেতর আঁকুপাকু করলেও সুযোগ মেলেনা সহসা। যদি না ওদের বাসায় কিংবা আমাদের বাসায় কোন বড় উপলক্ষ্যের আয়োজন ঘটে। আর সামনাসামনি দেখা হলেও নিজের বুকের ভেতর ঢাঁকের মতো বাজতে থাকা হৃদপিন্ডের জোর কম্পন থামাতেই এতো ব্যস্ত থাকতাম যে কেমন আছিস ভালো আছি বলে কখন সরে আসবো সেই চিন্তাতেই তটস্থ থাকতাম। দরজা কিংবা আসবাবের আড়াল থেকে নাতাশাকে চোখের কোণায় রেখে মনে মনে কত গল্প যে করে যেতাম! অথচ যখন প্রথম নাতাশা এসেছিল ওর সাথে কত সাবলীল ভাবেই না আমি মিশতাম। প্রেমে পড়াতেই আমি অত মুখচোরা হয়ে গিয়েছিলাম কি না কে জানে?

এইচএসসি পাশের পর বাবা একটা মোবাইল কিনে দেন ফলাফলে খুশী হয়ে। তখন একটু একটু লেখালেখির চেষ্টা করি। অনেক কষ্টে যোগাড় করা নাতাশার নাম্বারে নিজের মোবাইল নাম্বার হাইড করে ওর জন্মদিনে একটা মেসেজ পাঠাই।
‘ পরজনমে আমি ভীষণ সাহসী হবো।
লুকিয়ে শুধু নিজেকে বলবোনা কোন কথা।
আমাদের অপলক তাকিয়ে থাকায় জন্ম নেবে
শত সহস্র শব্দমালা।
দৃষ্টি রাখবে তো আমার চোখের তারায়?’

নাহ প্রতিদিন পাঠাইনি কোন ক্ষুদে বার্তা। পাছে নাতাশা টের পেয়ে সবাইকে বলে দেয়। শুধু তার জন্মদিনে ঠিক রাত বারোটায় পাঠাতাম একটা মেসেজ। আর আমার নিত্যদিনের ভাবনাদের ভারে ডায়েরীর পাতা রোজদিন ভারী হতো অজস্র শব্দের কারুকাজে, যার প্রত্যেকটাই শুধু নাতাশাকে ঘিরে লেখা।

সামনের মাসে নাতাশার বিয়ে। অথচ এখনো আমি বলতে পারিনি আমার মনের কথাটুকু। কখনো হয়তো বলতেও পারবোনা। আমার বাবা চাচারা যে নাতাশাদের ঠকিয়েছে এ কথা যদি নাতাশা কখনো আমার মুখের ওপর বলে বসে, এই ভাবনায় নিজের আবেগকে সদা লুকিয়ে রেখেছি সযত্নে।

এইটুকু লিখে থেমে যাই আমি। রতন যে বললো সফল পরিণতি চায় নাটকের। তবে কি আমার বাস্তবের না বলতে পারা কথাগুলো নাটকের চরিত্রকে দিয়ে বলিয়ে নেবো? থাকনা বাস্তব জীবনের অপ্রাপ্তিগুলো শুধু আমার হয়ে। নাটকের চরিত্রগুলো না হয় শেষ হোক মধুর সমাপ্তিতে। মূল চরিত্রের কিছু নাম, আর বাবা চাচাদের চরিত্রগুলো একটু বদলে দিয়ে রতনকে স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দেই। কেউই যেন বুঝতে না পারে এ আমার জীবনেরই গল্প।

আমাকে অবাক করে দিয়ে রতন জানায় স্ক্রিপ্ট তার ডিরেক্টরের পছন্দ হয়েছে। নাটকও নির্মান হয়ে যায় আর যথাসময়ে অন এয়ার হওয়ার নিউজ চলে আসে বাসায়। আমার পুরো বাড়িতে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। বাড়ির ছেলে যে কি না কাঠখোট্টা ইঞ্জিনিয়ার সে গল্প লিখেছে। সবাই মিলে নাটক দেখতে আমাদের বাড়ি এলেও সেজো চাচারা আসেনা। যদিও আমার খুব ইচ্ছে করছিল নাতাশাকে আসতে বলি আমি নিজে। নাহ এইবারও সাহস করতে পারিনি। সবার খুব বাহবা নিয়ে রাতে ঘুমাতে এলেও
শুধু মনে হচ্ছিল যার জন্য এই নাটক লেখা সে ই তো কিছু জানলোনা।

খুব সকালে ঘুম ভাঙে মোবাইলের টুং টুং শব্দে। পরপর কয়েকটা মেসেজ আসাতে ঘুম ভেঙে দেখতেই হয় কার মেসেজ। অবাক হয়ে দেখি নাতাশার নাম্বার।

‘আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন আমার জন্মদিনে একটা মেসেজ আসে একটা আননোন নাম্বার থেকে। আমার খুব ভাবতে ভালো লেগেছিল মেসেজটা তুমি পাঠিয়েছো। বহুবার তোমার কাছে জানতে চাইবো বলে কাছে এসেছিলাম। কিন্তু তুমি কেমন যেন পালিয়ে থাকতে বলে আর জানা হয়নি। তার ওপর তুমি যদি মা বাবাকে কিছু বলে দাও সেই ভয়ও ছিল। পুরো বছরে আর কোন মেসেজ আসেনি আবার পরের জন্মদিন ছাড়া। সে থেকে আমি বুঝে গেলাম ঐ অচেনা মানুষটা শুধু আমার জন্মদিনেই উপহার হিসেবে কয়েকটা লাইন লিখবে। কি ভীষণ অপেক্ষায় থাকতাম একটা জন্মদিন পেরোলে পরে কবে আরেকটা জন্মদিন আসবে?
তোমার নাটকটা খুব ভালো হয়েছে। আমিতো তোমার মতো কবিতা লিখতে পারিনা তাই ধার করা দুটো লাইন লিখছি।
অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়েও চিনতে পারিনি বলে
হৃদি ভেসে গেলো অলকানন্দা জলে।

তুমি কি আমার সেই অচেনা মানুষকে জানিয়ে দেবে আমি ভেসে যাওয়া হৃদয় নিয়ে তার অপেক্ষায় আছি।’

না পাওয়ার সম্ভাবনা থাকা কোন জিনিস অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়ে গেলে কেমন যেন ফাঁকা লাগতে থাকে চারদিক।
আমি কি নাতাশাকে ফোন দেবো? নাকি ওর ঘরের দরজায় এখুনি দৌড়ে গিয়ে কড়া নাড়বো?

#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে